দ্বিধা চক্র পর্ব-০৬

0
185

#দ্বিধা_চক্র
পর্ব ৬

একটা বিয়েতে এসেছে অবনি তার পরিবারের সাথে। পরীক্ষা প্রস্তুতির মুহূর্তে এসব বিয়েতে উপস্থিত হওয়া বাড়তি ঝামেলা। কোনোভাবেই আসতে চায় নি। কিন্তু বাবার আবদার ফেলতেও পারে নি। বাবা কিছু চাইলো আর অবনি মানা করে দিলো তা কখনো হয়নি, হবারও নয়। ফরিদ সাহেব অনেক বেশি আদর আহ্লাদে বড় করেছেন তার দুই কন্যাকে। কখনো কোনো কিছুতে বাধা দেন নি। মেয়ে দুটোও বাবার সম্মান রেখেছে সর্বদা।
বিয়েতে এলেও জলদি ফিরে যেতে হবে এমন শর্ত দিয়েই আসা। অবনি জানে এখানেও নিশ্চয়ই ওর পাত্রপক্ষ অপেক্ষা করছে। এই ব্যাপারটা ওভাবে কখনোই ভয়াবহ লাগেনি অবনির। বিনা ঝামেলা করে সে একাধারে পাত্র দেখেছে, পছন্দ হয়নি বলে একাধারে মানাও করে গেছে। কৈফিয়ত দেয়ার প্রয়োজন পড়ে নি। মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফরিদ সাহেব কিচ্ছু করবে না জানে অবনি। মেয়ের মতো বাবারও বেস্ট টা চাই জীবনে।

বান্ধবী বা পরিচিত কাউকে পাওয়া যায় কিনা দেখতে এদিক সেদিক ঘুরতে লাগলো অবনি। বাইরে সবুজ ঘাসে বিছিন্ন ভাবে সাজানো বিয়ের ডেকোরেশন। কোথাও পরীর ডানা সাজানো, কোথাও সিন্ডোরেলার ঘোড়ার গাড়ি। ফটো তোলার হিড়িক পড়েছে সবখানে। এসব দেখতে দেখতে হঠাৎই মুখোমুখি হলো নিলয়ের সাথে। চমকে উঠলো দুজনই।
নিলয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো পূর্ণিমার চাঁদের মতো। স্নিগ্ধ সাজে এলো চুলের মেয়েটির কপালের ছোট টিপে চোখ আটকে গেল। দুজনেই বাকহারা হয়ে চেয়ে রইলো একে অপরের দিকে। কিন্তু আশপাশের কলরব কতক্ষণ আর দুজনকে স্থির হতে দিলো।
ঘোর কেটে নিলয় প্রশ্ন করলো, কেমন আছো?
-ভালো, আপনি?
-ভালো।
চুপ রইলো কিছুক্ষণ দুজনেই, কিন্তু সরে গেল না।
আর কি কথা বলা যায়? সামনে দাঁড়ানো মানুষটি যখন প্রতিপক্ষ ছিল তখন দেখা মাত্রই মনের ভেতর যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতো। কিন্তু এখন তো মানুষটাকে কেমন আপন মনে হচ্ছে। আপন মানুষের সাথে ঠিক কী কথা বলে গল্প শুরু করা যায়?
– আপনারা খেয়েছেন? বলেই মনে হলো ভুল কথা বলে ফেলেছে অবনি। নিলয় নিশ্চয়ই ভাবছে এরা বিয়েতে কেবল খেতেই আসে।
নিলয় স্বাভাবিক উত্তর দিল, না, আমার বোন এলে বসবো। ও একটু পর আসবে।
– ও।
– তুমি ?
– আমি বসে পড়বো। আমার পরীক্ষা সামনে। বাসায় ফিরতে হবে।
-ও।
কথা এর বেশি আর বাড়লো না। দু’জনই একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিলো।

নিলয় আজ আর আড়ালে দাঁড়িয়ে অবনিকে খেয়াল করলো না। গোপন কথাটা যখন বলাই হয়ে গেছে তখন আঁড়ালে দাঁড়ালেও তা প্রকাশিত হয়ে রবে।
আজ বরং অবনি চোরা চোখে বার বার নিলয়কে দেখতে লাগলো।
দুজন বন্ধু জুটে গেছে নিলয়ের। নিজেদের মধ্যে আড্ডা হচ্ছে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। আনমনেও যদি তাকাতো, জানতে পারতো এক মায়াবতী অধীর আগ্রহে কারো দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে।
বন্ধুদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো নিলয়। হঠাৎ পা পিছলে বেসামাল হয়ে পড়তে পড়তে বাঁচলো। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মুহূর্তে পেছন ফিরে অবনিকে খুঁজলো। দেখলো, কিছু দূরে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসি আঁটকে আছে অবনি।
অসহায় বোধ করলো নিলয়। মেজাজটাও বিগড়ে গেল।অবনির সামনেই এমন অঘটন হতে হলো? মেয়েটা নিশ্চয়ই এখন বলবে, অন্যের দোষ দেখে বেড়ায় অথচ নিজে ঠিকমতো চলতেও পারে না।
নিলয়ের গম্ভীর চাহনীতে অবনির আফসোস হলো, কেন হাসতে গেল? মানুষটাকে বিব্রত না করলেও হতো।

আবনির বাবা মায়ের সাথে নিলয়ের বাবা মায়ের দেখা হলো সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময়ও হলো। ভাগ্যে লিখা থাকলে আজ তারা নিকটাত্মীয় হতো।

খাওয়া শেষে বের হলে আবার নিলয়ের সাথে দেখা হলো অবনির।
– আপনারা আরো সময় থাকবেন?
– হুম, বর বাবার বন্ধুর ছেলে। আমাদের দেরী হবে বের হতে।
– ও, আমি কিছুক্ষণ পর চলে যাবো।
– একা যাবে?
– না, একা যাবো না। ঠোঁট টিপে হেসে বলল, কেন, একা গেলে সাথে করে এগিয়ে দিতেন?
– তোমার অনুমতি থাকলে অবশ্যই দিতাম।
অবনি হেসে উঠলো। সুযোগ পেলে সেটা আর হাতছাড়া করতে চান না দেখছি।
নিলয় গম্ভীর সুরে বলল, তুমি জিজ্ঞেস করলে তাই উত্তর দিলাম। এরচেয়ে বেশি কিছু নয়।
অবনির হাসি উড়ে গেল। লজ্জিত মুখে বলল, আমি বোধহয় আপনার সম্মানে আঘাত করলাম।
পকেটে হাত রেখে অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে নিলয় বলল, সম্মানে নয়, আমার অনুভূতিতে। যাগ গে, তোমার পরিবার এদিকে আসছে। আমি গেলাম। তারা ভাবতে পারেন, তাদের রাজকন্যাকে আমি শাসাচ্ছি কি না।
– আমার পরিবার এমন নয়।
নিলয় উত্তর দিলো না। গম্ভীর মুখে মৃদু হেসে বিদায় নিল।

কথা ছিল খাওয়া শেষেই অবনি বিদায় নেবে। অথচ একবারও বাবা মাকে বাড়ি ফেরার তাগাদা দিলো না। এ সুযোগে ফরিদ সাহেব ও তার স্ত্রী গল্পে মসগুল রইলেন। অবনি ঘুরে ঘুরে নিলয়কে আবার খুঁজতে লাগলো, পেলো না। নিলয়ের পরিবার অন্য একটি পরিবারের সাথে গল্প করছে। একটি শাড়ি পরা মেয়ে সে পরিবারের সাথে দাঁড়িয়ে আছে ।
মেয়েটা কি নিলয়ের পাত্রী?
বেশ ফর্সা গায়ের রং কিন্তু কেমন যেন বোকা বোকা চেহারা। নিলয় এমন মেয়ে পছন্দ করবে?
মেয়েটার সাজও একটু বেশি বেশি। নিলয় এতো সাজগোজ করা মেয়ে পছন্দ করে?
সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েটা বেশ লম্বা। মোটামুটি নিলয়ের সমানই হবে। এতো লম্বা মেয়েকে কি নিলয়ের পাশে মানাবে? নাহ্, মোটেও না। নিলয়ের কনে হওয়া উচিত চটপটে, মিষ্টি এবং উচ্চতায় মানানসই। ঠিক যেমন…..
কীসব ভাবছে অবনি? কেন ভাবছে? সে তো পদ্মার পাড়ে স্পষ্ট বলে দিয়েছে আগ্রহ দুপক্ষের থাকা চাই। অবনির দিক থেকে কোনো আগ্রহ নেই। নিলয় তা মেনেও নিয়েছে। তাহলে এখন সামনে দাঁড়ানো ওই নিরীহ গোবেচারী তালগাছকে কেন হিংসা করছে?
আচ্ছা নিলয় কোথায়, ওকে দেখা যাচ্ছে না কেন? নিলয়ের হৃদয় অবনি দখল করে ছিল, তা কি এখন আর নেই? এতো জলদি হাল ছেড়ে দিয়েছে?
তাই হবে, তাই তো আজ কেমন গা ছাড়া ভাব দেখালো!
ভেতরে ভেতরে অবনির মন অস্থির হয়ে ওঠে, অভিমান জমে। খুব তো বলেছিল অনুমতি দিলে সাথে করে পৌঁছে দেবে। অথচ নিজেই গায়েব।
অবনির বাবা মা এসে বলল, চল, রাত বাড়ছে। তোর তো আবার পড়া আছে।
ভার মুখে প্রস্থান নিল অবনি তার পরিবারের সঙ্গে।

ওদিকে নিলয় ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে আছে একঘণ্টা ধরে। সকল অঘটন আজই হতে হলো। প্রথমে অবনির সামনে পা পিছলানো তারপর পুরো গ্লাস পানি প্যান্টের ওপর পড়লো। তাও এমন বিচ্ছিরি ভাবে যে কারো সামনে যাওয়া ইজ্জতের ব্যাপার। অবনির সামনে তো প্রশ্নই ওঠে না।
হয়তো নিয়তিও চায় না ওদের মিলন। তাই তো অবনির ইচ্ছে মতো চলছে সব।

চলবে।
ঝিনুক চৌধুরী।।