দ্বিধা চক্র পর্ব-০৫

0
203

#দ্বিধা_চক্র
পর্ব ৫

শহরের কোলাহল ছেড়ে পদ্মা পাড়ে চলে গেল নিলয়। সেখানেও কম কলরব নয়। সন্ধ্যা বাতি চারিদিকে জ্বলে উঠেছে। কিছুক্ষণ পর নীরবতা বাড়বে। একা আনমনে হাঁটতে থাকলো। মৃদু বাতাসে আকাশের লালিমাকে সঙ্গী করে হাঁটতে ভালোই লাগছে।
-এই যে মেরুন শার্ট, নিলয় সাহেব!
নিলয় থামলো, চমকালো কিন্তু পরক্ষণেই স্থির হলো। মাথায় পুরোপুরি গিঁথে গেছে অবনি। সারাক্ষণ ভাবতে ভাবতে চারপাশে অবনিকেই দেখতে পায়, শুনতে পায়।এর আগেও এমন হয়েছে। অথচ অবনি ছিল না কোথাও। ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না। নিলয় কেন মাথা থেকে অবনিকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না?
নিলয় আবার হাঁটতে শুরু করলো।
– কি ব্যাপার? আমাকে ইগনোর করতে চাইছেন? নিলয়ের সামনে দাঁড়ালো অবনি।
নিলয় অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো।
-কথা বলছেন না কেন? বিরক্ত করলাম?
– তুমি এখানে?
-আপনি যে কারণে, আমিও সেকারণে।
-মানে?
-বন্ধুদের নিয়ে ঘুরছি। আপনি?
-আমি একা?
-ও, মন খারাপ বুঝি?
নিলয় অবনির দিকে চেয়ে রইলো।
অবনি উত্তরের অপেক্ষা করছে।
-আমরা কিছুক্ষণ বসতে পারি? তোমার সময় হবে?
এমন গম্ভীর নিলয়কে অবনি আশা করেনি। বলল, আচ্ছা, বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসছি।
দুজন হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে পাড়ে বসলো।
-আপনি আজ কোনো স্পেশাল জায়গায় গিয়েছিলেন?
-হুম, কি করে বুঝলে?
-ছুটির দিনেও ফরমাল পোশাক, তাই।
নিলয় চুপ করে থাকলো।
-কনে দেখতে গিয়েছিলেন বুঝি?
-হুম!
-পছন্দ হয়নি তাই মন খারাপ? নাকি সেই মেয়েও…..
-না, যাই নি। মাঝপথে নেমে গেছি।
-ওমা, কেন?
নিলয় মুখ নামিয়ে আনমনে বলল, জানি না।
অবনি চুপ করে গেলো। নিলয়ও চুপ রইলো।
-আপনার পছন্দ মতো কাউকে পাচ্ছেন না?
নিলয় অন্যপাশে মুখ ঘুরালো। দূর প্রান্তে চেয়ে বলল, আমার কি চাই আমি নিজেও হয়তো জানি না। পছন্দের তালিকায় যা যা ছিল তেমন কাউকে পাই নি আমি অথচ এখন…. এমন একজনকে মনে বসিয়েছি যার কিছুই আমার পছন্দের সাথে মেলে না।
অবনি গম্ভীর হলো। ধীর গলায় বলল, এখন কি করবেন?
-আমার করার কিছু নেই।
-একটা প্রশ্ন করি?
– হুম।
-আপনার মনে যে বসে আছে সে কি আমি?
নিলয় নির্দ্বিধায় বলল, হু!
অবনি অপ্রস্তুত হল। শান্ত গলায় বলল, জীবন অনেক বৈচিত্র্যময়। প্রাণখুলে বাঁচতে শিখুন। সবকিছু ইগোতে নেয়ার দরকার নেই।
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো নিলয়ের বুক চিঁড়ে।
– ইগো! আমার বাবাও তাই ভাবছে। বলেছে, তোমার মানা করে দেয়াটা আমি নিতে পারছি না।
-আপনার কি তাই মনে হয় না?
-হয়তো! আমি ঠিক বুঝছি না।
-আমি খুব সাধারণ মেয়ে। আমাকে অতিরিক্ত প্রাধান্য দেয়ার দরকার নেই।
-সেটা আমারও কথা। কেন আমি সারাক্ষণ তোমার কথা ভাবি। কেন? কি কারণ? আজ অন্য মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। খুব করে চাইছিলাম মনকে ভিন্ন দিকে ফিরাতে। আমি পারছি না। আমার আর কী করা উচিত বলতে পারো?
-আমাকে আবিষ্কার করার ইচ্ছেটাকে ছেড়ে দিন।
-আমি ওসব তাত্বিক কথা বুঝি না অবনি। তোমাকে আবিষ্কার করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
তুমি জানো না, তোমাকে চুপিসারে দেখতে আমার ভালো লাগে। প্রতিদিন দেখি। গতকাল তুমি তোমার বাম হাতে চানাচুরের ঠোঙ্গা আর তেঁতুলের আচার একসাথে ধরে ছিলে। একবার চানাচুর মুখে দিচ্ছিলে সাথে করে আঙুলের ডগায় আচার তুলে চুষে খাচ্ছিলে। এমন অপরিষ্কার, জীবানুযুক্ত দৃশ্য আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখার মানুষ আমি নই অবনি। আমার স্বভাবের সাথে এসব যায় না।
অসাবধানে হাঁটতে গিয়ে নোংরা পানিতে পা দিলে তুমি। জিভ কেটে বান্ধবীর সাথে হাসতে শুরু করলে। ব্যাগ থেকে ময়লা টাকা বের করে ফকিরকে দিলে। আবার সেই হাতেই আচার তুলে মুখে দিলে। আমার অপছন্দের তালিকায় যা যা ছিল, তুমি সেই সব দোষের অধিকারী। অথচ এমন দৃশ্য আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। আমার ইচ্ছে করছিল তোমার সাথে আমিও আঙুলের ডগায় আচার তুলে খাই। ইচ্ছে করছিল এভাবে আরো কিছু সময় তোমার পিছে পিছে চলি। এসব কি আবিষ্কার করা, বলো? আমার ইগো, আমার খুঁতখুতে স্বভাব, আমার নিয়ম মেনে চলা কিছুই তোমার সাথে মিলে না তবু আমি শুধু….
-শুধু কি? অবনি প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকালো।
নিলয় অবনির চোখে চোখ রেখে বলল, এই যে দুজনে বসে গল্প করছি এটাই ভালো লাগছে। এরচেয়ে বেশি কিছু চাই না।
অবনির চোখ নড়ে উঠলো, কিছুটা হতাশ হলো মনের গোপনে। মুখ অন্যপাশে ফিরিয়ে বলল, সেটাই ভালো।এরচেয়ে বেশি কিছু চাইতে হলে চাওয়াটা দুপক্ষের দিক থেকেই হতে হয়।
নিলয় মুখ নামিয়ে হাসলো। জানি, তুমি আমাকে পছন্দ করো নি। তাই জোর করছি না। ভালো থেকো।
নিলয় উঠে হাঁটতে শুরু করলো।
-এই শুনুন!
নিলয় থামলো না। ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল।

অবনি একাই কিছুক্ষণ খোলা বাতাসে বসে রইলো।বাসায় ফিরে কাপড় না বদলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাতের খাবারের ডাক এলেও ঘুমিয়ে গেছি জানিয়ে উঠল না। অথচ রাতটা কাটলো নির্ঘুম। নিলয়ের কথাগুলো বার বার মাথায় ঘুরতে থাকলো। নিলয় কি অবনিকে ভালোবেসে ফেলেছে ? এভাবে ভালোবাসা হয় বুঝি ? কই, অবনির মনে তো কোনো অনুভূতি হচ্ছে না? একটু মন খারাপ হচ্ছে তবে সেটা নিলয়ের মন খারাপ দেখে। অবশ্য দুইদিন পর নিলয় যখন অন্য কাউকে বিয়ে করবে তখন কোথায় হারিয়ে যাবে এসব মন খারাপ! রাস্তায় অবনির সাথে দেখা হলে নিলয় তার বউকে বলবে, এই মেয়েটার একসময় পিছু নিতাম। বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। ভালোই হলো মেয়েটা মানা করে দিয়েছে। নইলে তোমাকে পেতাম কি করে! আহ্লাদি বউয়ের গালে টোকা দিয়ে আরো কত রোমান্টিক কথা বলবে!

অবনির বুকে চির চির করে হিংসার ব্যাথা উঠল। নিলয় অন্য মেয়েকে বিয়ে করে এই শহরেই ঘুরবে? অবনিকে দেখে তখনো কি নিলয়ের কষ্ট হবে না? চোখ এড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে?
আশ্চর্য! অবনি এতোকিছু কেন চিন্তা করছে! কেন বুকের মধ্যে হিংসার বুদবুদি জানান দিচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে আজকের সন্ধ্যাটা নিলয় যেন আর কারো সাথে না কাটায়। এই সন্ধ্যাটির অধিকার কেবল অবনির, নিলয়ের বিষাদগ্রস্ত মনের আকুতিও অবনি নিজের করে চায়।
আবার দেখা হলে এই অধিকারগুলো নিলয়ের কাছ থেকে চেয়ে নেবে অবনি। হ্যাঁ, অবশ্যই চেয়ে নিবে।

চলবে।