দীর্ঘ রজনী পর্ব-০৪

0
353

গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৪
,
,
,
,
,
দুদিন পর সাজির পরীক্ষা। সাজি পড়ালেখা নিয়ে ভিষন ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। আশেপাশে কি হচ্ছে এই নিয়ে তার বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই।সে দিব্যি বইয়ের ভেতরে মুখ গুঁজে আছে।

সেঁজুতি হাসান টেনশনে এদিক ওদিক হাঁটছে। দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে এখনো ড্রাইভার আসার নাম নেই। এইদিকে সাজির পরীক্ষা দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। মেয়েটাকে কার সাথে পরীক্ষার হলে পাঠাবে এই নিয়ে টেনশনে ম*রে যাচ্ছে সেঁজুতি। পায়চারি করছে আর জুবায়েরকে কনটিনিউয়াসলি কল করে যাচ্ছে।
এই নিয়ে পঞ্চম বারের মতো জুবায়েরের নাম্বারে ডায়েল করছে সে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কল রিসিভ করলো জুবায়ের।

সেঁজুতি দাঁত কিড়মিড় করে তেতে উঠা গলায় বললো,, মেয়ে জন্ম দিলেই হয় না। মেয়েকে নিয়ে টেনশনও করতে হয়। সকল টেনশনের বোঝা আমার মাথায় দিয়ে বিদেশিনীদের পেছনে পেছনে ঘুরছো তাইনা! কালকের মধ্যে তুমি দেশে আসবে। রান্না-বান্না করবে তুমি। মেয়ে নিয়ে টেনশন করবে তুমি। আর আমি বিদেশে যাবো। আমার দ্বারা তোমার মতো হাঁড়ে ব*জ্জা*ত লোকের সংসার করা সম্ভব নয়। বুঝেছো তুমি!! কি হলো কথা বলছো না কেন!!

জুবায়ের বরাবরই শান্ত স্বভাবের। সব সময় স্ত্রীর কাছে হেরে গিয়ে জিতে যাওয়া লোক সে। সেঁজুতি যতোবার তার উপর রেগে যায়, ততবারই জুবায়ের নিজের হার ঘোষণা করে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে দেয়। এতে করে সেঁজুতি হাসান শান্ত হয়ে যায়। তীব্র অ*প*রাধবোধ নিয়ে আগের মতো কোমলমতি গলায় জুবায়েরের সাথে আলাপচারিতা শুরু করে দেয় সে। সংসার জিবনের এতোটা বছর পার হয়ে গেছে এই ওবদি কখনো সেঁজুতির সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেনি জুবায়ের। আজকেও চুপ করে সেঁজুতির রাগ, অভিযোগ শুনছে। জুবায়ের জানে একটু পরেই রাগ পড়ে যাবে।

~~ কথা বলছো না কেন তুমি? মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছো কেন?

জুবায়ের মুচকি হেসে মিনমিনে গলায় বলল,, কি বলবো বলো! আমি জানি সব দোষ আমার। সংসারে টাকা দেওয়া ছাড়া তোমাদের আর কোনো দায়িত্ব নিতে পারছিনা। অপদার্থের মতো নিজের ব্যবসার পেছনে পড়ে আছি। তুমি না সামলে নিলে কিযে হতো। তুমিই তো একমাত্র ভরসা সেঁজুতি,,,।

স্বামীর এহেন কথায় হকচকিয়ে গেল সেঁজুতি। বুকের ভেতরে মৃদু কম্পন বয়ে গেলো। লোকটাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বোধহয়। ইস্ কেন যে এইসব কথা বলতে গেলাম। সেঁজুতি হাসান আর্তনাদ করে বললো,, তুমি এইভাবে কথা বলছো কেন জুবায়ের? তোমার মোটেও দোষ নেই। সংসারের দায়িত্ব তুমি আমি দুইজনেই পালন করছি ঠিক মতো। শুধু একটু রেগে ছিলাম বলে এতো বাজে কথা বলে ফেলেছি। ক্ষমা করে দাও আমাকে। আর কখনো এইভাবে বলবো না।

,, জুবায়ের ঠোঁট চেপে হাসছে। তার সহধর্মিণীর রাগ যে নিমেষেই হাওয়া হয়ে গেছে। হুটহাট রেগে গেলেও জুবায়েরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা তার। তাই রাগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না।

,, ক্ষমা চাইতে হবে না। আমার উপর রাগ করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোমার। তা এখন বলো রেগে ছিলে কেন?

জুবায়েরের প্রশ্নে সেঁজুতি হাসানের কপাল পুনরায় কুঁচকে এলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, ড্রাইভার আসেনি জুবায়ের। দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে। এখন আমি আমার বাচ্চাটাকে পরীক্ষার হলে পাঠাবো কি করে? টেনশনে আছি ভীষণ তাইতো রেগে ছিলাম। কি করি বলো তো?

,, আনিস আসবেনা সেঁজুতি। আমার কথা হয়েছে তার সাথে। আনিসের মেয়েটা খুব অ*সুস্থ,এই সময় মেয়ের পাশে তার থাকা উচিত।

,, ইয়া আল্লাহ!! কি বলছ এইসব? আমাকে আগে বলো নি কেন? শুনো ! আনিসের জন্য কিছু টাকা দিও। এই মাসের বেতনটাও দিয়ে দিও। মেয়েটার চিকিৎসায় যেন কোনো রকমের কমতি না থাকে। শুনেই কেন খারাপ লাগছে।

স্ত্রীর আক্ষেপ ভরা কথায় জুবায়ের মৃদু হাসলেন। কোমলমতি মনের অধিকারী সেঁজুতি। সংসার জিবনের পঁচিশটা বছর পার হয়ে গেলেও তার সেই প্রথম বছরের মতো উচ্ছাস কিংবা হুটহাট মন খারাপ আর রেগে যাওয়ার ব্যাপারটা যায়নি এখনো। আঠারো বছর বয়সী অতিশয় চঞ্চল এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিল জুবায়ের।সে এখন পাক্কা গিন্নি। সময়ের সাথে সব বদলালেও সেঁজুতি বদলায়নি।
লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,, তুমি চিন্তা করো না আমি ওইদিকটা সামলে নিবো। আর হ্যা তোমার বাচ্চাটাকে নিয়েও টেনশন করতে হবেনা। সাদকে আমি আগেই বলে রেখেছি। সাদ দিয়ে আসবে আবার নিয়েও আসবে।

,, তুমি কি পা*গ*ল হয়ে গেছো জুবায়ের? ছেলেটাকে কি তোমার মানুষ মনে হয় না? ছেলেটা কাজ করতে করতে শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গেছে। এখন আবার তোমার মেয়ের দায়িত্ব নিবে? দয়া মায়া নেই তোমার মনে?

,, আমি ঠিকই আছি সেঁজুতি। সাদ এই দায়িত্ব নিতে পিচ পা হবে না। দায়িত্বের এখনো যেখানে পুরো জিবন বাকি, সেখানে এই অল্প সময়ে হাঁপিয়ে উঠলে চলবে? তুমি চিন্তা করো না। বরং ছেলেটার একটু যত্ন নিও।

,, তোমার এই ডিপ্লোমেটিক কথা না আগে বুঝেছিলাম! না এখন বুঝি! আর যত্নের কথা তোমাকে বলে দিতে হবে না। সেটা আমি ভালো জানি।

স্ত্রীর কথায় শব্দ করে হাসলো জুবায়ের।বউটা বৃদ্ধ হবে তবে বুঝের হবে না। আলাভোলা চঞ্চল বউ তার। ঠিক মেয়েটাও মায়ের মত হয়েছে।

হাসির শব্দ শুনে তেঁতে উঠল সেঁজুতি।
,, দাঁত দেখানো বন্ধ করো। এই মাসের শেষে যদি তোমাকে দেশে না দেখি!তো তোমার বিদেশ যাওয়া ছুটিয়ে দিবো। তোমার ব্যাবসা আমি আ*গু*ন ধরিয়ে দিবো। বিদেশীনিদের দেখে দেখে দাঁত কেলাচ্ছো তা আমি ডের বুঝতে পারছি। থাকো তুমি তোমার বিদেশীনিদের নিয়ে। আমি আমার মেয়ে নিয়ে বড় আপার কাছে চলে যাবো। হুহ!
নিজের কথা শেষ হতেই খট করে ফোনটা কেটে দিলো। রাগে গজগজ করতে করতে ভেজা জামাকাপড় নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে ছাদে উঠে গেলো।

জুবায়ের এখনো ফোন কানে চেপে হাসছে। মান অভিমানের সংসার তার। টেনে টুনে এতো টুকু আসেনি, বরং স্বাচ্ছন্দ্যে পার হয়েছে। আশা করা যায় সামনেও পার হবে।
______

সকাল থেকে না হলেও পঞ্চাশটা কল এসেছে। সেঁজুতি মেয়ের জন্য নাস্তা তৈরি করতে ব্যাস্ত। যদিও জুবায়েরের জোরাজুরিতে নতুন সার্ভেন্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবুও সব কাজতো আর সার্ভেন্ট দিয়ে করানো যায় না। তাই রান্নাটা সেঁজুতি নিজেই করে। সেঁজুতির পাশে দাঁড়িয়ে দরকারি জিনিস গুলো এগিয়ে দিচ্ছে রেনু। কাজ থেকে কল রিসিভ করতে হচ্ছে বেশি তাকে। রেনু বিরক্ত হয়ে সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,, খালাম্মা এতো কল আসে কেন? রিসিভ করতে করতে হাত ব্যাথ্যা হয়ে গেছে।

সেঁজুতি পরোটা বেলতে বেলতে মুচকি হেসে বলল,, সাজির আজ পরীক্ষা । সবাই কল দিয়ে খবর নিচ্ছে। সাজিকে ওর নানুবাড়ি ,দাদু বাড়ির সবাই ভীষণ আদর করে। তাই তাদের চিন্তাও বেশি।

,, তা ঠিক বলছেন খালাম্মা। সাজিঁ আপা খুব চঞ্চল আর মিষ্টি তাই তো আদর না করে পারা যায় না।

,, হুম!! তুই এখন যা, গিয়ে দরজা খুলে দে। সাদ এসে যেন কলিং বেল বাজাতে না হয়। আর হ্যা সাজিকেও জাগিয়ে দে। সাতটা বেজে গেছে অলরেডি।

রেনু বিনা বাক্যে মোবাইল রেখে দৌড় লাগালো। খালাম্মা কোনো কাজ দিয়েছে মানে সেটা যে কোনো মূল্যে পুরো করতেই হবে তাকে।

রেনুর বয়স বেশী না। খুব জোর পঁচিশ ছাব্বিশ বছর হবে। ছিপছিপে গড়নের তবে গায়ের রংটা চাপা। দুই বাচ্চার মা সে।একটা পাঁচ বছরের ছেলে আর একটা এক বছরের মেয়ে। বরটা প*শু থেকেও খারাপ।কাজ করে না বরং ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ম*দ খেয়ে পড়ে থাকে। ম*দ খেতে না পারলে রেনুকে মা*রধর করে।রেনু বাচ্চাদের নিয়ে একপ্রকার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এখন পেটের দায়ে লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে রেনু।

সব কিছু শোনার পর সেঁজুতি ঘোষণা করে দিয়েছে। রেনু এই বাড়িতেই থাকবে ,এই বাড়িতেই কাজ করবে আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই । গেরেজের পাশের দুইটা রুম তাকে দেওয়া হয়েছে। ব্যাস রেনুর আর কি চাই। সে দিব্যি রাজি হয়ে গেছে। তাইতো সে প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কোনো কথা বলতে দেরী আর করতে দেরি।

রেনু এক দৌড়ে দরজা খুলে দোতলায় ছুট লাগায়। বিনা ব্রেকে ধপাস করে সাজির খাটের উপর প*ড়*লো। আচমকা বিছানা কেঁপে উঠায় চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে সাজিঁ।

বিছানায় রেনুকে পড়ে থাকতে দেখে হা হুতাশ করে উঠলো সাজিঁ। রেনু বেদনাদায়ক হাসি দিয়ে উঠে বসলো।

,,রেনুদি তুমি এইখানে এইভাবে পড়লে কেন? কতোটা ভয় পেয়েছি জানো? ভেবেছিলাম ভূমিকম্প এসেছে। বিয়েশাদী করার আগেই ম*রে যাবো ভেবেই কলিজা কেঁ*পে উঠেছিলো। আজ থেকে পায়ে ব্রেক লাগাবে। বুঝেছো!!

রেনু দাঁত দুই পাটি বের করে বললো,, ঠিক আছে সাজি আফা আমি চেষ্টা করবো। আপাতত উঠে পড়েন সাতটা বেজে গেছে।

সাজি কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে উঠে পড়লো। ওয়াশ রুমে যেতে যেতে গলা উঁচিয়ে বলে গেলো,, এর পর থেকে “আপনি” করে ডাকলে দুই তলা থেকে ধা*ক্কা মে*রে ফে*লে দিবো।

রেনু বিনা বাক্যে আবার ছুট লাগালো। তাকে কিছু বলা আর দেয়ালে মাথা ঠু*কে ঠু*কে ম*রে যাওয়া একই কথা।

ফ্রেশ হয়ে মোবাইল নিয়ে বসেছে সাজি। একে একে সবার সাথে কথা বলে দোয়া নিচ্ছে। তার ঠিক সামনে বসে যত্ন করে মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে সেঁজুতি। চোখের পলকে যেন বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। মনে হচ্ছে এইতো সেদিন জুবায়ের সহ স্কুলে ভর্তি করেছিল সাজিকে। দেখতে দেখতে কতটা বছর কেটে গেল। মেয়েটাও বড় হয়ে গেছে আর এখন এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। ভাবতেই অবাক লাগে।

দরজার সামনে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদ। সাজিকে গভীর ভাবে পরখ করে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। কোটের বোতাম খুলে সামনে এগিয়ে গেলো। রেনু সাদকে দেখেই কেটে পড়লো। এতো দিনে সাজির কাছে যা শুনেছে তাতে বুঝা যায় লোকটা সুবিধার না। নিশ্চয়ই খু*ন খা*রা*বি করতে হাত কাঁপবে না। তাই কে*টে পড়াই শ্রেয়।

সেঁজুতি সাদকে দেখেই খুশিতে গদগদ। রেনুকে ডেকে নাস্তা দিতে বললো। কিন্তু রেনু ফ্রীজের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাবে না মানে যাবে না।
অগ্যতা সেঁজুতি রান্না ঘরে যেতে হলো।

সাজি টেনে টুনে জামা ঠিক করে সোজা হয়ে বসলো। সাদ হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিরেট স্বরে বলল,, পরীক্ষার ঠিক আদ ঘন্টা আগে কেন্দে থাকতে হবে সাজি। রুমে যা, গিয়ে তৈরি হয়ে আয়। আস্তেধীরে তৈরি হবি,সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে তারপর নিচে নেমে আসবি। কোনো কিছু যেন না ছুটে।

সাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো সাজি। মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে তৈরি হতে চলে গেলো। রেগে ধমকে কথা বললেও সাদ ভাই নামের মানুষটা কখনো তার খারাপ চায় না। তাইতো তার কথার পিঠে কথা বলার সুযোগ হয়নি এই এক বছর।

সাজি চলে যেতেই সাদ কল দিয়ে সাজির রোল অনুযায়ী কোন হলে পড়েছে সেটা জেনে নিলো। ভাগ্যিস পিয়নের নাম্বারটা ছিল। নয়তো অনেক কষ্ট পোহাতে হতো।

নাস্তা শেষে সাজিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সাদ। প্রায় বিশ মিনিট পর কলেজের সামনে এসে পৌঁছলো। গাড়ি সাইডে পার্ক করে সাজির দিকে ঘুরে বসলো।

নিচের দিকে তাকিয়ে অনবরত হাত মোচড়াচ্ছে সাজিঁ। ভীষণ নার্ভাস লাগছে তার। পরীক্ষা মানেই ভ’য়ং’ক’র ব্যাপার। যা পড়ে এসেছে তার সব কিছু তালগোল পাকাতে লাগলো।

সাদ কয়েক সেকেন্ড সাজির দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে আলতো হাতে সাজির হাত ধরলো সাদ। সাদের হাতের স্পর্শে একরাশ ভয়,সংসয় নিয়ে চোখ তুলে তাকলো সাজি।
সাদ মুচকি হেসে বলল,, ভয় পাচ্ছিস?

ইনশাআল্লাহ চলবে,,,,