দোটানা ২ পর্ব-০১

0
1162

দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_০১

কাল রাত অব্দি যে বলেছিলো আমি তোমাকে নিজের প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসি সেই প্রেমিক পুরুষ বর্তমানে চোখের সামনেই অন্য মেয়েকে নিয়ে নোংরামিতে মগ্ন। অজোরে জল বইছে আরুশির চোখ দিয়ে,হল ভর্তি মানুষের সামনে সুইটিকে কিস করছে সায়ান,সেখানে উপস্থিত সকলেই হাততালিতে ফেঁটে পরেছে,তারাও যে সায়ানের লেভেলেরই লোক তাই এসব নোংরামো তাদের কাছে গৌরবের।মিনিট দুয়েক পর সুইটি সায়ান নিজেদের কার্যের সমাপ্তি ঘটালো,অতঃপর সুইটির কোমড়ের পাশে হাতে লেপ্টে ধরলো সায়ান,দুজন একে ওপরকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় এগিয়ে আসলো আরুশির ধারে।তাচ্ছিল্য স্বরে আরুশির উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো সায়ান।

কি হয়েছে বেবি,স্যারপ্রাইজ পছন্দ হয় নি।

সায়ান তুমি এসব…..?তুমি না আমায় ভালোবাসো?

হা হা হা হা,ভালোবাসবো আর তোকে,তাকিয়েছিস নিজের দিকে।হ্যাঁ তুই সুন্দরী তা মানি,তাছাড়া আর কি আছে তোর মাঝে?তুই ভাবলি কি করে তোর মতো ফকিন্নির মেয়েকে ভালোবাসবে সায়ান চৌধুরী,একবার ভেবে দেখেছিস কোথায় তুই আর কোথায় আমি,তাকা তোর কাপড়ের দিকে,যে ময়লা পুরাতন থ্রি-পিস পরে আছিস ওটা দিয়ে আমাদের ঘরের চাকরানীরাও নিজেদের ঘর মুছবে না,কিভাবে নিজেকে আমার সমতুল্য মনে করতে পারিস তুই?সত্যিই হাস্যকর।

তবে কেনো আমার পিছন পরে ছিলে?আমি তো আর নিজে থেকে তোমার জীবনে আসি নি।কেনো আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করলে আর এখন কেনো এমনটা করছো বলো?

আরে আর বলিস না, ওই যে ফকিন্নি হয়েও তোর আলাদা তেজ আছে না,ছেলেদের পাত্তা দিস না,ঘরে খাবার না থাকলেও ওপরের কাছে হাত পতিস না ওসব তেজ মারতে চেয়েছিলাম আরকি,রাস্তার মেয়ে হয়েও কি তেজ রে তোর।
না সোনা কিস করবো না,ওটা বিয়ের পর।কাছে এসো না,যা হবে বিয়ের পর।আব্বে তোর মতো ফকিন্নিকে বিয়ে কে করবে।তোর মতো মেয়েকে তো শুধু ভোগ করা যায় বিয়ে না।

কথাগুলো সহ্য করতে পারলো না আরুশি, হাত উঠিয়ে কড়া এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো সায়ানের গালে।সাথে সাথেই সায়ান অতিরিক্ত রাগে আরুশিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় ফ্লোরে,অতঃপর তেঁড়ে গিয়ে তার থুতনি চেঁপে ধরে।

ফকিন্নি তোর সাহস হয় কি করে আমার গায়ে হাত তোলার?আজ তো তোকে আস্তো শেষ করবো।

কথাটা বলে সায়ান আরুশির বাহু টেনে তুলে হেঁচড়ে নিয়ে একটা রুমের দিকে অগ্রসর হতে নিলে রিফাত ওকে বাঁধা দেয়।

কি করছিস সায়ান শান্ত হো,ছাড় ওকে।তুই যেমনটা চেয়েছিলি তাই তো করে নিলি এখন ছেড়ে দে জেদ,রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু করে বসলে তার পরিণাম কিন্তু ভারী পরতে পারে তোর উপর।তুই ভালো করে জানিস তোর বাবাকে।

রিফাতের কথায় থমকালো সায়ান,কিছু একটা ভেবে ছিটকে ফেললো আরুশিকে আবারও ফ্লোরে,প্রচন্ড ব্যাথা পেলো আরুশি নিজের ডান হাতটায়,পাশের টেবিলের কর্নধারে লেগে কপালের কোন কেটে রক্ত ঝড়তে শুরু হলো,গর্জে বলতে লাগলো সায়ান।

বেড়িয়ে যা ফকিন্নি, তোকে যেনো আমি আর আমার চোখের সামনে না দেখি,জাস্ট গেট লস্ট ফ্রোম হেয়ার রাইট নাউ।

কোনোরকম নিজেকে সামলে দাড়ালো আরুশি,ওর করুন অবস্থা দেখে অট্টহাসিতে মেতে উঠলো উপস্থিত সব,মনুষ্যত্ব আজ এতোটা বিলুপ্ত পেয়েছে ভাবতেই গা কাঁটা দিয়ে উঠলো তার, অতঃপর চোখ দিয়ে পড়ন্ত জল মুছতে ব্যস্ত হয়ে বেড়িয়ে আসলো আরুশি।

চৌধুরী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিতে পিয়নের চাকরি পেয়েছিলো আরুশি,অফিস বর্তমানে পরিচালনা করছে সায়ানের জমজ ভাই আয়ান,সায়ানের এসব কাজ টাজ নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই,বিলাসবহুল স্বাধীন জীবন তার পছন্দ, সেদিন বাবার আর চাচার জোরাজোরিতে অফিস গিয়েছিলো সে তখন চোখ পরে আরুশির উপর,দেখতে সে রূপবতী,তবে যথেষ্ট ভদ্র যা মোটেও সহ্য হলো না সায়ানের।যে সায়ানের জন্য মেয়েরা উল্টে পরে মরে সে সায়ানের দিকে একবার ফিরেও তাকায় নি আরুশি,বিষয়টা তার ইগোতে আঘাত করলো,একটু কথা বলতে চাইলেও আরুশি বেশি কৌতুহল দেখায় নি যাতে জেদ আরও বেড়ে গেলো সায়ানের,সায়ান চৌধুরীকে পাত্তা না দেওয়া যে তার জীবনের সব থেকে বড় ভুল হয়ে দাড়ালো,অতঃপর লেগে পরলো সায়ান আরুশির তেজ ভাঙার অভিযানে,সব অসাধ্য সাধন করেছে আরুশিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলার জন্য,অবশেষে আরুশির মন পেয়ে গেলেও তার শরীর পেতে ব্যার্থ হয়,উক্ত ব্যার্থতা সায়ান মেনে নিতে পারে নি।জোর করে কিছু করাতেও সায়ানেরই হার ছিলো,তাই নকল বিয়ের কাগজ বানায় যাতে আরুশি নিজেকে তার কাছে সপে দেয় তবে তাতেও আরুশি নারাজ হয়,পুর্নাঙ্গ মর্যাদায় তাকে ঘরে না তোলার আগ অব্দি এমন সম্পর্কে জড়াবে না সে,অতঃপর তাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করবে বলে এখানে ডেকে আনলো সায়ান,বলেছিলো যে এখানে তার বাবা মাও থাকবেন,আর তারপর ওকে এনে ওভাবে অপমান করলো,এতোকিছুর পরও সায়ানের রাগ দমন হয় নি,মেয়েদের শরীরে রাজত্ব করা ছেলে তুচ্ছ একটা মেয়েকে হাত লাগাতে পারে নি,উপর থেকে তার উপর হাত তুললো আরুশি।

রাগ দমনের সুবিধার্তে ড্রিংক করতে ব্যস্ত হলো সায়ান।

আরুশির বেহায়া মন এখনও মানতে রাজি নয় যে সায়ান ওকে ধোকা দিয়েছে,এতো কিছু কি করে মিছে হতে পারে,কোনো মানুষ কি পারে এতো পরিপূর্ণ অভিনয় করতে,সায়ানের অভিনয়ে হয়তো সত্যতাও হার মানবে এতোটা খাঁটি ছিলো তার অভিনয়।কি না কি করেছে আরুশির মন পেতে,এমন সব কিছুই করেছে যেমনটা আরুশি সবসময় সিনেমায় নায়িকাদের জন্য নায়ককে করতে দেখেছে,গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে উঠা আরুশি কল্পনার জগতে বিশ্বাসি,ওর কি জানা ছিলো জীবনটা না তো হয় কোনো সিনেমার মতো আর না হয় কোনো কল্পনার মতো,পৃথিবীর নির্মমতার সম্পর্কে নাই তার কোনো যথেষ্ট জ্ঞান, ছুটো থেকে মামির মার খেয়ে বড় হয়েছে,কোনো রকম অনার্স টা কমপ্লিট করেছে মামা আর মায়ের অবদানে উপজেলা শহরের একটা ছুটোখাটো কলেজ থেকে,অবশেষে মামা মারা গেলে চুরির অপবাদে মামি ওদের মারধর করে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়,মাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসে সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে,অতঃপর ঢাকার একটা ছুটো গলিতে থাকার জায়গা পায় তারা,অনেক কষ্ট করে এই তো কদিন আগেই একটা কোম্পানিতে পিয়নের জব পেয়েছে তাতেই দিন ভালো যাচ্ছিলো,কিন্তু হুট করেই আসলো জীবনে সায়ান,দেখালো রঙিন সপ্ন,অতঃপর শেষ করে দিলো সবকিছু, আরুশির অনেক দোষ,বোকা সে,বিশ্বাস করে সহজে সবাইকে,ভিতু সে,জানে না কোথায় কি বলতে হয়,গরীব হয়েও সম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়,হাত পাততে চায় না কারো দ্বারে।
আজ সকালে জবটাও চলে গেলো আরুশির,কারন সে গরীব,তার না কি এত বড় কোম্পানিতে চাকরি করার যোগ্যতা নাই।

কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি পৌঁছালো আরুশি,ঘরের ভিতর বেশ কয়েকজন লোকের উপস্থিতি টের পেলো,মনে ভয় কাজ করতে শুরু হলো ওর,মায়ের শরীরটা যে কদিন থেকে বেশ ভালো না,ছুঁটে ঘরের ভিতর গেলে দেখতে পেলো মা অচেতন হয়ে পরে আছেন বিছানাতে,আশপাশের কিছু মহিলা উনার জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হচ্ছেন,জ্ঞান ফিরছে না উনার,আরুশির মন ঘাবড়ালো অনেক,মাকে ধরাধরি করে একটা গাড়ি ডেকে নিয়ে গেলো হাসপাতালে। ডাক্তার জানালেন ব্রেন স্ট্রোক করেছেন উনি,চিকিৎসায় অনেক টাকা লাগবে,হাতে টাকা পাঁচ হাজার এর বেশি এক টা কড়িও আর নেই,নির্বাক ভঙ্গিতে বসে থাকলো আরুশি মায়ের কেবিনের বাইরে,কি করবে এবার।কোথায় যাবে,এই ঢাকাতে তেমন কাউকে জানে না সে,হুট করে নতুন চাকরিও পাওয়া যাবে না,এতো বড় ঢাকা শহরে বড় বড় ড্রিগ্রি হাতে নিয়েও কতো শত বেকার ঘুরে বেড়ায় সেখানে আরুশির হাতে সামান্য ডিগ্রি,উপর থেকে মাথায় গরীবের ট্যাগ।

এদিকে রাগ দমনের নাম নিচ্ছে না সায়ানের,গিলে যাচ্ছে একের পর এক ড্রিংক।

অনেক হয়েছে সায়ান অফ যা,আর কতো খাবি।এতো রাগ ভালো না।

রাগের কি দেখেছিস রিফাত,ওই মেয়েকে খুন করলেও রাগ কম হবে না আমার,যেখানে মেয়েরা আমার এক ঝলকের জন্য দিন রাত এক করে সেখানে আমাকে ওর পিছন ঘুরতে হয়েছে। জানিস এর তেজ মারার ফন্দিতে নকল বিয়ের কাগজও বানালাম,তাও হাত লাগাতে দেয় নাই শরীরে বলে না কি আমার পরিবার নিয়ে যখন ওকে বউ বানিয়ে ঘরে আনবো তখন নাকি সব হবে,ফকিন্নি হয়েও লাখের স্বপন যায় না।

আরে ভাই ছাড়,ওকে এতো অপমান করেছিস এটাই অনেক,এমন গবীর মেয়েদের জন্য যতোটা তার ইজ্জত প্রিয় থাকে ততোটাই প্রিয় হয় তাদের সম্মান,ওকে যে হারে অপমান করেছিস এটাই অনেক ওর জন্য।তবে আমার ভয় করছে ওই নকল বিয়ের কাগজ যদি তোর বাবার হাতে লাগে তাহলে কি হবে বুঝতে পারছিস তো।

আরে চিন্তা করিস না,ওসব পেপার ওর কাছে নাই,বোকাটাকে শুধু দেখিয়ে আমার কাছে রেখেছি,আর ও এখন আমাদের অফিসেও নাই,আয়ান সকালেই ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করেছে ওকে শুনেছি,আর বাড়ি গিয়ে অধিকার নিয়ে কথা বলার সাহস ওর নাই।

তাও এলার্ট থাকিস।

হুম।

কটা টাকার সন্ধানে এক রাতে কতো ঘুরেছে তা শুধু আরুশি জানে,অভাব করলেও কখনো কারো কাছে হাত পাতে নি সে,অবশেষে পরিস্থিতি তা করতেও বাধ্য করলো,মা ছাড়া এ ভুবনে আপন যে তার আর কেউ নেই,পারবে না তাকে হারাতে,বাবাকে শেষবার কবে দেখেছে কে জানে,চেহারাটাও মনে নেই- তার কথা আর কি মনে পরবে।তার মাকে ছেড়ে অন্য নারীর হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া ব্যাক্তিকে সে মনেও রাখতে চায় না,তবে অভাগিনী সেই মাকে সে কি করে বাঁচাবে,কি করে ধরে রাখবে নিজের বেঁচে থাকার শেষ আশাটাকে,কোথাও থেকে এক টা টাকাও ধার পায় নি,বিপদে নাকি বন্ধুর পরিচয় হয়,আর বিপদে পরেই আরুশি জানতে পেলো গরীবের বন্ধু কেউ হয় না,এখন তো গরীবেরাও গরীবের সাহায্যে এগোয় না ধনীরা কি আসবে,পৃথিবীটা যেনো স্বার্থপরদের কবলে যেতে চললো, একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে বিস্তর আকাশে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরুশি,ওই উপরওয়ালা ছাড়া তার সহায় যে আর কেউ নাই।

আল্লাহ একটা রাস্তা দেখান মালিক?বড্ড অসহায় হয়ে পরেছি,আপনিই তো সহায়,রহম করুন।

হুট করে মনে পরলো মির্জা বাড়ির কথা,সেখানে ওর মা কয়েকমাস আগে কাজ করতেন আরুশির চাকুরি হওয়ার আগে,সেখানে গেলে হয়তো কটা টাকা ধার পাবে,আর কোনোদিক বিবেচনায় না নিয়ে চলে গেলো সেখানে,তবে বরাবরের মতোই নিরাশ হলো,বরং সেখানেও তাচ্ছিল্যের স্বীকার হতে হলো তাকে,হাশেম মির্জা আরুশিকে নিয়ে কি হাসাহাসিই না শুরু করলেন,মা দুদিন কাজ করেছিলো বলে কি দুনিয়া শুদ্ধ করেছিলো যে অসুস্থ হলে তাকে টাকা দিতে হবে।হাশেম মির্জার ব্যাঙ্গ হাসি সহ্যের বাহিরে ছিলো,অপমানবোধ আর চোখ ভর্তি জল নিয়ে সেখান থেকেও বেড়িয়ে এলো আরুশি।

দুদিন গেলো যেমন তেমন,যথেষ্ট টাকা না দেওয়াতে ডাক্তারেরা আরুশির মায়ের তেমন কোনো চিকিৎসাই শুরু করেন নি এখন অব্দি,ওর মায়ের অবস্থা খুবই নাজেহাল, শিগ্রই যথেষ্ট চিকিৎসা শুরু না করলে ওর মাকে আর বাঁচানো যাবে না,হাতে পায়ে ধরে কোনো মতে মাকে হাসপাতালে রাখার জন্য ডাক্তারদের মানিয়ে বাড়ি আসলো যদি কিছু করে কোথাও থেকে টাকা আনতে পারে,ঘরে এমন কিছুই নেই যেটা বিক্রি করে যথেষ্ট টাকা পাবে,কোনো সহায় খুঁজে পাচ্ছে না আরুশি,চারিদিকেই অন্ধকার যেনো হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে,ব্যার্থ হয়ে মেঝেতে পরে কাঁদতে লাগলো এবার,হঠাৎ চোখ পরলো একটা কাগজের উপর যেটা ঘরে মুল্যবান কিছু খুঁজতে গিয়ে নিচে পরে গেছিলো,হাতে নিলো আরুশি কাগজটা।

অবশেষে আর কোনো রাস্তা না পেয়ে অনেক বড় সিন্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো আরুশি।

আমাকে ক্ষমা করো আল্লাহ,আমার কাছে আর কোনো রাস্তা নেই।মাকে বাঁচানোর জন্য আমি সব করতে রাজি।

চলবে…….