দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-০৪

0
529

#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৪র্থ_পর্ব

চারুর অগ্নিবাক্য শেষ হতেই গাড়ি থেকে বের হয় শ্রাবণ। ভুবন ভুলানো হাসি মুখে অক্ষত রেখে বলে,
“আসলে চোখটা চোখের জায়গায় ই আছে, শুধু আপনার সাথে দেখা করবার উচাটনে মনটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। আমার হৃদয় যে বেহায়া”

গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে বুকে হাত জড়ো করে হেলান দিলো শ্রাবণ। কালো শার্ট পরণে তার। হাতাখানা গুটিয়ে রেখেছে কনুই অবধি। ফলে লোমশ বলিষ্ট হাত দেখা যাচ্ছে। চুল গুলো কপালে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে রয়েছে। মুখে অমলিন হাসি। চারু সরু চোখে তাকে দেখছে। শ্রাবণের উপস্থিতিতে বেশ অবাক হলো সে। বলা নেই, কওয়া নেই এখানে এসে উপস্থিত হবে এই ঘটনা কল্পনাতীত। শ্রাবণকে দেখে বিস্ময়ে খাবি খেলেও শ্রাবণের অমন মোলায়েম কন্ঠ কর্ণপাত হতেই দূর দেশ থেকে আড়ষ্টতা জড়ো হলো চারুর হৃদয়ে। অজানা কারণেই লজ্জায় শ্যাম গাল জোড়া উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। সাথে ঈষৎ বিরক্ত এবং রাগও হলো। লোকটার আদিক্ষেতা সহ্য হচ্ছে না তার। গায়ে পড়া স্বভাব যাকে বলে। চারু আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,
“আপনি এখানে?”
“আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি”
“আমার কলেজের খোঁজ কোথায় পেলেন?”

এক রাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো চারু। শ্রাবণ কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলোকে হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে বললো,
“এ কি খুব কঠিন কাজ? যার সাথে সারাটাজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখছি সে কখন কি করে, না করে সব যে আমার নখদর্পনে সেখানে এই সামান্য জ্ঞানটুকু থাকবে না এটা হতে পারে?

চারু হকচকিয়ে উঠলো, বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো শ্রাবণের দিকে। তার সকল খবর নখদর্পনে মানে কি? এই কথার অর্থ কি? লোকটাকে যতটা সাদাসিধে ভেবেছিলো সে ততটা নয়। বরং প্রচন্ড ধূর্ত। শীতল কন্ঠে শুধালো,
“আমার সব খবর নখদর্পনে মানে? আমাকে ফলো করেন আপনি?”
“আরে আপনি তো সিরিয়াস হয়ে গেলেন, আমি তো কথার কথা বলেছি। এসব কথা ছাড়ুন, গাড়িতে উঠে পড়ুন। রোদ লাগছে আপনার চারুলতা, কষ্ট হচ্ছে।”

শ্রাবণের হেয়ালী কথায় চারুর বিরক্তি বাড়লো। কড়া স্বরে বললো,
“আমি ঠিক আছে। আপনার ব্যাস্ত হতে হবে না। বাড়ি যাবো এখন। তাই আসছি”

বলেই হাটা শুরু করলেই হাতখানা টেনে ধরলো শ্রাবণ। মূহুর্ত জীর্ণ নরম হাত খানা চলে এলো শ্রাবণ শক্ত হাতের মুঠোয়। শ্রাবণের আকস্মিক কাজে আবারো পিলে চমকে উঠলো চারুর। শিরদাঁড়া বেয়ে উষ্ণ শক্তের স্রোত বয়ে গেলো। হুট করেই সুপ্ত রাগটা মস্তিষ্কে চড়ে উঠলো, অপরিচিত কারোর গাঢ় স্পর্শ যে একেবারে সহ্য হয় না। হুংকার ছেড়ে বললো,
“হাত ছাড়ুন, এটা কেমন অসভ্যতা?”

মূহুর্তেই হাত ছেড়ে দিলো শ্রাবণ। বিব্রত কন্ঠে বললো,
“এই ভর দুপুরে রিক্সা পাবেন না, তাই বলছিলাম আমি আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি। অহেতুক কেনো কষ্ট করবেন?”

চারু কিছু বলার আগেই একটা ভারী কন্ঠ কানে এলো চারুর। বা দিকে তাকাতেই দেখলো হন্তদন্ত হয়ে ধ্রুব আসছে। তার চোখে মুখে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। বড় বড় পা ফেলিয়ে চারুর কাছে এসে দাঁড়ালো সে। ভারী স্বরে বললো,
“এখানে দাঁড়িয়ে আসিস কেনো চারু?”

ধ্রুবের উপস্থিতিতে শ্রাবণের কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়ালো চারু। অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,
“রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু তুমি এখানে?”
“ছোট মামু পাঠিয়েছে তোকে নিতে, বাইকে যেয়ে বস”

চারু অবাক হলো, কারণ তার বাবা তো জানার কথা নয় আজ ক্লাস হবে না! তাহলে কেনো পাঠিয়েছে ধ্রুব ভাইকে! কিন্তু প্রশ্নটা করলো না চারু। কারণ এই মূহুর্তে শ্রাবণের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। অসভ্য লোকটির মুখ দেখতেও নারাজ সে। তাই কোনো কথা না বলেই হনহন করে ধ্রুবের বাইকের কাছে চলে গেলো সে। চারু চলে গেলে ধ্রুব কঠিন চাহনী প্রয়োগ করলো শ্রাবণের দিকে। বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
“এভাবে রাস্তাঘাটে আমাদের বাড়ির মেয়ের হাত ধরবেন না। বিষয়টা দৃষ্টিকটু”

কথাটা বলেই এক মূহুর্ত দেরি করলো না সে। হনহন করে নিজের বাইকের উপর চড়ে বসলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“আমাকে ধরে বয়, স্টার্ট দিলেই তো উড়ে যাবি”

চারু উপায়ন্তর না পেয়ে ধ্রুব এর টিশার্ট খামছে ধরলো। ধ্রুব বাইক স্টার্ট দিলো। শ্রাবণের সরু দৃষ্টি স্থির চারুলতার উপর। এক বিচিত্র দৃষ্টি। শান্ত, স্থির কিন্তু তপ্ত। বাইকটা চলে গেলোও সেই দৃষ্টি সরলো না। তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের শব্দে বিরক্ত হলো সে। রিসিভ করেই তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“আসছি”

বলেই ফোনটা খট করে কেটে দিলো সে। তারপর নিজের গাড়িতে উঠে বসলো। পিচের রাস্তা চিরে রওনা দিলো গন্তব্যে___

বাইক চলছে মৃদু গতিতে। মৃদুমন্দা উত্তরী হাওয়া উড়ছে চারুর কেশ। বারবার হাত দিয়ে কানে গুজার প্রচেষ্টা করলো সে। ধ্রুব ফ্রন্ট মিররে লক্ষ করলো ব্যাপারটা। ভারী স্বরে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“চুলগুলো বেঁধে নিলেই তো পাড়িস। আর বিরক্ত করবে না”
“আমার প্রতি আজ দেখি বেশ দরদ হচ্ছে তোমার? প্রথমে কলেজ থেকে নিতে আসলে, এখন স্বাভাবিকভাবে কথা বলছো”

বিদ্রুপের স্বরে কথাটা বলে চারু। প্রতিত্তরে ধ্রুব বলে,
“দরদ বড়াই করে দেখানোর বিষয় না। সেটা নিতান্ত ব্যাক্তিগত গোপন ব্যাপার। তুই বুঝবি না”

লোকটা বরাবর ই এমন, সোজা কথার সোজা উত্তর যেনো সে দিতেই পারে না। চারু আর ঘাটালো না। চুপ করে বসে রইলো বাইকে। বাতাসের উত্তাল কথাগুলো নির্লিপ্ত মনে শুনোট লাগলো। পুরান ঢাকার চিকন গলিতে প্রবেশ করলো বাইক। গিঞ্জি গলির বাচ্চাগুলো ড্রেইনের পাশে কি জানে কুড়াচ্ছে। একরাশ কৌতুহল নিয়ে ব্যাপারটা দেখলো চারু। শৈশব ই ভালো, এই কৈশর সব বিপদের মূল আর যৌবন সকল ধ্বংসের মুল। যৌবন আসলেই পৃথিবীটা এলোমেলো হয়ে যায়। পারিপার্শিক হয়ে উঠে প্রতিকূল। তার ক্ষেত্রে যেমন হচ্ছে_______

চারুর ঘরটা দোতালায়। মাঝে চাপা সিড়ি। সিড়ির কোনায় রান্নাঘর। সিড়ি বেয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে উপড়ে উঠতেই কানে একটা বিচিত্র কথা এলো, মা এবং বড় চাচী গুসগুস ফুসফুস করছেন। তাদের কন্ঠে আতংকের ছাপ। বড় চাচী মারুফা বেগম ধীর স্বরে জাহানারে বলছেন,
“কে জানতো বলো এতো মারাত্মক ঘটনা ঘটবে, নাহিয়ানের গাড়ির কি না ব্রেকটা কেটে দিলো কেউ। আমি তো তাই বলি। এতো পারদর্শী ড্রাইভার থাকার পর ও কেনো নাহিয়ানের গাড়ির এক্সিডেন্ট হবে। এই আজব দুনিয়ায় আর কি কি দেখা লাগবে বল জাহানারা! কই নিজের ছেলের গুষ্টিভরা শত্রু। কিন্তু ঐ মহিলা আমাদের মেয়েকে দোষ দিচ্ছিলো”

কথাটা শুনতেই থমকে গেলো চারু। তার পা জোড়া হিম ধরে গেলো। তার সন্দেহ ঠিক। দূর্ঘটনাটা কোনো স্বাভাবিক বা কাকতালীয় ঘটনা নয়। বরং কারোর নিকষকৃষ্ণ ষড়যন্ত্র। নীল পরিকল্পনা। এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না চারু। ছুটে গেলো নিজ ঘরে। ভীত সন্ত্রস্ত চারু ঘরের দরজা দিয়ে দিলো। ঘাপটি দিয়ে বসে রইলো এক কোনে। ভয়ে শরীর ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। বুক কাপছে তার। অস্থির হৃদয়ে ঝড় উঠলো। নেত্রজোড়া ভিজে এলো তার। নোনাজল গড়িয়ে জড় হলো চিবুকে। তার পেছনেই পড়েছে লোকটা? একটু শান্তি দিলে কি হয়? এটা কি ভালোবাসা নাকি! চারু তাকে ভয় পায় না। ভয় পায় তার বিশ্রী ভালোবাসাকে। হাটুতে মুখ লুকিয়ে অশ্রু মুক্ত করতে লাগলো চারু। ভয় হচ্ছে তার। খুব ভয়, এই ভয়ের কি মুক্তি নেই_______

রাত নিঝুম, বিছানার পাশের জানালাটা কেউ খুলে দিলো। রড দিয়ে সুনিপুনভাবে খুললো জানালাটা। চারুর মাথাটা সেখানেই ছিলো। সুগাঢ় নয়নে দেখলো চারুর ঘুমন্ত শ্যাম মুখখানা। কিয়ৎকাল দেখে ছুড়ে দিলো একটা নুড়ি পাথরে মোড়ানো কাগজ। তারপর নিঃশব্দে দরজা ভিজিয়ে দিলো সে। আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো চারুর। ঘুমঘুম চোখে খুব কষ্টে চোখ খুললো সে। চোখটা ফুলে উঠেছে। কলেজের কাপড় ও ছাড়া হয় নি তার। মা চার-পাঁচ বার ডেকেছিলো। কিন্তু দরজা খুলে নি চারু। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছে মনে নেই। মাথার ক্লিপের জন্য হাত দিয়ে হাতড়াতেই হাতে বিধলো শক্ত একটা পাথরের অংশ। চোখ কচলে নজর দিলো সেখানে। একটা লাল কাগজের ধলা। চারুর ভেতরটা একটু নড়ে উঠলো। কাঁপা হাতে খুললো লাল কাগজটি। লাল মোটা কাগজ পাথরে মোড়ানো। তাতে গোটা গোটা কালো বর্ণে লেখা,
“কেমন আছো দূর দ্বীপবাসিনী………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি