ছায়া সঙ্গিনী পর্ব-০১

0
880

#ছায়া_সঙ্গিনী
#সূচনা পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

রাত দশটা ছুঁই ছুঁই, দরজায় কড়াঘাত হতেই আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দেখি ভাইয়া আসছে, আমি না দাঁড়িয়ে চলে আসতে নিলে ভাইয়া বললো,
-কে আপনি?
-আমি দুষ্টুমি করে বললাম,মার‌ওয়া’র আম্মু। তখন ভাইয়া ও দুষ্টুমি করে বললো,
-তাহলে তো আমার ছোট ব‌উ!
আমি ভাব নিয়ে বললাম, ইশশ্ মোটেও না। বুড়োর শখ কত!

আসলে উনি হচ্ছেন আমার একমাত্র দুলাভাই,আর উনার মেয়ে সাফা আর মার‌ওয়া মানে আমার ভাগ্নি, দুজন জমজ। ছোট জন মানে মার‌ওয়া,সে আমাকে আম্মু বলে ডাকে।সে জন্যই দু’জনে মজা করলাম।

ফিরে আসার সময়, ভাইয়ার দিকে এক নজর তাকাতেই লক্ষ্য করলাম, ভাইয়ার হাতে অনেক গুলো কোণ আইসক্রিমে।দিক পাশ না ভেবে, দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ার হাত থেকে একটা আইসক্রিম নিয়ে সাথে সাথে খেতে শুরু করে দিলাম। ভাইয়া তখন বললো,
-যেভাবে সাজগোজ করেছো, এখন আইসক্রিমের সাথে সব খেয়ে ফেলবে।
আমি তখন বললাম,খেলে খাবো তা-ও আইসক্রিম হাতছাড়া করতে পারবো না।
তখন ভাইয়ার বাম দিকে বাহিরের দরজাটা পুরোপুরি খুলে কেউ প্রবেশ করলো। আমি খেতে খেতেই আনমনে তাকালাম সামনের ব্যাক্তিকে দেখার জন্য। চোখ তুলে তাকিয়ে যাকে দেখলাম,তাতে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।
সামনের ব্যাক্তিও আমাকে এখানে এভাবে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না,তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।তার সাথে আরো তিনটা ছেলে,ঢুকলো দরজা দিয়ে, তখন সাফা আর মার‌ওয়া দৌড়ে এসে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিটাকে আঁকড়ে ধরে। তখন ব্যাক্তিটা ওদের দুজনকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
-মামা তোমাদের জন্য আইসক্রিম এনেছি! মামা কথা রেখেছে তোমাদের এবার বলো ফ্রেন্ড হবে তো?

লোকটার কথা শুনে, আমার হাতে থাকা আইসক্রিমের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে।এ বাসায় যে মেয়েটা কাজ করে লতা, ওকে ডেকে আমার হাতে থাকা আইসক্রিম টা ইঙ্গিত করে বললাম,
-এটা নিয়ে যাও, আমি একটু খেয়েছি। তোমার ইচ্ছে হলে খাবে না হয় ডাস্টবিনে ফেলে দিবে।

মেয়েটা কোন দ্বিরুক্তি না করে, মাথা কাত করে ডানে। তারপর চলে যায় এখান থেকে। তখন ভাইয়া বলে উঠলো,
-সেকি আয়রা তুমি তো আইসক্রিম খুব পছন্দ করো, তাহলে আইসক্রিম টা খেলে না কেন?
আমি তখন অজুহাত দেখিয়ে বললাম, আপনি ই তো বললেন, আমার সাজ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আর খেলাম না, এতো কষ্ট করে সেজেছি নষ্ট হতে দেই কি করে। আচ্ছা আমি যাই, আমাকে আবার ছবি তুলতে হবে।

আমার আইসক্রিম না খাওয়ার কারণটা ভাইয়া না বুঝলেও, অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটা ঠিক বুঝতে পেরেছেন।তা আমি খুব ভালো করে জানি, তাতে আমার কি? আমার খুব আনন্দ আনন্দ ফিলিংস হচ্ছে এতে। রুমে আসতেই আপু বললো, কিরে এতোক্ষণ কি করলি? তোর ছবি তোলার পর আমাকে সাফা,মার‌ওয়া’কে খাবার খাওয়াতে হবে।আয় তাড়াতাড়ি ছবি তুলে দেই।
আমার এখন ছবি তোলার মোড টাই নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু আপুকে বলা যাবে না সেটা।তাই বললাম, আচ্ছা তাড়াতাড়ি তোলে দাও। রুমের এক কোনায় গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন আপু বললো এখান থেকে বেশি ড্রয়িং রুমে সুন্দর হবে। আপুর কথা শুনে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললাম, না না এখানেই ঠিক আছে। কয়েকটা তুললেই হবে।

আপু ক্যামেরা অন করে রাখা মোবাইল টা নামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, কি ব্যাপার বলত? এতো কষ্ট করে শাড়ি পরে, সেজেগুজে এখন ছবি তোলার আগ্রহ নেই কেন? সেই সন্ধা থেকে লাফালাফি করে শাড়ি পড়লি অথচ এখন মনে হচ্ছে তোকে আমি জোর করে ধরে শাড়ি পরিয়েছি।

আপুকে কি করে বলবো, আমার এর মধ্যে কি হয়েছে? না না একদম বলতে পারবো না। আসলে, আমার যখন শাড়ি পরে ছবি তুলতে ইচ্ছে করে তখন রাত দশটা হোক আর বারোটাই হোক, ইচ্ছে হলেই হয়েছে। তখনই আমি শাড়ি পরে ছবি তুলতে শুরু করি। এটা আমার সেই স্কুল জীবন থেকেই অভ্যাস বলা যায়।আর সে কারণেই আজকে শাড়ি পরেছি।কে জানতো ভাইয়া কাউকে না জানিয়ে হুট করে, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত লোককে নিয়ে হাজির হবে!যাই হোক কোন রকম কয়েকটি ছবি তোলে আপুকে বিদায় করলাম। অবশ্য আপু এখন ড্রয়িং রুমে গিয়ে নিজেই বুঝতে পারবে, আমার মনের অবস্থা। মনে যখন আশাড়ের ধারার মতো কালো অন্ধকার ছেয়ে যায় তখন কি আর এসব শাড়ি সাজগোজ ভালো লাগে? একদম লাগে না। আমার ও তাই হয়েছে এই মুহূর্তে!
বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসলাম, এসে দেখি মার‌ওয়া আমার রেখে যাওয়া আইসেড দিয়ে নিজে নিজে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে করে কপালে চোখে লেপ্টে গেছে আইসেড দিয়ে।ওর এই অবস্থা দেখে, আমার প্রচন্ড হাসি পেলেও হাসলাম না।হজম করে নিলাম নিজের মধ্যে। ভেজা টিস্যু নিয়ে ওর মুখমন্ডল মুছে দিয়ে সুন্দর করে,আইসেড দিয়ে দিলাম। তখন রুমের বাহিরে থেকে কেউ ডেকে বললো,মার‌ওয়া মামুনি?
কন্ঠ স্বরের মালিক কে চিনতে বেশি সময় লাগলো না আমার! রাগে দুঃখে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলাম,যার ফলে হাতে ধরে থাকা আইসেডের গ্লাসটা ভেঙে বিঁধে গেল হাতে। সাথে সাথে যন্ত্রনায় কুঁকড়ে উঠলাম।টুপ টুপ করে রক্ত ঝরছে, সাদা টাইলস লাল রঙা ধারন করলো।মার‌ওয়া লোকটার কাছে দৌড়ে গিয়েও থেমে গেল। তারপর কি মনে করে আবার আমার কাছে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মু থেংকু।
নিজের বাম হাতটা পিছনে লুকিয়ে,ডান হাত দিয়ে মার‌ওয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে ছোট্ট পরস ছুঁয়ে দিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না,মার‌ওয়া চিৎকার করে বলে উঠলো, আম্মু নত্তো, আম্মু নত্তো!ওর কথায় বুঝতে পারলাম ও টাইলসের ঝরে পড়া রক্ত দেখে ফেলছে। শুধু তাই নয় ওর চিৎকারের শব্দ শুনে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটা বিনা অনুমতিতে রুমে চলে এলো!
পিছনে ফিরে তাকানোর সাহস হলো না আমার।তাই মার‌ওয়াকে বললাম, আম্মু এগুলো তেমন কিছু না। তুমি বাহিরে যাও আম্মু চেঞ্জ করবো। কিন্তু মার‌ওয়া মানতে নারাজ, সাড়ে তিন বছরের ছোট্ট মেয়েটির মস্তিষ্ক জুরে ঘুরছে যে তার আম্মুর নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। পিছন থেকে লোকটা ক্ষীণ স্বরে বললো,এনি প্রবলেম?
লোকটার কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো আমার। সাথে সাথে একটা ভেজা টিস্যু নিয়ে হাতের কাটা অংশটি মুড়িয়ে নিলাম।মার‌ওয়ার কালে হাত বুলিয়ে, লোকটাকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে ছাদে চলে এলাম। লোকটা হয়তো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তাতে আমার বিন্দুমাত্র যায় আসে না।
ছাদে এসে সস্তির নিঃশ্বাস নিলাম, হাতটা হয়তো অনেক গভীর ভাবেই কেটেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে ক্ষত বিক্ষত মনের থেকে বেশি নয়।

আজকের মতোই কোন একটি দিনে প্রথমবারের মতো আকস্মিক দেখা হয় লোকটার সাথে। আমি তখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি। আপুর তখন বিয়ের তিন মাস চলে, তো আপুর শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এলাম। বিকাল বেলা, ঘুম থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে ড্রয়িং রুমে এসে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার!ভাইয়ার সাথে সাত আটজন ছেলে বসে খোশ মেজাজে গল্প করছে আর কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে আমি পরে আছি টি-সার্ট আর প্লাজু, সাথে লম্বা পাতলা চুল গুলো সামনে পিছনে সমানভাবে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এই অবস্থায় আমাকে কেউ দেখলে গুনাহ তো হবেই তার সাথে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে।এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়তে পিছন ফিরে হাঁটা ধরতেই, একজন বলে উঠল, তুষার এই পিচ্চি কেরে?
সাথে সাথে সবার নজর আমার দিকে নিবদ্ধ হলো! আমি আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিলাম। কিন্তু কথা হচ্ছে গিয়ে, আমি তো বাথরুমে যাবো ফ্রেশ হতে। এদিকে আসর নামাযের সময় চলে যাচ্ছে।
তাই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম,অযু করতে যাবো। কারো জন্য নামায তো আর কাজা করতে পারি না।আপুদের ড্রয়িং রুমটা হাতের বাম পাশে,আর একটা বাথরুম ড্রয়িং রুমের সাথে বরাবর। আরেকটা হচ্ছে দুই রুমের মাঝে। কিন্তু ড্রয়িং রুমে বরাবর সোফায় বসলে,দেখা যায় কেউ রুমে বা বাথরুমে আসা যাওয়া করলে।
তো দরজা খুলে ঠিক করলাম দৌড়ে চলে যাবো বাথরুমে।
ঠিক তাই করলাম, একটা বড়সড় ওরনা নিয়ে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। একটা বড়সড় দম নিয়ে,যেই না ওরনা টা হ্যান্ডেলে রাখতে যাবো অমনি অনাকাঙ্ক্ষিত কোন এক পুরুষ কে দেখে বড়সড় এক চিৎকার দিতে নিলেই, একটা শক্তপোক্ত হাত চেপে ধরে আমার ঠোঁট জোড়ায়।
চোখ পাকিয়ে তাকালাম লোকটার দিকে, লোকটা তার বাম হাতের শাহাদাত আঙ্গুল তুলে বললো,হুশশ!একদম চেঁচাবে না। লোকজন শুনলে নিন্দা রটাবে। আমি বেড়িয়ে গেলে, দরজা ভিতর থেকে লক করে দিও।
আমি উহম উহম করে কিছু বলতে চাইলাম কিন্তু লোকটা তার সুযোগ না দিয়ে, বাথরুম থেকে বেরিয়ে গেল। তাই আমিও দরজা লক করে দিলাম। আসলেই কেউ দেখলে ক্যালেংকারী হয়ে যাবে। আপুর শ্বশুরবাড়ি বলে কথা।

আচ্ছা সেই অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটার পরিচয় পর্বটা শেরে নেই আগে। তিনি হলেন ভাইয়ার বন্ধুদের মধ্যে একজন, নাম রাহাত।ভাইয়াদের গ্রামের এক গ্রাম পরেই তাদের বাড়ি। সেদিনের পর থেকে ঘন ঘন তাকে আসতে দেখা যেত,ভাইয়াদের বাড়িতে।তার আগমন সবসময় আমাকে অপ্রস্তুত করে তুলতো! কেননা আমি যখনি এলোমেলো হয়ে ঘুরতাম তখনই তার দেখা মিলতো। এরকম একদিন, দুপুর বেলা ড্রয়িং রুমে সোফায় শুয়ে শুয়ে টেম্পরারি রান গেইম খেলছি আর ফেইসে চাল ডালের মিশ্রনের তৈরি ফেইস প্যাক লাগিয়ে রেখেছি। আকস্মিক কেউ এসে বিকট শব্দ তুলে!যার দরুন ধরাশ করে সোফা থেকে পরে গেলাম ফ্লুরে। মোবাইল টা হাতে থেকে পরে কোথাও যেন ছিটকে গেল, আর আমার মাথাটা গিয়ে লাগলো ট্রি-টেবিলের কোণায়।যার ফলে মাথা ফেটে রক্তের ধারা ব‌ইতে শুরু হলো! সেদিন ভেবেছিলাম সব দোষ রাহাত লোকটার কিন্তু সেরকম কিছু ছিল না। তবুও লোকটা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে আমায় পাঁজা কোলে তুলে নেয়, চিৎকার করে ভাইয়া কে ঢেকে সাথে নিয়ে হসপিটালে র‌ওনা হয়।
এর দুদিন পর লোকটা কে হসপিটালে দেখে, রাগে মাথা দপদপ করতে থাকে আমার।যাই যা নয় তাই কথা শুনিয়ে হসপিটাল থেকে বিদায় করেছিলাম।
সেদিন ভাইয়া মলিন মুখে বলেছিল,আয়রা কাজটা তুমি ঠিক করো নাই। এভাবে ওকে অপমান না করলেও পারতে। উপকারীর উপকার স্বিকার করতে হয়, সেখানে তুমি কিনা,,,
ভাইয়া ও বেড়িয়ে যান হসপিটালের কেবিন থেকে। পরে আপুর থেকে জানতে পারলাম, একটা বিড়াল কাঁচের ফুলদানিটা ভেঙে ফেলেছিল,যার ফলে এরকম শব্দ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আমার অবস্থা দেখে রাহাত লোকটা কাঁচের টুকরো গুলিতে পা রেখেই দৌড়ে আসে আমাকে উদ্ধার করবেন বলে!
_________
এই মুহূর্তে ছাদে দাঁড়িয়ে, পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে মনে বিচরণ করছি। হঠাৎ পাশে একটা ছায়া মানবের দিকে নজর পড়তেই, মনে হলো ভাইয়া এসেছেন। তাই বললাম, ভাইয়া আমি কিছুক্ষণ পর নিচে যাচ্ছি। আপনি নিচে চলে যান। আমার কথায় ছায়া মানবটা চলে গেল ঠিকই কিন্তু গেল ছাদের দরজা বন্ধ করতে!যার ফলে গা শিরশির করে উঠলো আমার,,,,

#চলবে?

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।)