দিওয়ানেগি পর্ব-৫১+৫২

0
480

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৫১+৫২
#M_Sonali

আলমিরের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে মেহরিমা। হাতে থাকা ফাইলটা সজোরে টেবিলের ওপর রাখে সে। সারা শরীর যেন রাগে জ্বলে যাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙে চুরমার করে ফেলতে। সবকিছু তছনছ করে দিতে। আলমিরের প্রত্যেকটা চুল একটা একটা করে টেনে ছিড়তে। ওর এত বড় সাহস হয় কি করে। অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে নিজের ডেস্কে এভাবে বসে থাকতে। কি ভেবেছে কি সে, মেহরিমা কিছুই বলবে না।

কথাগুলো মনে মনে বলছে আর রাগে ফুঁসছে সে। তার অবস্থা নিজের ডেস্কে বসে থেকে কাচের মধ্য দিয়েই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আলমির এবং আয়শা। দুজনেই বেশ মজা নিচ্ছে ওর অবস্থা দেখে। এদিকে মেহরিমা রাগে ফোসফোস করতে করতে কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। এত পরিমাণে রাগ হচ্ছে যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। সামনে থাকা কাঁচের গ্লাসে পানিটুকু ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। তারপর ক্লাসটা সজোরে রেখে দেয় টেবিলের ওপর। একটুর জন্য গ্লাসটা ভাঙতে ভাঙতে বেঁচে যায়।

ওর পাশের ডেস্কে বসে থাকা মেয়েটা বারবার এমন শব্দ শুনে ওর কাছে উঠে আসে। ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়,

“কি হয়েছে মেহরিমা ম্যাম? আপনি এমন করছেন কেন? আর এসব এভাবে ঠাস ঠাস করে রাখছেন যে? কোন প্রবলেম?”

উনার কথার উত্তরে হঠাৎ মেহরিমার খেয়াল হয়। যে সে কি করছিল এতক্ষন। সাথে সাথে শান্ত স্বাভাবিক হয়ে যায় সে। মুখে জোর করে হাসির রেখা টেনে বলে,

“না, না মানে কিছু হয়নি। আসলে হাত ফসকে পড়ে যেতে নিয়েছিল গ্লাসটা। তাই ধরতে গিয়ে এমন শব্দ হয়েছে। আর কোন সমস্যা নাই।”

মেয়েটি আর কিছু বলে না। নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। মেহরিমার এবার নিজের উপর ভিষন রাগ হতে থাকে। সে কেন করছে এমন। সেতো চায়না আলমিরের সাথে থাকতে! বরং তাকে ছেড়ে দিতে চায় সে। তাহলে আজ কেন তাকে অন্য একটি মেয়ের সাথে দেখে তার এত খারাপ লাগছে। এত কেন রাগ হচ্ছে তার?

কথাগুলো ভেবে নিজের উপর রাগ দেখিয়ে আবারো নিজের কাজে মনোযোগ দেয় মেহরিমা। যতটা সম্ভব আলমির এর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায় সে। ওদিকে নিজের ডেস্কে বসে সবকিছুই দেখছিল আলমির ও আয়শা। ওকে চুপচাপ কাজে মন দিতে দেখে মৃদু হেসে আয়শা বলে উঠল,

“আলমির তুমি বলো আর না বলো। আমি কিন্তু বুঝে গেছি মেহরিমা তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। আসলে তোমার উপর অনেক বেশি অভিমান থেকেই হয়তো সে তোমার থেকে এতটা দূরে সরে রয়েছে। যখন দেখবে ওর অভিমান ভেঙ্গে যাবে, তখন আবার তোমার কাছে ফিরে আসবে। তোমার জীবনটা ভালোবাসায় ভরিয়ে দিবে।”

ওর কথার উত্তরে আলমির একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসে ধীর গলায় বলে,

“সেটা আমিও জানি আয়শা। শুধু এটাই বুঝতে পারছি না ওর এই অভিমানটা কবে ভাঙবে। কবে সে আগের মতো আমার কাছে ফিরে আসবে। আমি জানি আমি অনেক বড় একটি ভুল করে ফেলেছি। নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছি এখন। কিন্তু কি আর করবো বলো, ওকে ছাড়া থাকায় আমার ভীষণ কষ্ট হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন ছিল যে আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। কন্ট্রোল হারিয়ে ওর সাথে ওই আচরণগুলো করেছিলাম। এর জন্য ওর কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। কিন্তু ও তো নাছোড়বান্দা। একটুও বুঝতে চায় না, বড্ড কষ্ট হয় আমার ওকে ছাড়া থাকতে। তাইতো তোমাকে এখানে নিয়ে আসা। যদি তোমার সাহায্য নিয়ে ওকে আবারও নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারি! তাহলে তোমার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না আয়সা।”

“ওহ আলমির, প্লিজ এভাবে বলোনা। বুদ্ধকে যদি সাহায্যই না করতে পারি। তাহলে আর বন্ধুত্বের মানে হলো কি। আর তাছাড়া কোনো একসময় তো আমার জন্য তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলে। আমিও না হয় সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করব তোমার জীবনে ওকে ফিরিয়ে দিয়ে।”

এতটুকু বলে থামে আয়শা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,

“বাই দ্যা ওয়ে, আচ্ছা তুমি আমাকে একটা কথা বলতো। আমি বিদেশ থেকে আসার পর থেকে বাবাকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। এমনকি তার ফোনটাও সুইচড অফ। বিদেশ থেকে আসার আগে যখন তাকে ফোন করেছিলাম, তখন সে আমাকে বলেছিল অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করছে আমার জন্য। কিন্তু এখন অব্দি তার খবর নেই। তুমি কি জানো বাবা কোথায় আছে? সরণ ভাইয়া বা আম্মুও তো কিছু বলতে পারছে না।”

ওর কথার উত্তরে আলমিরের মুখ মুহূর্তেই মেঘে ঢেকে যায়। সে গম্ভির হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না সে। আয়শাকে কি বলে দিবে তার বাবা ফিরোজ আহমাদকে সে’ই পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে! নাকি সব ঘটনা লুকিয়ে রাখবে?

ওকে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে আয়শা ভীষণ বিরক্ত হয়। কিছুটা ধাক্কা মেরে বলে ওঠে,

“কি হলো আলমির এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেন? বলো না তুমি কি বাবার ব্যাপারে কিছু জানো?”

ওর কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আলমির উল্টা প্রশ্ন করে বলে ওঠে,

“আচ্ছা তোমাকে একটা প্রশ্ন করব ঠিকঠাক উত্তর দিবে আয়শা?”

“কেন উত্তর দিব না, অবশ্যই দিব। বল কি প্রশ্ন করতে চাও।”

“ধরো তুমি একজনকে অনেক বেশি সম্মান করো। তাকে নিজের গুরু জন মানো। কিন্তু কোন এক সময় জানতে পারলে সে তোমার বাবা-মা ভাই সকলের খুনি। এমনকি তোমাকে খুন করার জন্যেও সে উঠে পড়ে লেগেছে। তোমার জীবনটা জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছে সে। তাহলে তুমি সেই লোকটাকে কি করবে? সবকিছু জানার পরেও কি তাকে আগের মতই সম্মান করবে? নাকি তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিবে?”

“অবশ্যই আমি তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিব। আর শুধু অ্যাকশন’ই কেন। আমি পারলে তাকে নিজ হাতে খুন করবো। যে কিনা আমার পুরো ফ্যামিলিকে মেরে ফেলবে। আমার জীবনটা তছনছ করে দেবে। তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তাকেও খুন করে নিজের বদলা নেব। কিন্তু তুমি হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছ কেন আলমির?”

আলমির ওর কথায় মৃদু হাসে। ছোট করে উত্তর দেয়,

“সময় হলে সব জানতে পারবে।”

তারপর নিজের কাজে মন দেয় সে। আয়শার মাথায় ওর কথার আগামাথা কিছুই ঢোকে না। তাই সে বেশ বিরক্ত হয়ে সোফার ওপর গিয়ে বসে। একটি ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে।
,
,
,
বিকেল ৪:৫০ মিনিট
একটু পরে অফিস ছুটি হয়ে যাবে। মেহরিমা সব গোজগাজ করে রেডি হচ্ছে বাসায় ফিরবে বলে। সকাল থেকে আর একবারও আলমিরের ডেস্কে যায়নি সে। আলমিরও তাকে একবারের জন্যও ডেকে পাঠায় নি। তাই তার ওপর ভীষন রাগ মেহরিমার। কিন্তু সেটা বুঝতে দিচ্ছেনা সে। রেডি হয়ে যখনই চিন্তা করে অফিস থেকে বেরিয়ে যাবে। তখনই দেখে আলমির নিজের ডেস্ক থেকে আয়শাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে।

ওদের দুজনকে একসাথে দেখে যেন আবারো রাগে শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে মেহরিমার। সে আর দেরী না করে অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। তখনই ওকে পিছু ডেকে আলমির বলে ওঠে,

“মিস মেহরিমা কোথায় যাচ্ছো তুমি? এখনো ছুটির টাইম হয়নি। দুই মিনিট বাকি আছে। এখানেই দাঁড়াও।”

মেহরিমা থমকে যায়। আর কোন কথা বলে না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকে। আলমির এবার অফিসের সবাইকে ডেকে একসাথে জড়ো করে বলে,

“গুড ইভনিং এভরিওয়ান। আমি আপনাদের মাঝে একটি অ্যানাউন্সমেন্ট করতে যাচ্ছি। এই কম্পানিটা স্টার্ট করার পর থেকে এখন অব্দি কোন পার্টি দেওয়া হয়নি। তাই আমি আর আয়শা মিলে ডিসিশন নিয়েছি আগামিকাল রাতে আমার বাসায় ছোটখাটো একটি পার্টি হবে। সবাই রাত আটটার সময় চলে আসবেন। কালকে সকলের ছুটি।”

আলমিরের কথা শুনে সবাই আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। সকলের মাঝে আনন্দের গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। সকলে ভীষণ আনন্দিত। কিন্তু মেহরিমার মন খারাপ। আয়শাকে ওর পাশে সহ্য করতে পারছে না সে। তাই রাগে গজগজ করতে করতে কোন কথা না বলে সোজা বেরিয়ে চলে যেতে নেয়। তখনই আলমির আবারো জোরে শব্দ করে বলে ওঠে,

“আর হ্যাঁ সবাইকে বলে দিচ্ছি, কেউ যেন মিস না করে কালকের পার্টি। কেউ যদি পার্টিতে না আসে, তাহলে তাকে জরিমানা করা হবে। সাথে আগামি তিন মাস কোনো বেতন দেওয়া হবে না।”

মেহরিমা ফিরে তাকায় না। কথাটা শুনে সোজা অফিস থেকে বেরিয়ে চলে যায়। আলমির বুঝতে পারে তার রাগের কারণ। সে মৃদু হেসে মনে মনে বলে,

“তোমাকে জানানোর জন্যই তো এত প্ল্যান। এই জ্বালা গুলো তোমাকে সহ্য করতেই হবে। তবেই তো তুমি আমার কাছে ফিরতে বাধ্য হবে জানপাখি।”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৫২
#M_Sonali

বাসা ভর্তি মানুষ। সবাই আলমিরের দেওয়া পার্টিতে এসেছে। যে যার মত নিজ নিজ আনন্দে ব্যস্ত। কিন্তু আলমিরের চোখ শুধু একজনকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখার জন্য যেন বুকের মাঝে হাহাকার করছে তার। সেই কখন থেকে শুধু তার অপেক্ষাতেই বসে আছে সে। কিন্তু তার আসার কোন নাম গন্ধ নেই। বেশ বিরক্ত হচ্ছে আলমির। তবুও অপেক্ষা করে যাচ্ছে মেহরিমার জন্য। আজ যে তার অনেক কাঙ্ক্ষিত একটি দিন। সে আজ এমন কাজ করবে যে মেহরিমাকে তার কাছে ফিরতেই হবে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দরজার দিকে চোখ আটকে যায় আলমিরের। মেহরিমা মেহেরকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে। অনেক সিম্পল ভাবে সেজেছে সে। সাদা রঙের লাল পাইরের একটি শাড়ি পরেছে। মুখে কোনো রকম সাজ নেই। শুধু মাত্র চোখে হালকা করে কাজল পড়েছে। মাথায় অনেক সুন্দর করে হিজাব বেধেছে। ঠিক যেনো অপ্সরী লাগছে ওকে আলমিরের চোখে।

আলমির শুনেছিলো নারীকে নাকি শাড়িতেই বেশি রূপবতী লাগে। আজ যেনো তার চাক্ষুষ প্রমান দেখছে সে। এমনভাবে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবে তাকে।

দরজা দিয়ে ঢুকতেই ওর চোখে চোখ পরল মেহরিমার। সাথে সাথে নিজের চোখ সরিয়ে নিল সে। পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। একজন কলিগের সাথে কথা বলতে লাগলো। ব্যাপারটা কিছুক্ষণ পরেই খেয়াল হলো আলমিরের। সে নিজেকে সামলে নিয়ে একজন গেস্ট এর সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো।
,
,
,
রাত ৯:০৫ মিনিট,
হঠাৎ করে পুরো বাড়ির লাইট অফ হয়ে গেল। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো ঘুটঘুটে অন্ধকার। সকলের মাঝে শুরু হল চাপা গুঞ্জন। তখনই সামনে একটি বিশাল পর্দার উপর আলো জ্বলে উঠলো। বিশাল পর্দায় ফুটে উঠল আলমির এবং মেহরিমার বিয়ের কিছু ছবি। যেখানে অনেক বেশী সুন্দর লাগছে দেখতে তাদের। যদিও প্রতিটা ছবিতেই তাদের মুখ গোমরা করা। দিদুন কেও দেখা যাচ্ছে পাশে বসা। মেহেরও রয়েছে হাসিখুশি ভাব নিয়ে।

ওদের বিয়ের ছবি দেখেই সকলের মাঝে হইহুল্লোর শুরু হল। অফিসের যারা জানতো না, আলমির এবং মেহরিমা স্বামী-স্ত্রী। তারা যেন অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেল। সবাই হা করে দেখতে লাগল ছবিগুলো। প্রায় ১৫ মিনিটের মত এভাবে সব চলল। সকলের মাঝে শুরু হলো গুঞ্জন। সবাই একে অপরের সাথে বাকবিতণ্ডায় ব্যস্ত। তখন’ই আবার চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো। সবার মাঝে হুঁশ ফিরে আসলো। সবাই দেখলো মেহরিমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে আলমির। তার মাথা নত করা। নিচ দিকে মাথা দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সকলের মত মেহরিমাও বেশ অবাক হয়েছে। সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পুরো বাড়িটায় নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে গেল। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। সকলের নীরবতা কাটিয়ে আলমির মাথা তুলে মেহরিমার দিকে তাকাল। তার দু চোখ থেকে দু ফোটা জল টুপ করে গড়িয়ে পরলো নিচে। সে করুন গলায় হাত জোর করে মেহরিমার দিকে তাঁকিয়ে বললো,

“আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না মেহু? আজ সকলের সামনে তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি জানি আমি ভুল করেছি। তোমার সাথে অনেক বেশি অন্যায় করে ফেলেছি। যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত এখন করছি। প্লিজ মেহু আমার কাছে ফিরে আসো। আমি আর কিছু চাই না। শুধু তোমাকে চাই। তুমি যা বলবে আমি সেটাই করবো। দরকার হলে তোমার কথা মতো নিজেকে খুন করে ফেলবো। তবুও তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। ফিরে আসো আমার কাছে প্লিজ মেহু।”

এতোটুকু বলে থামল আলমির। মেহরিমা এখনো কিছু বলছে না। সে চুপচাপ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আর আলমিরের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে চুপ থাকতে দেখে আলমির উঠে দাঁড়ালো। পাশে একজন গার্ডের কাছে ইশারা করে কিছু চাইতেই সে এসে একটি ফাইল হাতে দিয়ে গেল ওর। ফাইলটা মেহরিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এখানে আমার সব সম্পত্তির কাগজ আছে। আমি সবকিছু তোমার নামে লিখে দিয়েছি। আজ আমি নিঃস্ব। শুধু তোমাকে চাই। আমাকে ক্ষমা করো। ফিরে আসো আমার কাছে। তুমি আমাকে যে শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নেব। তবুও আমাকে শুধু ক্ষমা করে দাও। আমি আর এই বোঝা নিয়ে বেড়াতে পারছিনা। তুমি জানো না প্রতিটা মুহূর্তে বুকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে আমার। তোমাকে ছেড়ে থাকতে। যত তোমার কাছে এগিয়ে যেতে চাইছি তুমি ততই আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো। প্লিজ মেহরিমা এবারের মত ক্ষমা করে দাও। কথা দিচ্ছি জীবনে আর এমন ভুল করবোনা। তোমাকে ভুল বোঝার পর আমি একে একে সব হারিয়ে ফেলেছি। আমার দিদুন, আমার মা। সবাইকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। আজ আমি নিঃশ্ব। এখন তুমি আমার একমাত্র সম্বল। তোমাকে হারাতে চাই না। প্লিজ মেহু ফিরে আসো আমার কাছে। ক্ষমা করে দাও আমায়। তোমার কাছে আমি হাত জোড় করছি। এবারের মত মাফ করে দাও।”

কথাগুলো বলার সময় দুচোখ বেয়ে ঝরঝরিয়ে পানি পড়ছে আলমির এর। পুরো বাসাভর্তি লোকজন হা করে তাকিয়ে দেখছে ওর অবস্থা। কোন ছেলে যে এভাবে কোন মেয়ের জন্য কান্না করতে পারে সেটা হয়তো সবাই স্বচক্ষে না দেখলে বুঝতে পারতো না। কিন্তু মেহরিমা এখনো চুপ। কোন কিছু বলছে না সে। চুপচাপ আলমিরের হাত থেকে ফাইলটা নিল সে। ফাইলটা ওপেন করে তার ভেতরে থাকা কাগজপত্রগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। তার মনের অবস্থা বোঝার মত ক্ষমতা নেই আলমিরের। সে কিছু বুঝতে পারছেনা মেহরিমা কি করতে চলেছে।

সকলের দৃষ্টি এখন মেহরিমার ওপর। সবাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে মেহরিমার দিকে। আলমির কে সে ক্ষমা করে দিবে সেই আশায়। কিন্তু সকলের আশায় পানি ঢেলে দিয়ে মেহরিমা কাগজগুলো একটানে ছিঁড়ে ফেলে আলমিরের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল। রাগে চিৎকার করে বলে উঠলো,

“কি ভেবেছেন কি আপনি, আমি লোভী? এটাই বাকি ছিল আপনার কাছ থেকে পাওয়ার। আমাকে পুরো সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে আবার নিজের কাছে ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। আমার আত্মসম্মানকে আবারও নিস্তেজ করে দিতে? কখনোই নয়। আমি আপনাকে কখনোই কবুল করব না। আর না কখনো ক্ষমা করব। আপনার থেকে মুক্তি চাই আমি। আর কখনো আপনার মুখটাও দেখতে চাই না। আমি কালকেই আপনার চাকরিটা ছেড়ে দেবো। আর মেহেরকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাব। প্রয়োজন হলে ভিক্ষা করে খাব। তবুও আপনার মুখ দেখতে চাই না। আপনাকে আমি ঘৃণা করি আলমির। আমার দেখা সবচাইতে নিকৃষ্ট কোন পুরুষ হয়ে থাকলে সেটা আপনি। যাকে আমি পৃথিবীতে সবচাইতে নিকৃষ্ট প্রাণী মনে করি। আপনি আর আমাকে নিয়ে কত খেলবেন বলুন। ভালোবাসার নাটক করে আমার আত্মসম্মান শেষ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিনা অপরাধে জানো-য়ারের মত অত্যা-চার করে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আজ আবার কোন মুখে ফিরিয়ে নিতে চান আমাকে? আপনি তো শুধু এটুকু করেই থেমে যাননি। অন্য মেয়ের সাথে খারাপ সম্পর্কেও জড়িয়ে আছেন। আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে। তাহলে কেন আবার ফিরিয়ে নিতে চান আমাকে? আবারো খেলার পুতুল বানানোর জন্য? সেটা কখনোই পারবেন না। আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ড আয়শাকে নিয়েই থাকুন। আমার কথা ভুলেও ভাববেন না। আর আপনার এই সম্পত্তির কোন কিছুই চাইনা আমার। সেটা আপনি রাখুন। আপনার মুখটাও কখনো দেখতে চাই না।”

কথাগুলো বলেই সেখান থেকে চলে যেতে নিল মেহরিমা। সাথে সাথে ওর হাত টেনে ধরল আলমির। গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

“যে ভুলটা আমি করেছিলাম। আজ সেই একই ভুল তুমিও করছো মেহরিমা। মানছি আমি ভুল করেছি। তার জন্য অনেকবার ক্ষমাও চেয়েছি তোমার কাছে। বারবার ফিরে আনতে চেয়েছি। তবুও তুমি ফেরোনি। আর যাকে তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড বলে ভাবছো সে আমার বন্ধু মাত্র। তার অলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্বামী সন্তান সবাই আছে। আমি যেমন পুরো না জেনে তোমার অবিশ্বাস করেছিলাম। তুমিও আজ একই কাজ করছ মেহু। প্লিজ এমন করো না। আমি অনেক কিছু হারিয়েছি তোমাকে অবিশ্বাস করে। তুমি আমার মতই কাজ করে পরে পস্তিও না। প্লিজ ফিরে আসো, শেষবারের মতো বলছি আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

মেহরিমা ওর কোন কথাই শুনলো না। হাতটা ওর হাত থেকে ঝারি মেরে ছাড়িয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গেল বাইরে। পিছন থেকে আলমির অনেক ডাকলো লাগল তাকে। কিন্তু কোন কথাই শুনলো না সে। কোন দিকে খেয়াল না করে সোজা দৌড়ে রাস্তার উপর চলে গেল। হঠাৎ অপরপ্রান্ত থেকে একটি সিএনজি এসে ধাক্কা দিল তাকে। সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে ছিটকে পড়লো রাস্তার ওপর। মাথা ফেটে জ্ঞান হারালো সে।

ওর চিৎকার শুনে বাসা থেকে দৌড়ে বের হলো আলমির। সে ওর পিছু পিছুই আসছিলো। ওর পিছে পিছে সবাই বের হলো বাইরে। রাস্তার মাঝে আসতেই দেখল মেহরিমা পড়ে আছে। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে তার। সাথে তার প্রচুর পরিমাণ ব্লিডিং হচ্ছে। ওর অবস্থা খুবই খারাপ। ওকে এ অবস্থায় দেখা মাত্রই যেন বুকটা কেঁপে উঠল আলমিরের। মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়লো। সে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে গিয়ে মেহরিমা কে সে অবস্থাতেই কোলে তুলে নিল। ওর রক্তে ভিজে গেল আলমিরের গাঁয়ের পোষাক। সে দ্রুত ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলল। গাড়ি নিয়ে দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটে গেল। হসপিটালে নিয়ে যেতেই ইমারজেন্সি তে ভর্তি করা হল মেহরিমা কে।

মেহের সেই কখন থেকে কান্না করে চলেছে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাকে। আলমিরের অবস্থাও খুবই খারাপ। তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মেহরিমার আজ কিছু হলে সে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। আজ তার ভুলের কারণেই এ অবস্থায় পৌঁছেছে সে। যদি সেদিন মেহরিমা কে বিশ্বাস করতো। তাহলে হয়তো আজকে এই পরিস্থিতিতে পৌঁছাতে হতো না তাকে। সে একমনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগল মেহরিমার জন্য। প্রায় ঘণ্টা খানেক পর ডাক্তার বেরিয়ে আসলো ইমারজেন্সি রুম থেকে। সে দ্রুত এসে আলমিরের কাছে এসে প্রশ্ন করল,

“রোগীর সাথে কে এসেছেন? আপনি ওনার কি হন?”

“আমি ওর হাজবেন্ড। ও ঠিক আছে তো?”

“দেখুন ওনার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। ওনার মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করতে হবে। আপনি যত দ্রুত সম্ভব রক্তের ব্যবস্থা করুন। প্রচুর ব্লিডিং হওয়ার কারণে ওনার অবস্থা আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তারাতারি বি পজিটিভ রক্তের ব্যবস্থা করুন।”

আলমির অবাক হয়ে গেলো। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল,

“ওর মিসক্যারেজ হয়েছে মানে?”

“কেন আপনি জানেন না? উনি তো প্রায় চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ওনার পেটে বাচ্চা ছিল। কিন্তু একসিডেন্টের কারণে বাচ্চাটা মারা গেছে। এখন আপনি দেরি না করে দ্রুত উনার জন্য রক্তের ব্যবস্থা করুন। নইলে ওনাকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে যাবে।”

কথাগুলো বলেই চলে গেলেন ডাক্তার। উনার কথা শুনে যেন মাথার ওপর বাজ পরলো আলমিরের। সে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। তারমানে মেহরিমা অন্তঃসত্তা ছিলো? সে বাবা হতে যাচ্ছিল! কথাটা ভেবেই যেন বুকের মাঝে হাহাকার করে উঠলো তার। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। তবুও সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে রক্তের ব্যবস্থা করার জন্য ছুটে গেল। যেভাবেই হোক মেহরিমা কে বাঁচাতে হবে তাকে। সে দ্বিতীয় বারের মত তার মেহুকে হাড়াতে চায় না।

কিছুক্ষণের মাঝেই রক্তের ব্যবস্থা করে ফেলল আলমির। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে অপারেশন চললো মেহরিমার। এই তিন ঘণ্টায় ওজু করে জায়নামাজে বসে শুধু আল্লাহর কাছে মেহরিমার জানটা ভিক্ষা চাইছিল আলমির। তিন ঘণ্টা পর ডাক্তার যখন অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে আসলেন। সে দ্রুত ছুটে গেল তার কাছে। উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“আমার মেহু আমার ওয়াইফ এখন কেমন আছে ডাক্তার? ও সুস্থ হয়ে যাবে তো?”

ডাক্তার ওকে শান্ত হতে বলে কিছুটা নরম গলায় বলল,

“চিন্তা করবেন না। আপনার স্ত্রী এখন বিপদমুক্ত। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন ইনশাআল্লাহ। কিন্তু,,!”

এতোটুকু বলে থেমে গেলেন ডাক্তার। ওনাকে থাকতে দেখে আলমির ভ্রু কুচকালো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

“কিন্তু কি ডাক্তার? কি লুকাচ্ছেন আপনি আমার থেকে?”

“দেখুন আমি জানি কথাটা শোনার মত অবস্থা এখন নেই আপনার। তবুও আপনাকে কথাটা বলতেই হচ্ছে। প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। আসলে এক্সিডেন্ট এর ফলে আপনার স্ত্রীর জরায়ুতে বড় ধরনের ক্ষত হয়েছিলো। যে কারণে তাকে বাঁচানোর জন্য অপারেশনের সময় সেটা কেটে ফেলতে হয়েছে আমাদের। তাই আপনার স্ত্রী আর কখনোই মা হতে পারবে না। Sorry.”

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,