নতুন কন্ঠে ভালোবাসুক পর্ব-০৪

0
288

#নতুন_কন্ঠে_ভালোবাসুক
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৪

এক শুক্রবারের আসরের নামাজের পড়ে খুব ছোট আয়োজনে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। যে বিয়েতে সানাই বাজেনি! বরযাত্রী আসেনি, এমনকি কনেও লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পড়েনি। আমি বাড়িতে ছিলাম,আর বর ছিলো মসজিদে। খুরমা খেজুর দিয়ে আমাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। বিষয়টা খুব গোপনীয় ভাবে হয়ে গেলো। যেন আমার খুব অল্প বয়স! তাই লুকিয়ে বিয়ে হচ্ছে। এই কথাটা মনে হতেই মনে মনে আমি হাসলাম। জীবন যে আর কতবার নিজেকে ভেবে হাসবো জানি না। আমি নিজের বারান্দায় বসে রইলাম আনমনে। আমার খোলা চুল গুলো বারবার আমায় বিরক্ত করলো! কিন্তু আমার নজর ছিলো একটি ডালে। দু’টো পাখি পাশাপাশি বসে আছে। হঠাৎ একটি পাখি আসতেই, সেই পাখিটির সাথে অন্য পাখিটি উড়ে গেলো। বোকা একটি পাখি একলা পড়ে রইলো। সে বারবার কিচিরমিচির শব্দ করতে রইলো! কিন্তু অপর পাখিটি সেই আকুতি আর্তচিৎকার শুনলো না। আহারে বেচারী পাখিও নিজের ভালোবাসা হারালো। এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় সবাই সার্থপর। কেউ টাকার জন্য পিছনে ছুড়ি মারে, কেউ অন্য কারো কথায় মারে। কখনো কখনো সব কিছু নিজের করে পেতে মারে। আমি কখনো ভেবেছিলাম জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমাকে কবুল বলতে হবে। আমি তো ভেবেই নিয়েছি,বাকি জীবনটা কোন ভাবে কাটিয়ে দিবো। যে জীবনে না থাকবে কাউকে কিছু দেওয়ার তাড়া,না থাকবে কারো থেকে পাওয়ার তাড়া। তবুও কেন এভাবে আমাকে আবারও কারো জীবনে নিজের জীবনকে বাঁধতে হলো। আমার এই আকাশ ছুঁই চিন্তার মাঝে ঘাড়ে কারো ছোঁয়া অনুভব করলাম। চোখের কানিস বেয়ে আসা চোখের জলটুকু মুছে নিলাম। আমি যে এমনই, কখনো নিজের কষ্টটা কাউকে দেখাতে পারিনি। তাই হয়তো সবাই আমাকে কঠিন মনের মানুষ বলেই জানে। পিছনে তাকিয়ে দেখি মোহন দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বলতে নিলে আমায় চুপ করিয়ে দিলো। আমার দুই হাঁটুর উপরের নিজের মাথা রাখলো। ও এই কাজটা প্রায় করে! যখন ওর খুব কষ্ট হয় তখনই আমার কাছে ছুটে আসে। আর এসেই বলে।

_ আপু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার কোলটা দাও তো আমি কষ্ট কমাবো।

তারপর আমি বসে পড়লেই নিজের মাথাটা এভাবেই গুঁজে দিতো। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম। ও চুপচাপ সেই স্পর্শ অনুভব করতো। কখনো কখনো কেঁদে দিতো। আর আমাকে বলতো।

_ তুমি এমন কেন আপু,তোমার কি কষ্ট হয় না। তোমাকে আল্লাহ কি দিয়ে তৈরি করেছেন। তুমি কি কোন পাথর।

আর আমি বরাবরই হেঁসে বলতাম।

_ মহান আল্লাহ জানেন তো আমার কিছু পাগল ভাইবোন থাকবে,যাঁরা একটু হলেই কাঁদবে হাসবে। তাঁদের সামলানোর জন্য একজন মানুষ দরকার! খুব কঠিন একজন মানুষ। যে বৃষ্টিতে ছাতা হবে, উত্তাপ রোদের মাঝে বটবৃক্ষ হবে,স্রোত ভরা নদীর ভেলা হবে। তাই আমাকে এভাবে তৈরি করেছেন আল্লাহ।

আমার কথা শুনে ভাই আমার আরো কাঁদত। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতো।

_ তুমি ছাড়া আমি একলা পথ হাঁটবো কি করে আপু? তুমি যে সব সময় আমায় আগলে নিয়েছো। অন্ধকার রাতে যদি হোটচ খেয়ে পড়ি কে তুলে বুকে জড়িয়ে নেবে আমায়।

আমি ভাইকে আরো একটু কাছে টেনে বলতাম।

_ আমি সব সময় থাকবো। আল্লাহ ছাড়া কার সাদ্ধি আছে আমাকে তোদের থেকে দূরে করার।

আজ এগুলো সব অতীত। আজ ওরা ইচ্ছে করেই আমাকে দূরে সরিয়ে দিলো। আজ তো ওদের সুখের দিন তাহলে কষ্ট পাচ্ছে কেন। আজ আমি কেন জানি মোহনের মাথায় হাত রাখতে পারলাম না। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার দমটা এখনি বের হয়ে যাবে। কিভাবে থাকবো আমি ওদের ছাড়া। এই এতো এতো বছরের অভ্যাস গুলো কীভাবে আমি পাল্টে ফেলবো। এসব ভাবতেই আমার বুকটা ভারি হয়ে এলো। চোখের আড়াল করা জলটা আবারো চোখে ভির করলো। হাতটা সরিয়ে কোন রকম নিজেকে বৃথাই সামলানোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ মোহন আমার হাতটা টেনে নিয়ে ওর মাথায় রাখলো। বললো।

_ তুমি ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো আপু। কেন এতো ভালোবাসলে আপু! যে আজ তুমি থাকবে না ভাবলেই আমার মৃত্যু সমান কষ্ট হচ্ছে। কেন মাঝে মাঝেই আমাদের শাসন করলে না। কেন এই কঠিন পৃথিবীতে একা হাঁটতে শেখালে না। আজ যদি আমি অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে যাই কি হবে তখন? আমার কষ্টের থেকে তো বেশি তোমার কষ্ট হবে। আমাদের কেন তোমার মতো কঠিন হৃদয়ের বানালে না। কেন মোমের মতো আমাদের নরম তৈরি করলে। আজ তুমি চলে যাবে ভাবতেই গলে পানি হতে হচ্ছে আমাদের। আপুরে তুমি ছাড়া আমাদের কি হবে? কি হবে আমাদের এই সাজানো গোছানো সংসারটার। বাবা চলে যাওয়ায় আমার এতো কষ্ট হয়নি আপু,আজ যতোটা হচ্ছে।

মোহনের কথা শুনে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম। ওকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলাম। আর বললাম।

_ তোরাই তো ইচ্ছে করে আমায় পর করে দিলি। তোরা যদি আজ জোড় না করতি কার সাদ্ধি ছিলো আমাকে তোদের থেকে দূরের করার।

আমার কথা শুনে মোহন বললো।

_ আপু দিন শেষে আমরা যখন সবাই নিজেদের কষ্ট সুখের কথা তোমাকে বলে শান্তি পাই। তুমি তো কাউকে নিজের ভেতর বাহিরের কথা বলতে পারো না। বলতে পারো না নিজের কষ্টের কথা। ভাবো তোমার কষ্টের কথা আমাদের বললে আমরা ভেঙে পড়বো। আপু দিন শেষে সবার একটা আশ্রয় দরকার যেখানে দু-দন্ড শান্তি মেলে। তোমার একাকিত্ব আমরা কেউ মানতে পারছি না। আজ যখন সুযোগ এলো তাই আমরা সবাই মিলে তোমার কষ্ট একটু কমাতে চাইছি। প্লিজ আপু তুমি আমাদের ভুল বুঝো না। তুমি ভুল বুঝলে যে আমরা মরে গিয়েও শান্তি পাবো না।

_ এই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম,আমার ছোট ভাইবোনেরা বড় হয়ে গেছে। আজ নিজেদের সাথে সাথে অন্য সবার ভালোটাও বুঝে গেছে। আমি ভাইকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। তখনই বাতাসের বেগে ছুটে এতো সোনালী রূপালি। ওরাও আমাকে জড়িয়ে কাঁদতে রইলো। আমিও কাঁদতে রইলাম। আজ কোন বাঁধা নেই কান্নার। আজ সকল বাঁধা অতিক্রম করে আমি কাঁদবো। আজ আমি নিজের সবটুকু উজাড় করে কান্না করবো। তিন ভাইবোনকে জড়িয়ে আমি পরম শান্তিতে চোখ বুজলাম। চোখ খুলে দূরের সেই ডালে তাকাতেই দেখলাম, বসে থাকা পাখিটির কাছে উড়ে আসছে একটি নতুন পাখি। পাখিটির খুব কাছাকাছি বসেই কিচিরমিচির শব্দ করে তাঁকে ডাকতে রইলো। হয়তো তাঁকে বলছে তুমি একা নও,আমি আছি তোমার সাথে। তাহলে কি একদিন না একদিন প্রকৃতি দু’হাত ভরে দেয়! যা কেঁড়ে নেয় তাঁর থেকে তিনগুণ ।

—————-

দরজার কোণে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছলেন জাহানারা বেগম। অবশেষে তাঁর মেয়েটার একটা গতি হলো। আজ থেকে তবে তাঁর মেয়েটার একটা সুখের ঠিকানা পেলো। যে সুখের জন্য আজ তাঁর ছোট ছেলে আর মেয়েগুলো কঠিন হলো! সেই সুখ যেন তাঁর বড় মেয়ের কপালে আল্লাহ দেয়। হে আল্লাহ আপনি আমার এই মেয়েটাকে হেফাজত করুন। সবার জন্য ভাবতে ভাবতে নিজের কথা যে কখনো ভাবতে পারেনি,আপনি তাঁকে দু’হাতে সুখ দান করুন। আপনি দয়ার সাগর, আপনি ছাড়া যে আমরা সবাই অচল। এসব ভেবে যখন চোখের জল মুছে জাহানারা বেগম পিছু ফিরলেন, তখন দেখলেন আবির মোবাইলে ছবি তুলছে। তিনি একটু বিব্রতবোধ করলেন। জাহানারা বেগমকে এমন বিব্রতবোধ হতে দেখে! আবির হেঁসে দিলো। আর বললো।

_ বুঝলেন আন্টি,কিছু মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দী করে না রাখলে জীবনের আসল সুখ অনুভব হয় না। কোন একদিন এই ছবি গুলো দেখে সবাই নিজেদের অজান্তেই চোখের কোণে জল জমা করবে। সেই অনুভূতি গুলো যে কতোটা প্রানবন্ত তা বোঝানো সম্ভব নয়। আমি ওদের মতো ভাই বোনের বন্ডিং আর কোথাও দেখিনি। তাই আরকি।

আবিরের কথায় জাহানারা বেগম মুচকি হেঁসে দিলেন। পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। জাহানারা বেগম চলে যেতেই দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আবির। তাঁর এই কঠিন হৃদয়ের মেয়েটাকে এতো কেন মনে ধরেছে। কি আছে এই মেয়েটার মাঝে। আচ্ছা মেয়েটা কি জাদুটাদু জানে নাকি।

চলবে,,,