দিওয়ানেগি পর্ব-৫৩ এবং শেষ পর্ব

0
848

#দিওয়ানেগি #পর্ব_৫৩_শেষ_পর্ব
#M_Sonali

সকাল ৯:৩০ মিনিট,
মেহরিমার বেডের কাছে একটি চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে মেহের। একনজরে তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। এখন অব্দি জ্ঞান ফেরেনি মেহরিমার। ডাক্তার বলেছে কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো জ্ঞান ফিরে আসবে তার। আলমির সারারাত ওর পাশেই বসে ছিল। বারবার ওর মাথায় হাত দিয়ে চেক করছিল। সেই সাথে পাগলের মত করছিল ওর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায়। মেহেরকে বারবার মানা করে দিয়েছে বাচ্চার ব্যাপারে মেহরিমাকে কিছু না বলতে। অনেক কষ্ট পাবে সে জানলে। আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। এসব কথা বলে একটু আগেই মেহেরের জন্য খাবার আনতে বাইরে গেছে আলমির।

সেই থেকে মেহের চুপচাপ বসে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। হঠাৎ হাতে কারো স্পর্শ পাওয়ায় সে দিকে ফিরে তাকায় সে। তাকিয়ে দেখে মেহরিমার জ্ঞান ফিরেছে। সে এক হাতে ওর হাতের উপর স্পর্শ করেছে। সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় মেহের। বোনের পাশে গিয়ে বসে হাতটা দুই হাতে ধরে বলে,

“তোমার জ্ঞান ফিরেছে! এখন কেমন আছো আপু। কোথাও কষ্ট হচ্ছে না তো?”

মেহরিমা ওর কথার উত্তর দেয় না। নিজের পেটের ওপর হাত বুলিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে,

“আমার কি হয়েছিল মেহের? আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো?”

ওর প্রশ্নের উত্তরে মেহের মাথা নিচু করে ফেলে। কি বলবে ভেবে পায়না সে। ওকে চুপ থাকতে দেখে আবারও উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে,

“কি হল মেহের উত্তর দিচ্ছিস না কেন? বল আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো? আমার পেটটা এমন খালি খালি লাগছে কেন? ওর কোন অস্তিত্ব কেন টের পাচ্ছি না।”

“তুমি যে প্রেগন্যান্ট ছিলে সেটা তুমি আগে থেকেই জানতে আপু? কই কখনো তো আমার সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করো নি?”

“মেহের আমি তোর কাছে যা জানতে চাইছি তার উত্তর দে। বল আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো? ডাক্তার কি বলেছে? ডাক্তার কে ডাক আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। ওর অস্থিত্ব কেন টের পাচ্ছি না আমার মাঝে। আমার বাচ্চা ঠিক আছে তো। তার কোনো ক্ষতি হয়নি তো?”

কথাগুলো বলেই উত্তেজিত হয়ে যেতে লাগল মেহরিমা। ওকে উত্তেজিত হতে দেখে ওর হাতটা দুহাতে চেপে ধরল মেহের। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“আপু তুমি শান্ত হও। একটু চুপচাপ শুয়ে থাকো। এভাবে উত্তেজিত হলে তোমার শরীর আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। প্লিজ নিজেকে শান্ত করো।”

“আমি কিভাবে নিজেকে শান্ত করব মেহের? আমার মন বলছে আমার বাচ্চা নেই। আমার বাচ্চা মারা গেছে। খুন করেছে ওকে ওই আলমির। আমার বাচ্চাকে সে কেরে নিয়েছে আমার থেকে। সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। আমার শেষ সম্বল আমার বাচ্চা টাকেও মেরে ফেলেছে সে। আজ তার জন্য নিজের শেষ সম্বল টুকুও হারিয়ে ফেললাম।”

কথাগুলো বলেই অঝোরে কান্না করতে লাগল মেহরিমা। নিজের পেটে হাত বুলাতে বুলাতে। হঠাৎ মেহেরের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সে নিজের বোনের হাতটা ঝাড়ি মেরে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

“তুমি ভুল বলছ আপু। দুলাভাই তোমার বাচ্চাকে মারেনি। তোমার বাচ্চার খুনি তুমি নিজেই। তুমি নিজ হাতে খুন করেছো তাকে। নিজের অতিরিক্ত ইগোর কারণে হাড়িয়ে ফেলেছো নিজের সন্তানকে।”

ওর এমন কথায় চমকে উঠল মেহরিমা। কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল সে। কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে রইল মেহেরের দিকে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“এসব তুই কি বলছিস মেহের? তোর কি মাথা ঠিক আছে? আমি নিজের সন্তানকে কেন মারতে যাব? কোন মা কি পারে তার সন্তানকে মারতে!”

” হ্যাঁ আপু আমি ঠিকই বলছি। তুমি’ই তোমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী। দুলাভাই নয়। তুমি নিজের ইগোর কাছে এতটাই আটকে গিয়েছিলে যে একবার নিজের সন্তানের কথাটাও ভাবনি। সবসময় নিজের ইগো কে বড় করে দেখেছো। আমি জানি বাবা আমাদের আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সাথে এটাও শিখিয়েছিলেন যে বিয়ের আগে মেয়েদের আত্মসম্মান তার বাবা এবং বড় ভাইয়ের সাথে মিশে থাকে। আর বিয়ের পর থেকে তার স্বামীর সাথে। আমি বাবাকে সব সময় বলতে শুনেছি। বাবা বলতেন, বিয়ের পর সব সময় স্বামীর পাশে থাকতে। তাকে সব রকম পরিস্থিতিতে সহযোগিতা করতে। কখনো রাগারাগি ভুল বোঝাবুঝি হলে সেটা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে। আমি মানছি আলমির ভাইয়া অনেক ভুল করেছে। তোমার গায়ে হাত তুলে, তোমাকে অবিশ্বাস করে। কিন্তু তুমিওতো কম ভুল করনি আপু। আলমির ভাইয়া নিজের ভুলটা বোঝার পর তোমার কাছে অনেকবার অনেকভাবে ক্ষমা চাইতে এসেছে। কিন্তু তুমি নিজের ইগোর কাছে এতটাই আটকে ছিলে যে তার কথা শোনোনি। অন্তত নিজের বাচ্চার কথাটা চিন্তা করেও তাকে মেনে নিতে পারতে। একটা বার সুযোগ দিতে পারতে। কিন্তু তুমি সেটা করো নি। বাবা সবসময় বলতেন ক্ষমা করা একটি মানুষের সবচাইতে মহৎ গুণ। তাই সবাইকে একটি বার হলেও ক্ষমা করে সুযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু তুমি সেটা মনে রাখোনি আপু। তুমি শুধু নিজের আত্মসম্মান টাকে ধরে রেখেছিলে। কিন্তু তুমি কি আদৌ সেই আত্মসম্মান ধরে রাখতে পেরেছো? আলমির ভাইয়ার থেকে আলাদা হওয়ার পর আমরা নিজের বাবার বাড়িতেও থাকতে পারিনি। সেখানেও প্রতিবেশিদের কাছ থেকে অপমানিত হয়ে এলাকাছাড়া হতে হয়েছে। সেখানে কি আদৌ আমাদের আত্মসম্মান বজায় ছিল আপু? তাই আমি বলব আজ তোমার এই অবস্থার কারণ তুমি নিজে। সেদিন যদি আলমির ভাইয়াকে ক্ষমা করে দিয়ে একটিবার সুযোগ দিতে। তাহলে হয়তো আজ এই দিনটা দেখতে হতো না আমাদের।”

এতোটুকু বলে থামল মেহের। ওর কথাগুলো শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে মেহরিমা। নিজের ছোট্ট বোনটার মুখে এমন বড় মানুষের মতো জ্ঞানের কথা শুনে সত্যিই স্তব্ধ সে। নিজের ভুলটা ও যেন ধীরে ধীরে খেয়াল হচ্ছে তার। চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে তার। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মেহের আবার বলতে শুরু করলো,

“কাকে খুনি বলছো তুমি আপু? কাকে দায়ী করছো নিজের ভুলের কারণে হওয়া ক্ষতির জন্য। যে কিনা তোমাকে হসপিটালে নিয়ে আসার পর পাগলের মত করেছে। জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে তোমার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে। সারা রাত তোমার পাশে বসে থেকে তোমার সেবা যত্ন করেছে। তোমার জ্ঞান ফেরার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থেকেছে। তাকে দোষারোপ করছো তুমি? সত্যিই আজকে তোমার জন্য ভীষণ আফসোস হচ্ছে আমার। আপু তুমিও ভাইয়ের মতো স্বার্থপর হয়ে গেছো। নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কিছু চোখে পড়ে না তোমার। আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার মতো এই কথাগুলোই বলতো তোমাকে। প্লিজ আপু এখনো সময় আছে নিজের ইগোকে সরিয়ে আলমির ভাইয়ার কাছে ফিরে যাও। নইলে এর চাইতেও আরো বেশি পস্তাতে হতে পারে তোমাকে।”

কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে শান্ত করে নিলো মেহের। তারপর গম্ভির গলায় বলল,

“আমি ডাক্তারকে ডেকে আনছি।”

এতোটুকু বলেই আর দেরি না করে দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ রেগে আছে সে। মেহরিমা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার মুখে বলার মত কোন কথা নেই। সে গভীর টেনশনে পড়ে গেছে মেহেরের কথাগুলো নিয়ে। তাহলে কি সত্যি এতোদিন ভুল করেছে সে? তার ভুলের জন্যই আজ নিজের সন্তানের বলিদান দিতে হলো তাকে? কথাগুলো ভেবে দুচোখ বেয়ে ঝরঝরিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল মেহরিমার। তখনই কেবিনে প্রবেশ করল সরণ।

ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর পাশে এসে দাড়ালো সরণ। পাশে কার উপস্থিতি টের পেয়ে সে দিকে ফিরে তাকাল মেহরিমা। ওকে দেখে মাথা নিচু করে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। সরণ বলে উঠলো,

“কেমন আছো মেহরিমা? আলমির তোমাকে কোন অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে। ভীষণ খারাপ লাগছে আমার তোমাকে এ অবস্থায় দেখে। আলমির তোমায় ডিজার্ভ’ই করে না।”

মেহরিমা ওর কথায় কোন উত্তর দিল না। সেভাবেই চুপচাপ শুয়ে থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। ওর থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে সরণ আর একটু ওর কাছে এগিয়ে এলো। আবারো বলে উঠলো,

“আলমির শুধু তোমার থেকে তোমার সন্তানকে কেড়ে নেয় নি। সেইসাথে কেড়ে নিয়েছে তোমার সারা জীবনের মতো মা হওয়ার ক্ষমতাটুকুও। জানো ও মেহরিমা, তুমি আর কখনোই মা হতে পারবেনা।”

ওর বলা এই কথাটায় যেন কারেন্টের মত শট খেলো মেহরিমা। দ্রুত ওর দিকে ফিরে তাকাল সে। ভ্রু কুঁচকে উত্তেজিত গলায় বলে উঠল,

“এসব আপনি কি বলছেন সরণ? আমি কোনদিন মা হতে পারব না মানে?”

ওর কথার উত্তরে সরণ যখনই কিছু বলতে যাবে তখনি রুমের মধ্যে প্রবেশ করে আলমির। আলমিরকে দেখে থমকে যায় সরণ। কি বলবে ভেবে পায়না সে। ভয়ে গুটিয়ে যায় মুহূর্তেই।

ওকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহরিমা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে ওঠে,

“কি হলো সরণ? আপনি বলছেন না কেন, আমি কখনো মা হতে পারব না মানে? আমি মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছি মানে, কী হয়েছে আমার? সত্যি করে বলুন।”

“তোমার কিছু হয়নি মেহু। তুমি একদম ঠিক আছো। আমরা আমাদের প্রথম সন্তান হারিয়েছি ঠিকই, তবে আমাদের আবার সন্তান হবে। আমরা আবার মা বাবা হবো। এসব নিয়ে ভেবো না। নিজেকে শান্ত করো।”

কথাগুলো বলেই ওর কাছে এগিয়ে গেল আলমির। আর রাগি চোখে তাকালো সরণের দিকে। সরণ আর দেরি না করে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেল। কারণ আলমির এর রাগি চোখ দেখে সে আর ওখানে দাঁড়ানোর সাহস করলো না। সে বেশ ভালো করেই জানে আলমিরের রাগ সম্পর্কে।
,
,
,
পাঁচ মাস পর,
ছাদের ওপর খোলা চুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে মেহরিমা। মনটা তার ভীষণ খারাপ। গত ৫ মাসে আলমির এমন কোনো কাজ করেনি যেটাতে সে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট পায়। বরং সবসময় তাকে মাথায় তুলে রেখেছে। তার প্রতিটি আবদার মুখ ফুটে বলার আগেই পূরণ করেছে। কিন্তু মেহরিমার মন তো শুধু একটি সন্তান”ই চায়, আর কিছু নয়। যেদিন থেকে জানতে পেরেছে সে কখনোই মা হতে পারবে না। সেদিন থেকে যেন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে মনের ভেতর থেকে। সে বুঝতে পেরেছে ভুল শুধু আলমিরের নয় তার নিজেরও ছিল। নিজের ইগোর কাছে বড় হতে গিয়ে সব কিছু হারিয়েছে সে। আজ এই অবস্থায় পৌঁছেছে। তখন যদি আলমিরকে ক্ষমা করে একটি সুযোগ দিত, তাহলে হয়তো এই দিনটা দেখতে হতো না তাকে। সেদিন মেহের ঐ কথাগুলো না বললে হয়তো আজও সে একই ভুলের মাঝে থাকতো।

আলমির তার জীবনে কোন কিছুর অভাব রাখেনি। ভালোবাসা, যত্ন, সম্মান সবকিছু দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে তাকে। এতোটা ভালোবাসা দিয়েছে যে পৃথিবীতে কোন স্বামী তার স্ত্রীকে এত ভালবাসে কিনা মেহরিমার তা জানা নেই। কিন্তু তবুও সে মন থেকে কখনোই খুশি হতে পারেনি। বারবার শুধু সন্তান হারানোর বেদনা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে তাকে। যদিও সেটা আলমির এর সামনে কখনোই প্রকাশ করেনি সে। আলমির কষ্ট পাবে ভেবে।

মেহরিমা অবশ্য বেশ কয়েকবার আলমির কে বলেছে। আবার বিয়ে করে নতুন সংসার পাততে। তাদের সন্তানের জন্য। কিন্তু আলমিরের একই কথা। দরকার হলে সারা জীবন সন্তান ছাড়া থাকবে। তবুও সে দ্বিতীয় বিয়ে করবেনা। তার শুধু নিজের মেহুকে ছাড়া আর কিছু চাই না।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দু চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার। সে দ্রুত চোখটা মুছে নেয়। কারণ সে ভাল করেই জানে যখন-তখন আলমির চলে আসতে পারে। আর তার চোখের পানি সে একদমই পছন্দ করতে পারে না। বলতে না বলতেই আলমির সেখানে এসে হাজির। দু মগ কফি নিয়ে এসে মেহরিমার সামনে চেয়ারের উপর বসে। এক মগ ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বলে,

“এই নিন ম্যাম এটা আপনার জন্য। বিকেল বেলা ছাদে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কফি খাওয়ার মজাই আলাদা। একটা রোমান্টিক রোমান্টিক ফিলিংস আসে।”

মেহরিমা ওর কথার কোন উত্তর দিল না। মুচকি হেসে কফির মগটা হাতে নিল। আলমির কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,

“তোমার সাথে থেকে থেকে আমিও দুধ চিনি দিয়ে কফি খাওয়া শিখে ফেললাম। অবশ্য কাজটা মন্দ করনি। জীবন থেকে তেতো ভাবটা চলে গেছে আমার।”

কথাটি বলেই হেসে দিলো আলমির। মেহরিমা মুচকি হেসে কফিতে চুমুক দিল। চুমুক দিতেই সে তাড়াতাড়ি কফির মগটা পেবিলে রেখে উটকি করতে করতে বমি করে ফেলল। ওকে এমন করতে দেখে আলমিরের যেনো জানটাই বেরিয়ে আসলো। সে দ্রুত কফি মগটা রেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ওকে ধরলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,

“কি হয়েছে মেহু। তুমি হঠাৎ বমি করছ কেন। ঠিক আছো তো?”

“জানিনা আলমির, আমার কি হয়েছে। কয়েকদিন হল দুধ, ডিম, মাছ এসব কোন কিছুর গন্ধই সহ্য করতে পারছিনা। নাকের কাছে নিতেই শুধু বমি আসছে।”

“একথা তুমি আমাকে এখন বলছ মেহু! এতদিন তো কিছুই বললে না। চলো এক্ষুনি তোমাকে হসপিটালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।

ওর কথা শুনে মেহরিমা যেতে চায় না। কিন্তু তবুও আলমির জোর করেই তাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ ডাক্তার তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। পরীক্ষা শেষে কেবিন থেকে বের হতেই আলমির দ্রুত তার কাছে এগিয়ে যায়। উত্তেজিত কন্ঠে জিগ্যেস করে,

“ডাক্তার আমার স্ত্রীর কি হয়েছে? ও ঠিক হয়ে যাবে তো? ও হঠাৎ এভাবে বমি করছিলো কেন? ওর শরীর ঠিক আছে তো? ওর খারাপ কিছু হয়নি তো?”

এতগুলো প্রশ্ন একসাথে শুনে মুচকি হেসে দেন ডাক্তার। তারপর হাসিমুখেই বলেন,

“আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন। আপনার স্ত্রীর খারাপ কিছু হয়নি। বরং আপনার জন্য গুড নিউজ আছে। আপনি বাবা হতে চলেছেন। আপনার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট।”

ডাক্তারের কথাশুনে এক মুহূর্তের জন্য যেন হৃদস্পন্দন থেমে যায় আলমিরের। সে থমকে যায় সেখানেই। বরফের মতো জমে যায় তার শরীর। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ডাক্তার যেটা বলল সেটা কি আদৌ সত্যি? কাঁপা কাঁপা গলায় আলমির প্রশ্ন করে ওঠে,

“আপনি ঠিক বলছেন ডাক্তার? আমার স্ত্রী সত্যিই প্রেগন্যান্ট? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? ডাক্তার তো বলেছিল ও আর কখনোই মা হতে পারবেনা!”

“আমি জানিনা মিস্টার আলমির, আপনাকে এই কথাটা কোন ডাক্তার বলেছে। তবে যে’ই বলে থাকুক না কেন সে সম্পূর্ন মিথ্যে বলেছে। আপনার স্ত্রীর সবকিছুই নরমাল আছে। আর সে অবশ্যই মা হতে পারবে। এবং অলরেডি সে সন্তান সম্ভবা। নিজের স্ত্রীর যত্ন নিন আর হবু সন্তানের জন্য অপেক্ষা করুন।”

কথাটি বলেই ডাক্তার মৃদু হেসে সেখান থেকে চলে গেল। আলমির খুশিতে যেনো পাগলের মত হয়ে গেল। এতটা খুশি হয়তো তার জীবনে আর কখনো আসেনি। সে খুশীতে আত্মহারা হয়ে দ্রুত ছুটে গেল মেহরিমার কাছে। মেহরিমা ও খুশিতে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। সেও যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দুজনের মাঝে অনেকক্ষণ আনন্দ উল্লাস বয়ে গেল। ভালবাসার সাগরে ডুবে রইলো তারা। তারপর হঠাৎ করে আলমির গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো,

“ওই ডাক্তার কেন মিথ্যা কথা বলেছিল আমায়? কেন বলেছিল তুমি কখনোই মা হতে পারবে না? এটা আমাকে জানতেই হবে।”

মেহরিমা কে হসপিটাল থেকে নিয়ে বাসায় রেখে, সে ফিরে এল সেই ডাক্তারের খোঁজে। পাঁচ মাস আগে এতবড় একটি মিথ্যা কথা কেনো বলেছিল তাকে জানতেই হবে। কিছুক্ষণ খুঁজতেই তাকে পেয়ে গেল আলমির। সে কয়েকজন রোগী দেখছিলো। আলমির কারো তোয়াক্কা না করে সোজা তার কেবিনে ঢুকে পড়ল। ওকে দেখেই ডাক্তার চমকে উঠল। সে দ্রুত নিজের রোগীদেরকে কিছুক্ষনের জন্য বাইরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। তারা বাইরে চলে যেতেই আলমির সামনে থাকা টেবিলের উপর জোরে আঘাত করে বলল,

“আপনি একজন ডাক্তার হয়ে এত বড় মিথ্যে কথা কেন বলেছিলেন আমায়? কেন বলেছিলেন আমার স্ত্রী আর কখনো মা হতে পারবেনা? এত বড় মিথ্যে বলার কারণ কি? আপনি জানেন আপনার এই ছোট্ট একটি কথার জন্য আমাদের জীবনটা কতটা বিষিয়ে ওঠে ছিল। সব সময় মুখে মুখে হাসিখুশি থাকা সত্বেও মনের মাঝে কখনো শান্তি ছিল না। সারাক্ষণ একটি সন্তানের আশায় পাগল হয়ে থাকতাম আমরা। কেন বলেছিলেন আপনি এত বড় একটি মিথ্যা? কি লাভ ছিল আপনার এতে?”

ডাক্তার এবার বেশ আমতা-আমতা শুরু করলো। বেশ ভয় পেয়েছে তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়তে লাগল তার। সে আলমিরের দিকে তাকিয়ে করুন গলায় বলল,

“প্লিজ মিস্টার আলমির আপনি এত উত্তেজিত হবেন না। এখানে বসুন আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি। এখানে আমার কোন দোষ নেই। আমি নিরুপায় হয়ে আপনাকে ওই মিথ্যাটা বলেছিলাম।

আলমির ভ্রু কুকালো ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে গম্ভির গলায় বলল,

“মানে, কি বলতে চাইছেন আপনি?”

“আসলে আপনার স্ত্রীর মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার পর সেটা যখন আমি আপনাকে বলার জন্য আসছিলাম। তখনই মিস্টার সরণ আমার কাছে আসে। ডাক্তার ফিরোজ আহমাদের ছেলে। ডাক্তার ফিরোজ আহমাদ আমার কাছে ২০ লক্ষ টাকা পেতেন। যেটা আমি তখনো শোধ করতে পারিনি। ওনার ছেলে সরণ আমাকে বলে ওই টাকা আর আমার কাছ থেকে কখনোই নিবে না। যদি আমি তার হয়ে একাজটা করে দেই। যদি আপনাকে এবং আপনার স্ত্রীকে বোঝাই যে আপনারা আর কখনো মা বাবা হতে পারবেন না। আমি ওই ২০ লাখ টাকা শোধ এর লোভে পড়ে এই কাজটা করেছিলাম। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার ভুল হয়ে গেছে। ঐ কাজটা করা আমার উচিত হয়নি।”

আলমির ডাক্তারকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

“আচ্ছা ঠিক আছে এবারের মত আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর এরকম ভুল অন্য কারো সাথে কখনোই করবেন না।”

কথাটি বলেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে সে।
,
সরণ গত দু’মাস আগে তার বোন আয়েশা ও মায়ের সাথে বিদেশে চলে গেছে। সেখানেই সেটিং হয়ে গিয়েছে সে। আলমির শুনেছে সেখানে নাকি বিয়েও করেছে কিছুদিন আগে। যাওয়ার আগে ফিরোজ আহমাদ এর ব্যাপারে তারা সবকিছু জেনে গিয়েছে। এতে তারা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু তার পরেও বাবার কীর্তিকলাপ তাদের পছন্দ হয়নি। তাই দেশে না থেকে পরিবারের সবাই মিলে বিদেশে চলে গেছে। কিন্তু আলমির কল্পনাও করতে পারেনি সরণ এমন একটা কাজ করবে মেহরিমা কে পাওয়ার জন্য। তবে যাই করে থাকুক না কেন, এতে ওদের লাভই হয়েছে। ক্ষতি হয়নি। ওর এই কাজটার জন্যই হয়তো মেহরিমা আলমির এর কাছে ফিরে এসেছে। ওকে ক্ষমা করে আপন করে নিয়েছে। আর আজ তাদের জীবনে এতটা খুশির জোয়ার বইছে।
,
,
,
সাত বছর পর,
আজ মেহেরের বিয়ে। আলমিরের পুরো বাড়ি জুড়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে রমরমা হয়ে আছে। চারিদিকে যেন হৈ-হুল্লোড় আর খুশীতে মেতে আছে সবাই। তার মাঝেই দৌড়ে বেড়াচ্ছে ছোট্ট দুটি ছেলে মেয়ে। আলমির ও মেহেরিমার সন্তান তারা। মেয়ে আনিশা বয়স ৬ বছর। আর ছেলে মাহের বয়স ৪ বছর। এ বাড়ির সকলের চোখের মনি তারা। সারাক্ষণ নিজেদের দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখে বাড়িটা। আজকে একমাত্র খালার বিয়ে বলে তাদের আনন্দটা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। সকাল থেকে দুষ্টুমিতে মেতে আছে তারা। ওদের পুরো পরিবারটাই যেনো সুখে ভরে উঠেছে। কোথাও দুঃখের কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। কথায় আছে না, দুঃখের পরে সুখ এলে সেটাই হয় প্রকৃত সুখি। ওদের জীবনটাও ঠিক তেমনই হয়েছে। মেহরিমার প্রতি ভালবাসা আর একবিন্দুও কমেনি আলমিরের। বরং সময়ের সাথে সাথে তা আরো বেড়েই চলেছে। এ ভালবাসা তাদের অনন্দ কালের। এ ভালবাসার বন্ধন আর কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়। সব শেষে সবাই সুখি।

+++++++++++++সমাপ্ত+++++++++++++