দ্বিতীয় সূচনা পর্ব-৫০+৫১+৫২+৫৩

0
474

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫০
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

অয়নন্দিতার মন ভালো করার জন্য ফারহানের ছোট্টো প্রয়াস। অয়নন্দিতাকে নিয়ে কফি ডেটে এসেছে ফারহান।কিন্তু কিছুতেই মন ভালো করতে পারছে না। মিলির ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক। আল্লাহ পাকের দুনিয়ায় মানুষের জীবনের সত্যিই কোনো মূল্য নেই। ফারহান হাতের কাজগুলো ফেলে অয়নন্দিতার মন ভালো করার জন্য এতকিছু করছে কিন্তু মেয়েটা অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। ফারহান ভাবছে, এইভাবে কাঁদলে শরীর খারাপ হবে। বোঝাতে হবে তাকে।
‘অয়নন্দিতা, কী হয়েছে তোমার। তুমি এখনও আপসেট?’
টিস্যু দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা পানিগুলো মুছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে অয়নন্দিতা বলে,
‘আমি চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। মিলি ভাবীর অসুস্থতা আমায় কষ্ট দিচ্ছে। আমি মেনে নিতে পারছি না।’
‘কিন্তু আমাদের যে মেনে নিতে হবে। এছাড়া উপায় নেই তো।’
‘আল্লাহ পাক এটা কেমন কাজ করলেন। হাসান ভাইয়ার অবস্থা দেখলে তুমি বুঝতে। মানুষটা কেমন ছিল আর কেমন হয়ে গেছে।’
‘আমার কথা হয়েছে আজ হাসানের সঙ্গে। তবে সে যথেষ্ট শক্ত একজন মানুষ। সে বোঝে এতে তার কিংবা অন্য কারো হাত নেই। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, তার সব থেকে প্রিয় এবং কাছের মানুষটা হয়তো কিছুদিন পর হয়তো তার সঙ্গে থাকবে না। কিন্তু এটাই যে নিয়তি এটা তিনিও মেনেছেন।’
‘হাসান ভাইয়া বরাবরই এমন চুপচাপ থাকেন। ভেতরে কষ্ট হলেও চেপে রাখেন।’
‘কফি এসে গেছে অয়নন্দিতা। কফিটা খাও। আমি তোমাকে শত বুঝিয়েও তোমার মন ভালো করতে পারব না যদি না তুমি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হবে।’
অয়নন্দিতা ভাবছে হয়তো ফারহান ঠিকই বলেছে। সে কফির মগে হাত রাখে। চুমুক দিয়ে কফির স্বাদ গ্রহণ করে।
‘ফারহান, প্লিজ তুমি রাগ কোরো না। আসলে আমি জীবনে এতকিছু উপলব্ধি করেছি তো। বিশেষ করে প্রিয় মানুষগুলোর মৃত্যু। তাই মেনে নিতে পারি না৷’
‘আমি রাগ করিনি অয়নন্দিতা। রাগ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে, তুমি নিজের মনকে ঠিক করো প্লিজ।’
‘আই উইল ট্রাই।’
ফারহান হালকা হেসে অয়নন্দিতাকে দেখতে থাকে। আর অয়নন্দিতা পর পর কফির মগে চুমুক দিতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পর ফারহান আর অয়নন্দিতা এমন কিছুর সম্মুখীন হয় যার জন্য তারা কেউই তৈরি ছিল না।
অত্যন্ত অবাক হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ফারহান। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে ব্ল্যাক আউট হয়ে যায়। এই কয়েক সেকেন্ডেই তার মস্তিষ্ক অতীতের সব কিছু রিভাইন করে নেয়। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে অয়নন্দিতা আরও একবার হতবাক হয়ে যায়।
কিছু কিছু মানুষের নূন্যতম লজ্জাটাও থাকে না। এই মুহুর্তে সামনে থাকা মানুষটাকেও তেমন লাগছে ফারহানের কাছে। বন্দনা একবার ফারহানকে দেখছিল আবার অয়নন্দিতাকেও দেখছিল। কিছু সময়ের জন্য তার মস্তিষ্ক তাকে বলছিল অয়নন্দিতা তার খালি জায়গাটা দখল করে ফেলেছে। যেই ফারহানের সবটা জুড়ে একদিন সে ছিল এখন সেই ফারহানের সবটা জুড়ে আছে অয়নন্দিতা। অন্যদিকে, অয়নন্দিতা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিল তার উপর এখন বন্দনাকে আরও একবার নিজের চোখের সামনে দেখতে হচ্ছে বলে রাগ হচ্ছে। নির্লজ্জ বেহায়ার মতো বন্দনা ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ফারহান, সেও বন্দনাকে দেখছিল। গাঢ় নজরে দেখছিল যা অয়নন্দিতাকে ক্ষতবিক্ষত করছিল। নীরবতায় ইতি টেনে বন্দনা বলতে শুরু করে।
‘কেমন আছো তুমি?’
হয়তো এই প্রশ্নটা ফারহানের কাছে কমেডি বলে মনে হয়েছে। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে ফারহান যা বন্দনাকে ভেতর থেকে রক্তাক্ত করছিল। ফারহান হাসি থামিয়ে জবাব দেয়,
‘এতক্ষণ যাবত ভীষণ ভালো ছিলাম। কিন্তু এই মুহুর্ত থেকে আমি ভালো নেই।’
‘মানে?’
‘মানেটা হচ্ছে, একজন নারী কতটা নির্লজ্জ আর বেহায়া হতে পারে তা তোমায় না দেখলে বুঝতে পারতাম না।’
‘এক্সকিউজ মি!’
‘কোন সাহসে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ?’
‘দাঁড়ানোর জন্য সাহস লাগে বুঝি?’
‘এটাও তো ঠিক। কিছু কিছু বেহায়ার জন্য সাহস লাগে না।’
‘ফারহান, মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ।’
ফারহান আবারও হাসে।
‘মাইন্ডিং মাই ল্যাংগুয়েজ। বাট, তোমায় দেখার পর আমার একটা কথাই মস্তিষ্কে ঘুরঘুর করছে। আর তা হচ্ছে, তুমি একজন বেহায়া, নির্লজ্জ মেয়ে মানুষ। তোমার চেহারা যতটা সুন্দর ভেতরটা ততটাই কুৎসিত। অনেকটা মাকাল ফলের মতো।’
এবার বন্দনাও হাসে।
‘যাক স্বীকার তো করলে আমি দেখতে সুন্দর।’
‘হ্যাঁ। মাকাল ফল।’
অয়নন্দিতার রাগ হচ্ছে। মন চাইছে এক চড়ে বন্দনার দাঁতগুলো ফেলে দিতে। কিন্তু শত হোক, বন্দনা তার বরের এক্স ওয়াইফ। সেই হিসেবে কিছুটা সম্মানের পাত্রী সে নিজেও। অথচ ফারহান তার সম্মানের ছিঁটেফোঁটাও রাখছে না। অয়নন্দিতা চুপচাপ ততক্ষণে বসে পড়সছে। ভাবছে, দাঁড়িয়ে থাকার থেকে বসে কফি খেতে খেতে এদের কনভারসেশন শোনা উত্তম। এদিকে ফারহানকে বলতে শোনা যাচ্ছিল যে,
‘তোমার বর কী ভেবে যেন আমাদের রেগুলার ডিলারদের ধরে আমাদের কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে চাইছে। তোমার ওই গাধা বরকে বলে দিও সে যা চাইছে তা কখনও হবে না।’
‘ইনসাল্ট করছ তুমি আমায়।’
এবার আর অয়নন্দিতা কথা না বলে থাকতে পারল না।
‘ইনসাল্ট হওয়ার জন্য আপনিই এলেন। যেচে পড়ে এসে কেউ অপমানিত হলে অপরপক্ষের দোষ কোথায়?’
কথাটা শুনে বন্দনা অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। সে দেখতে পায় অয়নন্দিতা বসে আছে। কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। এবার ফারহানও বসে পড়ে। ফারহান মনে মনে বলছে, যাক, আমি বেঁচে গেছি। এবার আসল মানুষ কথা বলা শুরু করেছে। খেলা তাহলে ভালোই জমবে।
বন্দনা দাঁত মুখ খিটে বলতে শুরু করে,
‘হু আর ইউ? এন্ড হাউ ডেয়ার ইউ?’
অয়নন্দিতা মুচকি হাসে।
‘আই এম অয়নন্দিতা। ওয়াইফ অফ ফারহান শেখ। পড়ের উত্তরটা আমি দিতে বাধ্য নই। বাই দ্যা ওয়ে, আপনার স্বভাবটাই এমন, যেখানে সেখানে যখন তখন হুটহাট অপমানিত হতে চলে আসেন।’
অয়নন্দিতার কথা শোনার পর বন্দনার পুরো শরীরে যেন আগুন লেগে যায়৷ আগুন রাঙা চোখে সে অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর অয়নন্দিতা ততক্ষণে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ মুখে কাঠিন্য ভাব এনে বলে,
‘গেট আউট অফ আওয়ার লাইফ।’

চলবে……………………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫১
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

আননোন নাম্বার থেকে ফোন। হাসান ব্যস্ততার মধ্যে থাকায় রিসিভ করতে পারেনি। ফোন ব্যাক করার মতো সিচুয়েশনেও ছিল না। লাঞ্চ আওয়ার পড়লে ছুটে যায় বাড়ির দিকে। সেখানে মিলি তার জন্য অপেক্ষায় থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মিলির সঙ্গে দেখা করে অফিসে ফিরে এসে কাজে মন দেয় হাসান। মিলির পাসপোর্ট রেডি হচ্ছে। সব কিছু ঠিকমতো থাকলে সামনের মাসে তারা দু’জন ইন্ডিয়া যাবে। সেখানে মিলির চিকিৎসা করাবে। কম্পিউটারে চোখ রাখতেই ফোনটা আবারও বেজে ওঠে। এবার রিসিভ না করলেই নয়। হাসান ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।’
সালামের জবাবের পরিবর্তে ওপাশ থেকে নীরবতা ভেসে আসে। হাসান আবারও বলে,
‘কে বলছেন?’
‘নাম না বললে চিনতে পারবেন না?’
কন্ঠস্বরটা ধরতে না পেরে হাসান আবারও প্রশ্ন করে,
‘কে বলছেন?’
‘আমি সাজি বলছিলাম।’
‘সাজি!’
অনেকটা অবাক হয় হাসান। অসময়ে তাকে ফোন করেছে। কারণ কী?
‘সাজি, হঠাৎ তুমি ফোন দিলে?’
‘কেন, দিতে পারি না?’
‘নাহ, তা না। এর আগে তো কখনও ফোন দাওনি। তাই আর কি?’
‘এর আগে ফোন দিলে কি আপনি খুশি হতেন?’
সাজির কথাগুলো ভালো লাগছে না তার। এমনিতেই তার অনেকদিক সামাল দিতে হচ্ছে। তার উপর সাজি নামক প্যারা নতুন করে ঝামেলা করছে।
‘বলো, কী বলবে? বাসায় সবাই কেমন আছে? অয়নি কেমন আছে?’
‘সবাই ভালো আছে। আপনি কি ব্যস্ত?’
‘হ্যাঁ। অনেকটা।’
‘ওকে। কাজ করুন। এটা আমার নাম্বার। পরবর্তীতে ফোন দিলে বলবেন না যেন যে, আমি কে?’
‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?’
‘বলার তো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু সুযোগ নেই।’
‘ভালো থাকো তাহলে।’
আর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দেয় সাজি।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বন্দনাকে নিয়ে ভাবছে অয়নন্দিতা। বন্দনার এইভাবে হুট করে সামনে চলে আসাটা তাকে ভাবাচ্ছে। ফারহানের কাছ থেকে আরও শুনেছে বন্দনার হাজবেন্ড অন্য লোকের মাধ্যমে ফারহানদের সাথে কাজ করছে। সবটাই তাকে ভাবাচ্ছে। কোনো বড়ো বিপদ হবে না তো?

চলবে……………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫২
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

হাসপাতালে মোটামুটি সবাই উপস্থিত হয়েছে। মিলির মায়ের চাপা কান্না, আয়শা বেগমের চাপা আর্তনাদ হাসানের চোখের পানি সব মিলিয়ে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে গেছে। মিলির বাবা, শ্বশুর দু’জনেই দিশেহারা অবস্থায় আছেন। মিলির বাবার শোক, তার একমাত্র মেয়েটা এইভাবে চলে যাবে এটা তাকে মেনে নিতে হবে। মিলির শ্বশুরের শোক, বউটা এত অল্প বয়সে পৃথিবীর সমস্ত সুখ শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে পরপারে পাড়ি জমাবে সেই সাথে তার ছেলের হাসি আনন্দ সব নিয়ে যাবে৷ বেয়াই-বেয়ানকে মানসিক সাপোর্ট দিতে এসেছেন রমজান শেখ এবং রওশন বেগম। ফারহান অয়নন্দিতার ফোন পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছলে দেখতে পায় হাসান একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই সে। ফারহান কাঁধে হাত রাখার পর মুখ তুলে তাকায় হাসান। কে বলেছে পুরুষ মানুষ কাঁদে না। তারাও কাঁদে। কাঁদতে পারে তারা। যেমন কেঁদেছিল ফারহান। আজ কাঁদছে হাসান। শুধু তফাৎ একটাই। পুরুষ মানুষ নীরবে কাঁদে। ফারহান চোখের ইশারায় হাসানকে সান্ত্বনা দিতে নিলে হাসান বলে ওঠে,
‘সময় এসে গেছে। ওর চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে।’
কথাটা সেখানে উপস্থিত সবার বুকে কাটার মতো বিঁধে গেছে। সবার আড়ালে একজন আছে যে, এই কথাগুলো সহ্য করতে পারছে না। যার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে হাসানের কষ্টে। সাজির মাথায় ওড়না। ওড়নার একাংশ দিয়ে মুখটস চেপে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়। ওড়নার আড়ালে হাসানকে দেখছে সে বার বার। চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। প্রিয় মানুষের চলে যাওয়াটা দেখতে হচ্ছে হাসানকে। এর চেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য আর কী হতে পারে? ফারহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
‘কালও তো কথা হলো আমাদের। কাল তো বললে, ভালো আছে মিলি। আজ হঠাৎ করেই এত অসুস্থ হয়ে গেল।’
‘সকালবেলা ভালোই রেখে গেলাম। বারোটা বাজেই মায়ের ফোন। এত পরিমাণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল ওর। উফ, ওর যে কী কষ্ট হচ্ছে, বোঝাতে পারব না আমি। আমার যদি ক্ষমতা থাকত, আমি ওর সব কষ্ট নিজের করে নিতাম। ওর সমস্ত যন্ত্রণাগুলো নিজের করে নিতাম। সামনের মাসেই তাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যেতাম। সব ব্যবস্থাও করে ফেলেছিলাম। সে আমায় সুযোগ দিলে তো। কেন যে আমায় এত জ্বালাচ্ছে সে?’
অয়নন্দিতার মামীর পাশে বসে কাঁদছে। রওশন বেগম বুঝিয়েছেন তাকে যেন সে না কাঁদে। সবাই একত্রে ভেঙে পড়লে কীভাবে হবে? কাউকে না কাউকে সাহস তো রাখতে হবে যে বাকিদের সামাল দিতে পারবে।
ডাক্তারের সঙ্গে আলাপে বসেছেন রমজান শেখ। এখানে আসার পর তিনি দেখলেন ডাক্তার তো তার পরিচিত। চেম্বারে মোট পাঁচ জন উপস্থিত আছেন এই মুহুর্তে। মিলির বাবা, শ্বশুর, স্বামী। অয়নন্দিতার শ্বশুর, স্বামী। রমজান শেখ জিজ্ঞেস করলেন,
‘কন্ডিশন কেমন বুঝলেন?’
ডাক্তার একবার সবার মুখের দিকে তাকালেন। মিলিকে নিয়ে এখানে আরও আসায় ডাক্তার হাসানকে বেশ ভালো করেই চিনেন। তিনি হাসানকে দেখছেন। একজন স্বামী, যে তার সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা করছে স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু, হয়তো আল্লাহ পাকের এটা মঞ্জুর না। হয়ত মিলির ডাক পড়ে গেছে৷ এবার তাকে যেতেই হবে। ডাক্তার রমজান শেখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ক্যান্সারটা একদম লাস্ট স্টেজে গিয়ে ধরা পড়ায় তেমন কিছুই করার ছিল না। আমি আরও আগেই বলে দিয়েছিলাম তাদের। রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত৷ এবার যতদিন বাঁচে। এরপরেও তো হাসান অনেক চেষ্টা করেছে। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতাম একজন স্বামী তার স্ত্রীকে এতটা ভালোবাসে কীভাবে। যাই হোক, আল্লাহকে ডাকুন সবাই মিলে।’
হাসান টেবিলের পাশ দিয়ে ঘুরে ডাক্তারের কাছে যায়।
‘স্যার, আপনি কিছু একটা করুন না প্লিজ। আমায় শুধু দুটো দিন সময় নিন। আমি আজকের মধ্যেই সব ঠিক করে ওকে নিয়ে যাব ইন্ডিয়াতে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করাব।’
ডাক্তার হাসানের হাত ধরে বললেন,
‘শান্ত হও বাবা। নিজেকে সামলে নাও৷ চেষ্টা করো নিজেকে শান্ত রাখার। ভেঙে পড়লে চলবে না। ওর শ্বাসকষ্ট বেশি হচ্ছে। অক্সিজেন চলছে তবুও তার শ্বাসকষ্ট বন্ধ হচ্ছে না।’
‘আপনি শুধু আমায় দুটো দিন সময় দিন। প্লিজ।’
ডাক্তার বোঝাতে ব্যর্থ। হাসানের বাবা কাঁদছেন। মিলির বাবাও কাঁদছেন। ফারহান নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে।

রাত বারোটা। একটা মানুষও নড়েনি আইসিইউর সামনে থেকে। অনেকক্ষণ পর অনেক জোরাজুরি করার পর হাসানকে আইসিইউতে যেতে পারমিশন দেওয়া হয়। হাসান বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিলি বেডে শুয়ে আছে। অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় মিলিকে একটা লাশ মনে হচ্ছিল। হাসান যেন এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছে না। হাসানের দমটা যেন বের হয়ে যাবে এমন অবস্থা। সেদিন নামাজ পড়তে গিয়েছিল আর সেখানে হুজুর বক্তব্য দিচ্ছিলেন৷ আল্লাহ পাকের সৃষ্টির সেরা জীব হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ পাক তার সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাতকে বেশি ভালোবাসেন। তাহলে সেই আল্লাহ পাক-ই কেন এত তাড়াতাড়ি তার জানটা কবজ করতে চান। একটা মানুষকে কী করে এত কষ্ট দিতে পারেন। আল্লাহ পাকের কি একটু মায়া হয় না সেই মানুষটার জন্য। হাসান গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় মিলির দিকে। মিলির হাতটা ধরতেই পেছন থেকে নার্স বলে ওঠে,
‘ধরবেন না। অনেক কষ্টে ঘুমিয়েছেন একটু। ঘুমোতে দিন তাকে।’
নার্সের কথা শুনে হাসান চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। চোখ জোড়া বন্ধ করতেই গড়গড় করে পানি গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। নিজের স্ত্রীকে ধরতে বারণ করে নার্স। এর চেয়ে এত কষ্ট এই দুনিয়াতে আছে বুঝি?
শার্টের হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছে আইসিইউর বাইরে বের হয়ে যায় হাসান। বের হতেই তার সামনে পড়ে সাজি। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয় হাসান। সাজিও নিজের নজর সরিয়ে নেয় অন্যখানে। অনেকক্ষণ থাকার পর রমজান শেখ এবং রওশন বেগম বাড়ি চলে যান। ভাবীর সঙ্গে থাকার জেদ ধরে সাজি থেকে যায় হাসপাতালে। থাকার উদ্দেশ্য একটাই। হাসানকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া৷ এখানে উপস্থিত প্রত্যেকেই জানে মিলির মৃত্যু নিশ্চিত। সবাই ভেতর ভেতর নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। যে কোনো মুহুর্তে খারাপ খবর আসবে।
অয়নন্দিতা অনেক বোঝানোর পরেও হাসানকে খাওয়াতে পারেনি। ফারহানও বুঝিয়েছে। সে-ও খাওয়াতে পারেনি। হাসপাতালের করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে হাসান। অপেক্ষা করছে একটা ভালো খবরের। কিন্তু, কে জানে ভালো খবররের বদলে খারাপ খবর না চলে আসে।
সবার চোখকে আড়াল করে সাজি এসে হাসানের পাশে এসে দাঁড়ায়। হাতে খাবার।
‘খাবারটা খেয়ে নিন।’
ধরা গলায় হাসান জবাব দেয়,
‘ইচ্ছে করছে না।’
‘ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে।’
‘খাবারটা সরিয়ে নাও সাজি। প্লিজ, বিরক্ত কোরো না। যাও এখান থেকে।’
‘খেয়ে নিন।’
‘আমার বউটা ওইখানে বেডে শুয়ে আছে। আর তুমি আমায় এখানে খাবার খাওয়াতে এসেছ। কী মনে হয়, আমি খুব সুখে আছি? নাকি তুমি মনে প্রাণে চাচ্ছো যাতে মিলি চলে যায়, আর তোমার রাস্তাটা ক্লিয়ার হয়ে যায়।’
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সাজির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। হাতে থাকা খাবারটাও নড়ে যায়। হাসান এটা কী বলল? চোখের পানিগুলো অঝোরে ঝরতে শুরু করে তার। কয়েক সেকেন্ড পর হাসান সাজির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘সরি। উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছি আমি। সরি।’
হাসান চলে যায়। সাজি মূর্তির মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

ভোর চারটা।
হাসপাতালের একটা অংশ আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে। মিলি চলে গেছে। হাসানকে কিছু না বলেই মিলি চলে গেছে। হাসানের কাছে মিলির ওড়নাটা ছিল। সেটা জড়িয়েই কাঁদতে শুরু করে হাসান। তার একটাই অভিযোগ। কীসের এত রাগ ছিল তার প্রতি। কিছু না বলেই এইভাবে চলে গেল মিলি। কেন কিছু না বলে চলে গেল। আয়শা বেগম নিজের ছেলের আর্তনাদ সহ্য করতে পারছেন না। আর কেউ না জানুক তিনি অন্তত জানেন যে, হাসানের পুরোটা জুড়েই মিলির অবস্থান ছিল। আর সেই মিলি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এর থেকে কষ্টের, যন্ত্রণার আর কিছু হতে পারে না। কিছু হতে পারে না।

চলবে………………………….

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫৩ (প্রথম পরিচ্ছেদ)
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

মিলি চলে গেছে আজ প্রায় পনেরো দিন হবে। ঘরটায় হাসানের দম বন্ধ লাগে। পুরো ঘরটা জুড়েই মিলির গন্ধ। যেখানে তাকায়, সেখানেই মিলিকে দেখতে পায় সে। অসহ্য লাগে তার। পনেরো দিন পর হাসান অফিসে এসেছে। চোখ মুখের অবস্থা ভালো নয় তার।
অফিসে এসে কাজে মন বসানোর চেষ্টা করছে হাসান। কিন্তু পারছে না। সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। মিলি নেই, আর কখনও সে মিলিকে দেখবে না। যদি এমন হতো, মিলি তাকে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে চলে গেছে তবুও সে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারত। আমার মিলি দূরে আছে আপত্তি নেই। তবুও সে বেঁচে থাকুক। কিন্তু মিলি নেই। একেবারেই নেই। এই দুনিয়াতেই নেই। এটাই তার মনকে বার বার কাঁদাচ্ছে। দম বন্ধ লাগে ওই ঘরটায় পা রাখলে। বুকে চাপা ব্যথা হয়। মিলিকে চাই তার। তার ইচ্ছে করছে এখনি নিজেকে শেষ করে ফেলতে। এরপর মিলির কবরের পাশে তাকে কবর দেওয়া হবে। পরকালে না হয় তারা দু’জন একত্রিত হবে।
ভাবনা তো ভাবনাতেই ভালো লাগে। সব ভাবনা বাস্তবতায় টিকে না। তাকে হয়তো এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে। মিলি বিহীন তাকে জীবন কাটাতে হবে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কম্পিউটারের স্ক্রিনটা ক্রমশ ঘোলা হচ্ছে। হাসান টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ জোড়া মুছে নেয়। এমন সময় হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে। ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে দেখে সাজি ফোন করেছে। একদমই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। লাইনটা কেটে দিয়ে ফোনটাই বন্ধ করে রেখে দেয় ড্রয়ারে।

ফারহান আর জাহরাফ মুখোমুখি বসে আছে। ফারহানের মুখে স্বস্তির হাসি। জাহরাফ রাগে ফেটে পড়ছে। সে যা চেয়েছিল সেটা হয়নি। বরং উল্টোটা হয়েছে।
‘জাহরাফ সাহেবের মনটা দেখছি ভীষণ খারাপ। চেহারাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। যেটা আশা করেছিলেন সেটা হয়নি বলেই কি মন খারাপ?’
জাহরাফ তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। ভাবছে, এই লোকটাকে সে সব থেকে বেশি আঘাত করেছে। তবুও এই লোক এত স্ট্রং কী করে আছে? যার কাছে সব থেকে বেশি মূল্যবান ছিল বন্দনা, সেই বন্দনাকে সে নিজের করে নিয়েছে। তবুও এই লোকের এত পাওয়ার কীভাবে। জাহরাফ রাগে ক্ষোভে বলে ওঠে,
‘বন্দনাকে কেড়ে নিয়ে সর্ব শান্ত করে দিয়েছিলাম। এবার আরও বড়ো কিছু হবে তোমার সঙ্গে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।’
ফারহান হালকা হাসে।
‘সে বিক্রি হবার জিনিস ছিল তাই তুমি তাকে ক্রয় করে নিয়েছ। সে তোমার কাছে না হোক অন্য কারো কাছে ঠিকই বিক্রি হতো জাহরাফ। তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই। কারণ, এতে তো তোমার একার দোষ নেই। তারও দোষ ছিল। আমি কিন্তু এই এত দিনে একবারের জন্যেও তোমার আর তার মধ্যিখানে আসিনি। এত দিন পর তোমরা নিজেরাই আসছ। তোমার স্ত্রী তোমার কাছে থাকা সত্ত্বেও আমার খোঁজ খবর রাখে। ভেবে দেখেছ একবারও, এতে জিত কার হয়েছে আর হার কার হয়েছে। কফিশপে আমার বর্তমান স্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলে তোমার স্ত্রী। ভেবে দেখ তো, এখানে হারের পাল্লা কার ভারী। আমি তোমায় খোঁচামূলক কোনো কথা বলছি না। শুধু বোঝাচ্ছি। তুমি বা তোমরা যা করতেছ তা ঠিক হচ্ছে না৷ বন্দনা যখন তোমরা সঙ্গে চলে গেল তখন ভেঙে পড়েছিলাম এটা সত্যি কথা। তবে এতটাও ভেঙে পড়িনি যে তুমি এসে আমায় গুড়িয়ে দেবে। এইযে গতকাল তুমি যা করলে আমার সঙ্গে। আমি জানতাম তুমি এমনটাই করবে৷ তাই তো একই সময় দুই দিক দিয়ে মাল সাপ্লাই করে দিয়েছি। এক লট তুমি গায়েব করিয়েছ আর এক লট ওই একই সময়ে জায়গা মতো পৌঁছে গেছে। তুমি কি জীবনটাকে সিনেমা ভেবে বসে আছো কি না কে জানে। আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল, তুমি কিছু একটা করবে। আর আমার সন্দেহটাই সত্যি হলো। দেখ জাহরাফ, তুমি আর বন্দনা ভালো থাকো এটা আমিও মন থেকে চাই। মন থেকে চাই তোমরা তোমাদের আগামী দিনগুলোতে সুখী হও। তবে আমার লেজে পা দিও না। আমার লেজে পা দিলে আমি কিন্তু ফেরত কামড়টা বসাতে বাধ্য হবো।’
জাহরাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এবং দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। ফারহান একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নিঃশ্বাসটায় ঠান্ডা হাওয়া বের হচ্ছে। সমস্তটা জুড়ে প্রশান্তি কাজ করছে। ফোন হাতে নিয়ে অয়নন্দিতাকে ফোন করে ফারহান।
‘হ্যালো।’
‘অয়নন্দিতা, আমি পেরেছি। জাহরাফের ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করতে আমি পেরেছি। আমার মনে হয় না, জাহরাফ আর বন্দনা এবার আর আমাদের কোনো ক্ষতি করবে।’
কথাটা শুনে মুচকি হাসে অয়নন্দিতা। সেও আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।

সাজি তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে পরিবারে। সে তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হবে না। ফারহানসহ বাকি সবাই অবাক। সব থেকে বেশি অবাক হয়েছে অয়নন্দিতা নিজে। সাজির মনে এত কিছু ছিল সে কখনও টের-ও পায়নি। রমজান শেখ কী বলবেন তিনি ভাবছেন। তবে ফারাশ সাজির সাপোর্টে ছিল। ড্রইংরুমে সবাই বসে আছে। রমজান শেখ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,
‘তুমি কি তোমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়বে না?’
‘নাহ বাবা।’
‘ভুল করছ না তো?’
‘আমার যা ভাবার আমি ভেবে নিয়েছি বাবা।’
‘ওকে। দেখছি আমি। তুমি ঘরে যাও।’
সাজির পেছন পেছন অয়নন্দিতা যেতে নিলে রমজান শেখ তাকে আটকায়।
‘বউমা, তুমিও এখানে বোসো।’
তিনি ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘ফারহান, তোমার কি মতামত?’
‘আমি এখনও শকড বাবা।’
‘বউমা, তুমি কি কিছু বলবে?’
‘বাবা, আমি এখনও ভাবতেই পারছি না সাজি এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেবে।’
‘সাজির মা, তুমি?’
‘মেয়ে এমন কিছু চাইবে কখনও আশা করিনি। তবে মেয়ে যদি এখানে ভালো থাকে আমার আপত্তি নেই।’
আলাদা করে ফারাশকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। কারণ প্রত্যেকেই জানে ফারাশের জবাব হ্যাঁ। উঁচু-নিচু হবে না। সরাসরি হ্যাঁ।

সাজি ক্যান্টিনে বসে আছে। সামনে চায়ের কাপে থাকা চা এতক্ষণে হয়তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। সাজির মনটা অশান্ত হয়ে আছে। অপরপক্ষ থেকে কী জবাব আসে সেই চিন্তাই করছে সে। তমা নামের মেয়েটা এসে সাজিকে ডাকছে।
‘তোকে একজন খুঁজতে এসেছে।’
‘কে?’
‘নাম তো বলল হাসান। দেখতেও সেই লাগল। কে রে লোকটা?’
‘হাসান ভাই! এখানে?’
সাজি ছুটে গেল। তমা তাকিয়ে ছিল সাজির চলে যাওয়ার পথে।

‘আপনি, এখানে?’
সাজি হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করে।
‘তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। ইমারজেন্সি।’
‘বলুন।’
‘এখানে না। এক ঘন্টা সময় হবে তোমার?’
‘হ্যাঁ হবে।’
‘চলো তাহলে৷’
হাসান আর সাজি বের হয়ে যায়। রিক্সায় বসে দু’জন। হাসানের শরীর থেকে কড়া ঘ্রাণটা সাজির নাকে লাগছে। হাসানকে অনেকটা ফ্রেশ লাগছে। হাসান কাউকে ফোন করল৷
‘মোতালেব ভাই, আজ অফিসে লাঞ্চের পর ঢুকব। বসকে ম্যানেজ করে নিয়েন৷’
অপরপ্রান্তে থাকা মোতালেব ভাই কী বললেন বোঝা গেল না। হাসান ফোন রেখে দিয়েছে।
‘তুমি বাসায় যা যা বলেছ, তা কি ঠিক করেছ?’
‘কোনটা?’
‘ভণিতা কোরো না সাজি৷’
‘এমন প্রশ্নই বা করছেন কেন?’
‘আমার মধ্যে এমন কিছুই নেই। যার জন্য তুমি আমার সঙ্গে থাকতে চাচ্ছো। আর আমি মিলিকে ভুলতেও পারছি না।’
‘আপনাকে ভুলতে কে বলল?’
‘মনে রাখার মতো স্কোপ-ও তো দিচ্ছো না তুমি।’
‘খবরদার। সেদিন হসপিটালে যা বলেছেন তো বলেছেন। নেক্সট টাইম এইসব বলবেন না আমায়। আমি আপনাকে বলিনি তাকে ভুলে যান। আমি আপনাকে বলিনি তাকে মনে রাখা যাবে না। আমি শুধু আমার জায়গাটুকু চেয়েছি।’
‘তোমায় ভাবতে হবে, সেই জায়গায় আমি তোমায় বসাব কি না।’
‘বসাবেন না আমায়?’
হাসান কিছুক্ষণ সাজির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাজির চোখে পানি ভর করেছে।
‘আপনাকে বলিনি মিলির ভালোবাসা আমায় দিতে হবে। আপনাকে আমার ভালো লাগে। কেন লাগে জানি না। তাই থাকতে চাই৷ এক কাজ করবেন, আমায় ভালোবাসতে হবে না। শুধু সাথে রেখে দিন৷ তাহলেই হবে।’
হাসানের নজর ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। সাজির চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে সে।

চলবে…………………………………

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫৩ (দ্বিতীয় এবং শেষ পরিচ্ছেদ)
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

গত দু’মাসে অনেক কিছু বদলে গেছে। ফারহান তার ব্যবসায় আরও এগিয়ে গেছে৷ জাহরাফ আর কোনো ক্ষতি করেনি কিংবা ক্ষতি করার চাঞ্চ পায়নি। অয়নন্দিতাকে নিয়ে বাকি জীবনটা সুখেই থাকতে চায় সে।
অয়নন্দিতাও নিজের স্বামী সংসার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সংসারটাকে মনের মাধুরি মিশিয়ে সাজিয়েছে সে। এই সংসার কেবলই তার। প্রতিদিন সকালে নাস্তার টেবিলে সবাই মিলে একত্রিত হয়ে নাস্তা এবং রাতে সবাই একত্রে রাতের খাবার খাওয়ার ব্যাপারটা যেন ঈদের মতো। রওশন বেগম এখন ছাড়া হাত-পা। আগে ছিল এক বউমা এখন হয়েছে দুই বউমা। ফারাশ বিয়ে করেছে এক মাস হবে। খুব ধুমধাম হয়নি বিয়েতে। ফারাশ চায়নি বিয়েটা ধুমধাম করে হোক। নায়াও এতে সহমত পোষণ করলে দুই পরিবারের কিছু লোকজনের উপস্থিতিতে বিয়ে হয় ফারাশ এবং নায়ার। নায়াও অয়নন্দিতার মতো সমান তালে সংসারে সময় দেয়। কারণ, ফারাশ আগেই তাকে দিনে অন্তত একবার করে হলেও অয়নন্দিতার বর্ণনা শোনাত। শুনতে শুনতে নায়া এখন অয়নন্দিতাকে অয়নন্দিতার থেকেও বেশি চেনে।
কিচেন রুমে অয়নন্দিতা এবং নায়া উভয়েই উপস্থিত আছে। নায়া চা বানাচ্ছে অয়নন্দিতা অন্য কাজে ব্যস্ত। নায়া এদিক-সেদিক তাকিয়ে অয়নন্দিতাকে বলল,
‘ভাবী, সাজির কন্ডিশন কিন্তু ভালো ঠেকছে না।’
নায়া’র কথায় অয়নন্দিতা কপাল কুঁচকায়।
‘মানে?’
‘সাজি ইদানীং মন মরা হয়ে থাকে। তেমন কথাও তো বলে না।’
‘সাজিকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সে বুঝতে চায় না। ওইদিকে ভাইয়াও বুঝতে চাইছে না৷ দু’পক্ষের চাপে আমি পিষে যাচ্ছি।’
‘হাসান ভাইয়া কিন্তু চাইলে পারে।’
‘আমি তুমি কিংবা বাকিরা খুব সহজেই বলতে পারি গো নায়া। তবে যার যায় সে-ই বোঝে। মিলি ভাবী ভাইয়ার জন্য অনেক কিছু ছিল। তার এইভাবে চলে যাওয়াটা সে মানতে যেমন পারছে না আবার সাজির এমন আবদারও মানতে পারছে না।’
‘না পারছি সাজিকে বোঝাতে আর তুমি না পারছ হাসান ভাইয়াকে বোঝাতে।’
‘ফারাশ ভাইয়া কিন্তু সাজির ফুল সাপোর্টে।’
‘হ্যাঁ ভাবী। ফারাশ তো কাল রাতেও বলল শুধু একবার হাসান ভাই রাজি হোক। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ের ব্যবস্থা করব।’
নায়া চা বানিয়ে ফেলেছে৷
‘ভাবী, উপরে যাও। ভাইয়া রেডি হয়েছে কি না দেখ। নাস্তা রেডি৷’
‘তুমি টেবিল সাজাও আমি আসছি।’
‘আচ্ছা।’

ফারহানকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অয়নন্দিতা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারহানকে ফরমালে বেশ লাগে। মাঝে মাঝে অয়নন্দিতার হিংসা হয়। খুব হিংসা হয়। এইতো কিছুদিন আগে। কলেজের একটা প্রয়োজনীয় কাজে লিগ্যাল গার্জিয়ান হিসেবে ফারহানের যাওয়ার কথা ছিল। ফারহান গিয়েছিল সেখানে। মেয়েরা জানে যে সে অয়নন্দিতার হাজবেন্ড তবুও হা করে গিলে খেয়েছে মনে হয়েছে। আজ-কালকার মেয়েগুলোও বেহায়ার সেরা। সেদিন ফারহানের ওপরও তার রাগ হয়েছিল। কেন সে এমন ফিটফাট হয়ে কলেজে গেল। অয়নন্দিতা ভেবে নিয়েছে, সে আর কখনও কলেজে তার স্বামীকে নেবে না। ফারাশকে ভাই হিসেবে নেওয়া যেত। কিন্তু ফারাশকেও নেবে না। ফারাশও বেশ সুদর্শন। ঠিক করেছে, এরপর থেকে গার্জিয়ান হিসেবে শ্বশুরকে নেবে।
ফারহান ততক্ষণে অয়নন্দিতাকে দেখে ফেলেছে। অয়নন্দিতার এইভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে ফারহান খানিকটা অবাক হয়। দু’পা এগোতেই অয়নন্দিতা নড়েচড়ে ওঠে।
‘নাস্তা রেডি। খেতে এসো।’
অয়নন্দিতা বের হতে নিলে ফারহান তার হাতটা ধরে।
‘সারাক্ষণ এমন পালিয়ে পালিয়ে থাকো কেন?’
‘পালিয়ে পালিয়ে থাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘পালিয়ে থাকব কেন? আর রাতে তো তোমার সঙ্গেই বিছানায় ঘুমাই। পালালাম কোথায়?’
‘এইযে পালাচ্ছিলে।’
‘পালাইনি। ওকে। খেতে এসো।’
‘মেজাজ এখনও ঠিক হয়নি। হায়রে আল্লাহ।’
‘তোমাকে আর আমার কলেজে যেতে হবে না।’
‘হায়রে খোদা। সেইদিনের কথা ধরে বসে আছো। আচ্ছা এতে আমার দোষটা কোথায়?’
‘এত সেজেগুজে যেতে হবে কেন তোমায়?’
‘সেজেগুজে না গেলে তোমায় নিয়ে সবাই মজা করবে তো। বলবে, অয়নন্দিতার বর বয়স্ক, দেখতে কেমন খেত লাগে। এই সেই।’
‘আমার বুড়া জামাই-ই ভালো। তাদের কি? তুমি আর সেজেগুজে যাবে না। ব্যাস।’
‘তুমি তো বেশ হিংসুটে।’
‘হ্যাঁ। আমার স্বামীর ক্ষেত্রে আমি বেশ হিংসুটে।’
ফারহান গাল বাকিয়ে হাসে। অয়নন্দিতা বলে,
‘হাত ছাড়ো। নিচে যাব।’
ফারহান অয়নন্দিতাকে কাছে টেনে নেয়৷ সে কিছু বলবে তার আগেই ফারহান এক হাতে দরজা আটকে দেয়। আচমকা এমন কিছু হবে অয়নন্দিতা ভাবতে পারেনি। ফারহান অয়নন্দিতাকে দেওয়ালের সঙ্গে লেপ্টে ধরে বলে,
‘এত হিংসা মনে? হ্যাঁ।’
‘হু।’
‘তবে তৃষ্ণা মেটাও।’
‘মানে?’
ফারহান আর কথা না বাড়িয়ে অয়নন্দিতার ঠোঁট জোড়ায় নিজের ঠোঁটে মিলিয়ে দেয়। অয়নন্দিতা ফারহানের ব্লেজার আঁকড়ে ধরে। ঘরে থাকা ঘড়িটা টিকটিক শব্দ করছে। বারান্দা দিয়ে শো শো শব্দে বাতাস আসছে। জানালা দিয়ে কড়া রোদ এসে তাদের দু’জনের শরীরে পড়েছে। শরীর জোড়া একে অন্যের সঙ্গে মিশে আছে।

চলবে………………………….