দিওয়ানেগি পর্ব-৪৯+৫০

0
461

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৪৯+৫০
#M_Sonali

বাসার ভিতরে অন্ধকার দেখে আলমিরের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। সে দ্রুত আস্তে আস্তে বলে উঠল,

“সাবধান কেউ কোন আলো জ্বালাবে না। সবাই যে যেখানে আছো সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। একদম নড়াচড়া করবে না। যতক্ষণ না আমি অর্ডার দিব কেউ কোন কিছু করবেনা।”

ওর কথা মত সকল গার্ডরা নিজেদের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কেউ আলো জ্বালালো না। এখানে আসার আগে আলমির বুঝতে পেরেছিল মেহরিমার কাছে ফোন নেই। ওর ফোনটা অন্যকেউ নিয়ে এই মেসেজগুলো করছে। তাই সে গার্ডদের সাথে আগে থেকে সব রকম প্ল্যান করেই এখানে এসেছে। সব গার্ড এর কানের সাথে একটি করে ব্লুটুথ লাগিয়ে দিয়েছে সে। যার মাধ্যমে ওর কথা সবাই শুনতে পাচ্ছে। তারা চুপচাপ এভাবেই দাড়িয়ে রইলো। কেটে গেল প্রায় আধঘণ্টা। কোনোরকম সাড়াশব্দ বা কিছু বোঝা গেল না। গার্ডরা এবার বিরক্ত হয়ে যেতে লাগল। আলমির সেটা বুঝতে পেরে আবার আস্তে করে বলে উঠলো,

“কেউ বিরক্ত হয়ে ভুল পদক্ষেপ নিবে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। আমার বিশ্বাস এখনই কিছু একটা ঘটবে।”

কথাটা বলতে না বলতেই বাসার মধ্যকার একটি রুমে আলো জ্বলে উঠলো। সেখানে বেশ কিছু লোক পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। যার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ফিরোজ আহমাদ। সে বিরক্ত হয়ে সবাইকে বলছে,

“আমাদের প্ল্যান হয়তো সাকসেসফুল হলো না। ওরা কেউ ভিতরে আসেনি। আসলে এতক্ষণ নিশ্চই আলো জ্বালাতো আর সাথে সাথে মরতো। পুরো বাসার লাইটগুলো জ্বালিয়ে দাও আমাদের নতুন প্ল্যান করতে হবে।”

কথাগুলো বলে থামতেই আলমির গার্ডদের নিয়ে অন্ধকার থেকেই এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে লাগল সকলের উপর। ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ আর পালানোর সুযোগ পেল না। একেকজনের একেক জায়গায় গুলি লেগেছে। সবাই লুটিয়ে পরলো মেঝেতে। সবাই ব্যথায় কাতরাতে লাগলো। ফিরোজ আহমাদ এর হাত এবং পায়ে দুটো গুলি লেগেছে। সেও লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে লাগলো মেঝেতে। এবার আলমির দেরি না করে সকলকে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সকলের পাশে পড়ে থাকা পিস্তল গুলো তুলে নিয়ে ওদের দিকে পিস্তল তাক করে বলল,

“এবার বল সবাই। কোথায় পালাবি? তোদের মৃত্যু এসে গেছে।”

নিজেদের মৃত্যু সামনে দেখতে পেয়ে ভয়ে কঁকিয়ে উঠল সবাই। ফিরোজ আহমাদ কাতরাতে কাতরাতে হাতজোড় করে কান্না করে বলল,

“বাবা আলমির, আমি তোমার বাবার মত। ভুলে গেছো তোমাকে কত আদর করেছি। তুমি কিভাবে পারলে আমাকে গুলি করতে। তুমি ভুল ভাবছো। তোমাকে ওই মেহরিমা ভুল বুঝিয়েছে। ওই মেয়ে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে ভুলে গেছো। আমাকে বাঁচাও। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।”

ওনাকে এমন কাতরাতে দেখে মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল আলমিরের। গার্ডদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“একে এখান থেকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দাও। আর যত দ্রুত সম্ভব এর চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। আমি ডাক্তার কে ফোন করে দিয়েছি সে চলে আসবে। আর এদের সবাইকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। তবে সবার ওপর নজর রেখে। কেউ জেনো পালাতে না পারে।”
,
,
,
তিন দিন পর,
একটি নিরিবিলি জায়গায় ছোট্ট একটি বাড়ির মধ্যে বিছানার ওপর বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছে ফিরোজ আহমাদ। তার ঠিক পাশেই দুটি চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে মোহিনী এবং মৃদুল। সকলের মুখে কসটেপ লাগানো। কারো চিৎকার করার মত ক্ষমতা টুকুও নেই। তাদেরকে ঘিরে পুরো বাড়ির চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন গার্ড। এ এলাকায় আর কোনো বাড়ি নেই বললেই চলে। কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। চারিদিকে ঘন জঙ্গলের মতো আবরণ।

দুপুর ৩:০৫ মিনিট,
গাড়ি করে কোনো গার্ড ছাড়াই মেহরিমা কে নিয়ে সেই বাড়ির সামনে এসে নামে আলমির। তারপর দুজনে একসাথে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পরে। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মৃদুল মোহিনী আর ফিরোজ আহমাদ ওদের দেখে চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরিয়ে ফেলতে থাকে। আলমির দুটি চেয়ার নিয়ে গিয়ে ওদের সামনে রাখে। একটাতে নিজে বসে আরেকটাতে মেহরিমা কে বসতে দেয়। মেহরিমার চোখেও পানি ছল ছল করছে। নিজের ভাইয়ের এমন করুণ পরিণতি সহ্য হচ্ছে না তার। তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছে।

আলমির গার্ডদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে ওদের সকলের মুখের কসটেপ গুলো খুলে দিতে। তারা কসটেপ গুলো খুলে দেয়। সাথে সাথে তিনজনে জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে। সবাই আকুতি মিনতি করে ক্ষমা চাইতে থাকে ওদের কাছে। কিন্তু এতে আলমিরের মন গলে না। সে দাঁত কিড়মিড়িয়ে প্রশ্ন করে,

“আপনারা সবাই আমার সম্মানের ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু সম্পদের লোভে কেন আমার সাথে এমন টা করলেন। আমার পুরো ফ্যামিলিকে কেড়ে নিয়েছেন আমার থেকে। আপনাদের সকলের তো শাস্তি পেতেই হবে। কোন মাফ নেই আপনাদের। কিন্তু তার আগে সব কিছু খুলে বলেন। কে কিভাবে কি করেছেন। তাহলে হয়তো মাফ পেলেও পেতে পারেন।”

ওর কথার উত্তরে মোহিনী দ্রুতো বলে উঠলো,

“আমি, আমি তোমাকে সব বলছি আলমির। তবুও আমাকে ছেড়ে দাও। এভাবে বাধা থাকা অবস্থায় আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখান থেকে বের করো আমায়।”

“হুম এখান থেকে তো আপনাদের অবশ্যই বের করব। কিন্তু তার আগে প্রথম থেকে শুরু করে এখন অব্দি সব সত্য কথা গুলো খুলে বলুন আমার কাছে।”

এবার ঐ ঘর থেকে বের হওয়ার আশায় গড়গড়িয়ে সব কথা বলে দিতে লাগল মোহিনী। সে বলতে শুরু করল,

“আলমির বিশ্বাস করো। আমি তোমার তেমন কোন ক্ষতি করিনি। আমি শুধু বাবা আর ফিরোজ আঙ্কেলের কথামতো কয়েকটা কাজ করেছি মাত্র। যখন তোমরা হোটেলে গিয়ে ছিলে, তখন হোটেলে যে চিরকুটটা পেয়েছিলো মেহরিমা, সেটা আমি রেখে এসেছিলাম। তবে ওটা তোমাদের সাবধান করার জন্য নয়। বরং তোমাদের ভয় দেখাতে। যেন তোমরা ভয় পাও আর ভয়ে এমন কিছু করে বসো যেটার সুযোগ নিয়ে তোমাদের ক্ষতি করতে পারি। যদিও মেহরিমার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা ছিল না আমাদের। কারণ মেহরিমা তো মৃদুলের বোন। মৃদুল কখনোই চায় না তার বোনের কোন ক্ষতি হোক। আমরা শুধু চাইতাম তোমাকে মেরে তোমার সমস্ত সম্পত্তি মেহরিমা পাওয়ার পর, আমরা ভাগাভাগি করে নিয়ে নিবো ওর থেকে। তারপর মেহরিমা কে বিয়ে দিব সরনের সাথে।”

এতোটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দিয়ে আলমির প্রশ্ন করে উঠল,

“তার মানে আপনাদের সাথে সরণও আছে। সেও কি আপনাদের এই ভয়ানক প্ল্যানে সামিল?”

ওর কথার উত্তরে বিছানার ওপর থেকে ফিরজ আহমাদ বলে উঠলো,

“না আলমির সরণ এ ব্যাপারে কিছুই জানেনা। সে তো ছোটবেলা থেকেই তোমাকে নিজের ভাইয়ের মত ভালবাসে। তোমার সকল বিপদে সে পাশে দাঁড়াতে চায়। আমি’ই প্ল্যান করেছিলাম তোমার সম্পত্তির লোভে পড়ে। তোমার বাবার ওপর প্রচণ্ড হিংসা কাজ করতো আমার। সেই হিংসা থেকেই আমি দিপুর সাথে হাত মিলিয়ে দুজনে একসাথে থেকে সব করি। তবে আমি শুধু তোমার বাবার সকল খবরাখবর তার কাছে দিয়েছি। তোমাদের অতিরিক্ত কাছে থাকার কারণে এটা কোন ব্যাপারই ছিল না আমার জন্য।”

“আর মেহরিমার জন্য ঐ আংটি! সেটা কে পাঠিয়েছিল তাহলে।”

“ওটা আমি পাঠিয়েছিলাম একজনকে জোকার সাজিয়ে। আসলে ওই আংটিটা সরণ কিনেছিল মেহরিমার জন্য। তার অনেক সপ্নছিল মেহরিমা কে পরাবে। কিন্তু যখন আমি বুঝতে পারি তুমি ওকে ভালোবাসো। তখন চালাকি করে আংটিটা এভাবে ওর কাছে পাঠিয়ে ছিলাম। যাতে তুমি ওকে সন্দেহ করে ছেড়ে দাও। বর আমি সরণের স্বপ্ন পুরণ করতে পারি।”

এতোটুকু বলে থামলেন ফিরোজ আহামাদ। ওনার কথা শুনে মৃদু হাসল আলমির। পরমুহূর্তেই মুখটা গম্ভীর বানিয়ে প্রশ্ন করল,

“মেহরিমার সামনে আমার মাকে কে খুন করেছিল? কে ছুড়ি বসিয়ে ছিল আমার মায়ের বুকে?”

এবার সবাই চুপ করে গেল। কারো মুখে কোন কথা নেই। কিছুক্ষণ সময় কেটে যেতেই আলমির হুঙ্কার ছেড়ে বলল,

“কি হলো চুপ করে আছেন কেন সবাই? বলুন কার অনুমতিতে খুন করা হয়েছে আমার মাকে? কি সে?”

ওর হুঙ্কারে কেঁপে উঠলো মোহিনী। সে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,

“তোমার মাকে ফিরোজ আঙ্কেল খুন করিয়েছেন। সে জেনে গিয়েছিল তোমার মা আড়ালে থেকে তোমাদের সহযোগিতা করছে। তার ভয় ছিল সে মেহরিমা কে তার নাম বলে দিবে। সেই ভয় থেকেই মেহরিমার সামনে একজন মুখোশধারী লোককে পাঠিয়ে খুন করেছে তোমার মাকে। আর এমনভাবে কাজটা করেছে যেন মনে হয় মেহরিমা তোমার মাকে খুন করেছে। এতে তার দুইটা লাভ হলো। তুমি মেহরিমাকে তোমার মায়ের খুনি ভাবলে। তাই ওকে ছেড়ে দিলে। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মেহরিমাকে নিজের পুত্রবধূ বানিয়ে সরণের ইচ্ছা পূরন করবে সে।”

আলমির সব কথা শুনে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকানো ফিরোজ আমাদের দিকে। সে এতক্ষণে মুখ কাচুমাচু করে ভয়ে চুপসে গেছে। আলমির রাগে গজগজ করে উঠে দাঁড়ালো। তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার উপর মারার জন্য হাত তুলে আবার থেমে গেল সে। তারপর কিছু একটা ভেবে রুম থেকে সোজা বাইরে বেরিয়ে গেল সে।

এতক্ষণ সময় হলো সবাই কথা বললেও মেহরিমা আর মৃদুল কোনো কথাই বলে নি। দুজনের চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে। আলমির চলে যেতেই মেহরিমা অভিমানী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ভাইয়া কি ক্ষতি করে ছিলাম আমি তোমার? যে তুমি এমন নির্মম খেলা খেললে বউ এর সাথে মিলে? তুমি একজন ভাই নামের কলঙ্কো। ছোটবেলায় তো তুমি এমন ছিলে না! এখন কেন এমন হয়ে গেছো ভাইয়া? সত্যিই তোমাকে আজ নিজের ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করছি। আজ থেকে তোমার জন্য তোমার দু বোন মারা গেছে। আর কখনো তোমার মুখও দেখতে চাইনা আমি। ঘৃনা হচ্ছে তোমার উপর আমার।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৫০
#M_Sonali

নিজের বিছানার ওপর বসে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে গুনগুনিয়ে কান্না করছে মেহরিমা। কোনোভাবেই যেন কান্না আটকে রাখতে পারছেনা সে। যেন পুরো জীবনটাকে বিষাক্ত মনে হচ্ছে তার। মনটা যেন বিষিয়ে উঠেছে তার। শুধুমাত্র ছোট বোনটার জন্য কষ্ট লুকিয়ে হাসি মুখে থাকতে হয় তাকে।

এক ঘণ্টা আগেই নিজে সাক্ষী হয়ে নিজের ভাই ভাবি এবং ফিরোজ আহমাদ কে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে এসেছে মেহরিমা ও আলমির। সময়টা যেন বড্ড বেশি কষ্টের ছিল তার। যাওয়ার আগে মৃদুল তার দিকে অনেক মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। যার চাহনিতে ছিল অনুশোচনা রেশ। যে চোখের ইশারায় বারবার বোঝাতে চেয়েছিল ক্ষমা চাইছে সে মেহরিমার কাছে। যার চোখে ফুটে ছিল মেহরিমা জন্য ভালোবাসা ও স্নেহ।

কিন্তু এত কিছুর পরেও মেহরিমার তার প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া হয়নি। বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয়নি তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। বরং মন থেকে একটি শান্তি কাজ করছিল তার। বারবার মনে হচ্ছিলো সে তার বাবার আদর্শ ধরে রাখতে পেরেছে। তার বাবা সবসময় বলত কখনোই অন্যায় কে প্রশ্রয় না দিতে। অন্যায়ের সাথে থেকে তাকে সহযোগিতা না করতে। সব সময় অন্যায়ের বিরোধিতা করে তাকে শাস্তি দিতে। আজ সেটা করেছে মেহরিমা। কিন্তু তার পরিবর্তে নিজেকে ভেঙে ফেলেছে সে। চুরমার হয়ে গেছে তার মনটা।

হঠাৎ মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শ অনুভব করায় ধ্যান ভেঙে যায় মেহরিমা। সে মেহের এসেছে ভেবে দ্রুত নিজের চোখের জলটা মুছে নিয়ে উপরে ফিরে তাকায়। দেখে আলমির দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা মায়ায় ভরা। মেহরিমা দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে চলে যায়।

গভীররাত হওয়ায় বাইরে থেকে বেশ ঠান্ডা হাওয়া জানালা দিয়ে ভিতরে আসতে। আর সেই হাওয়ায় মেহরিমার চুলগুলো আলতো ভাবে উড়ছে। আলমির গিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দুজনের মাঝেই নীরবতা বিরাজমান থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর একটু গলা খাকারি দিয়ে আলমির বলে ওঠে,

“মেহের আমার ওখানে আছে। খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর জন্য চিন্তা করোনা। আমি এখানে এসেছি আজ রাতটা এখানে থেকে আগামিকাল সকালে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব।”

ওর কথার উত্তরে ভ্রু কুচকায় মেহরিমা। ওর দিকে গভীর চোখে তাকায় সে। তারপর ছোট করে প্রশ্ন করে বলে,

“নিয়ে যাবেন মানে?”

“মানে তোমাকে আর এ বাড়িতে একা একা থাকতে হবে না। কালকে তুমি আমার সাথে ও বাসায় চলে যাবে। তুমি আমি আর মেহের ওখানে থাকবো সারা জীবন একসাথে।”

এতোটুকু বলতেই ওকে থামিয়ে দিয়ে গর্জে উঠলো মেহরিমা। রাগে গজগজ করতে করতে হুংকার ছেড়ে বলল,

“আপনি ভাবলেন কিভাবে আমি আপনার সাথে আপনার বাড়িতে গিয়ে থাকব? আপনি কি ভুলে গেছেন সেই দিনগুলোর কথা! যখন আপনি আমাকে অবিশ্বাস করেছিলেন। আমার গায়ে বিনা অপরাধে জানোয়ারের মত আঘাত করেছিলেন। আপনি ভুলে যেতে পারেন কিন্তু আমি সেগুলো ভুলে যেতে পারি না। কখনো ভুলবো না। যেখানে আমার প্রতি বিশ্বাস নেই। আমার প্রতি ভালোবাসা নেই। আমার প্রতি সামান্য পরিমাণ মায়া নেই। যেখানে থাকলে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে হয়। সেখানে থাকা তো দূর, যাওয়ার কথাও কল্পনা করতে পারি না আমি। নিজের আত্মসম্মানকে বড্ড বেশি ভালোবাসি আমি। আর নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে আপনার সাথে থাকা অসম্ভব। আপনি এখান থেকে চলে যান। এখন তো আর আপনার কোন শত্রু নেই। যে রাত বিরাতে বাইরে বের হলে সমস্যা হবে। আমি আর আপনাকে এখানে দেখতে চাই না। চলে যান প্লিজ।”

কথাটি বলেই সেখান থেকে চলে যেতে চাইলে আলমির আচমকাই মেহরিমার হাত ধরে বসে। করুন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলে,

“প্লিজ মেহু এভাবে কথা বলো না। তোমার প্রতিটি কথা যে তীরের মত আঘাত করে আমার বুকের বাম পাশটায়। তুমি কেন বুঝতে পারো না আমি আমার ভুলের জন্য অনেক বেশি অনুশোচনায় ভুগছি। প্রতিটা মুহূর্ত সেই ভুলগুলো কুরেকুরে খাচ্ছে আমায়। প্লিজ তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর একটিবার সুজোগ দাও তোমাকে ভালবেসে আপন করে নেওয়ার। কথা দিচ্ছি জীবনে কখনো তোমায় গায়ে একটি ফুলের আচড়ও পড়তে দিবোনা। রাজরানী করে রাখব। প্লিজ মেহু আমাকে মাফ করে দাও। ফিরে আস আমার কাছে। তোমাকে ছাড়া থাকাটা বড্ড বেশী কষ্টকর হয়ে গেছে।”

মেহরিমা ঝাড়ি মেরে নিজের হাতটা ওর থেকে ছাড়িয়ে নিল। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে গর্জন করে বলে উঠলো,

“কোন মুখে মাফ চাইতে এসেছেন আপনি আমার কাছে? কোন মুখে এমন আকুতি মিনতি করছেন আলমির? আপনি যদি শুধু আমাকে আঘাত করেই থেমে যেতেন, তাহলে হয়তো ততটা কষ্ট পেতাম না যতটা কষ্ট আপনি আমাকে নিজের মুখের ভাষায় দিয়েছিলেন। আপনি আমাকে বাজে মেয়েদের সাথে তুলনা করতে ছাড়েননি। আমার পিতা-মাতার শিক্ষা নিয়ে কথা বলেছেন। যেটা এত বেশি আত্মসম্মানে লেগেছে আমার যে আমি চাইলেও আপনাকে ক্ষমা করতে পারবোনা। সম্ভব নয় আপনাকে ক্ষমা করা। আপনার জন্য আমার জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। বাবা মা মারা যাওয়ার পরেও আমি নিজেকে কতটা অসহায় ভাবি নি। যতটা অসহায় আপনি আমাকে বানিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি বিনা অপরাধে এমন শাস্তি দিয়েছিলেন যে শাস্তি আমার জীবনে একটি বিষাক্ত স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। প্লিজ আপনি চলে যান। আপনাকে সহ্য হচ্ছে না আমার। প্লিজ লিভ মি এ্যালন।”

ওর কথার উত্তরে আলমির কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। করুন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকল সে। দু চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল মনের অজান্তেই। চোখের জলটা কোনমতে মুছে নিয়ে দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে চলে গেল আলমির। মেহরিমা সেখানেই ফ্লোরে বসে পড়ে অঝোরে কান্না করতে লাগলো।
,
,
,
সারারাত না ঘুমানোর কারণে ভোর বেলার দিকে চোখ লেগে আসে মেহরিমার। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানেনা। যখন ঘুম ভাঙ্গে দেখে বেলা প্রায় দশটা বেজে গেছে। সে দ্রুত উঠে বসে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে কোনরকম দেরি না করে বেরিয়ে পড়ে অফিসের জন্য। অফিসে আসার আগে দারোয়ানের থেকে জেনে নেয় মেহের বাসায় এসেছিল। আর বই-পুস্তক নিয়ে স্কুলে চলে গেছে। আলমির তাকে সাথে করে নিয়ে গেছে। তাই ওর চিন্তা বাদ দিয়ে অফিসে রওনা হয় মেহরিমা।

অফিসে পৌঁছে ভিতরে গিয়ে বেশ অবাক হয় সে। দেখে সবার মাঝে কেমন যেন একটা গুঞ্জন চলছে। সেদিকে তোয়াক্কা না করে সে সোজা নিজের ডেস্কে চলে যায়। ডেস্কে গিয়ে বসতেই তার একজন কলিগ এসে সামনে দাঁড়ায়। হেসে হেসে বলে,

“আজকে এতো দেরি করলেন যে ম্যাডাম। এদিকে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে।”

মেহরিমা তার কথায় বেশি গুরুত্ব না দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলে,

“কি এমন ঘটেছে যে সবার মাঝে এত গুঞ্জন!”

“ওমা, তুমি সত্যিই কিছু জানোনা? আলমির স্যারের গার্লফ্রেন্ড এসেছে কত বছর পর। সে তো এখন স্যারের কেবিনেই আছেন। কত পুরোনো সম্পর্ক তাদের। দুজনকে মানিয়েছেও বেশ।”

ওর কথা শুনে ভ্রু কুচকায় মেহরিমা। মনে মনে বেশ রাগ হয় তার। কিন্তু মুখে সেটা না ফুটিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

“স্যারের গার্লফ্রেন্ড মানে? কে এসেছে?”

“আরে গার্লফ্রেন্ড না কি সেটা আমিও সঠিক জানিনা। তবে যারা আলমির স্যারের সাথে অনেক বছর হলো কাজ করছে তাদের থেকে শুনলাম। যে মেয়েটা এসেছে সে নাকি স্যারের গার্রফ্রেন্ড ছিলো। তবে যে যাই বলুক। মেয়েটাকে কিন্তু হেব্বি দেখতে। আলমির স্যারের সাথে পার্ফেক্ট জুটি।”

কেন জানেনা মেয়েটির বলা কথাগুলো মেহরিমার কাছে বিষের মত লাগছে। তার রাগে যেন সারা শরীর জ্বলে উঠছে। সে কোন রকম কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,

“তুমি এখন নিজের কাজে যাও। আর আমাকেও কাজ করতে দাও। এমন ফালতু কথার সময় নেই আমার।”

ওর এমন উত্তরে মেয়েটি বাকা হাসে। কোন রকম কথা না বলে সেখান থেকে চলে যায়। মেহরিমা এবার চিন্তায় পড়ে যায়। কেন জানে না মেয়েটির কথাগুলো ভীষণ রকম ভাবাচ্ছে তাকে। সে একবার চিন্তা করে আলমিরের ডেস্কে যাবে। কিন্তু কিভাবে যাবে, কোন একটা অজুহাতে যেতে হবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সে সামনে টেবিলে তাকিয়ে দেখে একটি ফাইল পড়ে রয়েছে। যেটাতে আলমিরের সই আনতে হবে। সে আর দেরী না করে ফাইলটা নিয়ে ছুটে যায় তার ডেস্কের দিকে।

অতিরিক্ত উত্তেজনায় ডেস্কে ঢোকার আগে নক করতে ভুলে যায় সে। ডাইরেক্ট গিয়ে ভিতরে ঢুকে পরে। আর এতেই যেন ভীষণ রকম ধাক্কা খেতে হয় তাকে। সামনে তাকাতেই দেখে আলমিরের গা ঘেসে সোফায় বসে আছে একটি অতি সুন্দরী মেয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা অসম্ভব স্মার্ট ধরনের। চুলগুলো গোল্ডেন কালার করা। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। মুখের বা পাশের গালে একটি ছোট্ট তিল। চেহারা অসম্ভব সুন্দরী। যেকোন ছেলে হয়তো প্রেমে পড়ে যাবে মেয়েটির।

ওকে এভাবে ভিতরে ঢুকতে দেখে মেয়েটি বেশ রেগে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে ওঠে,

“এই মেয়ে এটা কোন ধরণের অসভ্যতা শুনি? কারো ডেস্কে ঢোকার আগে যে তার অনুমতি নিতে হয় সেটা জাননা? সামান্য কমনসেন্স নাই নাকি?”

তার এমন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মেহরিমা। কি বলবে বা করবে ভেবে পায়না সে। আলমির ওর দিকে তাকিয়েই মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বলে ওঠে,

“আয়শা কাকে কি বলছো তুমি এসব? চুপচাপ বসে থাকো। কি ব্যাপার মেহরিমা কিছু বলবে?”

ওর কথার উত্তরে বেশ থতমত খেয়ে যায় মেহরিমা। আমতা আমতা করে বলে,

“এই ফাইলটাতে আপনার একটি সই লাগবে। সেটা নিতেই এসেছিলাম। তাড়াহুরোয় ভিতরে আসতে গিয়ে নক করতে ভুলে গেছি। সরি ভেতরে এসে এসব হবে জানলে কখনো এভাবে আসতাম না।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,