দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৬১
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
সাজিকে পার্লারে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল অয়নন্দিতার। কিন্তু অয়নন্দিতা সেই দায়িত্ব নায়ার ওপর ট্রান্সফার করে দিয়েছে। অয়নন্দিতা পার্লারে সাজবে না বলেই এই ব্যবস্থা। তার ঘরে সাজতেই ভালো লাগে। সিম্পল সাজ অলয়েজ পছন্দ তার। শাশুড়ি বেশ কয়েকবার তাড়া দিয়েছেন তাকে। ভ্যানুতে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে৷ ঘর ভর্তি মেহমান। নিজের ঘরে শান্তিতে সাজছে অয়নন্দিতা। শাড়ি পরে নিয়েছে কিন্তু কুচিতে সমস্যা হয়েছে। কুচিগুলো কিছুতেই গোছাতে পারছে না।
ফারহানকে প্রয়োজন তার। কিন্তু ফারহান কি আদৌ বাড়িতে আছে। ভ্যানুতেও তো চলে যেতে পারে। অয়নন্দিতা একা কিছুতেই কুচিগুলো গোছাতে পারে না। এরই মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ফারহান ঘরে ঢোকে। এমন আচমকা ঘরে ঢোকায় ভড়কে যায় অয়নন্দিতা। মেরুন রঙের পাঞ্জাবিতে মন্দ লাগছে না তাকে। ফারহান ঘরে ঢুকেই অয়নন্দিতাকে দেখতে থাকে। অয়নন্দিতা ভ্রু জোড়া কুঁচকে প্রশ্ন করে,
‘তুমি এখনও বের হওনি?’
ফারহান কিছু না বলে এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছে। অয়নন্দিতা ফের প্রশ্ন করে,
‘কী হলো, যাওনি এখনও তুমি?’
‘আমি চলে গেলে তুমি আমায় দেখতে কীভাবে?’
‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ।’
‘গাড়িতে উঠে গিয়েছিলাম। কিন্তু নেমে পড়লাম।’
‘কেন?’
‘তোমার কথা মনে করে। মা’কে ফারাশের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন বাড়িতে আমি আর তুমি।’
ফারহান এখন অয়নন্দিতার খুব কাছে। অয়নন্দিতার খোলা কোমর দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সে। অয়নন্দিতা এমনিতেই শাড়ি গোছাতে পারছে না। তার উপর ফারহান এমন করছে।
‘ফারহান, আমি কিন্তু অলমোস্ট রেডি হয়ে গেছি। এখন আর ফাইযলামি করবে না।’
‘করলে?’
‘ফারহান, আমাদের দেরি হয়ে যাবে কিন্তু।’
‘হোক৷ আগে আমি তৃষ্ণা মেটাব। এরপর অন্যসব।’
‘এত তৃষ্ণা মেটে, তবুও পিপাসা পায়?’
‘এই তৃষ্ণা মেটবার নয়।’
অয়নন্দিতা মুচকি হাসে। ফারহানের গালে আলতো চুমু দেয়।
‘এবার প্লিজ আমার কুচিগুলো ধরো। দেখ না, নিচ থেকে গোছাতে পারছি না।’
ফারহান হাটু গেড়ে বসে অয়নন্দিতার কুচিগুলো গুছিয়ে দেয়। কুচিগুলো গুঁজে দিয়ে সম্পূর্ণ শাড়ি ঠিক করতে সক্ষম হয় অয়নন্দিতা। ফারহান পাশেই ড্রেসিং টেবিলের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে তার বউ সাজছে।
‘তুমি নায়া আর সাজির সঙ্গে পার্লারে যেতে পারতে।’
‘তুমি তো জানো, আমার পার্লার ভালো লাগে না। আমি যা সাজগোজ করি, নিজেই করি। কেন, আমার সাজগোজ তোমার পছন্দ হয় না বুঝি?’
‘আমার চোখে তুমি পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর নারী। বুঝলে?’
‘হ্যাঁ। বুঝেছি।’
‘বর আসতে তো এখনও অনেকটা সময় বাকি। তাই না?’
‘তোমার ভাই এমনিতেও ভেজা বেড়াল। সে দেরি করেই আসবে।’
‘এই, এইভাবে কেন বললে? আমার ভাই লাখে একটা।’
‘হ্যাঁ। লাখে একটা। আর আমি?’
অয়নন্দিতা শব্দ করে হাসে।
‘তুমি কোটিতে একখান।’
‘এইজন্যই তো বউ আমার সেরার সেরা।’
আরও আধাঘন্টা পর অয়নন্দিতা সম্পূর্ণ রেডি হয়। এরপর ফারহান অয়নন্দিতাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ফারহান গাড়ি চালাচ্ছে আর বার বার অয়নন্দিতাকে দেখছে। একটা সময় পর অয়নন্দিতা বিরক্ত হয়ে বলে,
‘সামনে দেখে গাড়ি চালাও প্লিজ।’
‘এই সন্ধ্যায় আকাশের চাঁদ আমার পাশে বসে আছে।’
‘ফারহান, সামনে দেখে গাড়ি চালাও।’
‘তুমি সামনে এসে বসো তাহলে।’
‘ফারহান, প্লিজ। বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু। সামনে তাকাও।’
‘এই শাড়িটাতে তোমায় অপূর্ব লাগছে অয়নন্দিতা।’
‘শাড়িটা যে কিনেছে তাকে হাজারো ভালোবাসা।’
‘ইশ! বুকে গিয়ে লেগেছে।’
‘লাগা উচিত। না লাগলে কীসের বউ আমি?’
‘সেটাও ঠিক।’
বরযাত্রী সাড়ে আটটা নাগাদ ভ্যানুতে পৌঁছায়। হাসানকে বরের সাজে বেশ লাগছিল। উপস্থিত গেস্ট সবাই প্রশংসা করছেন। অয়নন্দিতা নিজের পরিবারের লোকদের দেখে আনন্দিত। রওশন বেগম জামাইকে আদরের সঙ্গে গ্রহণ করেন। অয়নন্দিতা তার মামার সঙ্গে দেখা করে। সবাই বেশ হাসিখুশি। নায়া আপাতত সাজির কাছে আছে। ফারাশ হাসানের সঙ্গে স্টেজে আছে।
কিছুক্ষণ পর হুজুরের আগমন ঘটে। এরপর থেকেই এক এক করে সব নিয়ম পালিত হয়৷ সাজিকে কবুল পড়িয়ে হাসানকেও পড়ানো হয়। স্বাভাবিক অবস্থাতেই শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়।
বিদায় পর্বে কান্নাকাটিও হয়ে যায় চোট। রওশন বেগম এবং রমজান শেখ দু’জনে মিলে আদরের মেয়েকে বিদায় দেন। ফারহান এবং ফারাশ দুই ভাই মিলে আদরের বোনকে তুলে দেয় পরের হাতে। একটাই প্রার্থনা, বোন যেন ভালো থাকে।
রাত প্রায় দুটো। হাসান সাজি মুখোমুখি বসে। ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সাজি এদিক-ওদিক তাকিয়ে মিলির ছবি দেখতে পায়। বিছানা থেকে নেমে মিলির ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাসান সাজিকে নামতে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। সাজি মিলির ছবিতে হাত রেখে বলে,
‘আমি তোমার জায়গা কখনও নিতে চাইনি। কখনও নেবও না। হাসান যেমন তোমার ছিল তেমন তোমারই থাকবে। তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে সারাজীবনের একাকীত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই আমার আগমন। আমি আমার ভালোবাসাটাই নেব। তোমারটায় ভাগ বসাব কখনও। কথা দিলাম তোমায়।’
হাসান সাজির হাত ধরে।
‘আজ এইসব বলছ যে?’
‘মিলিকে সব বলে নিলাম। আমি চাই মিলি যেখানেই আছে, আমাদের দেখছে। এবং আমাদের দোয়া দিক।’
‘মিলি জানে, এই সাজি তার জায়গায় ভাগ বসাবে না। সাজি, আমার জীবনের দ্বিতীয় সূচনা ঘটেছে আজ। আমি চাইব, এই দ্বিতীয় সূচনাই আমার জীবনটাকে সুন্দর এবং সুখের করবে।’
সাজি হাসিমুখে হাসানের বুকে মাথা রাখে। হাসানও নিজের বাহুডোরে সাজিকে আবদ্ধ করে।
অয়নন্দিতা বিছানায় শুয়ে আছে। ফারহান তার পাশেই। তাদের শরীরে অবশিষ্ট বলতে সাদা চাদরটুকুই আছে। মেঝেতে অয়নন্দিতার গহনা, চুড়ি, শাড়ি পড়ে আছে। অয়নন্দিতা বালিশ থেকে মাথা তুলে ফারহানের বুকে রাখে। ফারহানও পরম ভালোবাসায় অয়নন্দিতাকে জড়িয়ে নেয়। ফারহান অয়নন্দিতার চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলে,
‘আমার জীবনের দ্বিতীয় সূচনাটা যে এত মধুর হবে কখনও ভাবিনি আমি। তুমি আমায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছ অয়নন্দিতা। এই পরিপূর্ণতা সুখের। এই পরিপূর্ণতা শান্তির।’
অয়নন্দিতা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। বলে,
‘আমি ভালোবাসি তোমায়। আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সারাজীবন আমি আগলে রাখব। তোমার জীবনে দ্বিতীয় সূচনা হয়ে এসেছি আমি। এত সহজে তোমায় ছাড়ছি না।’
ফারহান বলে,
‘আজ আমার মতো হাসানও জীবনের দ্বিতীয় সূচনায় পা রেখেছে। মনে প্রাণে চাই সে সুখী হোক। তারা ভালো থাকুক।’
‘তুমি দেখবে সাজিও আমার মতো ভাইয়ার জীবনে পরিপূর্ণতা নিয়ে আসবে।’
‘তাই যেন হয়।’
ঘর অন্ধকার। বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। অয়নন্দিতা ফারহান আবারও মেতে ওঠে ভালোবাসার খেলায়। অন্যদিকে, হাসান সাজিকে নিয়ে পাড়ি জমায় সুখের সাগরে।
দুটো দম্পতির দ্বিতীয় সূচনা হোক সুন্দর এবং পরিপূর্ণ।
সমাপ্ত