দ্বিধা চক্র পর্ব-০৭

0
200

#দ্বিধা_চক্র
পর্ব ৭

এই যে সাদা শার্ট!
সম্মোধনটা পরিচিত বলে মুচকি হেসে পেছনে তাকালো নিলয়।
– তুমি এখানে? আমার পিছু নিচ্ছো বুঝি?
-আরে নাহ, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দোকানে ঢুকলাম। আপনি এখানে কেন?
-এটা আমার আস্তানা। ওপর তলায় আমার অফিস।
-ও আচ্ছা। অফিস শেষ?
-নাহ।
-কয়টা পর্যন্ত?
– এই আরো একঘন্টা আছে।
-ও!
-কেন?
-না এমনি, ভাবলাম দেখা যখন হয়েছে তখন না হয় একসাথে সামনে এগিয়ে গেলাম ।
নিলয় মুখ উজ্জ্বল করে হাসলো। অবনি তাকিয়ে রইলো। এই প্রথম কি নিলয় অবনির সামনে হাসলো?
-কটাদিন অফিসে যে পরিমান ফাঁকি দিয়েছি চাকরি না ছুটে যায়। সবশেষে দেখা গেল কপালে বউ জুটলো না, মাঝপথে আমি চাকরিহারা।
অবনি চোখ নামিয়ে নিল। হুম, ঠিক আছে, আসি আমি।
-না, না, দাঁড়াও একমিনিট।
ভেতরে একটা ছেলের সাথে কি যেন কথা বলে ফিরে এলো নিলয়। চলো।
-আপনার অফিস?
-আজ নাহয় শেষ বারের জন্য ফাঁকি দিলাম । মেহতাব সামলে নিবে।
বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। অবনি ছাতা মেলে জিজ্ঞেস করলো, আপনার সাথে ছাতা নেই ?
– ছাতা আনতে ভুলে গেছি, মিথ্যা করে বলল নিলয়।
-আচ্ছা, আসুন। আমার ছাতা যথেষ্ট বড়।
দুজনে একছাতার নিচে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলো। রাস্তা পাড় হয়ে খোলা মাঠের পাশ ঘেষে যাওয়া পাকা রাস্তায় অল্প সল্প গল্প চলল দুজনার।
-আজ আপনাকে বেশ হাসিখুশি লাগছে।
-হুম, ইদানীং ভালো ঘুম হচ্ছে।
-ও।
নিলয় জোরে হেসে উঠলো।
অবনি চমকে নিলয়ের মুখের দিকে তাকালো। নিলয়ের হাসি দেখতে ভালো লাগছে।
-অবনি, তোমাকে আজ কেমন বিভ্রান্ত লাগছে?
অবনি মুখ নামিয়ে আমতা আমতা করে বলল, রাতে ভালো ঘুম হয়নি।
– তাই! আমার কষ্টগুলো তুমি নিয়ে নিলে বুঝি?
অবনি চুপ রইলো।
নিলয় বলল, আমার ভালো ঘুম হওয়ার পেছনের কারণ কিন্তু তুমি।
-আমি?
– হুম, সেদিন পদ্মার পাড়ে তোমার সাথে গল্প করে মন অনেক হালকা হয়ে গেছে। তোমার একটা কথা আমার মনের চাপ কমিয়ে দিয়েছে।
-আমার? কোন কথা?
-বললে না, চাওয়াটা দুপক্ষেরই হতে হয়। সত্যিই তো! আমি একা চাপ নিয়ে মরে যাচ্ছিলাম। তোমার দিক থেকে সাড়াবিহীন হয়ে কতোদিন টিকে থাকতাম বলো? এরচেয়ে এই যে মাঝে মাঝে আমাদের হুটহাট দেখা হচ্ছে কথা হচ্ছে বন্ধুর মতো, তাই ভালো। ভাগ্যের জোড়া হয়তো আমাদের ভিন্ন কারো সাথে।
অবনি মিলন মুখে বলল, হুম!
-তুমি এতো নিষ্প্রাণ হয়ে আছো কেন?
-না এমনি। আপনি তাহলে খুব জলদি বিয়ে করতে যাচ্ছেন?
-তা জানি না। হয়তো।
-ও।

গত দুদিন অবনি সজাগ দৃষ্টিতে এদিক সেদিক চেয়ে সারাক্ষণ নিলয়কে খুঁজেছে। ভেবেছিল কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে হয়তো নিলয় দেখছে। হতাশ মনে বাড়ি ফিরেছে রোজ।
তাই আজ বায়োডাটা থেকে অফিসের ঠিকানা নিয়ে নিলয়ের অফিসের নিচে এসেছিলো। পদ্মা পাড়ের নিলয় যেন পুরোপুরি ভিন্ন কেউ ছিল। সেই মানুষটাকে খুব করে জানতে ইচ্ছে করছিল। ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিল তার হৃদয়ের ব্যাকুলতা। অথচ অবনির দিকে নিলয় এখন বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছে। অবনি খুশি হতে পারছে না। কোথায় যেন কি শুন্যতা, কি যেন হারিয়ে গেল! নিজের অনুভূতির দ্বিধা চক্র কিছুতেই মিলছে না অবনির। মন কী চাইছে?

বৃষ্টি কমে আসায় অবনি ছাতা বন্ধ করতে নিলো।
-ছাতাটা থাকুক না মাথার উপর!
অবনি চোখ তুলে তাকালো।
নিলয় অবনির চোখে চোখ রেখে বলল,
এক বিন্দুতে দুজন
থাকিনা কিছুক্ষণ!
হঠাৎ করে আসা দমকা হওয়া পরশ বুলিয়ে দিলো অবনির মনে-প্রাণে। দুচোখ ঝাপসা হয়ে এলো আনন্দঅশ্রুতে। কেমন যেন বৃষ্টি শেষে রংধনুর ছটা দেখতে পাওয়ার আনন্দ! চোখ আড়াল করতে অন্যপাশে মুখ ফেরালো অবনি।
– কি ভাবছো অবনি?
– না কিছু না। ছাতা বন্ধ করবো না?
পকেটে হাত ঢুকিয়ে সন্মুখপানে চেয়ে নিলয় বলল, তোমার ইচ্ছে।
-আমার ইচ্ছে শুনবেন আপনি?
-কেন শুনবো না? বলে দেখো।
– সত্যি?
– সত্যি।
-জুতা খুলুন তাহলে।
-কী কী ? চমকে উঠলো নিলয়।
অবনি হেসে উঠলো। আমি এমন কী বললাম যে আপনি লাফিয়ে উঠলেন?
-জুতা খুলবো কেন?
-কারন আমরা ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটবো।
-কী? হতবাক চোখে তাকালো নিলয়। মানে খুব দরকার? আমার তো দেখেই গায়ে কেমন কাটা দিয়ে উঠছে।
– কাটা দিবে কেন? আপনি কখনো ভেজা ঘাসে হাঁটেন নি?
– ইয়ে.. মানে.. ঘাসের উপর…
-ঠিক আছে আপনি থাকুন। আমার ছাতা এবং জুতাজোড়া পাহারা দিন।
অবনি তার জুতো খুলে দুহাতে পাজামা খানিক ওপরে টেনে ধরে মাঠে নেমে পড়লো।
সবুজ মাঠে পানিযুক্ত ঘাসের উপর লাল জামা পরে পা টেনে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে অবনি। এতো সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে!
নিলয় জুতোজোড়া খুলে প্যান্ট গুটিয়ে সামনে এগুলো। ঘাসের উপর পা দিতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল পুরো শরীরে। লাফিয়ে ফিরে এলো আগের জায়গায়। সেই কবে কখন ঘাস মাড়িয়েছে মনেও নেই। ছোটবেলা থেকেই পায়ে ক্যাডস পড়ে টিপটপ ফুলবাবু হয়ে খেলায় নামতো নিলয়। আজ হঠাৎ করে চাইলেই তো হবে না!

অবনি আনমনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই পেছন ফিরে মিষ্টি করে হাসছে। দূরে একা দাঁড়িয়ে একদম ভালো লাগছে না নিলয়ের। কেমন খাপছাড়া লাগছে।
সাহস করে ভেজা ঘাসে আবার পা দিল এবং এক পা দুই পা করে এগিয়ে যেতে থাকলো। অবনির কাছে যেতে যেতে মনের ঘিনঘিন অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নিরবে অবনির পাশে এসে দাঁড়ালে স্নিগ্ধ হাসি হাসলো অবনি।
নাহ্! এই মোহমায়া থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।

অবনি নিলয়ের দিকে হাত এগিয়ে দিল। নিলয় বুঝতে পারছে না কী করা উচিত?
দ্বিধাযুক্ত মনে অনুভূতির ভেলায় ভেসে হাত এগিয়ে অবনির হাত ধরলো।
অবনি সামনে এগুতে থাকলে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নিলয়ও সাথে সাথে চলল।
সামনের ছোট ঢালু গর্তের সামনে এসে নামতে বলল অবনি।
এইবার নিলয়ের মোহ সঙ্গে সঙ্গে কেটে গেল।
-অবনি এটাতে কাঁদা হবে!
-তো?
-এখানে কেন নামবো?
-আমি বলছি তাই।
-দেখো অবনি, এমন হতে পারে এখানে কুকুর হিশু করেছে কিংবা মানুষ….
-ছিঃ! আপনি বড্ড বেরসিক মানুষ !
-হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি তাই। আরো দুটো গালি দাও, সমস্যা নেই। তবু এখানে নামতে বলো না।
-নামতে হবে।
চিন্তার ভাঁজ পড়লো কপালে। দেখো অবনি, তোমার চটপটিতে সেদিন সত্যিই ঝাল ছিল। আমি ইচ্ছে করে বাজে ব্যবহার করিনি তাও যদি বলো সরি বলতে রাজি আছি।
-নামুন!
-শোনো শোনো, আমি বার বার নিজেকে তোমার সামনে বেস্ট প্রমাণ করতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিবার ধরা খেয়েছি। আমি বেস্ট নই মানছি, আমি এতোটা সাহসী মানুষও নই।
-তাহলে আসুন, দুজনে একসাথে নামি।
-অবনি, থামো না প্লিজ। পদ্মার পাড়ে তোমার কাছ থেকে চলে এলেও আমার মন তোমার সাথে আরো কিছুসময় থাকতে চেয়েছিল।
-চলুন নেমে পড়ি।
-না না অবনি, আরেকটা সত্যি কথা বলতে চাই। আশাকরি এটা শুনলে তুমি আমাকে ছেড়ে দিবে?
-কী?
-গতরাতে তোমাকে স্বপ্ন দেখেছি। তুমি…..
নিলয়ের হাত শক্ত করে ধরে কাঁদায় পা রাখলো অবনি। নিলয়ও তাল সামলাতে না পেরে নিচে নামলো।
গুঁড়ো গুঁড়ো বালিকাঁদার মিশ্রণ পায়ে অনুভূত হওয়ায় মুখ কুঁচকে চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে ধরলো নিলয়।
নিলয়ের মুখের ভঙ্গিমা দেখে ঠোঁট টিপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল অবনি।
নিলয় সাহেব, স্বাভাবিক হোন। আপনি নর্দমায় নামেন নি।
নিলয়ের কান্না আসছে। জীবনে এমন পরীক্ষা দিতে হবে কে ভেবেছিল। বেছে বেছে এমন মেয়ের প্রেমেই পড়তে হলো!
– এই যে, শুনছেন আমার কথা?
খুব কাছ থেকে একেবারে বুকের পাশে অবনির কথাগুলো ধ্বনিত হলো। নিলয় ধীরে ধীরে অনুভব করলো দুহাতে জড়ানো অবনির নরম হাত, চুলের মিষ্টি সুবাস, কাঁদা পানির মাঝে অবনির পায়ের আঙ্গুলগুলো নিলয়ের আঙুল ছুঁয়ে আছে।
চোখ খুলে সরাসরি অবনির চোখ তাকালো।
অবনি লজ্জা পেল। বেখেয়ালি হয়ে খুব বেশি কাছে চলে এলো কি?
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু মুহূর্ত নীরবে কেটে গেল।
-কেমন লাগছে বলুন?
-সবচেয়ে ভালো।
-তাহলে এতো মানা করছিলেন কেন?
-অবনি!
– হু..
-তোমাকে ভালোবাসি!
-ধ্যাৎ! সজোরে ধাক্কা দিল অবনি। নিলয় ভেজা ঘাসের উপর পড়ে পুরোপুরি ভিজে গেল।
অবনি ভাবলো নিলয় হয়তো রাগ করবে। কিন্তু নিলয় ভেজা শরীরে ঘাসের উপর বসেই জিজ্ঞেস করলো, আমাকে বিয়ে করবে অবনি?
অবনি কেঁপে উঠলো। তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারলো না। নিলয়ের চোখের আকুতি উপেক্ষা করার উপায় নেই। উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলো।
অবনি যেও না। উত্তর দাও, প্লিজ।
অবনি থামলো। ফিরে তাকিয়ে বলল, আপনাকে বিয়ে করার একটা যৌক্তিক কারণ বলুন, শুনি!
– সারাজীবন তোমার পিছে ভেড়ার মতো ঘুরবো।
– ছিঃ! আপনি আসলেই বেরসিক মানুষ।
– যেও না, অবনি।
– আপনি ফেল করেছেন। আমি একটা ভেড়াকে বিয়ে করতে যাবো কেন?
– তাহলে এই নিলয়কে বিয়ে করো। গ্যারান্টি দিচ্ছি ঠকবে না।
– কিসের গ্যারান্টি?
– আমার পরিবারের গ্যারান্টি।
অবনি অবাক চোখে তাকালো।
– হ্যাঁ অবনি, আমার পরিবারের প্রতিটা সদস্য খুব ভালো। তোমাকে মাথায় তুলে রাখবে। মা তোমার সাথে বসে রোজ ফুচকা খাবে, নদী বসে আচার চাটবে। বাবা আর লুকিয়ে মরণ চাঁদ হোটেল থেকে ডাল,পরোটা, ডিমভাজা কিনে আনবে না বরং তোমাকে সাথে নিয়ে আয়েশ করে হোটেলে বসেই খাবে। পুরো পরিবারের রাজত্ব তোমার হাতে থাকবে অবনি। আমি হব স্বেচ্ছায় রাজ্যত্যাগী সুখী মানুষ। বলো, করবে আমাকে বিয়ে?
অবনি ততোক্ষণে ছুটে পালাতে শুরু করেছে। খুব লজ্জা লাগছে। এভাবে খোলা মাঠে বৃষ্টি ভেজা বিকালে কেউ ভালোবাসি বলবে তা কি কখনো কল্পনা করেছিল!
দূরে যাওয়া অবনির উদ্দেশ্য চেঁচিয়ে নিলয় বলল, উত্তর দাও অবনি।
অবনি যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ভেবে দেখবো।
নির্জন মাঠে একজোড়া কপোত-কপোতী কথার আদান-প্রদান ঠিকঠাক না করলেও ভাবের আদান-প্রদান যথোপযুক্তভাবে করে নিলো। দুজনার হাস্যোজ্জ্বল মুখ পুরোটা না দেখলেও আংশিক দৃশ্য দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো একজন। প্রথমেই কল করে জানালো অবনির বাবাকে, ‘আপনার মেয়ে প্রেম করে আর আপনি আমার কাছে পাত্র খুঁজেন?’
প্রতিউত্তরে সুবিধা করতে না পেরে লাইন কেটে আরেকটি নাম্বারে কল দিল।
-আপনার ছেলে প্রেম করে বেড়াচ্ছে খরব রাখেন কিছু?
প্রতিউত্তরে আলহামদুলিল্লাহ শুনতে পেয়ে মোবাইলটাকে আঁছাড় মারতে ইচ্ছে করলো ঘটকের।

চলবে।
ঝিনুক চৌধুরী।