ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে পর্ব-০৬

0
202

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ০৬
#_আরজু_আরমানী

বারান্দায় চড়ুই পাখি ডাকছে। কিছুক্ষন আগে আমার ঘুম ভেঙেছে। চোখ ডলতে ডলতে বারান্দায় গেলাম। দুটো চড়ুই নীল অপরাজিতা ফুলের গাছে লতায় বসে আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ওদের ধরতে চাইলাম। কিন্তু ওরা টুস করে উরে গেলো। আমার মন খারাপ হলো। ফোন বেজে উঠলো। স্কিনে না তাকিয়েই ফোন রিসিভ করলাম,

” রাত্রি, আমি সাদ বলছি।”

আমি থমকে গেলাম। উনি কেন ফোন করেছেন? কি দরকার আমার কাছে ওনার? আমার ফোন নাম্বার পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ওনার সাথে রাগ দেখাতে ইচ্ছে হলো না। ধীর কন্ঠে বললাম,

” কি দরকার?”

” প্লিজ তুমি আমার সাথে একটু দেখা করো। আমার তোমাকে খুব দরকার। ”

কেনো দরকার সেটা সে বলেনি। আমি আজ একটু বাহিরেও যাবো। তাকে বললাম,

” কোথায় আসতে হবে?”

” আমি ঠিকানা এবং সময় ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিচ্ছি। ”

ওনাকে সম্মতি জানিয়ে দিলাম। ফোন রেখে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ফ্রেশ হয়ে তৈরি হলাম। একটু পরেই মোবাইলে উনি ঠিকানা এবং সময় জানিয়ে দিলেন। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক নয়টা বেজে পঁচিশ মিনিট। আমি দরজা খুলে বেরুতেই মায়ের হুংকার শুনতে পেলাম,

” এখন কি টিউশনি আছে? ”

তার এই ধমক গায়ে মাখালাম না। জুতা পায়ে ঢুকাতে ঢুকাতে বললাম,

” শপিং আছে। ”

” পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে।”

আমি কোনো কথা না বলে সোজা বের হয়ে এসেছি। আমি জানি আমার মা এখন পুরো বাড়ি মাথায় তুলবে। সবাই ডাকবে। আমাকে কতক্ষণ বকবে। তারপর আবার থেমে যাবে। আমি একটা রিক্সা নিয়ে সাদের দেয়া ঠিকানায় চলে এলাম। তিনি রেস্টুরেন্টের কর্নারের একটা টেবিলে বসে ফোন টিপছে। আমি গিয়ে সেখানে বসলাম। তিনি আমাকে দেখে ফোন রেখে বললেন,

” কি খাবে?”

” কিছুই না। আপনার দরকার টা কি সেটা বলুন। আমার একটু কাজ আছে। ”

” রাত্রি প্রথমত, আমাকে ক্ষমা করো। সেদিন তোমার সাথে ওইভাবে কথা বলার জন্য। যার জন্য এখন আমাকে তার মাসুল দিতে হচ্ছে। তুমি সেদিন চলে আসার পর থেকে নেহা আর পড়াশোনাই করছে না। আমি বা মা কেউ তাকে পড়াতে পারছি না। অন্য টিচার আনলেও সে নাকি পড়বে না। একমাত্র তুমি ছাড়া অন্য কারো কাছে সে পড়বে না। প্লিজ তুমি নেহাকে পড়াতে আসো।”

” আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আর আসতে পরবোনা।”

” উপকারীর উপকার একটু হলেও করো।”

মনে পরলো সেই সন্ধ্যের কথা। উনি আমায় সেদিন বাসায় না পৌঁছে দিলে আমি অনেক সমস্যায় পড়তাম। আজ সে সেই কথা তুলেছে। তার জন্য এটুকু তো আমি করতেই পারি। অবশেষে রাজি হলাম। তাকে বললাম,

” আমাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে।”

” কেউ করবে না। ধন্যবাদ আমার কথাটা রাখার জন্য। ”

আমি হেসে তাকে বললাম,

” কথা রাখা নয় আপনার উপকারের প্রতিদান এটা। এর বেশি কিছুই না।”

আমি চলে এলাম। বিকালে নেহাকে আবার পড়াতে যেতে হবে। কাল একটা কলেজে পরীক্ষা আছে। শপিং করেই বাসায় চলে এলাম। বাসায় ঢুকে দেখলাম আমার চৌদ্দ গুষ্ঠি ড্রয়িং রুমে বসে আছে। আমাকে দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে। আমি বুঝলাম না তাদের এই হাসির কারন। আমি আমার রুমে ঢুকে গেলাম। শরীর থেকে ঘামের গন্ধ আসছে। আমি গোসল করে এসে দেখি আমার বিছানায় এশা আপু, তিহা, তিশা, মেহেরিমা বসে আছে। ওদেরকে বললাম,

” যাও তোমরা। আমার কালকে একটা পরীক্ষা আছে। ”

” বিয়ের পর সব করিস।”

এশা আপুর কথা শুনে বললাম,

” আমার বিষয়ে কাউকে নাক গলাতে বারন করেছি।”

তারা আশ্চর্য হলেন। অবাক দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে আছে। আমি তাদের উপেক্ষা করে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। ভিতরে তাদের কথা শুনতে পেলাম। তারা বলছে,

” তাহমিদ ভাইয়ের কপালে দুঃখ আছে বুঝলি। রাত্রিকে আজকাল চেনা যায় না।”

” তাহমিদ ভাইয়া যে ওকে ভালোবাসে এটা কি ও জানে?”

ওদের এরকম কথায় আমার মন বিষিয়ে উঠলো। শেষ পর্যন্ত তাহমিদ ভাইয়া। তিনিও ধোকাটা দিলেন আমায়। বাহ রাত্রি বাহ দেখ তোর কপাল। আমি রুমে ঢুকে এশা আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,

” আচ্ছা আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে মোড়ে একটা ফার্মেসি আছেনা। ওখানে কি পটাশিয়াম সায়ানাইড পাওয়া যায়? ”

ওরা সবাই আঁতকে উঠলো আমার কথা শুনে। তিহা বললো,

” ওটা তো বিষ জাতীয়। তুমি কি করবে ওটা দিয়ে। ”

” বিষ মানুষ কি করে? আমিও সেটাই করবো।”

তখন ফোন বাজলো এশা আপুর। তিনি ফোন রিসিভ করে আমার কানে ধরলেন,

” এশা ফোনটা রাত্রির কাছে দে।”

আমি তাহমিদ ভাইয়ার কন্ঠ শুনে চেচিয়ে বললাম,

” আমাদের বাসায় আসুন একটা পটাশিয়াম সায়ানাইডের বোতল নিয়ে। ”

ফোনটাকে ধরে ফ্লোরে ফেলে দিলাম। কয়েক টুকরো হলো ফোনটা। রাগে চেচিয়ে বললাম,

” সবকটা স্বার্থপর। কেউ আমায় ভালোবাসেনা। আমিও কাউকে ভালোবাসিনা। ঘেন্না করি তোমাদের প্রত্যেককে। কেউ আমার সাথে আর কথা বলবে না। কেউ না। চলে যাও। ”

সবাইকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিলাম। দরজাটা বন্ধ করে কাঁদছি। কেন কেন কেন সবাই শুধু আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকের ন্যায় আচরন করে? ছোটবেলা থেকে মায়ের ভালোবাসা পাইনি। বড় হয়ে তার সমস্ত অন্যায় আমি সহ্য করেছি। বাবা কখনো আমার পাশে এসে দাড়ায়নি। কেউ কখনো আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলায় নি। কারো কোনো শক্ত হাত পাইনি আমার বিপদের সময় ধরার জন্য। কোনো একটা কাঁধ পাইনি যেখানে নিজের মাথাটা রেখে একটু শান্তিতে কাঁদতে পারি। নিঃসঙ্গ রাত। বুকে চাপা হাজারো কষ্ট ছিলো আমার। আমার বুকের ভিতরে জমে থাকা অসম্ভব কষ্টগুলোর কথা কেউ জানেনা।আমার ব্যাথাতুর চোখের ব্যাথা কেউ কখনো দেখেনি। সময় বাড়ার সাথে সাথে আমার কষ্টগুলো বাড়ছিলো কেউ তা দেখেনি। আমার কষ্টগুলো বোঝার জন্য, অনুভব করার জন্য কাউকে পাইনি। কেউ বোঝেনি আমাকে। বাকি জীবনেও বুঝবেনা। অন্তরের আকুলতা বেউ বোঝেনা। মনে কোনে জমে থাকা ব্যাথা গুলো কারো চোখে পড়েনা। অন্তরের অর্ন্তরদহন কেউ দেখেনা। সবাই শুধু কষ্ট দিতে জানে।

——————–

বিকাল পাঁচটা। নেহাকে পড়ানো শেষ করে ওদের বাসা থেকে নেমে দেখি তাহমিদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে দেখে কিছু বলতে যাবো তখন মনে পরলো সে আমায় বিয়ে করতে চায়। আমার কাছে এটাও ধোঁকা। ঘর পোড়া গরু সিদুরে মেঘ দেখে ডরায়। নিরব ভাইয়ার সেইদিন করা ধোঁকা আজো আমি ভুলতে পারিনি। তাহমিদ ভাইয়ার পাশ কাটিয়ে যেতেই তিনি আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি তাকে বললাম,

” এটা আপনার বাড়ি নয়। আর আপনি আমার উপর জোর খাটাতে পারেন না। ভুলে যান সেই রাত্রিকে যে কারো আঘাতের প্রতিঘাত করতো না। সে মরে গেছে। তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। ”

তাহমিদ ভাইয়া হাত ছেড়ে দিলেন। আমি হাঁটতে শুরু করেছি। তিনি আমার পাশাপাশি হাঁটছেন। মেইন রোডের কাছে আসতেই তিনি আমাকে বললেন,

” সবাইকে এক রকম ভাবা ঠিক হয়নি তোর।”

হাঁটা থামালাম। তার চোখে চোখ রেখে বললাম,

” সেদিন অন্য কেউ আমায় সাহায্য করতে আসেনি। আজ হঠাৎ তাদের স্বার্থে টান পরেছে তাই আমাকে খুঁজছে।”

” আমাকেও তোর স্বার্থবাদী মনে হয়?”

চোখ বন্ধ করতেই ওনার বাবা- মায়ের স্বার্থের কথা মনে পরলো। মাত্র একলক্ষ টাকার জন্য তারা দাদার সাথে কি ব্যবহারটাই না করেছে। তার গায়ে অব্দি হাত তুলছে। সেই কষ্টে আমার দাদা মারা গেছে। দাদার মারা যাওয়ার পর দাদি একদিন এসব কথা আমায় বলছিলো। সেদিন থেকেই আমি আমার বড় ফুফু মমতা এবং তার স্বামীকে প্রচন্ডভাবে ঘৃনা করি। তাদের ছেলে তাহমিদ। তাদের রক্ত বইছে তার শরীরে। সে কি করে ভালো মানুষ হতে পারে? আমি তা জানিনা। আমি তাহমিদ ভাইয়াকে বললাম,

” দাদা মারা গেছে কাদের স্বার্থের কারনে? মনে করুন সেই ঘৃনিত অতীতের কথা। আমাকে ঘাটাতে আসবেন না। কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। ”

তাহমিদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চলে এলাম। তার সাথে কোনো কথা বলার ইচ্ছে নেই। সবাইকে ঘৃনা করি আমি। মাঝে মাঝে নিজের অস্তিত্বের উপর ঘৃনা হয় আমার। আমার জন্ম না হলে এতো কিছু সহ্য করতে হতো না।

———–

ভর্তি পরীক্ষা শুরু সকাল দশটায়। আমি যেই গাড়িতে আসতেছি ওটা পরীক্ষা কেন্দ্রের কাছাকাছি আসতেই নষ্ট হয়ে গেছে। আমার এখন বুক ফেটে কান্না আসছে। আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো এই পরীক্ষাটা নিয়ে। কেনো দিনশেষে শুধু আমার ভাগ্যই খারাপ হয়? চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো।

” আমার গাড়িতে আসুন। ”

আচমকা এই শব্দটা শুনে যেন প্রান ফিরে পেলাম আমি। দ্রুত ওই গাড়িতে উঠে বসলাম। লোকটাকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে খেলাম আরেকটা ঝটকা। এটা দেখি সাদ। আমি তাকে বললাম,

” আমাকে সাহায্য করার জন্য কি সবসময় রেডি থাকেন আপনি?”

” মানবসেবা করতে ইচ্ছে হলো। মাথা ঠান্ডা করো। বেশি প্রেশার দিওনা।”

আমার চিন্তাগুলি আপনাআপনি সরে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছে গেলাম। তাকে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি বিনিময়ে শুধু একটু হাসলেন। তার এই হাসির কারন আমি খুঁজে পেলাম না।

চলবে………………