দুই পৃথিবী পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
4675

#দুই_পৃথিবী
#লেখিকা-নাইমা জাহান রিতু
#পর্ব-১০(শেষ পর্ব)
-এই নাও।
স্নেহা ঘুরে তাকিয়ে চা এর কাপ টা নিল আফসানের কাছ থেকে।এক বার চুমুক দিয়ে বললো
-ধন্যবাদ আপনাকে।তা এত রাতে চা টা কে করে দিল?
-আমি নিজেই করে নিয়ে এসেছি।
-উম্ম।ভালোই হয়েছে।
অন্ধকার রাত।চারিদিকে গভীর নিরবতা।মাঝে মাঝে ঝি ঝি শব্দ শোনা যাচ্ছে।আর কানে আসছে দু টো মানুষের দীর্ঘ নিশ্বাস এর শব্দ।আফসান কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে স্নেহার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে থাকলো।তারপর একসময় বললো
-তুমি আজ সন্ধ্যায় আমাকে কি বলেছো তোমার মনে আছে?
-আছে।
-এর জন্য কি তুমি অনুতপ্ত?
-না।
-অহ।
স্নেহা চা টা শেষ করে কাপ টা নিচে রাখলো।তারপর আফসানের দিকে এগিয়ে এসে বললো
-তুমি কি চাচ্ছো আমি এখন তোমার কাছে এখন মাফ চাই?
আফসান হালকা ঘাড় নড়ালো।যার মানে হ্যা বা না দুটোই হতে পারে।স্নেহা আফসানের শরীরের সাথে নিজের শরীর লাগিয়ে বুকে মাথা রেখে বললো
-তুমি যেটা করেছো সেটা ঠিক করো নি।আবার আমিও যেটা করেছি ঠিক করেনি।তাই না?
আফসানের জবাব না পেয়ে স্নেহা আবার বললো
-এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?হাত টা দিয়ে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরো তো।
আফসান কিছু না বলেই হাত দুটো স্নেহার কোমরে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্নেহাকে।তাদের দুজনের মাঝে এখন আর কোনো ফাক নেই।যেন একটু ফাক থাকলেই কেউ এসে ঢুকে পড়বে তাদের মাঝে।সেই কেউ টা কি মুহিব?হয়তো।কিন্তু না চাইলেও মুহিব এখন তাদের মাঝে ঢুকে পড়েছে।আর এই ভূল টা করেছে স্নেহা নিজে।কেন করলো স্নেহা এমন?
রাত ৩ টা।ছাদে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ।যারা একজন অপরজন কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।কেউ এত রাতে তাদের এই অবস্থায় দেখলে কি হবে এটা তাদের দুজনের কারো মাথা তেই নেই।অবশ্য সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির পর সবাই এখন যে যার ঘরে গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।ছাদে আসার সম্ভবনা এখন কারো নেই।আফসান এক হাত স্নেহার মাথায় রেখে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো
-চুল ভেজা কেন?
স্নেহা আফসানের বুকে এখনো মুখ গুজে আছে।আফসানের কথা শুনে মুখ হালকা করে উঠিয়ে বললো
-এসেই গোছল দিয়েছিলাম।
-তোমার এই চুলের প্রেমে আগে পড়েছিলাম।সেটা তুমি জানো?
-হুম।
আফসান স্নেহা খোলা চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে বললো
-চলো না,নতুন করে জীবন টা শুরু করি।এখনো সময় আছে।তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয় আমার।
-সন্ধ্যায় না বললে কষ্ট হয় না।
-এটা বলি নি কিন্তু।
-এই ৩ দিন কিভাবে কাটিয়েছ তাহলে?
আফসান মুখ টা উঠিয়ে হাসতে হাসতে বললো
-সিগারেট।সারা রাত তোমাকে স্মরণ করেছি,,আর টেনেছি।এই ৩ দিনেই ২০ টার মতো প্যাকেট শেষ করে ফেলেছি।দেখতে চাও?
-না।
আফসান আবারো স্নেহার চুলে মুখ গুজে বললো
-এখন কি করবে তুমি?এভাবে হয় না স্নেহা।প্লিজ চলো আমরা নতুন ভাবে জীবন শুরু করি।মাত্র ৩ দিনই তোমাকে ছাড়া যে হাল!
-কই?এখনো তো ঠিকই আছো।
-প্লিজ সিরিয়াস হও।তোমার মধ্যে সিরিয়াসের স ও খুঁজলে পাওয়া যাবে না।
-হয়তো।
আফসান স্নেহার মুখ টা দু হাত দিয়ে উঠিয়ে বললো
-অবশ্য আমার পিচ্চি বউ ও চলবে।
স্নেহা হালকা হেসে বললো
-আচ্ছা,আমি একটা প্রশ্ন করি?
-করো
-৪ মাসের মাঝে কি সত্যিই ভালোবাসা প্রেম এগুলো হয়?
আফসান ভ্রু কুঁচকে বললো
-হবে না কেন?ভালোবাসার মত ভালোবাসতে ৪ মাসও বেশি।অনেকের প্রথম দেখাতেই ভালোবাসা হয়ে যায়।আবার অনেকে সারাজীবন লাগিয়েও ভালোবাসতে পারে না।সেখানে আমরা ৪ মাস একে অন্যকে সময় দিয়েছি,জেনেছি।স্নেহা,তোমার কি মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ভালোবাসো না?
-না।আমি বাসি।আমি আসোলেই অনেক বেশি ভালোভাসি তোমায়।আর থাকতেও চাই তোমার সাথে।
আফসান স্নেহাকে টেনে আবার নিজের বুকে নিয়ে বললো
-জানি আমি।জানো আমার যখন ২৫ বছর বয়স,তখন মা আমাকে ফোন দিয়ে আসতে বলে এখানে।তখন আমার পরীক্ষা চলছিল।আর একটা বাকি ছিল।পরীক্ষা টা দিয়েই বিকেলে রওনা হয়ে এখানে আসি।আর সেই রাতেই আমার বিয়ে হয়ে যায় রিতার সাথে।আমার খালাত বোন ছিল রিতা।কি কারণে আমাকে সেই রাতে বিয়ে দিয়েছিল সেটা একবারো মার কাছ থেকে জানতে চাই নি।জানতে চাইলে হয়তো মা বলতো।কিন্তু ইচ্ছা করে নি।মা কে আমরা ভাই বোনেরা সবাই অনেক মানি।সে যদি আমাদের এসে বলে কাল থেকে আর দিন হবে না,সূর্য উঠবেনা আমি সেটাই বিশ্বাস করবো।তার কথার অমত করতে পারবোও না।তো যাই হোক মেনে নিলাম রিতা কে।মা বললো একটা ইয়ার গ্যাপ দিতে।এখানে থেকে যেতে।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও মায়ের কথায় থেকে গেলাম।তার মাঝেই রিতা প্রেগন্যান্ট হলো।আমরা ভালো ছিলাম।ভালোবাসা ছিল কিনা বলতে পারবো না কিন্তু কেয়ার ছিল একে অপরের প্রতি।রিতার যেদিন ডেলিভারি হলো সেদিন আমি ঠিক কতো টা ভয়ে ছিলাম সেটা বলতে পারবো না।আমাদের ১ বছরের সংসার জীবনের সমাপ্তি ও ঘটলো সেদিনই।আমার হাতে দুটো ফুটফুটে শিশু তুলে দিয়ে ডাক্তার বললো উই আর সরি।বিশ্বাস করো সেদিন কেঁদেছিলাম আমি একটি পিচ্চি বাচ্চার মতো।রিতা মারা যাওয়ার ৭ দিন পরেই আমি ঢাকায় চলে আসি।মা ও তখনো আমাকে আর কিছু বলে নি। এখানে রাফি রুনকিকে দেখতে আসতাম না খুব বেশি। তারপর শুরু হলো আমার নতুন জীবন।নতুন ভাবে সব শুরু করলাম।আমি যদি সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে পারি তুমি কেন তাহলে পারবা না স্নেহা?জীবন থেকে একজন চলে গেলে আরেকজন আসে এটা ঠিক।কারণ জীবন সময়ের মতো চলে।কেউ কারো জন্য বসে থাকে না।কিন্তু কোথাও একটা ফাকা স্থান থেকে যায় তার জন্য।এখনো কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের বাম দিকটায় চিনচিনে ব্যাথা হয়।রিতা কে মনে পড়ে আমার।
-হুম।
-আমি বলছিনা যে তুমি আমার সাথে থেকেই নতুন জীবন শুরু করো।মুহিবের সাথে থেকেও শুরু করতে পারো।সেক্ষেত্রে তখন আমার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।কারণ নতুন জীবন শুরুর পর পিছুটান রাখতে হয় না।
স্নেহা কিছুক্ষণ নিরব থেকে এক সময় বললো
-আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।রাফি,রুনকির মা হতে চাই।তোমার জীবনটা গুছিয়ে দিতে চাই।থাকতে দেবে আমায়?
আফসান হালকা হেসে জবাব দিল
-তার মানে তুমি শাবানা হতে রাজি?
-হ্যা রাজি।
-আমার মনে হচ্ছে তুমি সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছো,স্নেহা।এত হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু নেই।তুমি সময় নাও।আমি অপেক্ষা করবো।
-আমি যা বলার বলে দিয়েছি,আফসান।
-কাল সকালে আবার তোমার এই সিদ্ধান্ত চেঞ্জ হবে না তো?
স্নেহা আফসানকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো
-না হবে না।
আফসান চিন্তিত ভঙ্গিতে স্নেহাকে বললো
-তাহলে আমার মুহিবের সাথে কথা বলা উচিৎ।জানি না বেচারা কেমন রিয়াক্ট করবে!
স্নেহা কথা ঘুড়িয়ে বললো
-আচ্ছা তোমার বুকে এত শান্তি কেন?
আফসান দুষ্ট একটা হাসি দিয়ে বললো
-আরে আমার বুকে শান্তি আসবে কিভাবে?আমার বুকে তো আছে শুধুই স্নেহা।

সকালটা শুরু হয়েছে স্নেহার আজ চেঁচামেচির আওয়াজ দিয়ে।বিয়ে বাড়ির হাজার কাজ।আর সেই কাজগুলো নিরবে হবে এটা ভাবা অনর্থক।মুহিব এখনো ঘুমাচ্ছেই।স্নেহা গায়ে শাড়ির আচল টা ভালোভাবে নিয়ে দরজাখুলে বাইরে বেড়িয়ে এল।দোতালার মাঝের একটা ঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল।স্নেহা সরাসরি ছাদে উঠে প্রাণখুলে নিশ্বাস নিল কিছুক্ষন।তার আজ এতোটা ভাল লাগছে কেন?এত টা শান্তি পাচ্ছে কেন আজ সে?

উঠোনে আশার সাথে রাফি আর রুনকি বসে আছে।আশাকে রাগিয়ে দেওয়াই এখন তাদের আজকের দিনের প্রথম লক্ষ।কিন্তু মোটেও আজ সে রাগছে না।তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাফি আর রুনকি।
-ছোটফুপু,ও ছোটফুপু?
-বল
-কি করো তুমি?
-দেখছিস না?ফেসবুকিং করছি।
রাফি আর রুনকি দুজনেই দুষ্ট হাসি দিয়ে আশার মতো করে বললো
“দেখছিস না?ফেসবুকিং করছি।”
আশা কঠিন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আবার ফোন টেপায় মনোযোগ দিল।
– ছোটফুপু,ও ছোটফুপু?
আশা ফোন থেকে চোখ না উঠিয়েই বললো
-হু
-কথা বলো না একটু আমাদের সাথে।
-কি বলবো?যা তো আমার সামনে থেকে।
আবারো রাফি আর রুনকি বলে উঠলো
” কি বলবো?যা তো আমার সামনে থেকে।”
বলেই খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়লো একজন আরেকজনের গায়ের উপর।ঠিক ঐ সময়ই স্নেহা উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে বললো
-কি ব্যাপার?কি করা হচ্ছে?
রাফি আর রুনকি দুজনেই একবার স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলো
” কি ব্যাপার?কি করা হচ্ছে?”
স্নেহা ভ্রু কুচকে বললো
-ওরে বদের দল রে!
আবারো স্নেহার কথা নকল করে রাফি আর রুনকি বললো
“ওরে বদের দল রে”
এভাবেই কিছুক্ষন স্নেহার সাথে নকল নকল খেলার পর স্নেহা বললো
-অনেক হয়েছে।এবার স্টপ।আর এবার যদি তোমরা আমার কথার অনুকরণ করো তাহলে আমার কাছে যে চকলেটস গুলো আছে ওগুলো কেউ পাবে না।
চকলেট এর কথা শুনতেই দুজন নিরব হয়ে গেল।স্নেহা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো
“বাহ মা হওয়ার আগেই ম্যানেজ করার পদ্ধতি শিখে ফেলেছি।কনগ্রাচুলেশন মিস শাবানা।”
বাচ্চা দুটো কে কেন যেন খুব বেশি ভাল লাগে স্নেহার।দুষ্ট বটে কিন্তু অনেক মিশুক।এক অজানা বন্ধনে তারা জুড়ে গেছে।কেমন যেন একটা আকর্ষন কাজ করে ওদের প্রতি স্নেহার।তাছাড়া স্নেহার মতে বাচ্চা রা হবে মিশুক।সবার সাথে মিশবে,কথা বলবে,হই হুল্লোড় করবে এমন বাচ্চাই তো আসল বাচ্চা।বাড়ি ঘর মাথায় তুলে রাখবে।বাইরের কেউ আসলে এক নজরেই তারা বুঝবে এ বাড়িতে ছোট বাচ্চাকাচ্চা আছে।আর যারা গোমরা মুখ করে থাকে,মা ছাড়া কিছু বোঝে না,সারাদিন ম্যা ম্যা করে,কারো সাথে মেশে না তারা আর যাই হোক বাচ্চা না।আর রাফি আর রুনকি একদম স্নেহার মনের মতোই।আফসান,রাফি আর রুনকিকে নিয়ে তার সংসার টা খারাপ হবে না।একদম জমে উঠবে।ভেবেই তার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।এমন একটা পরিবারই তো সবাই চাই।ঢাকার বাইরে আসার পর থেকে এত সব লোকের মাঝে থাকার পর থেকে তার মাঝে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে।এখন কেন যেন বাকি দশটা মেয়ের মত সে না এটা ভাবতে ইচ্ছা করে না।পরিবেশের কারণেই কি এই পরিবর্তন টা হলো তার মাঝে?যদি এটাই কারণ হয়ে থাকে তাহলে এটা শুধু সম্ভব হয়েছে মুহিবের কারণে।মুহিবের কথা মনে হতেই স্নেহার আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠা মুখ নিমেষেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

মুহিব ঘরেই ছিল।বিছানায় বসে চা খাচ্ছিল।স্নেহাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মুহিব বললো
-কোথায় ছিলে?ঘুম থেকে উঠার পর দেখতে পেলাম না।
স্নেহা হালকা হেসে মুহিবের পাশে বসতে বসতে বললো
-নিচে ছিলাম।তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।
-বলো
-মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে আমাকে এইখানে আনার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
মুহিব ভ্রু কুঁচকে বললো
-এটাই তোমার জরুরি কথা?
স্নেহার মাঝে এখন ভীষণ অস্বস্তি কাজ করছে।কাল রাতে তো অনেক সহজেই আফসান কে বলে দিল সে আফসানের সাথে থাকতে চায়।কিন্তু ব্যাপারটা এত্ত সহজ না।মুহিবকে কিভাবে কি বলবে সে!তার একটা ভূলের জন্যই আজ এই পরিস্থিতি।
-কি হয়েছে স্নেহা?
স্নেহা চোখ টা বন্ধ করে কাপা কাপা স্বরে বললো
-আমি আফসানকে ভালোবাসি।
মুহিব স্নেহার কথা এখনো কিছু বুঝতে পারছে না।অবাক দৃষ্টিতে স্নেহার দিকে তাকিয়ে মুহিব বললো
-মানে?
-আমি আফসান কে ভালোবাসি,মুহিব।
-কোন আফসান?
-অনুর ভাসুর।
কথাটা শুনেই কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো মুহিব।স্নেহা ও আর কিছু বললো না।মুহিব কে পুরো ব্যাপার টা ধাতস্থ করতে কিছু সময় দেওয়া উচিৎ।এক সময় মুহিব উঠে দাঁড়িয়ে বললো
-কবে থেকে?
স্নেহা নিচের দিকে তাকিয়ে পিঁপড়া দেখছিল।কিছু পিঁপড়া মিলে একটি বড় পিঁপড়া কে কাধে করে নিয়ে যাচ্ছিল।সেইটাই লক্ষ করছিল বসে বসে স্নেহা।হঠাৎ মুহিবের আওয়াজ শুনে কিছুটা চমকে গেল স্নেহা।তারপর থেমে থেমে বললো
-তোমাকে কিছুদিন আগে আমার একটা প্রোট্রেট দেখিয়েছিলাম।ওই প্রোট্রেট টার আর্টিস্ট ছিল আফসান আবির।অনুর ভাসুর সে।তখন থেকেই আমাদের পরিচয়।
-আমাকে তাহলে বিয়েটা করলে কেন স্নেহা?
স্নেহা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবারো নিচে তাকিয়ে পিঁপড়া দের কার্যক্রম দেখতে শুরু করলো।মুহিব কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করলো।প্রথমে সে স্নেহার কথা বিশ্বাস করে নি।কারণ স্নেহার স্বভাবটা অন্যরকম।বানিয়ে বানিয়েও মাঝেমাঝে কথা বলে।কিন্তু পরে যখন আফসান ভাইয়ের কথা বললো তখন বিশ্বাস না করার কিছু নেই।আফসান ভাই তো জগন্যাথ ভার্সিটির চারুকলার অধ্যাপক।কিন্তু এখন স্নেহা এগুলো কেন বলছে?সে কি আফসান ভাইয়ের সাথে থাকতে চায়?যদি চায় তাহলে মুহিবের কি হবে!মুহিব তো সেই ছোট্ট বেলা থেকে স্নেহাকে ভালোবেসে এসেছে।ভালোবাসা মানে স্নেহাকেই বুঝেছে।কোনোদিন অন্য কোনো মেয়ের দিক চোখ তুলে তাকায়ও নি। মুহিব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অসহায় গলায় স্নেহা কে বললো
-এখন কি করতে চাও তুমি?
মুহিবের অসহায় মাখা গলার স্বর শুনে স্নেহার বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো।সে কি জবাব দিবে মুহিবকে?স্নেহা মুহিবের দিকে তাকালো।মুহিবের চোখ ছলছল করছে।মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তেই পানির বন্যা বয়ে যাবে।স্নেহা আবার নিচের পিঁপড়া গুলোর দিকে তাকিয়ে বললো
-আমি ঠিক করেছিলাম তোমার সাথেই থাকবো।এর জন্য এই ৪ দিনে নিজেকে যতটুকু পারি স্বাভাবিক থেকে সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ও করেছিলাম।কিন্তু..
স্নেহার কথার মাঝেই মুহিব বললো
-কিন্তু ৪ দিনেই তুমি হাপিয়ে উঠেছো।আমাকে আর সহ্য হচ্ছে না এই তো?আসলে আমি একটা বোকা।আর এমন বোকা ছেলের সাথে আর যা করাই যাক না কেন এক সাথে বসবাস করা যায় না।
মুহিবের কথাটা শুনে স্নেহা কেঁদে ফেললো।কিছুসময় পর ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুহিবকে বললো
-না।আমি হাপিয়ে উঠি নি।আমি নিজেও কিছু জানি না।আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না।
-এখন কি করতে তুমি চাচ্ছো সেটা আমাকে বলো?
স্নেহা মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললো
-আমি তোমাদের দুজন কেই চাই।আমি দুজনের সাথেই থাকতে চাই।আমি আফসান কে ভালোবাসি।কিন্তু আমি তোমাকেও..
মুহিব স্নেহার পাশে বসে বললো
-এটা হয় না।
স্নেহা কান্নার বেগ বাড়িয়ে বললো
-কেন হয় না!
-আমি জানি না।কিন্তু এটা হয় না।
মুহিবের গাল দিয়ে এক ফোটা পানি বেয়ে পড়তেই মুহিব হাত দিয়ে চোখটা মুছলো।তারপর ধীরে স্নেহার হাত টা ধরে কোমল স্বরে বললো
-আমাদের একটা সমাজে থাকতে হয়।আর এই সমাজে থাকতে গেলে তুমি এক সাথে দুই জন পুরুষ নিয়ে বসবাস করতে পারবে না।আর সেই পুরুষ নিজেও কখনওই এটা চাবে না যে তার নিজস্ব সম্পত্তি তার স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষকে সাথে নিয়ে একসাথে বসবাস করুক।এটা যেমন আমি চাবো না ঠিক তেমন আফসান ভাই ও চাবেন না।সবার আলাদা একটি জগৎ থাকে স্নেহা।তুমিই বলো আমাদের পৃথিবী কয়টা?১টা,,তাই না?তুমি কিন্তু চাইলেও দুইটা পৃথিবী কে একসাথে করতে পারবে না।কারণ দ্বিতীয় পৃথিবীর কোনো অস্তিত্ব নেই প্রথম পৃথিবীর জীবনে।পৃথিবী একটাই।আর আমাদের সবার এই একটা পৃথিবীতেই থাকতে হবে।আর এই পৃথিবীতে থাকতে গেলে আমরা সব জিনিশ পাবো না।অনেক জিনিশকেই স্যাকরিফাইস করতে হবে।তাহলেই আমরা সুখে থাকতে পারবো।
মুহিব কিছুটা দম নিয়ে বললো
-তুমি কি বুঝতে পেরেছো আমি তোমাকে কি বুঝাতে চেয়েছি?
স্নেহা ঘাড় নেড়ে বললো
-হু
-তাহলে..
কথা শেষ করার আগেই ঘরের দরজায় এসে টোকা পড়লো।মুহিব গলা উঁচিয়ে বললো
-কে?
-আশা।
-কিছু বলবা?
-আপনাকে বাইরে একটু ডাকে।
-তুমি যাও,আমি আসছি।
মুহিব স্নেহার মুখে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো
-একদম কাঁদবে না।আমি একটু আসি।
বলেই মুহিব বেড়িয়ে এল ঘর থেকে।

আফসান উঠোনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মুহিবের জন্য।মুহিব আসতেই আফসান হেসে বললো
-তোমার সাথে ভালোভাবে পরিচয়ই হয়ে উঠে নি।তাই ভাবলাম পরিচিত হয়।
মুহিব হাত এগিয়ে দিয়ে বললো
-হুম,আসলে বিয়ের বাড়ির ঝামেলা।
-চলো,যেতে যেতে কথা বলি।মা বাজারে যেতে বললো।চলো তোমাকে নিয়েই তাহলে ঘুরে আসি বাজার থেকে।
মুহিব হাসির মতো একটা ভঙ্গি করে বললো
-অবশ্যয়।চলুন।
মুহিবকে নিয়ে আফসান রিক্সায় উঠে সিগারেট বের করে মুহিবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
-সিগারেট?
-না ভাই।সিগারেট খাই না।
আফসান সিগারেট ফিরিয়ে নিয়ে বললো
-আমিও একসময় খেতাম না।এখন অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।কিছু মনে না করলে আমি কি আমার সিগারেট টা ধরাতে পারি?
-হ্যা,অবশ্যয়।ধরান।

অনু এক ঘন্টার মত হলো একা একা বসে আছে।কিছুক্ষণ আগে অবশ্য একবার তার ননদ আশা এসেছিল।কিছুক্ষণ বসে থেকেই আবার উঠে গিয়েছে।তারপর আর কেউ আসে নি।আতিক নামের লোকটিও সকাল থেকে উধাও।কোথায় গেছে কে জানে!বসে বসে এখন অনুর ঝিমুনি এসে গেছে।অনু বালিশের উপর মাথা দিতে না দিতেই আতিক এসে হাজির হলো রুমে।অনু তাকে দেখে শোয়ার বদলে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো।আতিক দরজাটা বন্ধ করে বিছানার কাছে এসে বললো
-কি ব্যাপার!উঠে বসলে কেন?শুয়ে থাক।
অনু বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো
-না,ঠিক আছে।
আতিক অনুর পাশে বসতে বসতে বললো
-আমাকে দেখে এত ভয় পাও কেন তুমি?আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
-আমি কি বলেছি যে ভয় পাই?
-না বললেও বোঝা যায়।
-কচু।
-দেখি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো তো।
অনুর আতিক সম্পর্কে যে ভয়টা ছিল গত রাতে সেটা কেটে গেছে।তারপর ও কেন যেন লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা লাগে।কাল রাতে লোকটার বুকে মাথা রেখে সে সারাটা রাত শুয়েছিল।তার প্রথম মাথা রাখতে অস্বস্তি লাগলেও পরে এত বেশি ভালোলাগছিল যে সেই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো ছিল না।ভাজ্ঞিস লোকটা জোর করে তার বুকে মাথাটা রাখিয়ে ছিল।
-কি?তাকাও বলছি।
আতিকের কথায় অনুর ঘোর কাটে।সে মুখ কিছুটা উঁচু করে তাকায় আতিকের দিকে।লোকটার চোখে কিছু আছে।কি আছে?হ্যা,,মায়া।লোকটার চোখ মায়ার ভরা।অদ্ভুত এক মায়ার কারণে লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে সারা দিনরাত্রি পার করা যাবে।আতিক হালকা কেশে বললো
-বাহ,ভয় দেখি একদমই করো না।
-জ্বি করি না।
-দেখি একটু ওইদিকে সরো।আমি একটু শোবো।
অনু সরতেই আতিক বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বললো
-আহ শান্তি!!এই,,মাথার চুল টা একটু টেনে দাও তো।
অনু চুল টানার জন্য কাছে আসতেই আতিক বললো
-না থাক লাগবে না।তুমি আমার পাশে একটু বসো।
অনু কিছুক্ষণ ইতস্তত করে আতিকের পাশে বসতেই আতিক এক ধাক্কায় অনুকে শুয়িয়ে দিয়ে অনুর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো আতিক।অনুর নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।কিছুক্ষণ চেষ্টা চালালো আতিকের কাছ থেকে ছাড়া পাবার।কিন্তু সেটা সম্ভব হয়ে উঠলো না।আতিক তার দুই হাত দিয়ে অনুর দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে।এক সময় অনু ও হাল ছেড়ে দিয়ে আতিকের হাত জোড়ে চেপে ধরলো।খানিকক্ষণ পর আতিক অনুর ঠোট ছেড়ে অনুর নাকে নাক ঘষতে ঘষতে বললো
-আমার বউ এই সব ব্যাপারে এত টা কাচা সেটা জানা ছিল না।অবশ্য কাচায় ভালো।সমস্যা নেই আমি আছি না?শিখিয়ে পড়িয়ে নেব।
বলেই অনুর গলায় নাক ডুবালো আতিক।আতিকের প্রত্যেকটা স্পর্শে অনুর শরীরে শিহরণ জেগে উঠলো।সে আতিক কে জড়িয়ে ধরে তার পরণের পাঞ্জাবি খামচে ধরলো।তারা ধীরেধীরে একজন অন্যজনের নেশায় ডুব দিতে লাগলো।ঠিক তখনি তাদের রুমের দরজা কড়া নাড়তে লাগলো কেউ।তারা প্রথমে কেউ কিছু না বললেও ধীরেধীরে কড়া নাড়া বাড়তেই থাকলো।যেন দরজা টা ভেঙেই ঢুকে পড়বে কেউ।অনু নিজেকে সামলে নিয়ে কাপা কাপা গলায় বললো
-কে যেন দরজায় কড়া নারছে।দেখুন না?
আতিক তখন পাগলপ্রায়।সে কোনো উত্তর দিল না।হঠাৎ বাইড়ে থেকে কান্নার আওয়াজে তার হুশ ফিরলো।সে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এল।তার সাথে সাথে অনুও শাড়ির আচলটা উঠিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এল।বাইরে এসেই তারা জানতে পারলো মুহিব আর আফসান যে রিক্সায় বাজার করতে গিয়েছিল সেই রিক্সাটা ট্রাকের নিচে চাপা পড়েছে।একজন স্পটডেড,আরেকজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।অবস্থা খুবিই খারাপ।যেকোনো সময় যা কিছু হয়ে যেতে পারে।কিন্তু কে মারা গেছে আর কে আহত সেটা এখনো জানা যায় নি।পুরো বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ।মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে সবাই।শুধু একজনই না কেঁদে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছে ‘আসলে পৃথিবী একটাই,কেউ যদি ভূলেও দুই পৃথিবী কল্পনা করে,তাহলে ঈশ্বর তার থেকে তার কল্পনার পৃথিবীটা কে কেড়ে নিয়ে সমতা করে দেয়।মানুষের জীবনের সাথে সিনেমার কতো মিল।অবশ্য সিনেমার কাহিনী গুলো তো এক একটা মানুষের জীবন থেকেই নেওয়া।নাহ??’

স্নেনার মেয়ের রুনকির আজ বিয়ে।নিজের পছন্দ করা ছেলের সাথেই বিয়ে হচ্ছে রুনকির।বিরাট আয়োজন করা হয়েছে ঢাকায় স্নেহার বাবার বাড়িটাতে।ছাদে প্যান্ডেল বসানো হয়েছে,গেট সাজানো হয়েছে।হরেক রকমের বাতির আলো জ্বলছে আর নিভছে।ঠিক ১৮ বছর আগের অনুর বিয়ের মত।
হাজারের বেশি মানুষ দাওয়াত করা হয়েছে বিয়েতে।কিন্তু যেভাবে একে একে মানুষ আসছে তাতে মনে হচ্ছে হাজার পার হয়ে যাবে।শেষে আবার খাবার কম না পড়লে হয়।
বর এল সন্ধ্যা ৭ টার পর।রাফি দৌড়ে বাবাকে ডাকতে এল।রাফি ঢাকা ভার্সিটি তে চারুকলা নিয়ে পড়ছে।আফসানের মতোই অসম্ভব সুন্দর আঁকতে পারে ছেলেটি।দেখতেও পুরো আফসানের কার্বন কপি।তার এক মাত্র বোনের বিয়ে আজ।তার যেন আজ কাজের শেষ নেই।সকাল থেকেই ছোটাছুটির উপরেই আছে।বাবাকে নিচতলায় না পেয়ে দোতালায় উঠে গেল সে।সেখানে ও বাবা কে না পেয়ে রান্নাঘরে এসে তার মা স্নেহাকে ডেকে বললো
-মা,বাবা কোথায়?
স্নেহা রান্না ঘরে এসে রান্নার তদারকি করছিল।রাফির ডাক শুনে এগিয়ে গিয়ে বললো
-কি হয়েছে?
-বর চলে এসেছে।নামাবে না বাবা?
-এসেছে তো কি হয়েছে?কিছুক্ষণ গাড়িতে বসে অপেক্ষা করুক।
রাফি রেগে গিয়ে বললো
-ধুর।তুমি সব কথায় হেয়ালি করে বলো।বাবা কোথায় সেটা বলো
-রুনকির ঘরে দেখেছিস?
-না তো।
-না দেখেই চিল্লাচিল্লি করবি না।বিরক্ত লাগে।
রাফি তার অভ্যাস মত হালকা হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো
“না দেখেই চিল্লাচিল্লি করবি না।বিরক্ত লাগে।”

মুহিব রুনকির ঘরেই ছিল।রাফি রুনকির ঘরে ঢুকতেই দেখলো রুনকি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাদছে।অসম্ভব ভালোবাসে মুহিব তার মেয়ে রুনকি কে।
আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে অনুর বিয়ের পরদিন মুহিব আর আফসান রিক্সায় বাজারের দিকে এগুচ্ছিল।টুকিটাকি কথা হচ্ছিল ওদের মাঝে।ঠিক তখনি পিছন থেকে একটি ট্রাক তেড়ে এসে তাদের ২ সেকেন্ড এর মাঝে পিশে ফেলে দিয়ে যায়।সেদিনের দূর্ঘটনায় আফসান ঠিক সেখানেই মারা যায়।মুহিবের অবস্থাও তেমন একটা ভালো ছিল না।জান যায় যায় অবস্থা।কিন্তু নিয়তি তাকে বাচিয়ে দেয়।সে আবার ফিরে আসে স্নেহার জীবনে।স্নেহার অবস্থা ও তখন ভালো না।প্রায় পাগল পাগল অবস্থা।সারাদিন চুপচাপ অন্ধকার ঘরে বসে থাকে আর কাদে।মুহিব স্নেহার এই অবস্থা দেখে সুস্থ হয়েই প্রথমে যায় নাটরে আফসানদের বাড়ি।সেখানে গিয়ে আফসানের মায়ের কাছ থেকে রাফি আর রুনকির দায়িত্ব টা নিতে চায়।আফসানের মা আয়েশা বেগম ও অমত করেনি।বরং মুহিবের কথায় তার বুক থেকে যেন হাজার টনের পাথর নেমে যায়।কারণ সে পুত্র বিয়োগ শোখে নিজেকে এখনো সামলাতে পারে নি।যে ছেলে সকালেও মায়ের সাথে কথা বলে বাজারের উদ্দেশ্যে বের হয়,সেই ছেলে আর ঘরে ফিরে আসে নি।এসেছে তার লাশ।বুড়ো জীবিত মা বাবার কাছে এর থেকে কষ্টের আর কি থাকতে পারে!তারা বুড়ো হয়ে গেছে।ধরতে গেলে কবরে এক পা দিয়েই আছে,অথচ তাদের রেখে আল্লাহ তাদের শক্ত সামর্থ যুবক ছেলেকে নিয়ে গেল।আর তারাই বা এখন কদিন বাঁচবে?আর তারা মারা গেলে রাফি রুনকি দুটো এতিম বাচ্চা কে কে দেখবে?আশা তো সারাজীবন এ বাড়িতে থাকবে না।আতিককে দিয়েও ভরসা নেই।তাই রাফি আর রুনকি কে মুহিবের সাথে পাঠিয়ে দিল।স্নেহা ওদের পেয়ে ধীরেধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো।সেই থেকেই মুহিব হয়ে গেল এতিম দুটো বাচ্চার বাবা আর স্নেহা মা।কম ভালোবাসা দিয়ে বড় করেনি তাদের।বরং আসল বাবা মা থাকলে যা করতো তার বেশিই করেছে।অবশ্য রাফি আর রুনকি দুজনেই জানে মুহিব আর স্নেহা তাদের আপন কেউ না।তবুও কোনোদিন তারা মুখের ফাকেউ উচ্চারণ করেনি এ কথা।এখন রাফি,রুনকি আর স্নেহাকে নিয়েই মুহিবের জীবন।পরে মুহিবরা অবশ্য বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করেছে।কিন্তু হয় নি।হয়তো আল্লাহ চাই না এতিম বাচ্চার আদরে অন্য কেউ ভাগ বসাক।

রাফি বাবা মেয়ের করুণদৃশ্যের মাঝে ঢুকে রুনকির মাথায় টোকা দিয়ে বললো
-আরে ছেমড়ি কেঁদে কেঁদে তো মেকাপ উঠিয়ে ফেললি।জামাই আর ফিরেও তাকাবেনি না।
রুনকি বাবার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে রাফির দিকে ঘুরে অভিমানী সুরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো
-তুই চুপ থাক।দরজায় নক না করে কারো ঘরে ঢোকা অসভ্যতা এটা জানিস না?
রাফি রুনকির মতো মুখ করে ভেংচি কেটে বললো
“তুই চুপ থাক।দরজায় নক না করে কারো ঘরে ঢোকা অসভ্যতা এটা জানিস না?”
রাফির কথা শুনে রুনকি চিৎকার করে তার মা স্নেহা কে ডেকে বললো
-মা,দেখ তোমার আদরের ছেলে বাঁদরামি শুরু করে দিয়েছে।
এ পর্যায়ে মুহিব তাদের থামিয়ে বললো
-রাফি,কি হচ্ছে এগুলো?আজ আমার মায়ের বিয়ে ভুলে গেছিস?
রাফি তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো
-ও হ্যা।বর এসেছে চলো।নামাইতে হবে তো।
মুহিব রাফির কথা শুনে দ্রুত হেটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল জামাইকে নামাতে।
রাফি রুনকির ঘর থেকে বের হয়ে আবার কি মনে করে যেন ভেতরে ঢুকে বললো
-তোর জামাই কি দেখে তোর সাথে প্রেম করলো রে?এত সুন্দর ছেলের উচিৎ ছিল পরির মতো কোন মেয়ের প্রেমে পড়া।সেখানে সে পড়লো এক পেত্নির প্রেমে।
বলেই সে দৌড়িয়ে বের হয়ে গেল।রুনকি রাফির কথা শুনে কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার দিকে।
মুহিব বরকে নামিয়ে স্নেহাকে ডাকতে এল।স্নেহা তখন আফসানের আকা পোট্রেট টির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।মুহিব তার পাশে বসে বললো
-কি করছো?
স্নেহা মুহিবের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো
-আমি কিন্তু আমার দুই পৃথিবীতেই একসাথে বসবাস করছি।

(সমাপ্ত)