দুই হৃদয়ের সন্ধি পর্ব-০৫

0
252

#দুই_হৃদয়ের_সন্ধি
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মুসমান হতবাক হয়ে আতিফা বেগমের কথাগুলো শুনতে থাকে। নকশি মেয়েটাকে প্রথম দেখাতেই তার ভালো লেগে গিয়েছিল। মেয়েটার ব্যবহারও তো কতো মিষ্টি। ক-ই তাকে দেখে তো মনে হয়নি এমন কিছু।

আতিফা বেগম কথা বলা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলে চলেছেন,
“জানো, আমি আজ এখানে আসতেই চাই নি। কারণ নকশির মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু নকশিই এখানে আসার জন্য জোর করে। আমি বারণ করলে ও শোনে না। নকশি বলে, ও নাকি তোমাকে দেখবে। কোন মেয়ে আরিফের বউ হয়েছে তাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবে। আমি অনেক বোঝালেও ও বুঝতে চায়না। মেয়েটার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে আমি ওকে নিয়ে আসি। পাছে আবার না নিজের কোন ক্ষতি করে দেয় সেই ভয়ে। তবে এখানে আসার আগে আমি ওকে কসম করিয়ে নেই যেন, তোমার বা আরিফ কারো সাথে যেন কোন খারাপ ব্যবহার না করে এবং শান্ত হয়ে থাকে। ও কথা দিয়েছিল কোন খারাপ ব্যবহার করবে না। তবে আমার মনে হয়, কোন খারাপ ব্যবহার না করলেও সবটা ও এত সহজে মেনে নেয়নি। তাও আমি সন্দেহ করছি পায়েসে লবণ নকশিই মিশিয়েছে তোমাকে সবার সামনে ছোট করার জন্য।”

মুসকানের চোখ মুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটে ওঠে। মুসকান থতমত খেয়ে বলে,
“এটা কিভাবে হতে পারে? নকশি তো নিজেই আমাকে পায়েস রান্না করতে সাহায্য করেছে। তাহলে ও এমন কেন করবে।”

“হিংসা। আমরা নারীজাতি যে বড্ড হিংসুটে হই মুসকান। আর যখন প্রসঙ্গ নিজের পছন্দের মানুষকে নিয়ে তখন হিংসাটা একটু বেশিই কাজ করে। আর এই হিংসাই আমাদের বিবেককে অন্ধ করে দেয়। আমাদের নিজেদের স্বভাববিরুদ্ধ অনেক কাজ করতে বাধ্য করে।”

মুসকান মন দিয়ে আতিফা বেগমের কথাগুলো শোনে। সে উপলব্ধি করে উনি ঠিকই বলছেন। মুসকান বলে,
“আমি নকশির সাথে কথা বলব। আগে থেকেই এসব ব্যাপারে বোঝাপড়া করা ভালো। নাহলে ও আমাকে নিজের শত্রু ভেবে ভবিষ্যতে আরো কোন ভুল করতে পারে।”

“হ্যাঁ মা তুমি ওকে বোঝাও। আমি নিজেও ওকে বলব এই ব্যাপারে। তবে তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আপা বা আরিফকে এই ব্যাপারে কিছু বলো না। হাজার হোক, আমি মা তো। মা হয়ে নিজের মেয়েকে সবার সামনে ছোট হতে দেখতে পারব না।”

“আপনি কোন চিন্তা করবেন না খালা। আমি কাউকে কিছু বলব না।”

আতিফা বেগম স্বস্তি পান। কৃতজ্ঞতার সহিত তাকান মুসকানের পানে।

★★★
নকশি আরিফদের বাড়ির গেস্ট রুমে অবস্থান করছিল। সদ্য হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসেছে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে আজ তার। সাথে সাথে বেশ অনুশোচনাতেও ভুগছে। নকশি মনে করে কিভাবে মুসকান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর সে পায়েসে লবণ মিশিয়ে দিয়েছিল। তখন হিংসা ও রাগের বশে এমন করে ফেললেও এখন ভীষণ খারাপ লাগছে তার। তাই নকশি ভাবল এখান থেকে যাওয়ার আগে মুসকানের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবে। নাহলে সে মনে শান্তি পাবে না।

নকশির ভাবনার মধ্যেই মুসকান গেস্টরুমের দরজায় কড়া নেরে বলে,
“আসতে পারি।”

আচমকা মুসকানকে দেখে বেশ অবাকই হয় নকশি। সামান্য হেসে বলে,
“হ্যাঁ ভাবি, এসো।”

মুসকান রুমে এসেই নকশির পাশে বসে। নকশির দিকে ভালো ভাবে তাকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। অতঃপর বলে,
“কেন করলে তুমি এমন?”

“কিসের কথা বলছ তুমি ভাবি?”

“পায়েসে নুন মেশালে কেন?”

নকশির হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে ওঠে। নিজের ভুলের কথা মনে করে কেঁদেই দেয় সে। নকশিকে হঠাৎ এভাবে কাঁদতে দেখে থতমত খেয়ে যায় মুসকান। নকশির উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“এভাবে কাঁদছ কেন তুমি? আমি তো এখানে তোমাকে শাসাতে আসিনি। জাস্ট, তোমার থেকে এটাই জানতে চেয়েছি যে তুমি এমন কেন করলে। কারণ তোমাকে দেখে আমার মোটেও কোন খারাপ মেয়ে মনে হয়নি।”

নকশির কান্নার গতি কমে আসে। সে মুসকানের সামনে হাতজোড় করে বলে,
“আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও ভাবি। আমি সত্যিই এমন করতে চাইনি৷ আমি অনেক আগে থেকে আরিফ ভাইকে ভালোবাসি জানো? যখন থেকে আমি ভালোবাসার অনুভুতিটা উপলব্ধি করতে পারি ঠিক তখন থেকে আমি ঐ লোকটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। যখন আমি আরিফ ভাইয়ের বিয়ের খবরটা শুনলাম তখন কি পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিলাম তুমি ভাবতে পারবে না। মনে হয়েছিল নিজেকে শে’ষ করে দেই।”

মুসকান আচমকা জড়িয়ে ধরে নকশিকে। নকশির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“তোমার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি নকশি। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো হতে দেখা যে সহজ ব্যাপার নয়। আমি নিজেও বুঝি ব্যাপারটা।”

কথাটা বলেই অতীতে ডুব দেয় মুসকান। সে তো নিজেও ভালোবেসে ছিল একজনকে। নিজের মন প্রাণ সব উজাড় করে। কিন্তু সেই মানুষটা যে এখন অন্যকারো। তার কথা মনে আসতেই মুসকানের চোখে কান্না চলে আসে।

নকশি মুসকানকে শুধায়,
“তুমিও কি কাউকে ভালোবাসতে?”

“বাসতাম। হয়তো এখনো বাসি। কিন্তু তার সাথে আমার মিলন আর সম্ভব নয়। কারণ সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। আর আমিও এখন বিবাহিতা। তাই সে আমার জন্য নিষিদ্ধ।”

নকশি বুঝল সে শুধু শুধুই এই মেয়েটার সঙ্গে শত্রুতা করেছে। যেখানে এই মেয়েটা নিজেই অনেক কষ্টে রয়েছে।

★★★
নকশি ও আতিফা বেগম একটু আগেই বাড়ি ফিরে গেছেন। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনরাও বিদায় নিয়েছে। এখন বাড়িতে বাইরের কেউ নেই।

রুহি ঘুমিয়ে পড়ায় মুসকান তাকে শুইয়ে দিয়েছে দোলনায়। অতঃপর নিজেও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে যাবে এমন সময় আরিফ রুমে চলে আসল। তার হাতে কালো রঙের একটি ডায়েরি।

মুসকানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সে বলে,
“এই ডায়েরিটা কি আপনার?”

মুসকান এক দেখায় চিনতে পারল এটা তারই। তড়িৎ বেগে ডায়েরিটা নিজের হাতে নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ এটা আমারই। কোথায় পেয়েছেন এটা?”

“আপনার সৎ বাবা এবং মা এসেছেন। ড্রয়িংরুমে বসে আছেন। তারাই এই ডায়েরিটা দিলেন। সাথে আপনার আরো কিছু জিনিসপত্র।”

“কেন এসেছেন ওরা? আমি এক্ষুনি যাচ্ছি ওদের সাথে কথা বলতে।”

ডায়েরিটা হাতে নিয়ে মুসকান ছুট লাগালো। ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হতেই শুনতে পেল তার মা কান্নাকাটি করতে করতে বলছে,
“আমি মোটেই মুসকানের বিয়ে দিতে চাইনি। কিন্তু নিজের স্বামীর মুখের উপর কিছু বলতেও পারিনি।”

মুসকানের সৎ বাবা বললেন,
“এসব ন্যাকা কান্না বাদ দাও, আসল কথা বলো। কাল তো মুসকানের বিয়ের তৃতীয় দিন তাই নিয়ম অনুসারে ওকে তো আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। ওদেরকে নিতেই তো আমরা এলাম।”

মুসকান শক্ত গলায় বলে ওঠে,
“আমি আপনাদের বাড়িতে আর কোনদিনও পা রাখব না। ভালো হবে যদি তোমরা সসম্মানে এখান থেকে ফিরে যাও।”

মুসকানের মা মরিয়ম উঠে এসে মুসকানের মাথায় হাত রেখে বলেন,
“আমায় ভুল বুঝিস না রে মা। আমার উপর রাগ করে থাকিস না।”

“তুমি কোন মুখে এসব কথা বলছ মা? তোমাকে তো আমার মা বলতেও ইচ্ছে করছে না। আমার মাকে তো আমি সেদিনই হারিয়ে ফেলেছিলাম যেদিন ঐ লোকটার সাথে তোমার বিয়ে হয়। তারপর থেকে তুমি কি মায়ের কোন দায়িত্ব পালন করেছ?”

মুখ নামিয়ে নেন মরিয়ম বেগম। ভীষণ লজ্জা পাচ্ছেন তিনি। নিজের ভুলগুলো এভাবে চোখের সামনে ধরিয়ে দেওয়ার কারনে আর কিছু বলতেও পারলেন না। মুসকান পুনরায় বলল,
“যখন তোমাকে আমার সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল তখন তুমি আমার পাশে ছিলে না। তাহলে এখনও তোমাকে আর আমার লাগবে না। পৃথিবীতে কত মেয়েরই তো মা নেই। আমিও নাহয় নিজেকে তাদেরই একজন ভেবে নেব।”

কথাটা বলে আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে চলে আসে মুসকান। মরিয়ম বেগম মুসকানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨