নানান রঙের মেলা পর্ব-০৩

0
217

‘নানান রঙের মেলা’ পর্ব-৩
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

খান বাড়িতে বর্তমানে একটা থমথমে অবস্থা বিদ্যমান। বাড়ি বড় থেকে ছোট সকলেই একটা চিন্তায় পড়ে গেছে। হুট করে এমপি মহোদয়ের আগমন কাউকেই স্বস্তি দেয়নি।

হলরুমে বড় সোফাটির এক পাশে বসেছেন তাদের স্থানীয় এমপি জওহর চৌধুরী। তার বাম পাশেই তার স্ত্রী রাইমা হাসান বসে আছেন। জওহর চৌধুরী এসেই প্রথমে সকলের সাথে এমন ভাবে কুশলাদি বিনিময় করলেন যেন তিনি কতদিনের চেনা পরিচিত কাছের মানুষ। শাফকাত খান বিচলিত হয়ে পড়লে তেমন একটা কথা বলতে পারেন না। এখন তার সেই অবস্থা-ই হয়েছে। ছোট ভাই সালাম খান ভাইয়ের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে নিজেই কথা বললেন।

-‘আপনাদের আগমনে আমরা খুবই খুশি হয়েছি ভাই সাহেব। তবে একটা প্রশ্ন না করলেই নয়! হুট করে এই সাধারণ মানুষগুলোর কাছে আপনারা কি মনে করে এসেছেন?’

জওহর চৌধুরী হাসলেন। মুঁচকি কিংবা মিষ্টি হাসি নয়। ঘর কাঁপিয়ে হো হো হা হা করে হাসলেন। তার এহেন কান্ডে সবাই তব্দা খেয়ে গেল। লোকটা হাসছে কেন?

বাড়িতে ছুটা কাজ করা মর্জিনা অরোরার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

-‘হেয় কি ফা’গ’ল টা’গল নি আফা? চাচামিয়া একখান কতা জিগাইলো হেয় হা হা হো হো কইরা ভ্যাটকায়। শেষকালে কি আম্রার এক ফা’গ’লরে নি বোট দিলুম!’

অরোরা বি’র’ক্ত চোখে তাকালো মর্জিনার দিকে। তারপর বলল,

-‘আহা! এসব কি ধরনের কথা বার্তা? উনারা শুনতে পেলে তোমার খ’ব’র করে দিবে। জানো? যাও, এখন কিচেনে গিয়ে দ্যাখো তো নাস্তা পানির আয়োজন কি করল বুয়া।’

মর্জিনা চলে যেতেই অরোরা আবার সামনে সভায় মনোনিবেশ করল। মেহনাজ এতক্ষণ উপরে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার আর তর সইতে না পেরে নিচে এসে বোনের পাশে দাঁড়ালো। তার চোখে মুখে কৌতূহল দেখা যাচ্ছে তবে সবার তুলনায় সেটা কম।

বেশ কিছুক্ষণ পর নানান আলাপচারিতার পর সুস্পষ্ট হলো এমপি মহোদয়ের আগমনের কারণ। কারণটা হলো তাদের বড় কন্যা অরোরাকে তার ছেলে তাজওয়ার খুব ভালোবাসে। এই মেয়ের জন্যেই তার ছন্নছাড়া ছেলে একটা লাইনে ফিরেছিল। বিসিএস দিয়েছে প্রশাসন ক্যাডারে টিকেও গেছে। এখন যার জন্য সে এতকিছু করল সেই মেয়েটি নাকি অন্যত্র বিয়ে করে নিচ্ছে। যা সে স’হ্য করতে না পেরে বাড়িতে ভা’ঙ’চুর করেছে। এবং মেয়েটাকে না পেলে বড় কোনো দু’র্ঘ’টনা ঘটিয়ে ফেলার হু’ম’কিও দিয়েছে। একমাত্র ছেলের এই দশা সইতে না পেরে তৎক্ষণাত ছেলেকে আশ্বস্ত করে তিনি স্ত্রী সমেত খান বাড়িতে পদার্পন করেছেন। সবটা শুনে খান বাড়ির সকলে কিংকর্তব্যবূঢ় হয়ে পড়ল। অরোরা মাথাতেই যেন সবচেয়ে বড় বা’জটা পড়ল। সালাম খান গুরুগম্ভীর মুখ করে ভাতিজির দিকে তাকালো। তারমানে এতদিন ধরে এতগুলো বিয়ে ভাঙার কারণ এই ছিল। শাহানারা খাতুন আর আসমা বেগম কথাটা শুনে ম’র্মা’হত হলেন। মেয়েটিকে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। মেয়েটিও তো আচার আচরণে তাদের পজিটিভ সাইন দিয়েছিল। তাদের চিন্তা হচ্ছে শাহরিয়ারকে নিয়ে। এক্ষুণি হয়তো ছেলেটা চলে আসবে। এই পরিস্থিতি যদি সে এসে দেখে তবে নিশ্চয় একটা বড় ধরনের কিছু ঘটিয়ে ফেলবে।

ক্যামেলিয়া, কামিনী, সুজানা এরা তিনজন নিজ নিজ রুমেই ছিল। তারা কে এসেছে না এসেছে সেদিকে এত একটা ধ্যান না দিয়ে নিজেদের নিয়েই মগ্ন। ক্যামেলিয়া নিরবে বসে ভাবছে জাওয়াদের প্রতিক্রিয়া কি হবে। কামিনীর খুব খিদে পেয়েছে। সে ভাবছে কখন সব বিদায় হবে আর সে একটু ভাত খাবে। অন্যদিকে সুজানা ভাবছে কালকে ভার্সিটিতে গিয়ে ইয়াসিরকে জেলাস ফিল করানোর জন্য রওনকের বাইকে চড়বে।

সুজানার ভাবনার মাঝেই সে বারান্দা থেকে ভেসে আসা একটা চিৎকার শুনতে পেল। চেনা গলা বুঝতে পেরেই সে বারান্দায় গেল দ্রুত। নিচে ইয়াসির দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে রা’গ আর ক্ষো’ভ প্রকাশ পাচ্ছে। সুজানাকে দেখেই বলল,

-‘কি শান্তি পাস তুই? হ্যাঁ! কি শান্তি পাস! আমাকে কাঁদাতে তোর ভালো লাগে? তুই এত বে’য়া’দ’ব কেন?’

সুজানা ভীত চোখে আশেপাশে তাকালো। তার রুমটা বাড়ির পেছনের দিকে। বারান্দাটা একটু ব্যাকসাইডে হওয়াতে আর আশেপাশে আর বাড়ি ঘর না থাকায় কোনো মানুষের শোনার সম্ভাবনা নেই বলে স্বস্তি পায়। কিন্তু বাড়ির মানুষ যে শুনতে পাবে তা নিশ্চিত। আর বাড়ির কেউ শুনলেই মহা বি’প’দ হয়ে যাবে। সে রেলিং ধরে ঝুঁকে বলল,

-‘চুপ! আস্তে কথা বল ইয়াসিরের বাচ্চা।’

-‘তুই চুপ কর বে’য়া’দ’ব। বিয়ে করছিস তুই? আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে সংসার করবি? দাঁড়া তোর সংসার করার সাধ মিটাচ্ছি আমি।’

সুজানা কিছু বলবে তার আগেই উন্মত্ত হয়ে ইয়াসির ওয়াল টপকে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। ভ’য়ে, আ’ত’ঙ্কে সুজনার গলা শুকিয়ে এলো। বাড়িতে আজ বাপ, চাচা, ভাই সবাই আছে। এটা কি করল ইয়াসির? এখন নিশ্চয় বড় ধরনের কে’লে’ঙ্কা’রি ঘটে যাবে।

ইয়াসির যখন হল রুমে প্রবেশ করল তখন এতগুলো মানুষ আর নিজেদের এমপি সাহেবকে দেখে সে বুঝল আসলেই বার্তাটা মি’থ্যে ছিল না। সে এমপির ছেলে তাজওয়ারকে চিনে। ওহ! তাহলে এই এমপির ছেলেকে দেখেই এতদিন ইগনোর করছিল তাকে সুজানা! সে আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে।

সে সামনে অগ্রসর হতেই শুনতে পেল এমপি মহোদয় বলছেন,

-‘এবার বলুন! আমাদের পরিবারে মেয়েকে দিতে আপনাদের আপত্তি নেই তো?’

শাফকাত খান কিছু বলবে তার আগেই গর্জে উঠে ইয়াসির বলল,

-‘আমার আপত্তি আছে।’

আলফাজ পাশেই ছিল সে এগিয়ে এসে বলল,

-‘এই ছেলে? তুমি কে? ভেতরে কীভাবে এলে!’

-‘যেভাবে আপনারা আসেন সেভাবেই এসেছি। পায়ে হেঁটে।’

জওহর চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে বলল,

-‘তুমি কে? তোমার আপত্তি কেন থাকবে?’

-‘আমার আপত্তি থাকবে না তো আর কার আপত্তি থাকবে! আপনি যে মেয়েটিকে পুত্রবধূ করতে চাইছেন সে আমার গার্লফ্রেন্ড। দীর্ঘ চার বছর ধরে আমরা প্রেম করছি।’

বাড়ির সকলে এমন কথা শুনে অরোরার দিকে চকিতে তাকালো। অরোরার মাথা ঘুরে উঠল। এই ছেলে বলছে কি? সে তো চেনেই না। শাফকাত খান অরোরাকে ধ’ম’কে উঠে বলল,

-‘এই ছেলে যা বলছে তা কি সত্য?’

একের পর এক মি’থ্যে অ’প’বা’দ আর সইতে পারল না অরোরা। সেখানে ঝরঝর করে কেঁদে উঠল। ইয়াসির বুঝতে পারল না অরোরা কেন কাঁদছে? সে হতভম্ব হয়ে গেল। শাহানারা খাতুনের এবার সত্যিই প্রেশার বেড়ে গেল। হায় হায়! মেয়ের এতগুলো আশিক! আসমা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেছেন। ঘটক মহিলাটা বসে বসে সব ঘটনা গিলছে। আর বাড়ির সব গুলো মেয়েকে দেখার চেষ্টা করছে। মেহনাজকে দেখেই সে প্রশস্ত হাসল। বড়টার থেকে একটু বেশি সুন্দর। যাক! দুইটা সুন্দরী দেখা হয়েছে। বাকি গুলোকেও দেখতে পারলে সে বাঁচে। আরো পাঁচ ছয় বাড়িতে মহিলা কথা দিয়ে এসেছে এই বাড়ির মেয়ে দেখাতে আনবে বলে। পকেটটা যে বেশ গরম হবে ভাবতেই তার খুশিতে তিড়িংবিড়িং লাফাতে ইচ্ছে করছে।

জওহর চৌধুরী এবং তার স্ত্রী অরোরাকে এভাবে কাঁদতে দেখে এগিয়ে গেলেন তার কাছে। রাইমা হাসান অরোরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

-‘বিশ্বাস করুন আন্টি, আপনাদের ছেলের নাম এই প্রথম শুনেছি আমি। তাকে আমি চিনিও না। প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক তো দূরের কথা।’

রাইমা হাসান তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-‘প্রেম করোনি সেটা তো আমার ছেলেও বলেছে। তবে তাকে চিনো না এটা কেন বলছ? তাজওয়ার কিছু বলেছে তোমায়? কোনো ভাবে ক’ষ্ট দিয়েছে! মা, ছেলেটা একটু ব’দ’রা’গী। রা’গের মাথায় অনেক সময় অনেক কিছু বলে দেয় সেসব কিন্তু মন থেকে বলে না। রা’গ ভাঙতেই আবার নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়। ছেলেটা আমার খুব ভালো।’

অরোরা দুদিকে মাথা নেড়ে মুখ বুজে কাঁদতে লাগল। ফুফু এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। অনেক নাটক দেখেছেন। তিনি অরোরার হাত ধরে টেনে নিয়ে রাইমা হাসানকে বললেন,

-‘আপনার ছেলেকে আমার ভাতিজি বিয়ে করতে যাবে কেন? সে আমার ছেলেকে বিয়ে করবে। আজ রাতেই ছেলে আমার ফিরবে। তারপর দরকার পড়লে রাতেই বিয়ে দিয়ে দিব।’

রাইমা হাসান তব্দা খেয়ে গেলেন। একবার অরোরার দিকে আরেকবার স্বামীর দিকে তাকালেন। জওহর চৌধুরীও অবাক হলেন। কিছু বলবেন তার আগেই তার ফোনে তাজওয়ারের কল আসে। তিনি রিসিভ করতেই তাজওয়ার ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইল,

-‘বাবা! কি বলছে ওরা? ও কি বলছে? বিয়েটা করবে তো?’

জওহর চৌধুরী হতাশ গলায় বললেন,

-‘ও তো তোকে চেনেই না বলছে।’

তাজওয়ার হিং’স্র বাঘের মতো তেঁতে উঠে বলল,

-‘কি! কি বলেছে ও! আমাকে চেনে না? আমাকে!’

-‘আহ বাবা তুমি শান্ত হও। অরোরা মা হয়তো এইরকম পরিস্থিতে ঘাবড়ে গেছে। তাই এমন কথা বলছে। মেয়েটা কাঁদছে।’

-‘অরোরা মানে? অরোরা কে?’

-‘তুমিও এখন আবার ওর মতো কথা বলছ! আশ্চর্য! অরোরাকে চিনো না? তুমি অরোরাকে পুত্রবধূ করে আনার প্রস্তাব পাঠিয়ে নিজেই এখন বলছ সে কে!’

-‘বাবা অরোরা নয় এরিনা!’

-‘এরিনা?’

হল রুমে থাকা সবাই জওহর চৌধুরীর কথা শুনছিলেন এতক্ষণ। এরিনার নাম নিতেই আরো চমকে উঠলেন উপস্থিত সকলে। এই এত চমকের মধ্যে টুইঙ্কেল আর নিয়ন বাড়িতে প্রবেশ করল। বাড়ির সামনে গাড়ি বহর দেখে আর অ’স্ত্র’ধা’রী লোক দেখে নিয়ন আর টুইঙ্কেল পেছনের দরজা দিয়ে প্রবেশের কথা ভুলে গেল। বাড়িতে এসেই বড় আপুকে সবার সামনে মাথা নত করে কাঁদতে দেখে টুইঙ্কেল ছুটে গিয়ে তার হাত ধরে বলল,

-‘কি হয়েছে আপা! কাঁদো কেন? দাদু কি মা’রা গেছে?’

মেহনাজ পাশ থেকে মৃদু ধ’ম’কের স্বরে বলে উঠল,

-‘টুনি! বা’জে কথা বলো না। চুপ করে থাকো নয়তো রুমে যাও।’

-‘না আমি এখানেই থাকব। আপা কেন কাঁদছে?’

শাহরিয়ার উ’দ্ভ্রা’ন্তের মতো খান বাড়ির সদর দরজা অব্দি আসতেই থমকে দাঁড়ালো। তার সামনে বরাবর বাড়ির মধ্যিখানে এক শাড়ি পরিহিতা রমণী হেঁচকি তুলে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ আর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শাহরিয়ার নিজের অবস্থান, কাজ ভুলে গেল। সে কেবলই অপলক তাকিয়ে রইল অপরূপা সেই নারীর দিকে। জীবনের তেত্রিশটা বসন্ত পার হওয়ার পর এই প্রথম তার অনুভব হলো যে বসন্তের ফুল অবশেষে ফুঁটেছে তার হৃদয়ে। ‘লাভ এট ফার্স্ট সাইটে’ তার কোনো কালেই বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আকস্মিক এক অচেনা নারীর এক ঝলকেই তার সেই অবিশ্বাসটা ভেঙে পড়ল।

ফোন কান থেকে নামিয়ে জওহর চৌধুরী শাফকাত সাহেবের দিকে তাকিয়ে ল’জ্জিত গলায় বললেন,

-‘ভাই সাহেব, আমি সত্যিই দুঃখীত। আসলে আমাদের বোঝার মধ্যে ভুল ছিল। অরোরা নয় আমার ছেলে এরিনাকে ভালোবাসে।’

অরোরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-‘দুঃখীত মা। তোমাকে খুব পেরেশানিতে ফেলে দিয়েছি। ক্ষমা করে দিও মা।’

অরোরা কান্না থামিয়েছে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতেই আলফাজ বলল,

-‘এই ছেলেটা কি বলছে! ও যে বলল চার বছর ধরে অরোরার সাথে রিলেশনে আছে!’

ইয়াসির চমকে উঠে বলল,

-‘আশ্চর্য! আমি কি একবারও বলছি অরোরা নামের কারো সাথে রিলেশন আছি! আমি তো সুজানার কথা বলছি।’

ফুফুর ফোনটা বাজছে। তার ছোট মেয়ে জিনিয়া কল করেছে। কল রিসিভ করতেই জিনিয়া বলল,

-‘মা? কথা হয়েছে? মেহনাজ কি বলল!’

ফুফু অবাক হয়ে বললেন,

-‘মেহনাজ! মেহনাজ কি বলবে? ওর কথা কেন আসছে? অরোরার সাথেই তো আমার কথা হওয়ার কথা।’

জিনিয়া চেঁচিয়ে উঠল,

-‘অরোরা আপুর সাথে কথা বলবে মানে? মা তুমি কি অরোরা আপুকে ভাইয়ার পছন্দের পাত্রী ভেবে বসেছ নাকি!’

-‘তো আর কে হবে?’

-‘মা, ভাইয়া মেহনাজকে পছন্দ করে। আশ্চর্য! তুমি কি উল্টাপাল্টা কিছু ঘটিয়ে দিয়েছ নাকি?’

ফুফু কল কে’টে মেহনাজের দিকে তাকালেন অবাক চোখে। মেহনাজও ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে ফুফুর দিকে।

সালাম খান বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ ছিলেন। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি একাধারে সুজানা আর এরিনার নাম ধরে ডাকতে থাকেন। সুজানা সিঁড়ির কোণেই দাঁড়িয়ে ছিল। বাবার ডাক পেতেই নিচে নেমে আসে। এরিনা আসেনি দেখে বুয়াকে তলব করে শাফকাত খান বলেন,

-‘এরিনাকে ডেকে আনেন বুয়া।’

বুয়া শুনতে দেরি কিন্তু সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠতে দেরি করেননি। এরিনার রুমে গিয়ে যখন দেখল এরিনা শুয়ে আছে। দুই বার ডাকলেও যখন কোনো হুশ পায়নি তখন তিনি হাত দিয়ে কয়েকবার ধা’ক্কা দিলেন। এতেও এরিনার হুশ না পেয়ে তিনি পাশে তাকাতেই দেখলেন বিছানায় একটা ঔ’ষু’ধের পাতা পড়ে আছে। দেরি না করে তিনি দৌঁড়ে নিচে এসে বলতে লাগলেন,

-‘ওরে আল্লাহ রে! হগ্গলে দেইখা যাও, এরিনা মায়ে বি’ষ খাইছে রে!’

আবইয়াজ তখন সবেমাত্র গোসল সেড়ে তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হচ্ছিল বুয়ার কথা শুনে দ্রুত তার পাশের ঘর অর্থাৎ এরিনার রুমে প্রবেশ করে দেখে বিছানায় শুয়ে আছে এরিনা। ভ’য়ে তার গা কাঁ’টা দিয়ে উঠল। সে পাশে গিয়ে প্রথমেই বেশ কয়েকবার ডাকতে লাগল, সাড়া না পেয়ে আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠল তার মন। সে তাড়াতাড়ি শ্বাস চলছে কিনা পরখ করে দেখল। শ্বাস পড়ছে দেখে সে স্বস্তি পায়। পাশেই এরিনার ঘুমের ঔ’ষু’ধটা পড়ে থাকতে দেখে সে বুঝে যায় এরিনার কি হয়েছে।

সে রুম থেকে বের হতেই দেখল তিন তলা থেকে হুড়মুড় করে কামিনী আর ক্যামেলিয়া নামছে। কামিনী তাকে দেখে থেমে গেলেও ক্যামেলিয়া এগিয়ে আসে। বলে,

-‘কি হয়েছে ভাইয়া?’

আবইয়াজ কামিনীর দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

-‘কিছু না।’

-‘বুয়া চেঁচালো যে!’

-‘বুয়ার স্বভাবই এমন চেঁচিয়ে সারাবাড়ি করা।’

আবইয়াজ নিচে নামার আগেই দেখল সবাই উপরে উঠে এসেছে। অরোরা আর এরিনার মা আমেনা কেঁদে কু’টে একাকার অবস্থা করেছে নিজের। আবইয়াজকে রহমত খান কিছু বলতে নিবে তার আগেই সে বলে ওঠে,

-‘কিছু হয়নি। ওর মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছিল বোধহয়। সবসময়ের মতো ঘুমের ঔ’ষু’ধ নিয়েছে। আমি চেক করে এসেছি।’

সবাই স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। সালাম সাহেব বুয়ার দিকে তাকাতেই বুয়া মেকি হেসে জায়গা থেকে সরে পড়েন। সবাই আবার নিচে নেমে আসে।

ততক্ষণে শাহরিয়ারকে দেখতে পেয়ে তার খালা তার দিকে এগিয়ে যায়। শাহানারা খাতুন প্রকৃত অর্থেই এবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

-‘কখন এসেছিস বাবা?’

-‘এই তো মাত্রই। মায়ের কি অবস্থা এখন?’

শাহরিয়ার দূরে সোফায় বসে থাকা মায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই উপর থেকে খান বাড়ির সকলে নেমে আসে। শাহরিয়ারকে দেখে সালাম খান বলেন,

-‘তুমি?’

শাহানারা খাতুন বলেন,

-‘আমার ছেলে। শাহরিয়ার।’

অরোরা পেছনেই ছিল। কথাটা শুনতে পেয়ে চমকে উঠে সামনে তাকাতেই শাহরিয়ারের সাথে তার চোখাচোখি হয়। মৃদু কম্পন টের পায় সে নিজের বুকের মধ্যে।

সবাই হল রুমে শান্তিপূর্ণ ভাবে বসে একে একে কথা বলতে বলতেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। এরিনার জন্য তাজওয়ারকে সুপাত্র বলেই মনে করেন তার পরিবার। এদিকে ইয়াসিরকে একের পর এক জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে সালাম খান। তার থেকে বায়োডাটা জেনে নিয়ে তিনি নিজ কন্যা মেহনাজের দিকে অ’গ্নি’দৃষ্টিতে তাকান। বাবার এমন চেহারা দেখে মেহনাজ একটু ভ’য় পায়। তবে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়ে দিলো তার আর যাবিরের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। যাবির কি করছে বা করবে তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। ফুফু সেসব শুনে সমানে তাকে কথা শোনাচ্ছেন। শেষে হাত ধরে অনুরোধ করেন। মেহনাজ অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকালো শুধু। তার বাবা যখন ফুফুকে কথা দিলো যাবির ফিরলে মেহনাজের সাথে তার বিয়ে দিবে তখনই সে সভা ছেড়ে রুমে চলে গেল। যাবিরের মতো একটা ভেজালকে সে মোটেও বিয়ে করতে চায় না। সবশেষে শাহরিয়ারের দিকে সবাই মনোযোগ দিলো। শাফকাত খান আর আমেনা বেগম মুগ্ধ চোখে তাকে দেখছিল। আমেনা মনে মনে তাকে মেয়ে জামাই বানানোর পণও করে ফেলে। শাহরিয়ারের ব্যাপারে সকলেই অনেক কিছু জানতে চায়, প্রশ্ন করে। শাহরিয়ার প্রতিটি কথার জবাব দিচ্ছিল আর অরোরাকে আড়চোখে দেখছিল। শাহরিয়ারের মা এবার খুব খুশি। যাক! মেয়েটা আসলেই ভালো। একেই ছেলের বউ করবেন তিনি।

এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল বাড়িতে কেউ খাবারের নাম তুলছে না। ক্ষুধা স’হ্য করতে না পারা কামিনী আর বসে থাকতে পারল না। সে কিচেনে গিয়ে দেখল সারি সারি খাবার অতিথিদের নাস্তার জন্য সাজিয়ে রেখে বে’কু’ব বুয়া হল রুমে বসে আছে। সে মর্জিনাকে ডাক দিয়ে বলল,

-‘আপাকে ডেকে আনো। আর এসব দিচ্ছো না কেন ওনাদের?’

-‘বাইরের রান্নাঘরে পোলাও, রেজালা চড়াইছে আপনের আম্মারা। সব রেডি হইয়াও গেছে। এখন তাই আর এসব নিতে মানা করছে। বড় খানা খাওনের পর ছোট খানা খাওয়ানো হইব।’

মর্জিনা চলে যেতেই কামিনী কু’চি করে বাটিতে রাখা আমের দিকে তাকিয়ে ভাবল, থাক! সে পরে খাবে রেজালা। এখন সে তার সবচেয়ে প্রিয় খাবারটা খাবে। সে একটা ছোট বাটি নিয়ে তাতে একটু ভাত আর আম নিয়ে কয়েক চামচ বেশি করে গুড়া দুধ আর স্বাদমতো লবণ দিয়ে মেখে নিলো। তারপর একটা টেবিল চামচ নিয়ে একটু খেতে নিবে ওমনি তার হাত থেকে বাটিটা কেউ কে’ড়ে নিলো। রে’গে গিয়ে পাশ ফিরতেই দেখল আবইয়াজকে। আবইয়াজ তার দিকে একবার তাকিয়ে তার অপর হাতে থাকা চামচটাও ছি’নি’য়ে নিলো। আর টপাটপ দুই চামচ মুখে পুড়ে বলল,

-‘মজা তো।’

ক্ষুধার চোটে কামিনীর অবস্থা এমনিতেও খারা’প। তার উপর মুখের সামনে থেকে খাবার কে’ড়ে নেওয়া হয়েছে তার। সে ভুলে গেল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে। ক্ষি’প্ত গলায় বলল,

-‘ওটা আমার। আপনি কেন নিলেন?’

-‘নতুন করে বানিয়ে খাও।’

কথাটা বলেই আবইয়াজ চলে গেল। একটু যেতেই তার আলফাজের সাথে দেখা। আলফাজ ভাইকে বলল,

-‘এক চামচ দাও। ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। আর কতক্ষণ এভাবে থাকব কে জানে!’

আবইয়াজ ভাইকে দুই চামচ খাইয়ে দিয়ে আরেকটু সামনে অগ্রসর হতেই নিয়নের দেখা পেল। ছেলেটাকে ভীষণ কাহিল দেখাচ্ছে। আবইয়াজ বলল,

-‘কি হয়েছে?’

নিয়ন অসহায় গলায় বলল,

-‘খিদে পেয়েছে ভাইয়া।’

আবইয়াজ ছোট ভাইয়ের হাতে বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘নে খা।’

নিয়ন খাওয়া শুরু করতেই রিজভী এসে বলল,

-‘আমাকেও একটু দাও।’

আলফাজ পানি খেয়ে আসতে আসতেই দেখতে পেল নিয়নরা যেখানে বসে আছে সেখানে ছোট্ট টেবিলের উপর একটা একটা পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা আছে কিছু। সে নিয়নকে বলল,

-‘এটা কী?’

-‘ভেলপুরি। টুনি এনেছে। আপাদের জন্য।’

আবইয়াজও কথাটা শুনে একবার পলিথিনের দিকে তাকালো। রিজভী বলল,

-‘ভাইয়া চলো খাই। ভেলপুরি খুব মজার খাবার।’

আলফাজ বলল,

-‘তাই নাকি?’

-‘হ্যাঁ।’

আবইয়াজ বারণ করল না ধরতে। কিন্তু আলফাজ আর রিজভী খুলে টপাটপ দুইটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলল। নিয়নও একটা নিলো। আবইয়াজ খেতে চায়নি প্রথমে কিন্তু ভাইদের জোরাজুরিতে খাওয়া শুরু করল। এরপর একে একে সবগুলো প্রায় শেষ করে ফেলল। টুইঙ্কেল গোসল সেড়ে এসে দেখে তার ভাইয়েরা বোনদের জন্য আনা ভেলপুরি খেয়ে নিচ্ছে। দেখে সে ‘নাআআআআ’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল। তখন আজমাইন আর নিবরাস বাড়িতে প্রবেশ করছিল। টুইঙ্কেলের চিৎকার শুনে নিবরাস অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। আর বলতে লাগল,

-‘কি হয়েছে টুইঙ্কেল? আপনি ঠিক আছেন তো!’

#চলবে।