নানান রঙের মেলা পর্ব-০২

0
238

‘নানান রঙের মেলা’ পর্ব-২

লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

মোড়ের মাথায় নিয়ন দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে স্প্রিং বল। একটু পর পরই সে সামনে তাকিয়ে দেখছে। ছোট চাচা বলেছেন, সে যেন বাড়ির সবচেয়ে ছোট মেয়ে টুনিকে মোড়ের মাথায় গিয়ে বলে দেয় আজকে বাড়িতে সদর দরজা দিয়ে না প্রবেশ করে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এই কাজের পেছনের কারণ হলো, পাত্রপক্ষের চোখে যেন সে না পড়ে। বিশেষ করে ওই ঘটক মহিলার নজরে যেন না পড়ে। মহিলা চরম অ’ভদ্র।

রিজভী তখন ললিপপ খেতে খেতে আসছিল। ভাইকে রাস্তায় এমন উঁকিঝুকি দিতে দেখে বলল,

-‘ছোট ভাইয়া কি করছ?’

নিয়ন পেছন ফিরে রিজভীর দিকে বি’র’ক্ত চোখে তাকালো। তারপর রিজভীর অন্য হাতে থাকা ললিপপের বক্স থেকে একটা বের করে মুখে পুড়ে বলল,

-‘টুনিকে দেখেছিস?’

-‘টুনি আপুর কলেজ তো অন্য রোডে। আমার স্কুল তো এদিকে।’

হাত দিয়ে রাস্তাটা দেখালো রিজভী। তারপর বলল,

-‘কেন? কি হয়েছে?’

-‘বড় আপাকে দেখতে এসেছে।’

-‘তাই নাকি? এবারও ভাঙবে মনে হচ্ছে।’

রিজভী হাসল কথাটা বলে। নিয়ন আরো একবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘এবারের টা হয়ে যেতেও পারে। ছেলে ডাক্তার শুনে আপা একটু নরম হয়েছে। শোন, তুই বাড়ি যা। আপাদের সবাইকে তো আজ ঘরবন্ধী রাখা হবে। আমি তো এখানে, ওদের হুট হাট কিছু লাগতে পারে। সেগুলো এনে দেওয়ার জন্য আমি আর তুই ছাড়া আর কে আছে! যা যা, বাড়ি যা!’

রিজভী বাড়ির দিকে রওনা হলো। যাওয়ার পথেই তার দেখা হলো এলাকার বড় ভাই শান্তর সাথে। শান্ত রিজভীকে দেখে বলল,

-‘ভায়া! খবর ভালো?’

-‘খুব ভালো ভাই।’

-‘তাই নাকি? এত ভালোর পেছনের র’হ’স্য কী?’

-‘র’হ’স্য কিছু না। আপার বিয়ে লাগবে।’

শান্ত চমকে উঠে বলল,

-‘মানে! কি বলছ? তোমার আপার বিয়ে!’

-‘জ্বি ভাই। পাত্রপক্ষ এসেছে, হবু দুলাভাই ডাক্তার শুনলাম।’

-‘তোমার আপা রাজি?’

-‘হুম। রাজি তো মনে হচ্ছে। নিয়ন ভাই তো তেমনই বলল।’

-‘ওহ নো!’

-‘নো কেন?’

-‘কিছু না। আমি আসছি, একটা কাজ আছে।’

শান্ত ধপাধপ পা ফেলে চলে গেল। রিজভীও বাড়ির দিকে পা বাড়ালো পুনরায়।

ক্যামেলিয়া নিজের রুমে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। শুয়ে শুয়ে জাওয়াদের কথা ভাবছে। জাওয়াদ তার কলেজের ইংরেজী প্রফেসর ম্যামের ছেলে। কলেজ জীবনে জাওয়াদ সে প্রথম দেখে। এরপর থেকেই তাকে ভালোবাসে। কতবার প্রকাশ করেছে নিজের ভালোবাসা বে’হা’য়া’র মতো। তারপরেও কোনো সাড়া পায়নি। জাওয়াদ যেন তাকে স’হ্য করতেই পারে না। ক্যামেলিয়ার হুট করেই গতকাল রাতে দেখা নাটকের কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে নায়ককে ভালোবাসার কথা স্বীকার করানোর জন্য নায়িকা মি’থ্যে বিয়ের অভিনয় করে। আর নিজের কাজে সফলও হয়। ক্যামেলিয়া মেয়ে মানুষ। সে বুঝতে পারে কে তাকে পছন্দ করে আর কে করে না। জাওয়াদ যদিও মুখে বারবার বলেছে সে পছন্দ করে না কিন্তু তার চোখের ভাষা ক্যামেলিয়ার কাছে অন্যরকম মনে হতো। মনে হতো ভালোবাসে প্রকাশ করে না। আচ্ছা! আজকে একবার সেই পদ্ধতিটা এপ্লাই করে দেখলে কেমন হয়? যদি জাওয়াদ তাকে ভালোবেসে থাকে তবে তো আসবে তা জানাতে আর না বাসলে আসবে না। আর ক্যামেলিয়াও আর পা’গ’লের মতো তার পিছু পিছু ঘুরবে না। সে ঠিক করে নিলো, আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। গ্যালারি খুঁজে নিজের একটা শাড়ি,গহনা পরা ছবি সে হোয়াটস্অ্যাপে জাওয়াদকে পাঠিয়ে দিলো। নিচে লিখল,

-‘অনেক ঘুরেছি। আর ঘুরব না। আমি এবার বুঝে গেছি একটা কথা। আমরা যাকে ভালোবাসি তার পেছনে না ছুটে যে আমাদের ভালোবাসে তার কাছেই যাওয়া ভালো। আমিও সেটাই করছি। আমাকে যে চাইছে তার কাছেই যাচ্ছি। আপনি ভালো থাকবেন। আমার কৃতকর্মের জন্যে আমি দুঃখীত ভাইয়া।’

এরপর সব কিছু থেকে সে জাওয়াদকে ব্লক করে দিলো। জাওয়াদকে ভাইয়া ডাকত না সে। কিন্তু আজ ভাইয়াও বলেছে। যে ছেলে সাইয়া হতে চায় সে ভাইয়া ডাক নিশ্চয়ই মেনে নিবে না।

এরিনা সবে মাত্র গোসল সেড়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। তখনই দেখল তাজওয়ার দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপাশে। এরিনাকে দেখেই ফোন হাতে নিলো। তারপর কাউকে কল দিয়ে ফোনটা কানে তুলল। এরিনা বুঝল কলটা তার কাছেই এসেছে। রুমের ভেতরে ঢুকে দেখল তার ফোন বাজছে। রিসিভ করতেই কাতর স্বরে তাজওয়ার বলল,

-‘কীভাবে পারো এমন করতে?’

এরিনা অবাক হলো। বারান্দায় এসে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়েই বলল,

-‘কি করেছি?’

-‘তোমার বাড়িতে পাত্রপক্ষ এসেছে কিনা সেটা বলো।’

-‘হ্যাঁ এসেছে।’

-‘ছেলে ডাক্তার!’

-‘হুম। তেমনই শুনলাম।’

-‘তোমার পছন্দ হয়েছে?’

-‘না হওয়ার মতো তো কিছু নেই। সবার শুনছি ভালোই লাগছে।’

-‘এনা!’

খুব শীতল ডাকলটা এরিনার মন ছুঁয়ে গেল। বলল,

-‘কি?’

-‘আমি তোমার জন্য সবরকম ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করলাম। বিসিএস দিলাম। টিকেও গেলাম। কেবল এখন চাকরিটা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। একটু ধৈর্য রাখতে পারলে না?’

-‘আপনি এসব কি বলছেন!’

তাজওয়ার হুট করেই গম্ভীর হয়ে ওঠে। চোখ দুটো তার আরো আগেই লাল হয়েছিল। কিন্তু এখন যেন সেটা প্রকট হলো। দাঁতে দাঁত চেপে সেই র’ক্তচক্ষু নিয়ে সে এরিনার দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘আমি ভেবেছিলাম নিজেকে বদলালে তুমি আমার হবে। আমি আগেই বলেছি আমি সাধু পুরুষ না। তারপরেও তেমনটা হওয়ার চেষ্টা করছিলাম, শুধুমাত্র তোমার জন্য। এখন তো দেখছি সাধু হলেও তোমাকে পাওয়ার চান্স নেই। তাহলে আর দরকার কি তেমন হওয়ার! অনেক স’হ্য করেছি আর না। এবার আর ভালো মানুষ সাজতে পারব না। খা’রা’প হলে যদি তোমাকে পাওয়া যায় তবে আমি খা’রা’পই হবো।’

কথা গুলো তাজওয়ার কলটা কে’টে দিলো। তার এমন কাজে এরিনা হতভম্ব হয়ে গেল। মানুষটার আবার হুট করে কি হলো? ভালোই তো ছিল সে। হঠাৎ আগের মতো আচরণ করল কেন?

তাজওয়ার হলো এমপির ছেলে। ব’দ’রা’গী, জে’দী, মা’র’কু’টে স্বভাবের ছেলে। পড়ালেখা শেষ করেও চাকরি বাকরি না করে ভার্সিটিতে এসে সময় কাটাতো। ভার্সিটির পপুলার বয় সে। খুব নাম ডাক তার। পড়ালেখায় সবসময় সিজিপিএ ৪ পেয়ে এসেছে। এই এত ভালো ছেলে রা’জ’নী’তি করে নিজের একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ন’ষ্ট করছে দেখে শিক্ষকগণ খুবই দুঃখ পেতেন। ক্লাসে ছেলেটার যেমন সুনাম করতেন তেমনই এসব স্বভাবের জন্য একটু আধটু দুর্নামও করে বসতেন। এরিনা সবসময় দূর থেকেই তাজওয়ারকে দেখেছিল। ছেলেটা তার ভাইদের মতোই মেধাবী, দেখতেও লম্বা, সুন্দর, সুঠাম দেহী। কিন্তু তার ভাইরা এমন লা’ফা’ঙ্গা না কেউই। এটা ভেবেই সে মুখ ফিরিয়ে নিতো ছেলেটার থেকে। তাজওয়ারের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ক্যান্টিনে। বেশি কিছু না! তাজওয়ার শুধু তাকে সামনাসামনি দেখেছিল। ব্যাস! তারপর থেকেই ভার্সিটির জাতীয় ভাবির খেতাব সে পেয়ে গেল। দীর্ঘ দুই বছর হয়ে আসছে তাকে এই খেতাবটা স’হ্য করতে হচ্ছে। স’হ্য করতে হচ্ছে তাজওয়ারকেও। তাজওয়ার ক্যারিয়ারে মন দিয়েছিল কেবল এরিনাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। একদিন এরিনা তাকে খুব কথা শুনিয়েছিল তার পিছনে পড়ে থাকার জন্য। নিজের কথা দিয়ে সে তাজওয়ারকে বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে তার বাবার টাকার ফুটানি না দেখিয়ে নিজে উপার্জন যেদিন করবে, নিজের পায়ে যেদিন দাঁড়াবে সেদিনই যেন তাকে চাইতে আসে। নয়তো এমন ছেলের কাছে তার পরিবার তাকে দিবে না। তাজওয়ার চুপচাপ সবকথা শোনে। তারপর থেকেই আর কখনো ভার্সিটিতে গিয়ে এরিনার পিছু ঘোরেনি। ঘর বন্ধী হয়ে দিন রাত বিসিএসের জন্য পড়েছে। আর মেধাবী তাজওয়ার সফলও হয়েছে। চাকরিটাও হয়ে গেছে বলা চলে। ভেবেছিল চাকরি পেয়েই সে এরিনার হাত চাইবে তার পরিবারের কাছে। আর এর মধ্যেই এসব ঘটে গেল!

এরিনার হুট করেই তাজওয়ারের করা আচরণের কারণটা মাথায় এলো। আর তখনই সে ‘ইয়া আল্লাহ্’ বলে কপাল চাপড়ায়। তাজওয়ার ভেবেছে যে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। আর সেও ভ্যাবলার মতো কথা বলেছে যার ফলে তাজওয়ার এমন রে’গে গেছে। এবার সে এই একরোখা, জে’দী, অপ্রতিরোধ্য যুবকটাকে কীভাবে বোঝাবে যে সে ভুল ভেবেছে। যা রা’গ তার! শুনতে চাইবে কি এরিনার কথা! এরিনা দুই তিনবার তাজওয়ারকে কল দিলো। ফোন সুইচড্ অফ বলছে। চিন্তায় এরিনার মা’ই’গ্রে’নের ব্য’থা শুরু হয়ে গেল তখনই। উপায়ন্তর না পেয়ে ঘুমের ঔ’ষু’ধ খেয়ে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

কলেজ গেইট থেকে বের হতেই নিয়নকে দেখে টুইঙ্কেল দৌঁড়ে তার কাছে গেল। নিয়ন বেশ কিছুক্ষণ মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়েও যখন তার দেখা পায়নি তখন কলেজের সামনেই চলে এসেছে।

টুইঙ্কেল হলো টুনি। বাড়ির ছোট কন্যা টুইঙ্কেলকে সবাই আদর করে টুনি বানিয়ে দিয়েছে। টুইঙ্কেল বলে তাকে শুধু তার বড় ভাইয়া, বাবা আর বাহিরের সবাই ডাকে। বাড়ির চারটা সদস্যের কাছে ছাড়া আর সব সদস্যের কাছে সে টুনি। দাদু ডাকে টুনটুনি পাখি। আর মা ডাকে টুনটুন।

নিয়ন রিকশা ডেকে রিকশাতে উঠতেই টুইঙ্কেল বলল,

-‘এখনই যাব না।’

-‘তো কি করবি?’

-‘আপারা ভেলপুরি খেতে চেয়েছিল। বলেছে কিনে নিয়ে যেতে।’

-‘উফ! আগে বলবি না! রিকশা ডেকে ফেললাম।’

-‘থাক কিছু হবে না। আঙ্কেলকে সকালে বলেছিলাম দুইশ টাকার বানিয়ে রাখতে। রেখেছে মনে হয়। যাই টাকা দিয়ে নিয়ে আসি।’

টুইঙ্কেলের যাওয়ার পথে একবার তাকিয়ে নিয়ন কলেজ গেইটে তাকালো। অরিনকে দেখা যাচ্ছে। কতদিন পর দেখল মুখটা। বুকের মধ্যে নিয়নের দামদাম করে শব্দ হচ্ছে। অরিন তার দিকে তাকাতেই সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। উহু! ধরা পড়া চলবে না।

খান বাড়ির সদস্য সংখ্যা ২১। পরিবারের সদস্য ছাড়াও কাজের লোক আছে তিনজন। ড্রাইভার আছে চারজন। দাঁড়োয়ান আছে দুইজন। বলার বাকি নেই যে অত্যন্ত ধনী ও বনেদী পরিবার তাদের। শাফায়েত খান ছিলেন শাফকাত খানদের পিতা। তিনি এই তিনতলা ভবনটি তার সময়কালেই করেছিলেন। তারপর এই নিয়ে চৌদ্দবার বাড়িটি সংস্কার করা হয়। তাই এক দেখাতে কেউ কখনোই বলতে পারে না যে বাড়িটির বয়স এতবেশি। দেখে মনে হয় আজকালে তৈরি হওয়া বাড়ি।

শাফায়েত খান পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। বর্তমানে তার চার পুত্র আর এক কন্যা জী’বিত আছেন। শাফায়েত খানের জী’বিত অবস্থায় তার বড় পুত্র আবরিশাম খান ও তার স্ত্রী রুকসাত জাহান মা’রা যান রোড এ’ক্সি’ডে’ন্টে। তাদের সন্তানই হলো আবইয়াজ খান। আবরিশাম খান শাফায়েত খানের প্রথম পক্ষের সন্তান ছিলেন। তার জন্মের সময় তার মা মা’রা যান। পরবর্তীতে তার দেখভালের জন্য শাফায়েত খান আবার বিবাহ করেন হোসনে আরা বেগমকে। হোসনে আরা বেগম নিজের পুত্রদের থেকে কখনো আলাদা করে দেখেননি আবরিশাম খানকে। বরং একটু বেশিই ভালোবেসেছেন। এখন যেমন সব নাতি নাতিনের চেয়ে আবইয়াজকে ভালোবাসেন তেমনই ছেলে মেয়েদের মধ্যে আবরিশামকে ভালোবাসতেন। ছেলের মৃ’ত্যুর পর শাফায়েত খান খুব ভেঙে পড়েছিল। তাই তো তার দুই মাসের মাথায় তিনিও দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।

শাফকাত খানের চার সন্তান। তারা হলো আজমাইন, অরোরা, এরিনা আর রিজভী। সালাম খানের এক পুত্র ও এক কন্যা আলফাজ আর মেহনাজ। ইমরোজ খানের তিন সন্তান, সুজানা, নিয়ন আর টুইঙ্কেল। আর সবশেষে রহমত খানের দুই যমজ কন্যা ক্যামেলিয়া আর কামিনী।

অরোরাকে পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়েছে। বলতে গেলে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তাদের পরিবার বৃত্তান্ত জেনে খান বাড়ির সকলেরও তাদেরকে পছন্দ হয়েছে। তারা চাইছে পাত্রকে একবার দেখার জন্য। পাত্রের মা শাহানা খাতুন ছেলে শাহরিয়ারকে কল দিলে সে ফোন তুলে না। শাহানা খাতুনের মনে পড়ে সকালে তার ছেলে বলেছে আজ পাঁচটা ওটি আছে। অনেক কাজ আজকে। শান্তিতে শ্বাস ফেলারও সময় নেই নাকি। শাফকাত খানকে বলতেই তিনি মুখটা একটু কালো করে ফেললেন। ছেলেটার ব্যাপারে শুনে তাকে দেখার বড় শখ হয়েছে তার।

শাহানা খাতুনরা ফিরতে চাইলে তাদের ফিরতে দেওয়া হলো না। কারণ তাদের আসা উপলক্ষে খান বাড়িতে আয়োজন করে রান্না বান্না করা হয়েছে। প্রতিবারই পাত্রপক্ষ এলে এমন আয়োজন তারা করেন। পাত্রপক্ষ ভালো হলেও মেয়ের তাদের পছন্দ হয় না বলে বারবার বিয়ে ভাঙে। তিনি মনে মনে দোয়া করতে লাগলেন এবার যেন সব ঠিকঠাক হয়। ছোট ভাইদের মেয়ে গুলোও তো আছে। তারা অরোরার বিয়ের আগে নাকি বিয়ে করবে না। এদিকে বয়সও তো কারো থেমে নেই। নিজেকে এসব ভাবলে খুব অ’প’রা’ধী মনে করেন তিনি।

শাহানারা খাতুনের কল শাহরিয়ার রিসিভ করতে না পারলেও মায়ের এতগুলো কল দেখে কল ব্যাক করতে ভোলেনি সে। শাহরিয়ারের কল এসেছে দেখে তার খালামণি আসমা বেগম তার বোনের থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে কানে দিলো। তারপর একটু দূরে গিয়ে কথা বলল,

-‘হ্যাঁ শাহ বল।’

-‘খালামণি মা কোথায়? এতবার কল দিলো যে!’

-‘আর বলিস না। তোর মা তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে পাত্রী দেখতে এসে। প্রেশার লো একদম। পাত্রী দেখতে এসে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে আমার তো ল’জ্জা লাগছে।’

কথাটা শুনে শাহরিয়ার চেঁচিয়ে উঠল।

-‘হোয়াট! মায়ের কি হয়েছে? এখন কেমন আছে মা? কি করছে? আর তোমরা কোথায় বললে!’

-‘একসাথে কত কথা বলে ছেলেটা! আমরা তোর বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে এসেছি। তোর হাসপাতালের সামনের রোডেই। হেঁটে আসতে তোর দশ মিনিট লাগবে। তাড়াতাড়ি আয় বাবা। আমি একা কি করব বুঝতে পারছি না।’

-‘ তুমি ঠিকানাটা বলো আমি আসছি।’

আসমা বেগম ঠিকানাটা বলতেই শাহরিয়ার রওনা হলো খান বাড়ির উদ্দেশ্যে। আসমা বেগমও শাফকাত খানদের জানিয়ে দিলো তাদের ছেলে আসছে। আর বোনকেও বলে দিলো সে তার ছেলেকে আনার জন্য মি’থ্যে কথা বলেছে। শুনে তো শাহানা খাতুন একটু বিচলিত হয়ে পড়লেন। ছেলেটা এসে যদি দেখে মি’থ্যে বলা হয়েছে তাকে তাহলে একটা বা’জে অবস্থা হয়ে যাবে।

অরোরা ডাইনিং এ খাবারের বাটি গুলো সাজিয়ে রাখছিল। শাহরিয়ার আসবে শুনেছে সে। মানুষটা কেমন হবে এই ভেবেই তার মনটা দুরুদুরু করে কাঁপছে। প্লেট গুলো মুছে রাখার সময় সেখানে তখন শাহানারা খাতুন আসে। এসে তার পাশে দাঁড়ায়। তাকে দেখে অরোরা বলেন,

-‘আন্টি বসুন।’

শাহানারা খাতুন বসেননি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অরোরার কাজ দেখছিলেন। অরোরা লা’জ শ’র’মের মাথা খেয়ে হঠাৎ করেই শাহানারা খাতুনকে প্রশ্ন করে বসল,

-‘আপনার ছেলে কি খেতে পছন্দ করেন?’

শাহানারা খাতুন অরোরার মুখের দিকে তাকিয়ে মুঁচকি হাসলেন। অরোরা তখন নিজের কাজে ল’জ্জা পেয়ে গেল। শাহানারা খাতুন বললেন,

-‘সে তৈলাক্ত খাবার পছন্দ করে না। কি সব হাবিজাবি খায়। সেদ্ধ সেদ্ধ শাক সবজি খাবে। ভাতও খুব মেপে খায়। আগে এমন ছিল না জানো! বিদেশ ছিল দুই বছর। তারপর থেকেই এই অবস্থা। ছেলে আমার না খেয়ে শুকিয়ে গেছে।’

শেষের কথাটা দুঃখ করে বলল শাহানারা খাতুন। অরোরার কেন যেন ভালো লাগল। আহ! এতসুন্দর ডায়েট মেইনটেইন করে। নিশ্চয়ই স্বাস্থ্য সচেতন। শাহানারা খাতুন আফসোস করে বললেন,

-‘ছেলেটা এখানে এসে কিছু খাবে না মনে হয়। হাসপাতাল থেকে আসছে তো। ও হাসপাতাল থেকে ফিরে সবার আগে গোসল নিবে। সারাটা দিন ওটিতে কা’টে তো তাই গোসল ছাড়া এমনি কিছু খেতে পারে না। তার এক কথা হাইজিন মেইনটেইন করতে হবে। হাইজিন ইজ দ্য মোস্ট ইম্পর্টেন্ট থিং ফর আ হিউমেন।’

কথাটা শুনে অরোরার যেন মন গলে গেল। না দেখা মানুষটার জন্য অন্তরে ভালো লাগা অনুভব হলো। সে এভাবে ওভাবে কথা বলে শাহানারা খাতুনের থেকে শাহরিয়ারের ব্যাপারে আরো জেনে নিলো।

আলফাজ বাড়ির মেইন গেইটে এসে দেখল তার ফুফুর গাড়ি আসছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। ফুফু তাকে দেখে কিছু না বলে রা’গে গজগজ করতে করতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। আলফাজ বুঝতে পারল না ফুফু এমন করল কেন। অন্যসময় তো আদর করে জড়িয় ধরেন। আজ কি হলো! সেও ব্যতিব্যস্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল।

ফুফু ড্রয়িং রুমে এসে বো’মা ফাঁটালেন। চিৎকার করে বললেন,

-‘তোমরা কি মানুষ?’

শাফকাত খান এগিয়ে এসে বললেন,

-‘কিরে! রে’গে আছিস কেন? কি হয়েছে?’

-‘কি হবে মানে? মেয়ের বিয়ে দিচ্ছো নাকি আমার ছেলেটাকে মা’র’তে চাইছ?’

সালাম খান এগিয়ে এসে বললেন,

-‘কি বলছিস তুই! ঝেরে কাঁশ।’

-‘ডাকো, অরোরাকে ডাকো।’

অরোরাকে ডাকার প্রয়োজন পড়েনি। সে নিজেই এসে উপস্থিত হলো। ফুফুকে জড়িয়ে ধরতে যাবে তার আগেই ফুফু তাকে হাতের ইশারায় থামতে বলল। অরোরা এহেন কান্ডে কি করবে বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও এসে ভীড় করল। সিঁড়ির কোণে মেহনাজ এসে দাঁড়াতেই শুনতে পেল,

-‘ছেলেটা আমার বিজনেস ডিলের জন্য লন্ডন গেছে। তার পাপা কত আশা ভরসা নিয়ে ছেলেকে পাঠিয়েছে। এখন সেই ছেলে কোটি কোটি টাকার লস করে বিজনেস ডিলটা ফেলে দেশে ফিরে আসছে। জানো কার জন্য এমন কাজ করছে? তোমাদের মেয়ে অরোরার জন্য। সে নাকি বিয়ে করবে আজকে। ছেলে আমার বলেছে ও যদি আজ বিয়ে করে তো সে প্ল্যান থেকে ঝা’প দিবে।’

কথাটা বলেই ফুফু হুহু করে কেঁদে উঠলেন। তাকে অরোরার মা আমেনা বেগম জোর করে সোফায় বসিয়ে শরবত এগিয়ে দিলেন খাওয়ার জন্য। এদিকে অরোরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাবির এমনটা বলেছে! সত্যি সত্যি? তার আর যাবিরের মধ্যে এমন সম্পর্ক কবে হলো!

সবাই যখন একটা শক পেয়ে ভাষাহারা হয়ে পড়েছে তখন তাদের আরো বেশি শক দিতেই যেন বুয়া দৌঁড়ে এলেন বাহির থেকে। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে করতেই চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,

-‘ওরে আল্লাহ রে! এম্পি আইছে রে! এম্পি! কত্ত গাড়ি লইয়া আইছে। কত্ত ব্যাডা লগে। ব্যাডাগো হাতে আবার গু’ল্লি কত বড় বড়!’

#চলবে।