দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-০৬

0
447

#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৬ষ্ঠ_পর্ব

পায়ের শব্দ প্রবল হচ্ছে। হয়তো কাছে চলেছে এসেছে ছেলেগুলো। চারু কোনোমতে উঠেই ছুটলো। পায়ের শব্দ একেবারে কাছে চলে এসেছে। ঠিক তখনই এক জন মানুষের সাথে ধাক্কা খেলো চারু। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই এক জোড়া শীতল শক্ত হাত নিপুনভাবে সামলে নিলো তাকে। এক প্রবল পুরুষালী কড়া গন্ধ নাকে আসছে। ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো চারু। তার শরীর ঈষৎ কাঁপছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। দম আটকানো অস্থিরতা ঘিরে ধরলো তাকে। কিয়ৎকাল নিস্তব্ধতাই হলো তার সঙ্গী।
“আপনি এভাবে ছুটছিলেন কেনো চারুলতা?”

সেই নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে এক গম্ভীর কিন্তু অস্থির পুরুষালী কন্ঠ কর্ণপাত হলো চারুর। তড়াক গতিতে চোখ মেললো চারু। চোখ খুলতেই সামনে থাকা পুরুষের সাক্ষাত পেলো। মূহুর্তেই ভয়, অস্থিরতাগুলো স্বস্তির রুপ নিলো। কেনো নিলো জানা নেই, তবে এই ক্ষণ পরিচিত লোকটাকে দেখে আসন্ন বিপদে আশার আলো খুজে পেলো চারু। জড়ানো গলায় বললো,
“ওরা আমার পিছু নিয়েছে”
“কারা?”

অস্থির গলায় জানতে চাইলো শ্রাবণ। চারু কাপা হাতে আঙ্গুল তাক করলো পেছনে। দু-তিনটা ছেলে চারুর থেকে কিছু দূর আসতে থেমে গেলো। শ্রাবণের চোখ রাঙ্গানো কঠিন দৃষ্টিতে তাদের নেশাটা উবে গেল। ঘুরে পেছনে দৌড় দিলো তারা। চারু এখনো তার বাহুডোরে আটষাট হয়ে আবদ্ধ। শ্রাবণ স্বর নরম করার চেষ্টা করে জানালো,
“ভয় পাবের না চারুলতা, ওরা চলে গেছে”

চারু এখন ক্ষীন কাঁপছে। ভীত নজরে পেছনে তাকালো সে। শুণ্য গলিতে দুটো কুকুরকে ঘুরতে দেখে রুদ্ধশ্বাস ছাড়লো সে। হঠাৎ তটস্থ হলো নিজের অবস্থান। অস্বস্তিকর অবস্থার মুখোমুখি হবার পূর্বেই সরে এলো সে। নিজের ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বললো,
“ধন্যবাদ”
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু এতো রাতে এখানে কি করছিলেন আপনি? আর একটু হলেই তো একটা অঘটন ঘটে যেতো। জানেন না দিনকাল ভালো নয়”

শীতল কন্ঠে বলা কথায় রোষের হাতছানি ঠিক ই টের পেলো চারু। মিনমিনে স্বরে বললো,
“বান্ধবীর বাড়ি এসেছিলাম, সময়ের দিকে খেয়াল ছিলো না। রিক্সাও পাই নি। ভেবেছি হাটতে মোড়ে রিক্সা পাবো”
“পেয়েছেন কি? উল্টো তিনটা মাতালকে জুটিয়েছিলেন। ভাগ্যিস আমি ছিলাম”

হ্যা, ভাগ্যিস শ্রাবণ ছিলো। নয়তো কি হতো মা’বুদ ই জানেন। চারু কিছু বলার সাহস পেলো না। শ্রাবণের কন্ঠে অগ্নি ঝড়ছে, লোকটা এমন ভাবে ঝাড়াঝাড়ি করছে যেনো নিজের বিবাহিত স্ত্রীকে বকাঝকা করছে। কি অদ্ভুত অধিকারচর্চা!.. বেশ কিছুক্ষণ কড়া ভাবে শাসিয়ে কিঞ্চিত শান্ত হলো শ্রাবণ। নমনীয় স্বরে বললো,
“চলুন, বাড়ি পৌছে দেই। পাকনামি করবেন না। আমি মতামত শুনবো না”

কঠোরভাবে শেষ কথাটা বললো শ্রাবণ। চারু শুধু ঘাড় কাত করলো। চারুর চুপসে যাওয়া মুখখানি দেখে স্মিত হাসলো সে। মেয়েটির তেজটা ভয়ের চাদরে ঢাকা পড়েছে। তবে মেয়েটিকে সকল রুপেই ভালো লাগে তার, লাজুক লজ্জাবতী হোক বা তেজী সূর্যের প্রতীভ মুখশ্রী। কিংবা ভয়ে শিটিয়ে যাওয়া কিশোরীর সন্তস্ত্র চেহারা। সবকিছুই বড্ড ভালোলাগে। শ্রাবণ হাটতে শুরু করলে চারু আরোও একবার বিপাকে পড়লো। পা টেনে হাটতেও কুকড়ে যাচ্ছে। তখন ভয়ের দরুন টের না পেলেও এখন আচ্ছামত বুঝতে পারছে পা টা বাজেভাবে মচকেছে। শ্রাবণ কিছুদূর এগিয়ে গেলেও পুনরায় পিছিয়ে আসলো। ভ্রুকুঞ্চিত করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“এতো বেপোরোয়া কেনো চারুলতা? তুমি সত্যি বড্ড নিষ্ঠুর”

কথাটা শেষ হবামাত্রই পাজাকোলে তুললো তাকে। শুণ্যে ভাসতে দেখে তড়িঘড়ি করে বললো,
“এ কি! কি করছেন?”
“চুপ, একটা কথা বললেই আছাড় দিবো। তখন পায়ের সাথে মাজাও যাবে। খোঁড়া বউ এ আমার সমস্যা নেই, কিন্তু আমার কোলে কোলেই ঘুরতে হবে। ভেবে দেইখো”

মূহুর্তেই রেগে গেলো চারু। লোকটির জোর খাটানোর ধরণ দেখেই তার আক্কেলগুড়ুম। অন্যসময় হলে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু নিজের অসহায়ত্বের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলো না। মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে চেয়ে রইলো সে। শ্রাবণ নিঃশব্দে হাসলো, তারপর চারুকে নিয়ে এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে।

চারু গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে রয়েছে। অপেক্ষা শ্রাবণের আসার। সে ফার্মেসিতে গিয়েছে। স্প্রে, ব্যান্ডেজ কিনতে। তার মতে এখন ই প্রাথমিক চিকিৎসা করতে হবে। নয়তো ব্যাথা কমবে না। চারুর অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়ি গেলে না জানি কিসের সম্মুখে পড়তে হবে কে জানে। বাবা দুবার ফোন করেছে অবশ্য৷ ভয়ে ফোন ধরে নি। এই শ্রাবণের বেশি বাড়াবাড়ি। এই বাড়াবাড়ির প্রয়োজনীয়তা ছিলো না। ঠিক তখনই তার সাইডের দরজাটা খুলে শ্রাবণ। বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই পাটা হাটুতে উঠিয়ে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় চারু বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। লোকটি কোনো বিব্রতবোধ ছাড়াই তার পা টা নিজ হাটুর উপর রেখে স্প্রে লাগাতে লাগলো। পরম যত্নে পাটা ব্যান্ডেজ করে দিলো। তার শীতল হাতের স্পর্শে বাড়ে বাড়ে কেপে উঠছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। নিঃশ্বাস গাঢ় হচ্ছে। মাঝেই কোমল কন্ঠে বললো,
“ব্যাথা করছে?”

চারু দুপাশে মাথা নেড়ে “না” জানালো। শ্রাবণ একটু থেমে বললো,
“একটু ব্যাথা করবে। আংকেলকে বলবো, কালকে ডাক্তার দেখাতে। এখন তো রাত হয়ে গেছে। মচকেছে তো, ভাঙ্গে নি। তাই হাসপাতালে নিচ্ছি না। কিন্তু ক দিন রেস্ট নিও। লাফালাফির প্রয়োজনীয়তা নেই”

চারু খেয়াল করলো, আপনি নামক সম্বোধনটা কোথায় যেনো উড়ে গেলো। তুমিতে চলে এসেছে। চারু কিঞ্চিত অস্বস্তি বোধ করলো। মিনিয়ে বললো,
“বাড়ি যাবো”

শ্রাবণ যত্নে ব্যান্ডেজ করে দিলো। ব্যাথাটা কমেছে কিঞ্চিত। শ্রাবণ এবার পা টা তুলে খুব সাবধানে রাখলো। তারপর দরজাটা দিয়ে, ড্রাইভিং সিটে বসলো। তারপর স্টার্ট দিলো গাড়ি। পিচের রাস্তা চিরে কালো নীলাম্বরীর নিচে চললো গাড়ি।

🍁🍁🍁

শ্রাবণকে চারুর সাথে দেখে বাড়ির সবাই এর চক্ষুচরাগ গাছ। আহসান সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো। জাহানারা হতভম্ব হয়ে গেলো দৃশ্যটি দেখে। যতই বিবাহ ঠিক হোক না কেনো! মেয়ে একজন ছেলের কোলে করে বাড়ি ফিরেছে দৃশ্যটি দৃষ্টিকটু। ধ্রুব চোয়াল শক্ত করে চেয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে। এদিকে মনিরুল সাহেবের মুখে প্রসন্নতা। গদগদ কন্ঠে বললেন,
“এ কি! শ্রাবণ বাবা তুমি এখানে? কি হয়েছে চারু মায়ের”

শ্রাবণ নমনীয় কন্ঠে বললো,
“ভেতরে আসবো বড় চাচা? ওর পা মচকে গেছে। ওকে শোয়ানো প্রয়োজন”

জাহানারা বিচলিত হয়ে উঠলো,
“এ মা, কিভাবে হলো? আসো আসো! একেবারে ওর রুমেই নিয়ে আসো!”

চারুকে তার বিছানায় শোয়ানো হলো। শ্রাবণ সবকিছু খুলে বললো। আহসান সাহেব সব শুনে কৃতিজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। মনিরুল সাহেব আয়োজন শুরু করলো আপ্পায়নের। প্রথমে না করলেও বাধ্য হয়ে খেতে বসতে হলো। শ্রাবণকে নিয়ে দহরমমহরম দেখে চারুর চাচাতো বোন চিত্রা একটু গুতা দিয়ে বললো,
“বুবু, দুলাভাই তো একেবারে হিরো! কি সুন্দর হিরোদের মতো তোকে বাঁচালো”
“থামবি তুই”
“ভুল বললাম নাকি! তোদের না বেশ মানায়। আমি তো যখন দেখলাম ভাই কোলে করে তোকে সদর দিয়ে ঢুকছেন, শিস বাজাতে ইচ্ছে করছিলো। মায়ের হাতে মার খাবো বিধায় দমে গেলাম। কি মধুর সিন”

চারু চোখ রাঙ্গালো চিত্রাকে। কিন্তু কিসের কি! সে বরাবর ই ইঁচড়েপাকা। চারু যতটা শান্ত সে ততটাই চঞ্চল। দেখতেও চারুর সাথে মিল নেই। অসম্ভব সুন্দরীদের কাতারে পড়ে সে। তবে বড্ড বেশি বকে। চারু কড়া কন্ঠে বললো,
“এতোই ভালো লেগেছে যখন বিয়ে করে নে না। আপদ ঘাড় থেকে নামুক”
“হাহ! আমি যে অন্য আপদের ঘাড়ে উঠতে চাই গো। তোমার আপদ দুলাভাই ই থাক”

বলেই হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো সে। চারু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। অবশেষে মস্তিষ্ক মুক্তি পেলো। কিন্তু যা ভাবলো তা হলো না! বরং নতুন এক চিন্তা মন এবং মস্তিষ্কে চড়ে বসলো। শ্রাবণমুখর এক চিন্তা________

☘☘☘☘

নিগূঢ় রাত নিজ রুমের টেবিলের উপর হাত জোড়ো করে বসে রয়েছে ধ্রুব। মেজাজটা বশে নেই। শ্রাবণকে নিয়ে অতিআদিক্ষেতা সহ্য হচ্ছে না। বড় মামা কি না জোরপূর্বক তাকে বাড়িতে রেখে দিলেন। আর ওই বেহায়া খেয়ে দেয়ে থেকেও গেলো। খাবার টেবিলে বসতে যেয়েও উঠে আসলো সে। বড় মামা তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“তুমি পরে বসো”

কথাটা আতে লাগায় রাগ করে খেতেই গেলো না সে। প্রতিরাতের ন্যায় নিজের অভিযোগগুলো যখন ডাইরির পাতায় লিখতে ব্যাস্ত তখন ই নারী কন্ঠ কানে এলো,
“কি লেখো ধ্রুব ভাই?”

চমকে উঠলো ধ্রুব। তাড়াতাড়ি ডাইরি বন্ধ করে দিলো সে। পেছনে ফিরতেই মেজাজ খারাপ হয়ে উঠলো, খেকিয়ে বললো,
“তুই এখানে?”

চিত্রা হাতের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমার ডাইরি পড়ার ইচ্ছে আমার নেই। মা বললো তোমাকে খাবার দিতে তাই আসলাম। তখন মুখ ফুলিয়ে যে ঘরে ঢুকেছো আমি কিন্তু দেখেছি”

চিত্রার ত্যাড়া কথায় বিরক্ত হলো ধ্রুব। খপ করে প্লেটটা নিয়ে বললো,
“এবার যা বের হ, আর নক না করে ঘরে আসবি না। ধামড়া ছেলের ঘরে ঢুকতে লজ্জা লাগে না? যা বের হ”

চিত্রার উজ্জ্বল মুখখানা নিভে যায়। অপ্রতীভ স্বরে শুধায়,
“আচ্ছা, আমি তো বুবুর থেকেও সুন্দর। তাহলে বুবুর প্রতি ভালোবাসা আর আমার প্রতি অবজ্ঞা কেনো………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি