দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0
569

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫৮
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

মিলির বাবা-মা দু’জনেই উপস্থিত হয়েছেন। হাসান তাদের সামনে বসা। আয়শা বেগম খাইরুল সাহেব দু’জনেও বসে আছেন। মিলির মায়ের চোখে পানি। আয়শা বেগম মিলির মায়ের দুঃখ বুঝতে পারছেন। মিলি সাধ করে এসেছিল এই ঘরে। কিন্তু নির্মম ভাগ্য তা হতে দিল না। কেড়ে নিল মিলিকে দুনিয়া থেকে। সব শেষ করে দিল। খাইরুল সাহেব নিজে মিলির বাবা-মাকে ফোন করে ডেকেছেন। কিছু সিদ্ধান্ত নিতে চান তারা। মিলির মা-বাবাকে এটা জানানো উচিত বলে মনে করেছেন তারা। যদিও আজ-কালকার ফ্যামিলিগুলো এইসব পাত্তা দেন না। কিন্তু তাদের সম্পর্কটাই অন্যরকম। তাই সবটাই জানাতে চান তারা।
সবই শুনলেন তারা৷ এবার তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানার পালা। মিলির বাবা সব দিক ভেবে বললেন,
‘মিলি নেই। না আছে ওর কোনো সন্তান। এখন সম্পর্কটা এমন যে, আমরা আপনাদের কিছু বলতে পারব না।’
খাইরুল সাহেব বললেন,
‘কেন বলবেন না? আর সম্পর্ক কেমন? আমাদের সম্পর্কটা আজীবনই থাকবে। মেয়ে নেই তার মানে এই না যে, সম্পর্ক থাকবে না। হাসান যেমন আপনাদের ছেলে হয়ে ছিল এখনও তেমন হয়েই থাকবে।’
মিলির মা সবই বুঝতে পেরেছেন। তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন। এরপর বললেন,
‘একই ঘটনা যদি মিলির সঙ্গে ঘটত তাহলে আমরাও দ্বিতীয় চিন্তা করতাম। হয়তো কয়েক মাস পর কিংবা বছর খানেক পর৷ আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা খুশি মনে রাজি আছি। আপনারা এগোতে পারেন।’
আয়শা বেগম কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,
‘বউ হয়ে এসেছিল আমার বাড়িতে। যেমনই ছিল, আমার মেয়ে হয়েছিল। আল্লাহ পাক কপালে যে এমন এমন রাখছেন, তা বুঝতে পারিনি।’
‘সেটাই। অনেক কান্নাকাটি করছি। ফিরে কি আসছে? ফিরে আসে নাই। কখনও আসবেও না। সবারই জীবন আছে একটা। আমরা চাই, হাসান নতুন করে সব শুরু করুক৷ আমরা মন থেকে রাজি। আর হাসান, অবশ্যই বাসায় যাবে।’
হাসানের কন্ঠনালী ধরে গেছে। কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে। তবুও বহু কষ্টে বলল,
‘আপনারা না চাইলেও আমি যাব ওই বাসায়। কারণ, ওই বাসায় মিলির ঘ্রাণ আছে। আর এই বাসায় মিলির অস্তিত্ব আছে। আমি যাব ওই বাসায়।’
আরও কিছুক্ষণ কথা হলার পর হাসান উঠে যায়। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেয় সে। মিলির ছবির দিকে তাকায়৷
‘অসময়ে আমায় ছেড়ে চলে গেলে তুমি। তোমার কাছে অনেক কিছু চাইবার ছিল। চাইবার সুযোগ দিলে না। সব সময় নিজেরটুকুন বুঝে নিয়েছ। আমারটুকুন বুঝে নেওয়ার সুযোগ দিলে না। আমার প্রতি রাগ হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু রাগও করতে পারি না। তুমি তো জানো, রাগপ আমার দ্বারা হয় না। জীবনে কখনও যেই কাজ আমি করিনি সেই কাজটাও করে ফেলেছি। দেখলে তো, তোমার চলে যাওয়াটা আমায় কতটা খারাপ বানিয়ে দিয়েছে। আমি তোমাকে কখনও ভুলতে পারব না মিলি। কখনও না। ভালোবাসি আমি তোমায়। তুমি শারীরিক রুপে আমার কাছে নেই এটা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি যে তুমি আমার মনে থাকবে। সারাজীবন। সাজিকে নিয়ে তোমার মনে কোনো রাগ রেখো না। সাজি তার জায়গায় থাকবে আর তুমি তোমার জায়গায়। আগেই বলেছি সাজি, আমি তোমায় সারাজীবন ভালোবাসব।’
হাসানের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। এই ঘরে রাখা মিলির কিছু ছবি আছে। ছবিগুলো সে সরাতে চায় না। এই বিষয়টা নিয়ে সে কথা বলবে।

অয়নন্দিতার হাতে একশো কাজ। সাজির বন্ধুরা এসেছে। মেহেন্দির অনুষ্ঠান চলছে। নায়াকে বকা ঝকা দিয়ে মেহেদী দিতে বসিয়েছে সে। নায়া মেহেদী দিতে চাইছিল না। সে কাজ করবে। এত কাজ অয়নন্দিতার উপর ছেড়ে নিজে বসে বসে মেহেদী দিবে এটা তার কাছে খারাপ লাগছিল। অয়নন্দিতা, রওশন বেগম বুঝিয়ে তাকে বসিয়েছে। নায়া এ বাড়িতে বউ না মেয়ের মতো চলতে পারে। কোনো বাধা নিষেধ নেই। শাশুড়ি যেন মা আর জা যেন বড়ো বোন। নায়ার কোনো কিছুতেই সমস্যা হয় না। বিয়ের আগে ফারাশ যেমনটা বলেছিল তার থেকে অধির আদর পায় নায়া এ বাড়িতে।
অয়নন্দিতার সব দিকে চোখ। সবার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে পরেরদিনের অনুষ্ঠানের সবটাই অয়নন্দিতা সামাল দিচ্ছে। বাইরের দিকটা ফারহান এবং ফারাশ দেখছে।
রান্নাঘরে অয়নন্দিতা কাজে ব্যস্ত। রওশন বেগম এসে সামনে দাঁড়ান। শাশুড়িকে দেখে অয়নন্দিতা বলে,
‘কী ব্যাপার, আপনি এখানে কী করছেন? আপনি হাতে মেহেদী লাগাননি কেন?’
‘বউ কি আমি নাকি তুমি?’
‘বউ তো স্টেজে। আমি তো বউয়ের ভাবী।’
‘তুমি আমার ছেলের বউ। আমার ঘরের লক্ষী। তুমি এখানে খেটে মরতেছ। কাজের মানুষরা সব গোছাবে। তুমি চলো, মেহেদী দিবে।’
‘মা, আমি এইগুলো শেষ করি। এরপর বসব।’
‘নাহ। বহু কাজ করেছ। ওইদিকে নায়ারও মেহেদী দেওয়া শেষ। ফারহান কয়েকবার এসে এদিক-ওদিক তাকিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আমার ছেলেটা তার বউকে খুঁজছে। চলো, বসবে চলো।’
‘মা, আমি পরে মেহেদী দিয়ে নেব।’
‘তুমি এখনি মেহেদী দিবে। নয়তো সাজি রাগ করবে। সাজি পাঠিয়েছে আমায়। এখনি চলো।’
শাশুড়ির আবদারে রাজি হয় অয়নন্দিতা। রান্নাঘর থেকে বের হবে এমন সময় শাশুড়ি ডাক দেয়।
‘অয়নন্দিতা।’
পেছনে তাকে অয়নন্দিতা।
‘জি মা।’
‘সবুজ শাড়িতে তোমায় খুব সুন্দর লাগছে।’
এক গাল হাসে অয়নন্দিতা। নিজের পরনের শাড়ির দিকে তাকায় একবার। মাথা উঁচু করে শাশুড়িকে থ্যাংকস জানিয়ে স্টেজের দিকে পা বাড়ায় সে৷
ফারহান কাজের ফাঁকে একবার স্টেজের দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখ এদিক-ওদিক। তার মিষ্টি বউকে খুঁজছে সে। যদিও অয়নন্দিতা বলেছিল, স্টেজে আমায় খুঁজে লাভ নেই। কারণ, আমি ব্যস্ত থাকব। তবুও তার নজর খুঁজছে অয়নন্দিতাকে।
ফারাশ আর নায়াকে চোখে পড়ে তার। নায়া তার হাতের মেহেদী দেখাচ্ছে ফারাশকে। তারা সেল্ফি তুলছে। নায়া ফারাশের কথা হাসছে। এদের দু’জনের জুটি টা বেশ সুন্দর। অয়নন্দিতাকে চোখে পড়ে ফারহানের। সবুজ শাড়িতে অসাধারণ লাগছে অয়নন্দিতাকে। রজনীগন্ধার মালাটায় অপূর্ব সুন্দর লাগছিল তার বউকে। পেছন থেকে সাজি এসে ভাইকে নাড়া দেয়।
‘কী দেখছ ওইদিকে?’
বোনের কথায় নিজেকে কন্ট্রোল করে ফারহান।
‘কোথায় কী দেখছি?’
‘মিথ্যা বলছ কেন? তুমি ভাবীকে দেখছিলে। তাই না’
বোনের কথাটা সত্যি। আসলেই সে তার বউকে দেখছিল। ফারহান এক নজর ফারাশ আর নায়া’র দিকে তাকায়। এরপর চট করেই মাথায় বুদ্ধি আনে।
‘সাজি, শোন না।’
‘বলো।’
‘তোর মেহেদী দেওয়া শেষ?’
‘এই দেখ৷ কী সুন্দর হয়েছে না।’
‘বাহ! খুব সুন্দর হয়েছে। এবার একটা কাজ করতে পারবি।’
‘কী কাজ?’
‘আমার মোবাইলটা নিয়ে যা। তোর ভাবী যেন না দেখে, কিছু ক্যান্ডিট ছবি তোল। না যেন দেখে।’
‘ওহ হো৷ ক্যান্ডিট ছবি!’
‘ইয়ার্কি না করে ছবি তোল গিয়ে।’
‘ওকে।’
ভাইয়ের কথায় সাজি স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়। সাজি হাঁটছে। এমন সময় সাজির মোবাইলে মেসেজ টোন বেজে ওঠে। যেখানে লেখা আছে, সাজি, জানি তুমি ব্যস্ত। ফ্রী হয়ে ফোন দিও। কিছু কথা বলব৷ সিরিয়াস কিছু ভেবে নিও না। নরমাল কথা বলব। মেসেজটা পড়ে সাজি মুচকি হাসে।

চলবে………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫৯
লেখা আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

সাজি ঘরে এসে ফোন করে হাসানকে। হাসান অপেক্ষাতেই ছিল। তাই ফোন রিসিভ করতে বেশি সময় লাগেনি তার। হাসানের হ্যালো বলার ঢংটা সাজির ভীষণ প্রিয়। অবশ্য হাসানের সব কিছুই তার ভালো লাগে। বলতে গেলে হাসান নামক গোটা মানুষটাকেই তার ভালো লাগে। সাজি কিছু বলবে তার আগেই হাসান বলে,
‘মেহেদী দেওয়া শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। তোমার কন্ঠস্বরটা এমন লাগছে কেন? তুমি কি কিছু ভাবছিলে নাকি?’
হাসান যতই সাজিকে দেখে, জানে ততই অবাক হয়। ইদানীং তার ধারণা হয়েছে সাজির মাঝে অদৃশ্য কোনো শক্তি কাজ করে যার দ্বারা সে সব কিছু জানতে পারে। হাসান ভাবছে, সে যে কিছু নিয়ে ভাবছিল এটা সাজি জানল কীভাবে? নাকি শুধুই কন্ঠস্বর শুনে আন্দাজ করেছে। যদি আন্দাজ করে থাকে তাহলে মেয়েটার প্রখর বুদ্ধি আছে। সবকিছুই ক্যাচ করে ফেলে। হাসান ধীর কন্ঠে বলল,
‘তেমন কিছুই হয়নি। মিছে টেনশন নিও না।’
‘তোমার গলার স্বরটাই বলে দিচ্ছে হয়তো কিছু হয়েছে নয়তো তুমি কিছু ভাবছিলে। তুমি যদি আমায় কিছু বলতে চাও বলতে পারো।’
‘মেহেদী দিয়েছ, ডিজাইনটা তো দেখালে না?’
‘তুমি তো ফ
ভিডিও কল দাওনি।’
‘একবার বলতে তাহলে চলেই আসতাম।’
‘কথা ঘোরাচ্ছ কেন হাসান? কী বলতে চাও বলো।’
হাসান ভাবছে, বলবে কি বলবে না। চিন্তা না করে বলে দেওয়াই ভালো। আফটার অল সাজির মনে কী আছে সেটা অন্তত বোঝা যাবে। হাসান গলা ঝাড়া দেয়।
‘সাজি, তোমায় কিছু বলতে চাই।’
‘হ্যাঁ, বলো। আমি শুনছি।’
‘আমার ঘরে মিলির কিছু ছবি আছে। দেয়ালে আমার আর মিলির বড়ো একটা ছবি টাঙানো আছে। সাজি, এই ছবিটা আমি…’
হাসানের কথা শেষ না হতেই সাজি বলে,
‘সরাতে পারবে না, তাই তো?’
হাসান সম্মতি জানায়।
‘হ্যাঁ। সরাতে পারব না।’
‘সরাতে হবে না। ওটা ওইখানেই থাকবে এখন যেখানে আছে। আর শুধু ওই ছবিটা কেন, বাকি এইগুলো আছে কোনোটাই সরাতে হবে না। আমরা বরং আমাদের একটা ছবি ফ্রেম করে বিছানার কাছে বেড টেবিলের ওপর রাখব। কেমন?’
হাসান ভেবেছিল সাজি আপত্তি করবে। ও যে এত সহজেই মেনে যাবে, এটা ভাবতেও পারেনি হাসান। এইজন্যই একা একা ভাবে, সাজি আসলেই অন্যরকম। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখে হাসান। ঘুমোতে হবে তাকে। আগামীকাল হলুদ পোগ্রাম। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে তাকে৷ রাতে ঠিকমতো ঘুম না হলে তার মাথায় পেইন হয়। আগে মাথায় পেইন হলে মিলি মাথা টিপে দিত। হাসান আপন মনে বলছে, কেন জানি প্রতিটা পদক্ষেপে মিলির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি আজ-কাল। প্রিয় মানুষটা চলে গেছে কিন্তু রেখে গেছে হাজারো স্মৃতি। যা ভোলার মতো না।

অয়নন্দিতার এমনিতেও মেহেদী দেওয়ার মতো ধৈর্য নেই। কোমর ভেঙে বসে থেকে মেহেদী দেওয়াটা শখ কম শাস্তি বেশি মনে হয় তার কাছে। শাশুড়ি আর ননদের কথা রাখতে গিয়ে মেহেদী দিতে বাধ্য হয়েছে সে। এখন ব্যাক পেইন উঠে গেছে। কোমর অতিমাত্রায় ব্যথা করছে। আজ দুই বউ দু’হাত ভরে মেহেদী দেওয়ায় কাউকে হাতে পানি লাগাতে দেননি রওশন বেগম। বড়ো একটা বোলে পোলাউ মাংস নিয়ে দুই বউ আর মেয়েকে খাইয়ে দিয়েছেন। রওশন বেগমের ছেলের বউদের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কেউ আবার মনে মনে হিংসা করেন। কেউ বা এটাকে আস্কারা ভাবেন। যদিও রওশন বেগমের ভয়ে কেউ মুখ খুলেন না।
খাবার শেষ করে অয়নন্দিতা নিজের ঘরে আসে। ফারহান সেই যে বাবার সঙ্গে হিসাবে বসেছে এখনও আসেনি৷ ওইখানেই খাওয়া দাওয়া করেছে। এদিকে অয়নন্দিতার কোমরের বারোটা বেজে গেছে। ইচ্ছে করছে হাতের মেহেদীগুলো ধুয়ে ফেলতে। কিন্তু এত সুন্দর ডিজাইন করা, তুলতেও ইচ্ছা করছে না তার। বিছানায় বসতে গিয়েও পেইন টের পাচ্ছে সে। এমন সময় ফারহানের প্রবেশ ঘটে৷ ফারহানকে দেখে অয়নন্দিতা বলে ওঠে,
‘এখন এলে তুমি?’
‘কেন, ব্যস্ত ছিলাম তো। কাল হলুদের পোগ্রাম। সেই সব নিয়ে আলোচনা করতে হলো। বাবার কিছু বন্ধুরা তাদের ফ্যামিলি নিয়ে আসবেন। তাদের ওয়েলকাম করতে হবে। সবটাই তো আমায় সামলাতে হচ্ছে।’
‘ভালো করেছ। এখন একটু এখানে আসবা প্লিজ। আমার মাথা থেকে ফুলের গহনাটা খুলে দাও না। আর কানের দুলগুলোও খুলে দাও। কোমরের অবস্থা খারাপ। প্রচুর পেইন হচ্ছে৷’
ফারহান তাকিয়ে আছে তার বউয়ের দিকে। বউ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক নাগারে এতগুলো কথা বলে দিল। ফারহানের পরবর্তী নজর অয়নন্দিতার কোমরের দিকে। আজ যেন কীচক শাড়ি পরেছে সে, কোমরের অংশ দেখা যাচ্ছে। ফর্সা কোমরটা সরাসরি ফারহানের চোখে বসেছে। এদিকে ফারহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অয়নন্দিতা বলে,
‘এই, দাঁড়িয়েই থাকবে? এসো না প্লিজ। আমার মাথা থেকে ফুলের গহনাটা খুলে দাও। শাড়ি পরেই খুলব। হাতে মেহেদী। শুকিয়ে গেছে অলমোস্ট, আরেকটু রেখে তুলে ফেলব। জানো, ওরা এত সুন্দর ডিজাইন করে দিল। আমার তো হাতে পানি লাগাতে একদম ইচ্ছে করছে না।’
অয়নন্দিতা কী বলছে সেদিকে কান নেই ফারহানের। সে দরজায় খিল দিয়েছে। মুহুর্তের মধ্যেই অয়নন্দিতার খুব কাছে চলে আসে সে। আয়নায় ফারহানের রিফ্লেকশন দেখতে পায় অয়নন্দিতা। তার পিঠের পুরো অংশ ফারহানের বুকের সঙ্গে মিশে আছে। ফারহান অয়নন্দিতার ঘাড়ে মুখ গুজেছে। ঘ্রাণ নিচ্ছে সে। তার মতে, অয়নন্দিতার শরীর থেকে ঘ্রাণ আসছে। একটা মাতাল করা ঘ্রাণ। অয়নন্দিতাকে কিচ্ছু বলতে দিচ্ছে না ফারহান। সে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু ফারহান আঙ্গুলের সাহায্যে তার মুখ বন্ধ করে দেয়। অয়নন্দিতার শরীর রি রি করছে। অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি জাগছে মনে। তবুও কম্পিত কণ্ঠে বলে,
‘ফারহান, খুলে দাও না প্লিজ।’
ফারহান নিজ হাতে অয়নন্দিতার মাথা থেকে ফুলের গহনা খুলে দেয়। কান থেকে দুল জোড়া খুলে দেয়। ফারহান তার দু’হাত অয়নন্দিতার কোমরে রাখে। শিহরণে অয়নন্দিতার চোখ বন্ধ হয়ে যায়।
‘ফারহান ছাড়ো। আমি শোবো। আমার ব্যাক পেইন হচ্ছে।’
ফারহান কোমরটা আরও চেপে ধরে বলে,
‘আমি ম্যাসাজ করে দিই। ভালো লাগবে তোমার।’
এই মুহুর্তে ফারহানের কন্ঠস্বর বলতে গেছে। মনে হচ্ছিল ফারহান নেশার ঘোরে আছে। অয়নন্দিতা আয়নায় দেখছে ফারহানের চোখ বন্ধ। সে চোখ বন্ধ করে অয়নন্দিতার ঘ্রাণ নিচ্ছে। অয়নন্দিতার দম বন্ধ লাগছে। সে চাপা স্বরে বলল,
‘উহু। লাগবে না। তুমি ছাড়ো, আমি বিছানায় যাব।’
‘আমি নিয়ে যাই।’
‘আমি হাঁটতে পারি। তুমি ছাড়ো।’
ফারহান অয়নন্দিতার কথা শোনেনি। সে অয়নন্দিতাকে কোলে তুলে নেয়। চোখ জোড়া তার লাল হয়ে আছে। অয়নন্দিতা বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। বিছানার পাশে দাঁড় করায় সে অয়নন্দিতাকে। কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল খুলে কোমর থেকে শাড়ির শেষ অংশ খুলে নেয়। অয়নন্দিতা চোখ বড়ো করে তাকায় ফারহানের দিকে। ফারহান তখন তাকে দেখছিল। আবারও কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। উপুর করে শুইয়ে দেওয়ায় অয়নন্দিতা ঘাবড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সে স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করে৷ ফারহান আলতো হাতে তার কোমর ম্যাসাজ করে দিচ্ছে৷ সেই অদ্ভুত অনুভূতি, অয়নন্দিতাকে আবারও চেপে ধরেছে। সহ্য করতে না পেরে বালিশ চেপে ধরে সে। দু’হাত ভর্তি মেহেদী তার। ফারহানের নাক অবধি মেহেদীর ঘ্রাণ পৌঁছে গেছে।
অয়নন্দিতা ফারহানের হাতকে বাধা দেয়। সোজা হয়ে শুয়ে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ফারহান দেখছে, এক অপরুপা নারী অর্ধ নগ্ন অবস্থায় তার সামনে শুয়ে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ওঠানামা করছে বলে বুকটা তার উঁচু-নিচু হচ্ছে। অয়নন্দিতাকে এর আগেও এমন বহুবার দেখেছে সে। তবে আজকের দেখাটা অন্যরকম। আজকের দেখাটা তার কাছে স্বর্গীয় সুখ। অয়নন্দিতা মেহেদী ভর্তি হাতেই ইশারা করে ফারহানকে। ইশারা পেয়ে ফারহান অয়নন্দিতার খুব কাছে চলে আসে। ফারহানের বুকে হাত রেখে অয়নন্দিতা ইশারা করে লাইটের দিকে। লাইট জ্বালানো। ফারহান লাইটের দিকে তাকিয়ে একটা ভঙ্গি করে। যা দেখে অয়নন্দিতা হেসে দেয়৷ ফারহান লাইটটাও বন্ধ করে। আবারও দু’জন দু’জনার কাছে চলে আসে। ফারহান-অয়নন্দিতা একে অপরকে দেখছে।
এক পর্যায়ে অয়নন্দিতা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ফারহান অয়নন্দিতার গলায় ঠোঁট ডোবায়। অয়নন্দিতার সারা শরীরে শিহরণ জাগে অতিমাত্রায়। ফারহানের হাতের চাপে শুকনো মেহেদীগুলো গুড়িয়ে গুড়িয়ে পড়ছে চাদরে। অয়নন্দিতার আপাতত মেহেদীর দিকে মন নেই। তার মন এখন ফারহানের মধ্যে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ফারহানকে আঁকড়ে ধরে সে।
হঠাৎই দরজায় কড়া পরে। দরজার ওপাশ থেকে সাজি ডাকছে।
‘ভাবী, একবার বাইরে এসো। একটু দরকার আছে।’
অয়নন্দিতার কানে সাজির কন্ঠস্বর লাগে৷ ফারহানও শুনতে পায় তার বোনের কন্ঠস্বর। কিন্তু তাদের একজনেরও উঠতে মন চাইছে না। নেশায় আসক্ত দু’জন পায়রা নিজেদের মিলনে ব্যস্ত। চারপাশের শব্দ কানে যাচ্ছে না। সাজি আরও কয়েকবার ডেকেছে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে চলে যায়। কিছুটা পথ হাঁটার পর সাজি পেছনে ফিরে তাকায়।আন্দাজ করতে পারে ঘটনা, যা ঘটে যাচ্ছে। হালকা হেসে নিজের ঘরে চলে যায় সাজি।
একের পর এক নিঃশ্বাস পড়ছে। গরম নিঃশ্বাস। অয়নন্দিতা জড়িয়ে আছে ফারহানকে। আর ফারহান জড়িতে আছে অয়নন্দিতাকে৷ আপাতত দুনিয়া যাক ভার ম্যায়। তারা দু’জন খানিকটা সময় সুখ বিনিময় করুক।

চলবে……………………………..

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৬০
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

একই শহরে দুই পরিবারের অবস্থান বলে দুই পরিবার একত্রেই হলুদ পোগ্রামের আয়োজন করে। রাত আটটা নাগাদ হাসানরা পৌঁছে যায়। অয়নন্দিতা সবদিক সামলে নিয়ে নিজেও তৈরি হয়ে গেছে। আয়নায় নিজেকে দেখছে আর নিজের বিয়ের কথা মনে করছে অয়নন্দিতা। একদিন সে-ও হলুদ পোগ্রামে বসেছিল। বিয়ের দিন বউ সেজেছিল। রুপকথার রাজপুত্র তো ঘোড়ায় চড়ে আসে কিন্তু তার মনের রাজপুত্র সেদিন গাড়ি করে এসেছিল। ফারহানকে মনে করতে করতে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে অয়নন্দিতার।
কোনো এক প্রয়োজনে ফারহান ঘরে প্রবেশ করে। আয়নার সামনে কোনো এক হলুদ পরীকে দেখে ভড়কে যায় সে। পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে করতে এক পা দু পা বাড়ায় ফারহান। হলুদ রঙের জামদানী শাড়ি পরে তাকে একটা সূর্যমুখীর মতো লাগছিল। সেই সাথে হালকা গহনা সৌন্দর্যের মাত্রাকে আরও দ্বিগুণ করে দিয়েছে৷ চুলের খোঁপায় বেলীফুলের মালাটা ত্রিমাত্রায় ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। ফারহান না চাইতেও বেলীফুলের ঘ্রাণে মত্ত্ব হয়ে যেতে বাধ্য হয়। সে একদম অয়নন্দিতার কাছে এসে দাঁড়ায়। নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেয় অয়নন্দিতার। ধরা গলায় বলে ওঠে,
‘এই মেয়ে, একই সঙ্গে এত রুপ কেন তোমার?’
ফারহানের গালের সঙ্গে নিজের গাল মিশিয়ে অয়নন্দিতা বলে,
‘কত রুপ পেয়েছ?’
‘বলব?’
‘হু।’
‘হলুদ শাড়িতে সূর্যমুখী। খোঁপায় দেওয়া বেলীফুল। সব মিলিয়ে হলুদ পরী। একই সঙ্গে এত রুপ। আমি তো পাগল হয়ে যাব।’
‘পাগল হলে সামলে নেব।’
ফারহান অয়নন্দিতার কোমরে হাত রাখে। শিউরে ওঠে অয়নন্দিতা। ঘাড়টা সরিয়ে নেয়। ফারহান সেখানেও সুযোগ নেয়। চট করেই ঘাড়ে চুমু দেয় অয়নন্দিতার। অয়নন্দিতা নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফারহানের দিকে ঘুরে যায়।
‘সুযোগ পেলেই এমন করতে হবে তোমার, তাই না?’
‘সুযোগ আর দিলে কই?’
‘সুযোগ না দিতেই এত কিছু। সুযোগ দিলে তো আমায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
‘হুশ, কথা বোলো না। ভালোবাসতে তো দাও না।’
এমন সময় ফারহানের ফোন বেজে ওঠে। ফোন বের করে দেখে ফারাশ নিচ থেকে ফোন করেছে। অয়নন্দিতাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
‘নিচে যেতে হবে। তুমি এসো তাড়াতাড়ি।’
ফারহান পা বাড়াতেই অয়নন্দিতা ফারহানের হাতটা ধরে নেয়৷ বাধা পেয়ে ফারহান ঘুরে তাকায় অয়নন্দিতার দিকে। ইশারায় জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে? উত্তরে অয়নন্দিতা বলে,
‘আমার ভালোবাসা দিয়ে এরপর এ ঘর থেকে বের হবে। নয়তো বের হতে দেব না।’
ফারহান এক চোখ উঁচু করে তাকায় অয়নন্দিতার দিকে।
‘আমায় আটকে রাখার শক্তি আছে তোমার?’
‘আমি শক্তি প্রয়োগ করতে পারি না। আমি ভালোবাসার বিনি সুতোয় বেঁধে ধরব তোমায়। ভালো না বেসে তুমিও এই বাঁধন ছেড়ে বের হতে পারবে না।’
ফারহান এগিয়ে আবারও অয়নন্দিতার সামনে দাঁড়ায়। কোলে তুলে নেয় অয়নন্দিতাকে। বিছানায় শুইয়ে দেয় তাকে। হঠাৎই কে যেন নিচে গান চালিয়েছে। সেই গানের শব্দ উপরে আসছে৷ গানটা দু’জনেরই কানে লাগছে। লিরিক শুনে অয়নন্দিতার মনে পড়ে এই গানটা তো তার ভীষণ প্রিয়৷ “দিল কি তাপিশ আজ হ্যায় আফতাব, বাজি মুরে দিল কি তাপিশ আজ হ্যায় আফতাব”— ফারহান অয়নন্দিতার একটা হাত নিজের হাত দিয়ে আটকে দেয়। অনেকটা ঝুকে পড়ে অয়নন্দিতার দিকে। অয়নন্দিতাও চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। ফারহান গুনে গুনে সাতটা চুমু দেয় অয়নন্দিতার পুরো মুখ জুড়ে। অয়নন্দিতাকে বসিয়ে রেখে ফারহান পা বাড়াতে গেলে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে অয়নন্দিতা। ফারহান বুঝে গেছে আজ তার বউ তাকে ছাড়তে চাইছে না। অয়নন্দিতা ফারহানের সামনে দাঁড়িয়ে পা জোড়া উঁচু করে ফারহানের কপালে চুমু খায়।
‘রাতে সবটা পুষিয়ে দেব। কথা দিচ্ছি।’

হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। সাজি আর হাসান পাশাপাশি বসে আছে। হাসান আড় চোখে দেখছে সাজিকে৷ হলুদ আর মেরুন রঙের কম্বিনেশনের শাড়িতে অপূর্ব লাগছিল সাজিকে। এক এক করে সবাই এসে তাদের হলুদ মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আজ নায়াকেও পরীর মতো লাগছে। রওশন বেগম মেয়ে, ছেলের বউদের দিকে তাকিয়ে আছেন আর মনে মনে একশো বার মাশা-আল্লাহ পড়ছেন। একটাই দোয়া তার, তার সংসারে যেন কারো নজর না লাগে।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সবাই অয়নন্দিতাকে নাচার জন্য অনেক রিকুয়েষ্ট করে। কয়েকবার না করার পর ফারহানের ইশারা পেয়ে রাজি হয়। ফারাশ মিউজিক প্লে করে। সাউন্ড সিস্টেমে গান বাজছে। “দিল টুটা, জাগ ছুটা, তু রুঠা, রাব রুঠা”— গানের তালে অয়নন্দিতার পা পড়ে। ফারহান বিমোহিত দর্শকের মতো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার দিকে। নায়া ভিডিও করছে। ফারাশও মায়া ভরা তাকিয়ে আছে তার রাজরানীর দিকে৷ হাসান সাজি দু’জন দু’জনের হাত শক্ত করে ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর পর দু’জন দু’জনকে দেখছে। হাসান সুযোগ বুঝে সাজির কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে সাজির সৌন্দর্যের প্রশংসা করছে।
আপাতত চারপাশের কোলাহল ফারহানের কানে ঢুকছে না। তার কানে কেবল সাউন্ড সিস্টেমে প্লে করা গানটা বাজছে আর চোখের সামনে অয়নন্দিতা নাচছে। সে এত দিনেও জানত না যে, তার বউ এত সুন্দর নাচে। নাচের মধ্যে এক সময় অয়নন্দিতা ফারহানের সামনে চলে আসে। হাতের ভঙ্গিতে ফারহানের সামনে নাচছে সে৷ এরপরই গানটা শেষ হয়ে যায়। সেখানে উপস্থিত সবাই হাত তালি দিয়ে অয়নন্দিতার নাচের প্রশংসা করে। অয়নন্দিতা ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহান হাতের বুড়ো আঙ্গুল এবং তর্জনী আঙ্গুলের সমন্বয়ে ভঙ্গিমায় তার বউয়ের নাচের প্রশংসা করে। অয়নন্দিতা খানিকটা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।

চলবে…………………..