ধরো যদি হঠাৎ সন্ধ্যে পর্ব-০৫

0
215

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ০৫
#_আরজু_আরমানী

মায়ের চড় খেয়ে ফ্লোরে পরলাম। আজ হঠাৎ এই হামলার কারন আমার জানা নেই। আজ আমি কোনো অন্যায় করিনি। তার সাথে খাবার খেতে বসিনি, তাসকিনের কোনো খাবার খাইনি। তবে এই মারের কারন কি? আমার চুল ধরে ফ্লোর থেকে উঠালেন। সে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আগে তিনি আমায় মারলে আমার চোখে থাকতো অসামান্য জল। তবে আজ জল কেনো কোনোকিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। আমার চুল ধরে জিজ্ঞেস করলেন,

” আমি যখন বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজে আনি তখন বিয়ে করিস না। আজ অন্য ছেলের সাথে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াস। এসব কর আমার বাড়িতে থাকতে পারবিনা। কে ওই ছেলেটা?”

মায়ের হাতে মার খাওয়ার অভ্যাস তো এখন পুরনো হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি কোন ছেলের কথা বলছেন? সাদ নামটা মাথায় আসতেই সবটা বুঝেছি। তার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। তার থেকে নিজের চুল ছাড়িয়ে নিয়ে ধীর স্বরে বললাম,

” এই বাড়িটা আপনার নয়। আমি যতদূর জানি, এটা আমার দাদা রেদোয়ান খানের ঘাম ঝরানো টাকায় তৈরি করা বাড়ি। আপনি এই বাড়িকে নিজের বাড়ি বলে আমার দাদাকে অপমান করছেন। এটা আমি মেনে নেবো না। সরি।”

তিনি আমার কথা শুনে ভুত দেখার মতো তাকিয়ে আছেন। তার মনে হচ্ছে এটা রাত্রি না অন্য কেউ। রাত্রি তো কখনো কারো আঘাতের পাল্টা জবাব দিতো না। তখন কেউ বলে উঠে,

” তাহিরা তোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। নিজের দাবার চালে এবার তুই নিজেই ফেঁসে যাবি। উল্টো দিন গোনার সময় এসেছে। ভোঁতা লোহাকে আঘাত করতে করতে সেও একসময় ধারালো ফলায় পরিনত হয়। ”

আমি তাকিয়ে দেখলাম নানু। তিনি এসব কথা বলছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। সে আমার মাথায় চুমু খেয়ে বললো,

” বাহির থেকে এসেছো। ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আসছি তোমার রুমে। ”

আমি চলে এলাম নিজের রুমে। হাতের পার্সটা টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। শাওয়ার নিলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে হেয়ার ড্রেয়ার দিয়ে চুল শুকালাম। রান্নাঘরে এসে এক মগ হট কফি বানালাম। নিজের রুমের বারান্দায় এসে বসলাম। চুলগুলো ছাড়া। কফিতে চুমুক দিলাম। মোবাইলের নেটটা অন করলাম। অনেক অনলাইন ক্লাস খুঁজলাম। দুটো ভালোমানের পেয়েও গেলাম। তবে সেখানে আগে টাকা জমা দিতে হবে। সাত হাজার টাকা লাগবে। আমার কাছে আছে শুধু পাঁচ হাজার। বাকি টাকা কোথায় পাবো? এখন মাসের মাঝামাঝি সময়। কোনো স্টুডেন্টের বাবা- মা এখন টাকা দিবেনা। মাথায় আবার নতুন করে চিন্তার বাসা বাঁধলো। আমার ড্রয়ারে চার হাজার টাকা আছে কিন্তু সেটা আমি নিবোনা। তখন নানু আমার রুমে ডুকলো। বারান্দায় এসে আমার পাশে বসলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

” তুমি কি আমার দু হাজার টাকা দিতে পারবে? আমি সামনে মাসেই দিয়ে দেবো।”

” হ্যাঁ। তবে কেনো জানতে পারি?”

তাকে পুরো বিষয়টা খুলে বললাম।। সে তখনি টাকা দিয়ে দিলো। আমি অনলাইন কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। আমাকে ক্লাস করতে দেখে নানু অন্য রুমে চলে গেলেন।

————————-

সকালটা আমার খুব সুন্দর ভাবেই কাটলো। দুপুরে গোসল সেরে বাইরে আসতেই নিরব ভাইয়ার ফোন পেলাম। ওনার ফোন রিসিভ করলাম। উনি বললেন,

” আমাদের বাসায় একটু আসতে পারবি?”

তার কথা শুনে মনে হলো সেদিনের করা সেই বিশ্বাসঘাতকতার কথা। বিদ্রুপের হাসি হেসে বললাম,

” আপনি বিশ্বাসের সেই স্থানটা হারিয়ে ফেলেছেন। ”

” প্লিজ। ”

ফোন কেটে দিলাম। তার কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না। আমার রুম থেকে বের হলাম। সবাই খেতে বসেছে। আমি রান্নাঘরে গিয়ে খাবার নিয়ে আমার রুমে ঢুকলাম। খাওয়া শেষ করে টিউশনে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। তখন বাবার আগমন ঘটলো আমার রুমে। দরজা নক করেই রুমে ঢুকলেন তিনি। আমি তাকে বসতে বললাম। সে বসলো। আমার উদ্দেশ্যে বললো,

” তুমি আর টিউশনি করতে যেওনা। তোমার মা এটা মেনে নিতে পারছেনা। ”

” যে ভালোবাসতে জানেনা তার শাসন করার কোনো অধিকার নেই বলেই আমি মনে করি। এ বিষয়ে আমি কারো সাথে কথা বলতে চাই না। ”

” আমারও কিন্তু সম্মান হানি ঘটে। আমার দিকটা একটু ভেবে দেখো।”

বিরক্তিমাখা কন্ঠে তাকে বললাম,

” কেউ কি আমার কথা কখনো ভেবেছে? যে আমি তাদের কথা ভাববো।”

আমার তৈরি হওয়া শেষ। পার্সটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। বাবার সাথে কথা বলতে আমার একটুও ভালো লাগেনা। একটা রিক্সা ডেকে নেহাদের বাসার উদ্দেশ্যে চললাম।

————————-

নেহাকে পড়াচ্ছি। আমার ভীষন তেষ্টা পেয়েছে। নেহাকে বললাম,

” এক গ্লাস পানি খাওয়াও নেহা।”

নেহা উঠে পানি আনতে যেতেই ওখানে এলো সাদ। তাকে দেখে আমি নড়েচড়ে বসলাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

” তুমি কোন কলেজে পড়ো?”

” ভর্তি হইনি এখনো।”

” মানে তুমি মাত্র এস.এস. সি. পাশ করেছো। ”

” হ্যাঁ।”

নেহা পানি এনে আমাকে দিলো। আমি পানি খেয়ে ওকে পড়ানো শুরু করলাম। সাদ নামক বাচালটার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। সে আমার পড়ানো থামিয়ে বললো,

” তুমি ওকে পড়াবে পরে। আমি আগে তোমার ক্লাস নিবো। তুমি কি পারো? কতদূর লেখাপড়ার দৌড়? সেটা আমাকে জানতে হবে। বলো তোমার পড়াশোনা কতদূর?”

” আমি মাত্র এস. এস. সি. পরীক্ষা দিয়েছি। এখনো কোনো কলেজে ভর্তি হইনি। ভর্তি হবো কিনা তাও নিশ্চিত না। এতটুকুই দৌড় আমার লেখাপড়ার। ”

সাদ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বললো,

” মাত্র মেট্রিক পাশ করেছো তুমি। এই পাশ নিয়ে তুমি আমার মতো মাস্টার্স ডিগ্রী হোল্ডারের বোনকে পড়াচ্ছো। তুমি আদৌও কি কিছু পারো? আমার মাথায় ঢুকছে না। ”

কথাগুলো আমার আত্মসম্মানে আঘাত করলো। আমি তাকে কিছু বললাম না। নেহাকে জিজ্ঞেস করলাম,

” তোমার আম্মু কোথায়?”

” তার রুমে।”

আমি মিস শিখার রুমের দরজা নক করে বললাম,

” আন্টি আমি কি ভেতরে আসব ?”

ভদ্র মহিলা শোয়া থেকে উঠে বসলেন। আমাকে ভিতরে আসতে বললেন। আমি তার রুমে ঢুকলাম। সে আমাকে বসতে বললো। আমি পাশে থাকা চেয়ারটাতে বসলাম। আমি তাকে বললাম,

” আন্টি আমাকে ক্ষমা করবেন। এই কথাটা আমি আপনাকে কখনো বলতে চাইনি। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি।”

তিনি চিন্তিত মুখে বললেন,

” কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো।”

” আন্টি আমি আর নেহাকে পড়াতে পারবোনা।”

” কেনো মা? কি হয়েছে? ”

” আন্টি যেখানে আত্মসম্মানে আঘাত পরে সেখান থেকে সরে যাওয়াটাই বেশি ভালো। আপনি আমাকে প্লিজ জোর করবেন না। আমার যোগ্যতা সম্পর্কে আপনি জানেন।আমার লেখাপড়া দেখেই আপনি আমাকে পড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন। সেখানে অন্য কেউ উল্টো পাল্টা কথা বললে আমি থাকতে পারবোনা। আমি আসি।”

আমি আর কোনো কথা বলিনি। চলে এলাম ও বাসা থেকে। অন্য দুটো টিউশনি করিয়ে আমার মাসের খরচ চলে যাবে। আল্লাহর উপর ভরসা। অন্য দুটো টিউশনি করিয়ে বাসায় ফিরছি। বাসে বসে আছি। অনেক মানুষ বাসটাতে। পাশে একজন লোক বসে আছে। বই দিয়ে মুখ ঢাকা। নিশ্চয়ই স্টুডেন্ট হবে। গরমে ঘামে আমার পিঠ ভিজে চিপচিপে হয়ে আছে।প্রচন্ড পানি পিপাসা পেয়েছে। কিন্তুু আমার কাছে কোনো পানির বোতল নেই।পাশের লোকটা আমাকে বললো,

” পানি খাবেন?”

কন্ঠটা পরিচিত লাগলো। তার দিকে তাকাতেই অবাকের চরম সীমায় পৌছালাম। সাদ আমার পাশে বসে আছে। তার বলা কথাগুলো মনে পরলো। বাসের মধ্যে কোনো সিনক্রিয়েট করলাম না। সামনের স্টপেই আমি নামবো। এটুকু সময় চুপ করে থাকতে হবে। সেই অনুযায়ী চুপ থাকলাম। সাদ তখন বললেন,

” সরি তোমাকে ওভাবে কথাগুলো বলা ঠিক হয়নি।”

আমি তার কোনো কথার জবাব দিলাম না। মূলত তার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। আমাকে চুপ থাকতে দেখে সাদ বললো,

” প্লিজ রাত্রি…….

সে সবটুকু কথা শেষ করতে পারলোনা। তার আগেই বাস থামলো। আমি নেমে গেলাম। সেও আমার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগলো। কতটুকু আসার পর আমি তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। হালকা কন্ঠে আমি তাকে বললাম,

” দেখুন, আপনার সাথে কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। আপনি আমার পিছনে পিছনে আসবেন না। এতে আমার সমস্যা হয়। প্লিজ আপনার কাছে অনুরোধ আমার আপনি আর আমাকে ফলো করবেন না। আমি আর কখনো আপনার বাসায় যাবোনা। মাফ করবেন।”

কথাগুলো বলে আমি দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সে হয়তো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। থাক তাতে আমার কি? বাসার সামনে চলে এসেছি। কলিংবেল টিপতেই তাসকিন দরজা খুললো। আমি কোনো দিকে না তাকিয়ে আমার রুমের দিকে চলে এলাম। ড্রেস পাল্টে শাওয়ার নিয়ে একমগ ব্লাক কফি বানিয়ে বারান্দায় বসলাম। অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। আমি জয়েন হলাম তাতে। ফোনে কখন একটা কল এলো। সম্পূর্ণ আন নন নাম্বার থেকে। কলটাকে ডিকলাইন করে আবার ক্লাসে মনোযোগ দিলাম। ক্লাস শেষ করে শুয়ে পরলাম। তখন আবার কল এলো সেই আন নন নাম্বার থেকে। এই আন নন নাম্বারের জ্বালাটা মনে হয় আবার শুরু হবে। প্রবল বিরক্তিতে কপাল কুচকে ফোনটা রিসিভ করলাম।

” আই আম সরি। ”

আর কোনো কথা শুনতে পেলাম না। ফোনটা কেটে গেলো। কে ফোন করলো? তার পরিচয়টা অব্দি জানিনা। আর আমাকে এভাবে সরি বলার কি দরকার। কারো কাছে আমি এতোটা ইম্পরট্যান্ট নই। হয়তো রাস্তার কোনো পাগল হবে। আমি এসব চিন্তা করতে করতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।

চলবে…………..