দোটানা ২ পর্ব-১৬+১৭

0
416

#দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_১৬

সায়ান জীবনে এই প্রথম অনুতপ্ত অনুভব করছে।তবে তাও মানতে রাজি না তার নিষ্ঠুর মন।তবে নিজেকে কোনোভাবে বোঝাতেও সক্ষম হচ্ছে না।আরুশির জন্য আজ মনে বড্ড পীড়ন হচ্ছে তার।যদি সে ঠিক সময়ে না আসতো তবে আজকে কি হয়ে যেতো আরুশির সাথে।কথাটা ভাবলেই যেনো গায়ে কাটা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেনোই বা খারাপ লাগবে তার।ও তো নিজে থেকেই চাইছিলো আরুশির সাথে এমনটা হোক।কিন্তু এখন কেনো তা পীড়া দান করবে তাকে!নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে বাড়ি এসে পৌঁছালো সায়ান।নিজের রুমের দিকে যেতে নিলে চোখ পরলো আরুশির রুমের দিকে।রুমের দরজা অনেকটা খোলাই ছিলো যেহেতু আরুশিকে কোলে নিয়ে ঢুকেছে আয়ান,আজানোর প্রয়োজন মনে করে নি আর।তাই সায়ানের চোখ সোজা ড্রেসিংটেবিলের আয়নার দিকে গেলো যেখানে আয়ান আর আরুশির প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে,আরুশি আয়ানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা গুজে কান্না করছে আর আয়ান ব্যাথীত ভঙ্গিতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মুহুর্তটা যে ছুরিঘাতের মতো বিধলো সায়ানের বুকে।চোখে তার জল টলমল করতে লাগলো।মুঠো শক্ত করে চলে গেলো রুমে।

আরুশি অনেক কান্না করছে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে।আয়ানের বুকে যেনো সে এক শান্তির জগতের খোঁজ পেয়েছে আরুশি।অতি আবেগে মাথায় স্বাভাবিকতা অনেকটা গুলিয়ে গেছে তার।আরুশির এভাবে জড়িয়ে ধরাতে আয়ানের ভিতরেও আবেগের খেলা শুরু হয়েছে।তাই বর্তমানে স্বাভাবিকতার ছোঁয়ায় যে আয়ানও নেই। আরুশির ব্যাথা যেনো আয়ানও অনুভব করতে পারছে।ইচ্ছে করছে আরুশির সব কান্নার কারন মিটিয়ে দিতে।আরুশিকে বুকে আঁকড়ে ধরে লুকিয়ে রাখতে যেনো বাইরের কোনো বদ নজর আরুশির উপর না পরে।আরুশিকে সুরক্ষিত রাখার এক তীব্র পণ ধরা দিয়েছে আয়ানের মনে।অনেক্ষন নিরবতা পালনের পর এবার মুখে বাণী ফুঁটালো আয়ান।

হয়েছে আরুশি আর কেঁদো না।তুমি জানো তোমাকে কান্না করা মানায় না।তোমার মুখে হাসির বাসই যথার্থ।

আয়ানের কথায় আবেগের ঘোর অনেকটা কাটলো আরুশির।ইতস্তত বোধ নিয়ে ছেড়ে দিলো আয়ানকে।অল্প দূর হয়ে বসলো ওর থেকে।

আয়ানেরও অল্প দ্বিধা বোধ হলো তাই উঠে দাঁড়িয়ে নরম স্বরে বললো।

তুমি বসো আমি তোমার জন্য খাবার পাঠাচ্ছি।

আপনিও খেয়ে নিবেন।

হুম।

কথাটা বলে আয়ান রুমের বাইরে গেলো।

আরুশির জন্য খাবার পাঠিয়ে দিয়ে– আরুশি খাবার খেয়েছে তা নিশ্চিত হওয়ার পর সায়ানের রুমে গেলো আয়ান।

সায়ান চিৎ হয়ে শুয়ে আছে।মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে অজস্র ভাবনা।সাথে তিক্ত অনুভুতিও আছে মনের ভিতর।আরুশি ওকে জানোয়ার বললো।আজ প্রথম বার আরুশির চোখে নিজের জন্য অসীম ঘৃণা দেখে সহ্য করতে পারছে না সায়ান।আরুশি ওকে ঘৃণা করে, ওকে ভালোবাসে না মেনে নিতে পারছে না সে।বুকে চিন চিন ব্যাথা অনুভব করছে সায়ান।নিজের ভিতর চলা বর্তমান অনুভুতি সম্পর্কে অবগত হতে পারছে না,তবে কষ্ট হচ্ছে তার খুব।কষ্ট হওয়ার কারনটা না জানতে পারার ব্যার্থতাও তার কষ্ট আরও প্রখর করে তুলছে।সায়ান তো এমনই। ওর তো কারো জন্য কখনো না হয় দরদ,না হয় অনুতাপ।তবে আজ কেনো তা হবে!কেনো আজ অন্য মেয়ের মোহে পরলো না সায়ান?কেনো আরুশির খেয়াল মাথায় আসলো তখন অন্য মেয়ের সাথেও থাকা সত্ত্বেও!কেনো আরুশিকে ছোঁয়ায় মিরাজের উপর এমন ক্ষিপ্ত হলো সে!কেনো আরুশির শরীরের আঘাত তার বুকে পীড়া দান করলো!আরুশির চোখের জল কেনো তার সহ্য সীমার বাইরে চলে গেলো!পারছে না কোনোকিছুর জবাব খুঁজে বের করতে।এসব ভাবনায় পুরোই মাথা ধরে গেছে সায়ানের, হঠাৎ রুমে প্রবেশ করলো আয়ান।আয়ানকে দেখে সায়ান উঠে বসে ভ্রুকুঁচকে জিজ্ঞেস করলো?

আয়ান তুই এখানে?আয়ান সায়ান কখনোই একে ওপরের রুমে যায় না তাই আয়ানের এখানে আসা আশ্চর্য করলো সায়ানকে।আয়ান গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো।

আরুশিকে কেনো ওখানে এভাবে ডাকালি সায়ান?কি ক্ষতি করেছে ও তোর?কেনো ওর প্রাণের পিছন হাত ধুয়ে পরে আছিস?

দেখ আয়ান এসবে তুই নাক গলাতে আসিস না।আমি কি করেছি আমি জানি।এ বিষয়ে আমি পরে আরুশির সাথে কথা বলে নিবো।আর মনে রাখিস ও আমার হবু স্ত্রী তাই ওর থেকে তোর দূরে থাকাই ভালো।তুই ওর পাশে কম ঘেষলো খুশি হবে।

আয়ানের সামনে আরুশিকে নিয়ে অধিকার খাটিয়ে মনে প্রশান্তি পেলো সায়ান।তবে আয়ান ততোটাই চটে গেলো।তেড়ে গিয়েই সায়ানের নাক বরাবর একটা প্রবল ঘুষি বসিয়ে দিলো,সায়ান কাত হয়ে পরলো।আয়ান গর্জে বলে উঠলো।

কোন মুখে আরুশির সাথে আবারও কথা বলার কথা বলিস?আরুশি তোর হবু স্ত্রী বললিও কি করে! তুই ওর পায়ের কাছেও যাওয়ার যোগ্যতা রাখিস না আর আসিস ওর উপর হবু স্বামীর ক্ষমতা খাটাতে।
এবার সায়ানও চট করে উঠে এসে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো আয়ানের নাক বরাবর।আয়ানও একসাইড হয়ে পরলো। হুংকার দিয়ে বললো সায়ান।

তোর এতো কেনো জ্বলে আরুশিকে নিয়ে আমি অধিকার খাটালে?
এটাই সত্য ও আমার হবু বউ তুই মান বা না মান।

আজ দেখাবো তোকে সত্য কি আর মিথ্যে কি।

কথাটা বলে আয়ান সায়ানের উপর ঝাপিয়ে পরলো,শুরু হলো দুজনের লড়াই।তবে আজ কোনো মোরগা লড়াই হচ্ছে না হচ্ছে যেনো ষাঁড়ের লড়াই।আজ আর কেউ কারো চুল আর কাপড় ধরে টানছে না,লাথি ঘুষি শুরু হয়েছে দুজনের মধ্যে এই প্রথম বার।একে অপরকে যেনো প্রাণেই মেরে ফেলবে,মারামারির আন্দাজ পেয়ে বাড়ির সব চাকর বাকর ছোটে আসলো সেখানে।আরুশির পা কাটা তাই তড়িঘড়ি করে খুঁড়িয়ে এলো সেখানে যায়ানও এলো ছোটে।সবাই মিলে অনেক কষ্টে ওদের ছাড়ালো।আরুশি সায়ানকে ধরলোই না বরং আয়ানকে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে গেলো।চাকরেরা সায়ানকে ধরলে আয়ানকে টেনে টুনে বুঝিয়ে নিজেদের সাথে নিয়ে গেলো আরুশি যায়ান।আরুশি আয়ানকে নিজের রুমে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো আর যায়ানকে বললো সায়ানের কাছে যেতে।সায়ান চাকরদের ঝারি দিয়ে নিজেকে ছাড়ালো।সবাই ভিতু হয়ে ছেড়েও দিলো।গর্জে সবাইকে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে বললে সবাই বেড়িয়ে গেলো।যায়ান ছুটে আসলো সায়ানের কাছে।সায়ানের এক নাক দিয়ে রক্ত পরছে।এছাড়াও অনেক ছুটো খাটো আঘাত পেয়েছে শরীরে।আয়ানেরও এমনই হাল।দুজন সমানে সমানে ছিলো।যায়ান ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে সায়ানের কাছে এসে তার ক্ষত দেখতে চাইলে ওর হাত সরিয়ে দিলো সায়ান।ক্ষিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

আরুশি কোথায়?কারন তখন সায়ান আরুশিকে আয়ানকে ধরে নিজের সাথে নিয়ে যেতে দেখেছে।যায়ান স্বাভাবিক ভাবে বললো।

আরুশি আপু আয়ান ভাইয়াকে নিয়ে গেছেন নিজের রুমে।আর আমাকে পাঠিয়েছেন তোমার দেখবালের জন্য।

কথাটা আরও মন পোঁড়ালো সায়ানের।আমার কাউকে লাগবে না বলে যায়ানকে টেনে রুম থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিলো।তারপর রাগে টগবগ ভঙ্গিতে বিছানায় এসে বসলো আর মনে মনে ভাবতে লাগলো।

আয়ানকে নিয়ে গেলো নিজের সাথে করে।নিজ হাতে ওকে সেবা করবে আর আমার জন্য পাঠালো যায়ানকে।কেনো এমনটা করলো আরুশি?আমাকে কি তবে সত্যিই এতোটা ঘৃণা করতে লাগলো?আমাকে অবশেষে পর করে দিলো?দেক না পর করে আমার কবে থেকে ওর এটেনশন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভিতরে এলো!কেনো বার বার ওর খেয়াল আসে আমার মাথায়!ও থাকুক না যাকে তাকে নিয়ে পরে তবে তোর কি সায়ান?কেনো আজ ওর উপর অধিকার খাটাতে চাইলি,হবু বউ বলে স্বীকৃতি দিলি!তুই তো ওকে পছন্দ করিস না,ও তো তোর জন্য সামান্য রাস্তার মেয়ে তবে কোনো এখন টান হচ্ছে ওকে নিয়ে মনে! এমনটা তো আগে কখনো হয় নি কাউকে নিয়ে।কেনো এমনটা হচ্ছে? কেনো আমি শান্তি পাচ্ছি না! কেনো?

সায়ানের অশান্ত ভাব সময়ের সাথে বাড়ছে।অস্থিরতা কমাতে সিগারেট মুখে নিলো তবে তার নেশাতেও কোনো প্রশান্তি খুঁজে পেলো না।তাই বেড়িয়ে গেলো আবারও ম/দ্যের টানে।

আয়ানকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসালো আরুশি।তারপর ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আয়ানের পাশে এলো।ওর আঘাতে ওষুধ লাগাতে নিলে ওর হাত আটকালো আয়ান।রাগ দমিয়ে স্বাভাবিক ভাব নিয়ে বললো।

আমার লাগবে না ওসব।আমি ঠিক আছি।নিজে করে নেবো।তুমি কাটা পায়ে হাটতে গেলে কেনো?এতো কেয়ারলেস কেনো তুমি? রেস্ট করো এবার।আমি চলি।

চলি বলে চলতে নিলে আরুশি আয়ানের হাত পাকড়াও করলো।তাকে বিছানা থেকে উঠতে দিলো না।

চুপচাপ বসেন। মা বাবারা বলে গিয়েছেন বলে আমার খেয়ালই শুধু মাথায় রাখলে হবে না নিজেরও খেয়াল রাখতে হবে।অতঃপর আয়ানের ক্ষততে ওষুধ লাগাতে লাগলো আরুশি।আয়ান এবার নরম স্বরে বললো।

তোমার কেনো মনে হয় আমি তোমার খেয়াল শুধু মা বাবাদের কথায় রাখছি?

আমার খেয়াল রাখার তো আর অন্য কোনো কারন নেই আপনার কাছে।তাই না?
আয়ান কিছু বললো না বরং ভাবলেশহীন হয়ে চেয়ে রইলো আরুশির পানে।আরুশি ওর দিকে না তাকিয়েই বললো কথাটা।

ছাড়েন এসব।এটা বলেন এখন আপনি আবার সায়ানের রুমে কেনো গেছিলেন?

ও তোমার সাথে কেনো এমনটা করলো তা জানতে।ওকে এভাবে ছেড়ে দিলে তো হয় না।

দেখুন স্যার আপনি বা আমি বা বাবা মায়েরা সায়ানকে মেরে গালি দিয়ে এমনকি বুঝিয়েও সঠিক পথে আনতে পারবো না যদি সে নিজে থেকে সে পথে না আসে।সায়ান এখন ছোটো বাচ্চা না আর না তো আপনি,যথেষ্ট জ্ঞান আপনাদের দুজনেরই আছে।দেখুন সায়ান যতটুকু খারাপ করবে নিয়তি তার সাথে ততোই খারাপ করবে আর সেসব খারাপ পরিনাম থেকেই সে নিজের পাপ কর্ম সম্পর্কে অবগত হবে।তার প্রাশ্চিত্য করার চেষ্টা করবে।আল্লাহ ছাড় দেন ছেড়ে তো দেন না।আপনি কেনো শুধু শুধু আমার হয়ে ওর সাথে ঝগড়া করবেন?ও যতোই যেমনই হোক ও আপনার ভাই এটাই সত্য।এক মায়ের গর্ভ থেকে আপনাদের দুজনেরই আগমন এভাবে কথায় কথায় ঝগড়া করলে তো হয় না।

ও ভাই না ভাই নামের কলঙ্ক।ওর নিয়তি ওকে কি দেবে আমি জানিনা।তবে ও আজ তোমার সাথে যা করেছে তার জন্য আমি কখনোই ওকে ক্ষমা করবো না।আর বাবা মাকেও ওকে সাজা দিতে হবে।

দয়া করে কথাটা আর বাড়াবেন না।মা বাবাদের এসবে টানবেন না প্লিজ।

আমাকে এ বিষয়ে রিকুয়েষ্ট করতে এসো না আরুশি।আমি এখানে তোমার কোনো কথা শুনবো না।

আয়ান উঠে চলে গেলো নিজের রুমে।আরুশি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

সায়ান ম/দ্য হাতে নিয়েও আজ মনে শান্তি পাচ্ছে না।আরুশির নেশা যে গায়ে মেখেছে সে –অন্য নেশা আর গ্রাস করতে পারছে না।পাব এ গিয়ে দুই ঢোঁক ম/দ্য পান করলেও কোনো স্বাদ যেনো পেলো না।ম/দ্যের বোতল ছুড়ে ফেলে ভেঙে আবারও বাড়িতে আসলো।

আরুশি তখন আয়ানের রুমে খাবার নিয়ে যাচ্ছিলো দৃশ্যটা সায়ানের চোখে পরলো।আয়ান খাবার খায় নি চাকরদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে আরুশি।সায়ানের হৃদয় দহন আরও বাড়লো দৃশ্যটার ফলস্বরূপ ।রুমে চলে গেলো।নিজেকে আজ বড্ড একা আর অসহায় মনে হচ্ছে সায়ানের। তার শরীরে আঘাত অথচ আরুশির চোখে তা পরলো না,বরং আয়ানের আঘাতগুলোই চোখে পরলো আরুশির।সায়ানও তো খায় নি তবে সে খেয়াল তো আরুশি করলো না।খাবার নিয়ে গেলো আয়ানের জন্যে।সায়ানের এখনও মনে আছে সম্পর্ক চলাকালীন সায়ান যদি একটুও অসুস্থ হতো আর কথাটা আরুশির কানে যেতো তবে আরুশি অস্থির হয়ে পরতো।সারাদিন ফোন করতো।ওকে খোঁজে ওর কাছে আসতো।ওর সেবা করতো।ওর খাওয়া দাওয়ার কতো খেয়াল রাখতো।ওর জন্য পাগল হয়ে থাকতো সারাক্ষণ। ওকে ছাড়া তো আর কিছুই বুঝতো না।আর আজ ওকে চোখেই পরলো না তার।সায়ানের চোখে জল ছলছল করতে শুরু হলো মনের অশান্তিতে।

আয়ানকে জোর করে খেতে বাধ্য করলো আরুশি।আয়ান বরাবরের মতো আরুশির সাথে পেরে না উঠে খেতে বাধ্য হলো।আরুশি রিকুয়েষ্ট করলো আয়ানকে এসব কিছুই যেনে বাবা মায়েদের না বলে।তবে আয়ান তা মোটেও মানতে প্রস্তুত হলো না।দ্বিধায় পরলো আরুশি।

চলবে……….

#দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_১৭

সারারাত ঘুম হলো না সায়ানের। খুব ভোরের দিকে ঘুম লাগলো।তাই দেরি করে ঘুম ভাঙলো তার আজ।কিন্তু ঘুম থেকে উঠে নিজেকে দেখে অবাক হলো।ওর শরীরের আঘাতগুলোতে ওষুধ লাগানো।দরজাটা খোলা অবস্থায় রেখেছিলো সে রাতে বেখেয়ালবশত,হয়তো যায়ান এসে এসব করে গেছে ভেবে খুব রাগ হলো সায়ানের।কোনোরকম ফ্রেস হয়ে যায়ানকে খোঁজে বের করে ওর মাথায় ঝাপড় মেরে বললো।

তোকে মানা করেছিলাম না আমার গায়ে ওষুধ না লাগাতে।তবে এতো আহ্লাদ কেনো দেখাতে গেলি?কে বলেছিলো তোকে আমার শরীরে ওষুধ লাগিয়ে দিতে।

যায়ান কাদু মুখ করে বললো।

আমি কখন ওষুধ লাগালাম তোমার গায়ে।আমার যেনো বয়েই গেছিলো এতো।মনে হয় তোমার মাথা আয়ান ভাইয়ার মার খেয়ে পুরো গেছে তাই এমনটা করছো।কথাটা বলে বিরক্তি নিয়ে চলে গেলো যায়ান।সায়ান ক্ষিপ্ত হয়ে চাকরদের জিজ্ঞেস করলো কে ওর গায়ে ওষুধ লাগিয়েছে।তবে কেউ স্বীকার এলো না তাতে।আয়ানও তো সায়ানের গায়ে ওষুধ লাগাবে না আর একমাত্র বাকি থাকে আরুশি,এর মানে কি আরুশি ওর আঘাতে ওষুধ লাগালো।মনে এক রাশ ভালোলাগার খেলা শুরু হলো সায়ানের।

আজ আরুশি আয়ান অফিস গেলো না আয়ান অফিস বন্ধ দিয়েছি আজ নিজে।কারনটা সেই জানে কাউকেই জানায় নি।আরুশি নিজের রুমে আয়নার সামনে দাড়িয়ে গুনগুন করে গান করছিলো আর চুল আঁচড়াচ্ছিলো তখনি রুমে প্রবেশ করলো সায়ান।আরুশি কিছু বললো না যেনো ওকে দেখেও না দেখার ভান করলো।

সায়ান মৃদ্যু স্বরে বললো।

আমাকে কি দেখতে পারছো না?না দেখেও দেখতে চাইছো না?আরুশি এবারও নিরুত্তর যেনো কথাগুলো ওর কানেই গেলো না।ও নিজের মতো গুণগুণ করে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত।সায়ানের রাগ চড়লো তাতে প্রচন্ড,তাই অতি বেগে এগিয়ে গিয়ে আরুশির বাজু চেঁপে ধরে দাঁত কটমট করে বললো।

শুনতে পাও না আমার কথা?কি বলছি আমি?

ছাড়ো সায়ান আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই না।

আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না তবে ওই আয়ানের সাথে কেনো খিলখিল করো সারাদিন।এতো দরদ কেনো ওর জন্য?

ভালোবাসি উনাকে তাই এমনটা করি তোমার সমস্যা আছে এতে সায়ান?

তুমি আয়ানকে ভালোবাসতে পারো না।কারন তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসো খেয়াল আছে তোমার।আরুশির কথায় সায়ানের রাগ আরও বাড়লে কথাগুলো বলে প্রচুর চাপ দিয়ে ধরলো আরুশির বাজুতে যাতে আরুশির ব্যাথা লাগলো অনেক, এখানে যে মিরাজের নখের আঁচড়ও ফুটে আছে তাই আরুশি ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে, যাতে হতভম্ব হয়ে সায়ান ওকে ছেড়ে দেয়।

কি হয়েছে আরুশি কোথায় লেগেছে তোমার?আসলে আমি খেয়াল করি নি সরি।
এই প্রথম আরুশি সায়ানের চোখে নিজের জন্য অস্থিরতা দেখলো তাও সায়ান এই প্রথম ওকে সরি বললো।আরুশি অবাক হলেও তা ঝটফট কাটিয়ে হাসিতে ফেটে পরলো।সায়ান হতবাক ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

চমৎকার সায়ান তুমি চাইলে ইচ্ছে মতো ফস্টিনস্টি করতে পারো।কারে সুইটিকে নিয়ে ফুর্তি করতে পারো।ক্লাবে ক্লাবে মেয়েদের নিয়ে পরে থাকতে পারো।চাইলে যার তার মন নিয়ে খেলা করতে পারো।আমারও তো মন নিয়ে খেলা করলে।জোর করে আমার ভালোবাসা আদায় করলে তারপর ইচ্ছে মতো মন ভাঙলে,আমাকে অপমান করলে।রেপ করানোর জন্য গুন্ডা পাঠালে, প্রাণে মারার চেষ্টাও করলে আরও না জানি কতো কি আর এসব এতো কিছুর পরও তুমি আশা করো আমি তোমাকে ভালোবাসবো।মানে তুমি চাইলে সব করবে আর আমি এক তুমির অপেক্ষা করে থাকবো দিন শেষে।

কথাগুলো প্রচন্ড আঘাত করলো সায়ানের বুকে।ব্যাথা ভরা বাণীতে বললো।

তবে আমার আঘাতে ওষুধ কেনো লাগালে ভালোই যখন বাসো না?আমি তো তোমাকে ডাকি নি।

দেখো সায়ান মা বাবারা বাড়িতে নেই। উনাদের অনুপস্থিতিতে বাড়ির সবার খেয়াল রাখা আমরা একে ওপরের দায়িত্ব, সেই দায়িত্বজ্ঞান তোমার মাঝে নেই বলে তো তা আমার মধ্যে বিলুপ্তি পায় নি। তাই ওষুধ লাগিয়েছি এর থেকে বেশি কোনো কারন নেই এখানে।

সত্যিই কি বেশি কিছু না?

একদম না সায়ান।আর একটা কথা সামান্য রাস্তার মেয়ের কাছে সরি বলা কখন থেকে শিখলে শুনি।কোথায় গেলো দ্যা গ্রেট মি.সায়ান চৌধুরীর দম্য?হয়তো ভুলবশত সরি বলেছো আশা করি এমন ভুল সামনে থেকে করবে না।আর প্লিজ আমার থেকে দূরে থেকো ভালো লাগে না তোমাকে আমার।

আরুশি রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।সায়ানের ভিতরে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে সাথে ভয়ও।আরুশিকে কি সত্যি ও হারিয়ে ফেললো?আরুশির কি সত্যিই ওকে আর ভালো লাগে না।আরুশি কি সত্যিই আয়ানকে ভালোবাসে,মনে অজস্র প্রশ্ন নিয়ে সায়ান রুম থেকে বেরুলো তখন চোখে পরলো নিচে টেবিলে চলা আয়ান আরুশির দৃশ্য।আয়ান নাস্তা করতে বসেছে আর আরুশি ওকে সার্ভ করছে।ঘরে তো চাকরবাকরও আছে যথেষ্ট তবে আরুশি কেনো আয়ানকে সার্ভ করবে এতো আহ্লাদ কেনো দেখাবে আরুশি।সায়ানও তাই নিচে গিয়ে নাস্তা করতে বসলো।দুজন চাকর ওকে খাবার সার্ভ করে দিতে এগিয়ে আসলে সায়ান গম্ভীর কন্ঠে বললো।

যে সার্ভ করছে সে করলেই পারে।একজনকে উনি সার্ভ করবেন আর অন্যজনকে করবেন না এটা কেমন কথা।

আয়ান কথাটা শুনে সায়ানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো।তবে আরুশির আলাদা কোনো হেলদোল নেই,স্বাভাবিক ভাবে সায়ানের কাছে গিয়ে তাকে খাবার সার্ভ করতে লাগলো।আয়ান চটকে বললো।

ওকে তুমি সার্ভ করছো কেনো আরুশি?

আরুশি কিছু বলার আগে সায়ান বলে উঠলো।

তোর সমস্যা কি আয়ান তাতে?জ্বলে বুঝি তোর?

জ্বালাবো তো তোকে আমি দাঁড়া।

কথাটা বলে আয়ান উঠতে নিলে সায়ানও উঠতে নেয় তখনি আরুশি দুজনকে ধমকিয়ে বলে।

সাট আপ। কি আপনারা দুজন?চুপ করে বসেন কার কি লাগবে বলেন দিবো।ঝগড়া না করে প্লিজ খেতে থাকেন।

এবার দুজন শান্ত হয়ে বসে ফরমায়েশ করতে লাগলো।তবে সমস্যা হলো এক সময়ে দুজনেরই এক জিনিস চাই।একসাথে দুজন এক জিনিসের নাম বলে থাকে।এমনটা ওরা ইচ্ছে করে করছে না দুজনের এই সমস্যা দুজনের যখন যা চাই তখন এক জিনিসই চাই।পছন্দ আর প্রয়োজন যেনো দুজনেরই এক।তবে এখন তার ফায়দা উঠাতে চাইছে দুজন।ইচ্ছে করে এটা ওটা ডিমান্ড করছে যেনো আরুশি ওদের সার্ভ করে।এদিকে বেচারি আরুশি এক সাথে একই খাবার দুদিকে কিভাবে সার্ভ করবে।এদিকে ডিমান্ড করে করে নিজেদের প্লেট পুরো ভরে নিয়েছে দুজন।তবুও ডিমান্ড কমছে না।বেচারা যায়ান এক সাইডে প্লেট নিয়ে বসে অসহায়ের মতো ওদের কান্ড দেখছে।এদিকে আরুশি সহ্য করলো না আর এসব, এবার অনেক ক্ষিপ্ত হয়ে বললো।

এনাফ,অনেক হয়েছে আর না।কি পেয়েছেন আপনারা একটু ভালোমানুষি কেউ দেখালে তার মাথায় চড়বেন।যত্তোসব।নিজেদের হাত আছে নিয়ে খান আর আমাকে ছাড় দেন।

আপু আমি আলাদা আবদার করবো না,তুমি আদর করে যাই দিবো খাবো আমাকে একটু সার্ভ করে দেও না।

তুমিও নিজে নিয়ে খেতে পারো যায়ান।অতি বিরক্তির ফলে ঝারি মেরে কথাটা বলে চলে গেলো আরুশি নিজের রুমে।

যায়ান রেগে তাকালো আয়ান সায়ানের দিকে তারপর বললো।

আজ তোমাদের জন্যই আরুশি আপু আমাকে বকলো।আল্লাহ যেনো তোমাদের কপালে বউ না রাখেন।

অতঃপর যায়ান নাস্তার প্লেট নিয়ে চলে গেলো তার রুমে,আয়ান সায়ানও একে ওপরের দিলে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলো আর খেলো না।

কিছুক্ষণের মধ্যে মা বাবারা চলে এলেন।আয়ান সব জানিয়েছে উনাদের ফোনে তাই আজ বিয়ে থাকা সত্ত্বেও জোর করে উনাদের আসতে হলো,এজন্যই আয়ান অফিস বন্ধ দিয়েছে আজ।এসেই নিরব সোজা সায়ানের গালে একটা থাপ্পড় বসালো।তবে সায়ান কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না তেমন শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।ওর ভঙ্গিতে মনে হলো ও নিজেও এতে অনুতপ্ত।নিরব আবারও আরেকটা থাপ্পড় সায়ানের গালে বসাতে গেলে নিহান ওকে আটকালো।নিরব গর্জে বলে উঠলো।

আজ থেকে তোমার পকেট মানি বন্ধ।দেখবো কোন ক্লাব তোমাকে জায়গা দেয়।দাও তোমার ওয়ালেট।সায়ান ওয়ালেট না দিলে নিরব তার কাছে এসে তা কেরে নিলো।তারপর ওখান থেকে তার সকল কার্ড নিয়ে নিলো।

এসব কি করছো ডেড?এবার সায়ান অনেকটা প্রতিক্রিয়া দেখালো।নিরব রেগে আগুন হয়ে বললো।

আজ থেকে আমাদের পক্ষ থেকে তোমার সব আদিখ্যেতা বন্ধ। দেখবো এখন নিজে থেকে কি করো।

সায়ান দাঁড়ালো না সেখানে।বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

ও ফিরে আসলে ওর গাড়ির চাবিটাও নিয়ে নিস নিহান।আমি নিতে গেলে কিন্তু ক্যাল্যাঙ্কারি হবে।

রাগে ফুসতে ফুসতে রুমে চলে গেলো নিরব।আরুশিকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলো নিহান।

মা রে।মাফ করে দিও।কি করবো বলো আমরা।এই সায়ানটা এমন হবে কে জানতো।তবে আমরা আর ওকে তোমায় কষ্ট দিতে দিবো না দেখে নিও।

কি বলছেন ছুটো বাবা বাচ্চারা বিগড়ে গেলে এতে বাবা মায়ের কি দোষ হতে পারে।আপনি মাফ চেয়ে আমায় ছুটো করবেন না।

নিহান মৃদ্যু হেসে আরুশির গালে স্নেহের হাত ছুঁইয়ে চলে গেলো।

রাত হয়ে গেলেও সায়ান এখনও বাড়ি ফিরে নি তবে বড়রা সায়ান আর আরুশির ব্যাপারে অনেক বড় সিন্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন এতোক্ষণে।

আরুশি ভয় পাচ্ছে এবার যদি বিয়ের কথা উঠে তবে সে কি করবে।ওর উদ্দেশ্য তো সায়ানের বউ হবার কখনোই ছিলো না।

চলবে………..