দুই দুয়ারী পর্ব-০৪

0
107

#দুই দুয়ারী

পর্ব ৪

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে, গাছের উপরে পাখিদের চিৎকারে আমার কানে তালা লাগার অবস্থা হয়। তবু আমি হাত সরাইনা গাছ থেকে, আমি বসিও না। দাঁড়িয়ে থাকি, অনড়, এক জায়গায়। ক্ষুধা আর তৃষ্ণা আমাকে কাবু করে ফেলছে আস্তে আস্তে, তবু আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্ধকার নামা দেখতে থাকি। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে রাখি, আবার চোখ খুলে পর্যবেক্ষন করি। তারপর আবার।

তখনও সূর্য পুরোপুরি ডুবেনি, আকাশের এক কোন লাল হয়ে আছে, আমি দেখলাম তিনজন মানুষ হেঁটে আসছে। ইমাম সাহেব, মিলি, জালাল। আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা, মুখ ফিরিয়ে থাকি।

মিলির সব ধ্যান জ্ঞান রান্না আর খাওয়ায়, সে সরাসরি কাজের কথায় চলে গেল, ” ভাত আনছি। ভাত খান ”

কার উপর অভিমান, আমি জানিনা, বললাম, ” খাবোনা, যাও তুমি ”

ইমাম সাহেব একটু যেন অবাক হলেন, অবোধ্য একটা দৃষ্টি খেলা করে গেল তার চোখে, তারপর যেন নিজেকে সামলে বললেন, ” জোয়ান একটা মানুষ, বাচ্চা তো না যে হারায় গিয়া কানবা। পরিষ্কার কইরে বলো ও না কি খুজ। আর ধরো না পাইলা, ঢাকায় যাও গা। সেখানে তো নিজের বাড়ি চিনবা নাকি? ”

আমি বললাম না, ঢাকায় যেয়ে লাভ নেই, আমার বাবা খুব সম্ভবত জন্মই নেননি এখনো, সুতরাং ওই শহরে আমার কেউ নেই। বরং এই ভালো, আমার দাদা, দাদার ও বাবা…. ভাবতে ভাবতে ফিকফিক করে হাসতে লাগলাম। কি সব অবাস্তব কথাই না মাথায় আসছে!

মিলি তাকিয়েছিল এক দৃষ্টিতে, বললো, ” আর এখানে আইসেই বা দাঁড়ায় আসেন কেন? কি ঘটনা? ”

ঘটনা বলার প্রশ্নই উঠেনা, আমি বসে পরে নোংরা হাতে খেতে শুরু করলাম। আঃ। অমৃত। অথচ রেধেছে শুধু লাউ। সাথে দুটা কাঁচা মরিচ এনেছে মনে করে। খাওয়া শেষ করার আগেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো।

” চলো আমার সাথে? ” ইমাম সাহেব প্রশ্ন করার মত বললেন। আমি গেলাম না। আমাকে মশার কামড় থেকে শুরু করে পাগল কুকুর পর্যন্ত ভয় দেখিয়ে তারা বিদায় নিলো।

যাবার সময় মিলি বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। মেয়েটার মনে অনেক মায়া। আমি চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম তার চোখের কোনায় পানি চিকচিক করছে।

রাতটা এভাবেই কেটে গেলো, ক্ষনে ক্ষণে শেয়ালের ডাক শুনে চকিত হলাম বারবার। বসে পরেছি অনেক আগেই, কিন্তু শক্ত মাটি, আরাম হয়নি কোন। হয়তো সকালের দিকে ঘুমিয়ে গিয়ে থাকবো, ঘুম ভাঙলো অচেনা কণ্ঠের ডাকে।

” আপনি কে? ” লোকটা বললো, ” এইখানে এইভাবে বসে কি করেন? ”

আমি চুপ করে রইলাম, ঘুম ভাঙতেই আবার গাছের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে গেছি, চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করা শুরু করেছি।

চুক চুক করে জিভ দিয়ে শব্দ করলেন ভদ্রলোক, ” আহারে। এতো কম বয়স। না জানি কি দুঃখে পাগল হইসে ”

দুপুরের দিকে দলবল নিয়ে এলো নজরুল ( নাকি দাদা বলবো? আমার চেয়ে সামান্যই বড় হবে বয়সে, কি করে দাদা বলি?)। আমার দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসলো সে, ” এই মিয়া। কি ভঙ ধরছেন? গাছের নিচে কি? ”

তার সংগীদের একজন পা দিয়ে খোঁচাল আমাকে, ” উঠেন। এখানে এইভাবে বইসে থাকা নিষেধ। উঠেন ”

নানা ভাবে আমাকে বিরক্ত করে তারা বিদায় নিলো। আমার দাদার চরিত্রের এই দিকটি সম্পর্কে আমার ধারণা ছিলোনা, ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসেবে জেনে এসেছি। আমি কারো সহানুভুতি চাইনি, কিন্তু নিষ্ঠুরতাও আশা করিনি।

আগেই বলেছি আমার মধ্যে গুন বলে তেমন কিছুই নেই। বাবার টাকা উড়িয়ে মায়ের আঁচলের নিচে বড় হওয়া মানুষ আমি। এখানে আমার খুব একা লাগছে, আর সেটা বোঝার মত কেউ নেই। রাতে আমার শীত ও লেগেছে অনেক, সে কারণে জ্বর ও এসেছে বোধহয়।

বিকেলে অবশ্য চেয়ারম্যান সাহেব নিজে এলেন এবং আমার সব প্রতিবাদের মুখে জোর করে আমাকে সাথে নিয়ে চললেন। আমি আরও ঝামেলা করতে পারতাম কিন্তু মানুষটা যখন আমার নোংরা ধুলোমাখা শরীরটা জড়িয়ে ধরে রীতিমতো কেঁদেই ফেললেন, আমি হাল ছেড়ে দিলাম। এখন এনারাই আমার আপন, আমার আর কোন গতি নেই।

***

আমার বিছানার উপর, ঠিক আমার পাশে বসে, আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এক কিশোর। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসতেই সেও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

” আমি কোথায়? ” বলেই এতো হাসি পেলো, পুরোপুরি সিনেমার ডায়লগ বলে ফেলেছি অজান্তে, আমি ফ্যা ফ্যা করে একটু হাসলাম ও।

” আমাদের বাড়িতে ” ছেলেটা বলল, চোদ্দ পনের বছর বয়স, আমার ছোট ভাই বলে যে কেউ ভুল করবে দেখলে। জানিনা এই ব্যাপারটা কিভাবে এদের চোখ এড়িয়ে আছে, হয়তো মাথাতেই নেই, তাই।

” তুমি নজরুল ভাইয়ের ছোট ভাই, তাই না? ” দাদা নানাকে অনেকেই ভাই বলে, বিশেষ করে দাদি নানীকে আপা বলার চল তো বেশ পুরোনো, সুতরাং আমি নজরুল ভাই বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

” হ্যাঁ ” ছেলেটা হাসল, আর আমার বুকের ভেতর টনটন করে উঠল। এর কথা শুনেছি আমি, বাঁচেনি বেশিদিন, কে জানে কি হয়েছিল! কোথায় থেকে বাচ্চা একটা দৌড়ে ঘরে ঢুকেছে তখন, দুরন্ত সেই বাচ্চা, এসেই বিছানার উপর উঠেছে, লাফাচ্ছে তারপর। দুই একবার লাফিয়েই তার আগ্রহ শেষ, এবার আমার গায়ের কাঁথা ধরে টানছে।

” আমার বড় ভাইয়ের ছেলে ” ছেলেটা বলল, ” লুৎফর ওর নাম। একটু দুষ্ট আছে ”

আমি খুশিতেই হেসে ফেললাম, হায়রে বড় চাচা। ছোট বেলায় এর ভয়ে একবার প্যান্টে প্রাকৃতিক কাজ করে দিয়েছিলাম। এবার বাগে পেয়েছি, আচ্ছা করে একটু বকে দিব নাকি?

” আপনার জন্য পায়জামা আর একটা জামা পাঠাইসে আব্বা, এগুলা আমার বড় ভাইয়ের। ধোয়া আছে।”

” গোসল করতাম ” লজ্জা কাটিয়ে বলি, ” বাসায় বড় কেউ নাই? ”

” আম্মা আসে ” সে হাসল আবার, ” আর ভাবি। ডাক দিবো? ”

ভাবি মানে আমার দাদি, আমাকে খুব ভালোবাসে, মা বলে আদরে আদরে আমার মাথা খেয়ে থাকেন উনি। উনার সাথে দেখা করতে ভালো লাগবে আমার। বললাম, ” ভাবীকে ডাকবে একবার? ”

” উনি সামনে যায়না কারো, তার উপর এখন ” হাত দিয়ে উঁচু পেট ইঙ্গিত করলো, ” আরো যায়না ”

আমার গা শিরশির করে উঠল, বাচ্চা হবে এমন কথাই কি বুঝাতে চাইছে ও? শিশুটা যদি আমার বড় চাচা হন, তাহলে অনাগত সন্তানটি…. আমার বাবা। ঘটনার অস্বাভাবিকতায় আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম।

নজরুল ভাইয়ের পোশাক পরে, অল্প কিছু খেয়ে আমি আবার বের হব, এই বাড়ি থেকে স্কুলটা একটু দূরেই। বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, চেয়ারম্যান সাহেবের দেখা পেলাম। এই লোক বোধহয় দুই একজন লোক সঙ্গে না নিয়ে থাকতে পারেন না, সবসময় আগে পিছে কেউ না কেউ থাকে। তিনি তাদেরকে পিছে ফেলে প্রায় ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

” তোমাকে কালকে দেইখে এতো মন খারাপ হইসিলো, আহারে বাচ্চা ছেলেটা কেমনে বুড়া মানুষের মত গাছের নিচে বইসা ছিলা। তোমার কি লাগবে বলো? ঢাকার বাসে উঠায় দিবো? ”

” আমি ” কষ্টে চোখের পানি আটকালাম, ” আমি ঢাকায় যাবোনা। কয়েকদিন থাকতে হতে পারে গ্রামে। কিন্তু আসলে আমার থাকার জায়গা নেই ” বলে ফেললাম।

” হায় হায় বলে কি ছেলে? কয়েকদিন এইখানে থাক। কয়েকদিন কেন অনেকদিন থাকো। ” উনি অনায়াসে বলে ফেললেন, জানতেও চাইলেন না আমার সমস্যা কোথায়।

কিন্তু সঙ্গী দুজনের মুখ কঠিন, একজন কোন রকম লুকানোর কোন চেষ্টা না করেই বললো, ” সেটা কি ঠিক হবে? চিনেন না জানেন না, আপনার কত শত্রু…

” হাহাহা ” উনি মুখ খুলে হাসতে গিয়ে পানের পিক একটু গড়িয়ে পরলো থুতনি বেয়ে, ” আমার শত্রু? কে আমার শত্রু? যুদ্ধের সময় নিজের বুকটা পাইতা দিয়া এই তল্লাটের মানুষগুলিরে নিরাপদে রাখসি ” তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ” বুঝছ বাবা? তোমার কোন চিন্তা নাই। যতদিন লাগে থাকো। এইখানে সবাই তোমার এই চাচারে খুব ভালোবাসে। কেউ কিছু বললে বলবা আমার মেহমান, কোন সমস্যা হবেনা ”

আমি ওনাকে বলে একটা গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করলাম, বটগাছটার কাছে যাওয়া আমার খুব প্রয়োজন।

***

কিন্তু সেদিন ও কাজ হলোনা। তার পরের দিন ও না। এমনকি তার পরের দিন ও না। সাতদিন পরে আমি প্রচন্ড হতাশ হয়ে গেলাম, মনে হলো, আমি বোধহয় সত্যিই আটকে গেছি এই সময়ে। আমার নিজস্ব পরিকল্পনা করা জীবন হয়তো আর ফিরে পাওয়া হবেনা।

সেইরাতে চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় আর ফেরত গেলাম না। নিজের অজান্তেই কখন মিলিদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, জানিনা।

অন্ধকার রাত, চাঁদের আলো খুব সামান্যই। কিছুদিন আগেও সোডিয়াম লাইটের আলোয় উদ্ভাসিত ঢাকা শহরেও রাতে ভয় পেতাম, আজ বিদ্যুৎহীন গ্রামের মেঠোপথে একলা হেঁটে বেড়াচ্ছি।

কি অদ্ভূত মিলি বাইরেই ছিল। তার বাড়ি থেকে একটু দূরে, পুকুরর পারে সে বসে আছে। পানিতে প্রতিফলনের জন্য জোছনা এখানে উজ্জ্বল, সেই আলোয় ওকে দেখে আমি আবার বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। আসলেই স্বপ্ন না সত্যি?

” আপনি ” ও হাসল, যেন আমাকে সে বললো, এটা আপনি, যেন আমি জানতাম না।

আগেও একবার এই প্রশ্ন করেছি, আবার করলাম, ” তোমার ভয় করেনা? ”

” নাহ। আমাকে কেউ কিছু বলেনা। বসেন না!”

আমি বসলাম, একটু দূরে, হেসে বললাম, ” আজকে কি রান্না করলে নতুন? ”

” আজকে করিনাই। আজকে আমার মন খারাপ। আপনার কথা বলেন। ওই গাছের গোড়ায় কি খুঁজেন বলেন তো!”

আমার খুব ইচ্ছে করে বলতে, কিন্তু পারিনা। গ্রামের সাধারণ কম বয়সী একটা মেয়ে, ও হয়তো বুঝতে পারবে না। নাহলে ইংরেজি সিনেমার মত করে ওর কাছে ব্যাখ্যা করতাম।

” এই যে একটা কাগজ, এর এক পিঠ থেকে আরেক পিঠ পর্যন্ত যেতে হলে কি করতে হবে বলো তো? কলমটাকে ধরে রেখে এক পিঠ থেকে শুরু করে আরেক পিঠ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু যদি কাগজটায় ফুটো করে ফেলি? তাহলে এক পিঠ থেকে আরেক পিঠে এমনি এমনি পৌঁছে যাবে….

” কিছু বললেন? ”

” হ্যাঁ। ওই বট গাছের গোড়ায় সেদিন একটা ফুটো ছিল। আমি অন্য পিঠে পৌঁছে গেছি। কিন্তু ওটা বন্ধ হয়ে গেছে এখন…

মিলি খিলখিল করে হাসছে, ” কি বলেন একা একা? আসলেই পাগল আপনি। রাতে ঘুমাবেন কই ঠিক করসেন? ”

আমি রাগ করে বললাম, ” এখানেই। কেন? তাড়িয়ে দিবা? ”

ও উঠে দাঁড়ালো, ” ইমাম সাহেবের বাসায় ঘুমান। ওই যে, উনি দাঁড়ায় আছে। যান, ওনার সাথে যান ”

আমি অবাক হয়ে গেলাম, এই গ্রামের মানুষ কি রাতে ঘুমায় না? লোকটা এত রাতে এখানে কি করছে?

” রাত বিরাতে পুকুর পারে বইসে থাকে ” উনি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ” পাগলী পুরা। কোন ভয়ডর নাই। আমি যেদিন পারি, পাহারা দেই….

হঠাৎ আমি থমকে গেলাম, ওনার কণ্ঠের একটা বিশেষ শ্রেণীর মায়া আমার কানকে ফাঁকি দিতে পারলোনা। কেন জানিনা প্রচন্ড রাগে আমার হাত পা কাঁপতে লাগলো। বয়স্ক একটা লোক, কত বড় সাহস…

আচ্ছা আমার কি? আমিতো এখানকার কেউ নই! আমাকে ফিরতে হবে। এখানে আমি থাকতে চাইনা। চাইনা।

চলবে