তোর রঙে রাঙাবো পর্ব-০৮

0
1892

#তোর_রঙে_রাঙাবো
#Part_08
#Writer_NOVA

রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি রিকশার জন্য। আকাশের অবস্থা বেশি একটা ভালো নয়।কালো মেঘের ছড়াছড়ি সারা আকাশ জুড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই রিমঝিম তালে বৃষ্টি নেমে গেল।আমি কোথাও না সরে সেখানেই দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ফোটাগুলো অনুভব করতে লাগলাম।হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার শরীরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে না।উপরে তাকিয়ে দেখলাম কালো রঙের একটা ছাতা।অবাক হয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলাম সেদিনের সেই ছেলেটা। কি জানি নাম? ওহ মনে পড়েছে,তীব্র। সে ছাতা হাতে নিয়ে আমার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ছাতাটা আমার মাথায় ধরে রাখায় সে অনেকটা ভিজে গেছে। তার তেল জবজবে মাথার এলোমেলো চুলের কর্ণিশ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি পরছে।

তীব্রঃ বৃষ্টিতে ভিজে গেলে তো আপনার জ্বর হবে।দেখতে পাচ্ছেন বৃষ্টি হচ্ছে তারপরেও এখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন? নিজের শরীরের একটুও যত্ন নেন না।এখনকার জ্বর কি ভালো নাকি? পাক্কা দুই সপ্তাহ বিছানায় পরে থাকবেন। (শান্ত গলায়)

আমি কোন কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে ভ্রু কুঁচক তাকিয়ে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।দুই শার্টের হাতা কুনুই পর্যন্ত এনে ফোল্ড করা।গলায় কালো-সাদা ডোরার টাই।তেল দেওয়া মাথার ডান পাশে সিঁথি কাটা।চোখের চশমায় বৃষ্টির পানি পরে ঘোলাটে হয়ে আছে।বৃষ্টির মধ্যেও সে বিন্দু বিন্দু ঘামছে।সেটা অবশ্য তার নাক না দেখলে বুঝতে পারতাম না।কেন জানি তার সাথে এই বোকা ফেস ও কাপড়চোপড়ে মানাচ্ছে না।আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তীব্র কিছুটা অস্বস্তিতে পরে গেলো।আমতা আমতা করে বললো।

তীব্রঃ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভিজবেন? চলুন সামনের ঐ টং দোকানের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। একসাথে এরকম একটা ওয়েদারে চা খাওয়া যাবে।

আমিঃ আমি কি বলেছি আপনার সাথে চা খাবো? আপনি এতো বেশি ধরে নিলেন কেন?(কিছুটা কড়া গলায়)

তীব্রঃ না আপনি তা বলেন নি।আমি বলছিলাম।দয়া করে মিস এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ঐ টং দোকানের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। তাহলে আসলে আমরা ভিজবোনা।

আমিঃ আপনাকে কি বলেছি আমার মাথায় ছাতা ধরতে? আপনি হুট করে কোথা থেকে চলে আসেন বলেন তো? আপনি কি সত্যি এই কলেজে পড়েন? আপনাকে দেখে তো তা মনে হয় না।আমি যখনি একা থাকি তখনি আপনাকে নিজের পাশে দেখি।

তীব্রঃ আপনি এরকম রেগে যাচ্ছেন কেন?আমি দেখলাম আপনি একা একা বৃষ্টিতে ভিজছেন।তাই আমার ছাতাটা আপনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।এটা যদি আমার ভুল হয় তাহলে আমি মাফ চাইছি।প্লিজ রাগ না করে চলুন না ঐদিকটায়।(অনুরোধের সুরে)

ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আর রাগ দেখাতে পারলাম না।কিরকম অসহায় ফেস করে রেখেছে।সকাল থেকে মনটা ভালো না।তাই এরকম ব্যবহার করে ফেলেছি তার সাথে। আকুলতার দৃষ্টি আমি উপেক্ষা করতে না পেরে তার সাথে সামনের টং দোকানের নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। তীব্র ছাতাটা বন্ধ করে দোকানের কোণায় রেখে সেখানকার বেঞ্চিতে বসলো।দোকনদারকে কড়া লিকারের দুধ চা দিতে বলে আমার দিকে তাকালো।

তীব্রঃ আপনার কড়া লিকারে সমস্যা হবে না তো?

আমিঃ না। আমি সব লিকারেই চা খেতে পারি।

তীব্রঃ আমি আবার কড়া লিকার ছাড়া চা খেতে পারি না।আপনি ঐ দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এই বেঞ্চিতে বসুন।আমার সাথে যদি বসতে অসুবিধা হয় তাহলে আমি দাঁড়িয়ে পরি আপনি বসে পড়ুন।

আমিঃ ভারী অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!! আমার মাথায় ছাতা ধরে নিজে পুরো চুপচুপা ভিজে গেছেন।এখন আবার আমাকে বসানোর জন্য নিজে বেঞ্চ থেকে উঠে পরবেন।আমি বাপু আপনাদের ছেলেদেরকে বুঝি না। কখন কিরকম থাকেন আল্লাহ মালুম।আমার ভাইয়ু একটা, এখন আবার আপনাকে পেয়ে গেলাম।আপনার দাঁড়াতে হবে না। আমি আপনার পাশেই বসতে পারবো।যদি আপনার কোন সমস্যা না হয়।

তীব্রঃ না না আমার সমস্যা কেন হবে? আমি তো চাই, আপনি আমার সাথে বসুন।

আমিঃ মানে?

তীব্রঃ কিছু না।এমনি বললাম আরকি।(দোকনাদারের দিকে তাকিয়ে) মামা, চা কতদূর?আজ খেতে পারবো তো।

তীব্র দোকানদারের সাথে কথা বলতে লাগলো।বৃষ্টির বেগ আরো বেড়েছে। আশেপাশে কোন মানুষ নেই।ছোট্ট টং দোকানে এখন মাত্র আমরা তিনজন।তীব্র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমার ভাইয়ুর মতো আরেকটা রহস্যময় মানুষের দেখা পেলাম।গায়ের রং আহামরি সুন্দর নয়।আমার আবার ফর্সা ছেলে ভালো লাগে না। সাদা বাঁদড় মনে হয়। আমার কাছে মনে হয়, সুন্দর মানুষের অহংকার বেশি থাকে।জানি না কথাটা কতটুকু সত্য। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি। কেউ দয়া করে মাইন্ড করেন না।

🌺🌺🌺

তীব্রর গায়ের রং কিছুটা তামাটে বর্ণের।আমার গায়ের রং থেকে কিছুটা ডিপ।চেহারায় কিছুটা মাসুম ভাব ও মায়া আছে।ভেজা শরীর থাকায় গায়ের রং কিছুটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। দোকনদার লোকটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।আমার কাছে দৃশ্যটা ভীষণ ভালো লাগছে। আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তীব্র বোকার মতো ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকালো।তারপর মুচকি হেসে চা নিয়ে কাপটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।মুখে হাসির রেখা টেনে মাথা নিচু করে বললো।

তীব্রঃ চা খেয়ে নিন।নয়তো ঠান্ডা হয়ে পানি হয়ে যাবে। ওয়েদারটার সাথে চা খেতে কিন্তু খারাপ লাগবে না।ততক্ষণে যদি বৃষ্টিটা কমে আসে।চিন্তা করবেন না।আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিবো।

আমিঃ তার দরকার নেই। আমি একা চলে যেতে পরবো। ছাতা দিয়ে হেল্প করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ।

তীব্রঃ আপনি আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন।আর আমার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হচ্ছে বৃষ্টিকে।আজ বৃষ্টি না থাকলে হয়তো আপনার সাথে এরকম সময় কাটাতে পারতাম না।একসাথে চা খাওয়া হতো না,এরকম একটা ওসাম ওয়েদারে।আমার কাছে বেস্ট একটা দিন।সারাজীবন স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।আমি খুব মিস করবো দিনটাকে।

আমিঃ কেন?

তীব্রঃ আপনি বুঝবেন না।আপনি যদি আমার মতো করে ভাবতেন তাহলে বুঝতে পারতেন।

আমিঃ হয়তো।

তীব্রঃ পৃথিবীর মানুষ বড় অদ্ভুত। এই পৃথিবীটাকে যত কম জানবেন তত মঙ্গলজনক।মানুষ বড় স্বার্থপর প্রাণী। এরা গিরগিটির চেয়ে অনেক দ্রুত নিজের রং বদলায়।কে যে কখন আপনাকে তার স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে চলে যাবে আপনি বুঝতেও পারবেন না।পৃথিবীকে যত চিনবেন ততই এর প্রতি অনীহা জন্মে উঠবে।

আমিঃ এই স্বার্থপর পৃথিবীর বেশি কিছু না চেনাই ভালো।তাহলে হয়তো বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে যাবে।

তীব্র আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিলো।আমার কেন জানি ছেলেটাকে ভীষণ ভালো লাগছে। কথার মধ্যে রেসপেক্ট ও ভক্তি খুঁজে পাচ্ছি। ব্যবহারটাও আময়িক,মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।তবে চোখের ভাষাটা বোঝা দায়।সেটার মাঝেও ভালো লাগা কাজ করছে। কথায় আছে না, যাকে ভালো লাগে তার সবকিছুই ভালো লাগে। আর যাকে ভালো লাগে না। তার ভালো কিছুও ভালো লাগে না। আমাকে নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তীব্র নিজের দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নিলো।তারপর নিচুস্বরে বললো।

তীব্রঃ আমরা নিজের আশেপাশের কতটুকু জানি। ভালো-খারাপ দুইটো মিলেই পৃথিবী।তবে মনে রাখবেন খারাপ আছে বলেই ভালোর এত কদর।সবকিছু যদি একরকম হতো তাহলে পৃথিবীটা এতো রং-বেরঙের হতো না। অবশ্য তাতে,সবকিছুর ওপর একঘেয়েমী সৃষ্টি হয়ে যেতো।

আমিঃ আপনি ঠিক বলেছেন।আপনার সাথে আমি একমত।আপনার কথায় যুক্তি আছে।

তীব্রঃ আমি যুক্তিহীন কোন কথা বলি না। আর আপনাকে ধন্যবাদ?

আমিঃ হঠাৎ ধন্যবাদ কিসের জন্য?

তীব্রঃ আমার কথায় একমত হওয়ার জন্য।

আমিঃ ওহ আচ্ছা।

বেঞ্চ থেকে উঠে, চা হাতে নিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিলাম।আমার পাশে দাঁড়িয়ে তীব্র মৃদ্যু শব্দ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।না, ছেলেটার সাথে থাকতে খারাপ লাগছে না। বরং অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে। ছেলেটার ব্যবহার মন্ত্র মুগ্ধকর।চেহারার দিকে তাকালে মনটা ভালো হয়ে যায়।আর যাই করুক, মেয়েদের সম্মান দিতে জানে।ব্যাস এতটুকুই আমার মনে বেশ গভীরভাবে ভালো লাগার দাগ টেনেছে।ব্যবহারটাও আময়িক, কথার মাঝেই আছে একগাদা রেসপেক্ট ও ভক্তি।এর সাথে এমন ওয়েদারে থাকা যায়।

চা শেষ হতে হতে সত্যিই বৃষ্টি কমে গেলো।আমি বিল দিতে চেয়ে ছিলাম কিন্তু দিতে দিলো না।বিল দিয়ে আমার পাশে পাশে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। চৌরাস্তার কোণায় এসে একটা রিকশা পেলাম।আমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে জোর করে ভাড়াটাও দিয়ে দিলো।যতক্ষণ আমার রিকশাটা দেখা যাচ্ছিলো ততক্ষণ এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে ছিলো।আমি রিকশার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট তা দেখতে পেয়েছি। যা দেখে আনমনে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠলো।

#চলবে