না চাহিলে যারে পাওয়া যায় পর্ব-১১+১২

0
304

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-১১

“আন্টি, আঙ্কেলের এ অবস্থা কবে থেকে?”
অবাক রুহির মুখ থেকে কথা সরে না। জিভ অসার হয়ে আছে, চোখ দুটোকে এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
“আন্টি!”
রুহি থমকে গেলো। রোজী স্থির চোখে চেয়ে বললো-
“শোন রুহি, জানি এই মুহূর্তে নতুন করে সব শুরু করা অনেক কঠিন। তবুও বলবো, যা করছো মন থেকে করো। অন্যকে ফাঁকি দিতে গিয়ে না হয় নিজেই ফাঁকিতে পড়বে। তুমি আমাকে আম্মা আর ওকে বাবা ডাকো শুনতে ভালো লাগবে। তাছাড়া আমরা এতোটাও খারাপ মানুষ নই যে তোমার জীবন অতিষ্ট করে তুলবো। হতে পারে গতবার সবকিছু ভুলভাল হয়েছে তার মানে এই না যে সবসময় ভুলই হবে। রাজ একবার না হয় ভুল করেছে এবার করবে না এই আশা করি।”
রুহি এবার খুব বিরক্ত লাগলো। বারে বারে যেন ওকেই ভুল প্রমানের চেষ্টা। সে রুক্ষ স্বরে বললো-
“আন্টি, পাঁচ বছর খুব অল্প সময় কি? আপনার ছেলের জায়গায় যদি আমি এমন কিছু করতাম তবে কি এতো সহজে মেনে নিতেন আমাকে? কিংবা আপনারা কি আমার অপেক্ষায় ছেলেকে বসিয়ে রাখতেন সারাজীবন? আমি জানি, তিনমাসও অপেক্ষা করতেন না তার আগেই বিয়ে করিয়ে এ বাড়ির জন্য নতুন বউমা নিয়ে আসতেন। অথচ দেখুন, এতোদিন পর আমি এসেছি এজন্য আপনারা কৃতজ্ঞ না হয়ে উল্টো আমাকে নানা ভাবে হেউ করার চেষ্টা করছেন। এটা কি ঠিক হচ্ছে?”
রোজীর মুখের কথা আঁটকে গেলো। সে বিস্মিত হয়ে রুহির দিকে তাকিয়ে আছে। রুহি মিস্টি করে হাসলো-
“কথা আমিও বলতে পারি শুধু শিষ্টাচার আর সৌজন্যতাবোধের কারনে চুপ থাকা। এটাকে দূর্বলতা ভেবে নিলেই মুস্কিল। আপনার ছেলের জীবনে ফেরার কোন ইচ্ছে ছিলোনা আমার। সে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে এসেছে আমাকে কাজেই কোন বিষয়ে আমাকে চাপ দেবেন না প্লিজ।”
রোজী ক্ষর চোখে রুহিকে দেখলো-
“তোমার শশুর যখন সুস্থ ছিলো তখন তার চোখে চোখ রাখার সাহস ছিলো না আমার। শাশুড়ী মা বুবু সবাইকে খুশি করেই এই সংসারে থেকেছি আর তুমি প্রথম দিনেই আমার সাথে এমন স্বরে কথা বললে? বাহ বেশ ভালো।”
রুহির মন একটু নরম হলো। বেশি বলে ফেলেছে এই ভেবে নিজেকে শুধরে নিতে চাইলো-
“সরি মা, আমি বলতে চাইনি আসলে আপনি বাধ্য করলেন। আমি কিন্তু..”
রোজী হাত দেখালো-
“থাক কৈফিয়ত দেওয়ার দরকার নেই। এই মানুষটার কল্যানে তুমি আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছো। মানুষটা যতদিন সুস্থ ছিলো ততদিন নিজের মনমর্জিতে চলেছে। না ছেলেদের না আমার কারো কথা শোনেননি। তোমাকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্তও তার একার। ছেলেটা বারবার বলার পরও কোন কথা শোনেনি। তার কারনে পাঁচটা বছর আমাকে একা একা কাটাতে হয়েছে। এখন যখন বিছানায় পড়েছে তখনও তার ইচ্ছে রাখার জন্যই আমাদের চেষ্টা। এটা মনে রেখো রাজও তোমাকে শখ করে এ বাড়িতে আনেনি। তার পেছনেও এই মানুষটার হাত আছে। আমাদের সবার প্রতি অন্যায় করে মানুষটা তোমার প্রতি ন্যায় করতে চায়। ভালো না ব্যাপারটা?”
রুহি ভীষণ অসহায় চোখে বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখলো। শরীরের অর্ধেক অংশ প্যারালাইজইড মানুষটা কেমন অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা না বললে হয়তো এখানে আর ফিরে আসা হতোনা রুহির। এই সম্পর্কটা তাকে তিক্ততা ছাড়া আর কিছু দেয়নি। পৃথিবীর সব বাবারা কেন যে সন্তানের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এটাই বুঝে উঠতে পারে না রুহি। সন্তান একটা আলাদা সত্তা, তার ভালোলাগা মন্দলাগা আছে, নিজস্ব বিচার বিবেচনা বোধ আছে। বাবারা যা ভাববে সেটাই ঠিক আর সন্তানেরা যা ভাববে সেটাই ভুল এমন ধারণা থেকে কবে বেড়িয়ে আসবে সবাই?

★★★

“তুমি কি ফোনটা খুলবে? তোমার বাবা ভীষণ চিন্তা করছে তোমাকে নিয়ে। তার সাথে একটু কথা বলো।”
রুমে ঢুকতেই রাযীন কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো রুহির। মোবাইলে নতুন নাম্বার নিতে হবে। শুভ ফোন দেবে এই ভয়ে রুহি সে নাম্বার বন্ধ করে রেখেছে।
“আপনার নাম্বার থেকে বাবাকে ফোন দিন আমি কথা বলবো।”
“কেন?”
“আমি আমার নাম্বারটা চালু করতে চাই না।”
“কেন?”
“সমস্যা আছে।”
“কি সমস্যা?”
রাযীন শয়তানি হাসি দিলো-
“প্রেমিকের কল আসবে তাই না?”
“হ্যা আসবেই তো। আসাটাই তো স্বাভাবিক নাকি?”
রুহি রেগে গেলো। রাযীন মুচকি হাসলো-
“আরে আসলে কথা বলবে। সমস্যা কি কথা বলতে? আমি তো সব জেনেই তোমাকে বাসায় এনেছি।”
রুহির মেজাজ ভালুক জ্বরের মতো ওঠানামা করে। সে দাঁত কিড়মিড় করে দু’হাত করজোড়ে রাযীনকে কুর্নিশ করে-
“আপনার বড় দয়া মহারাজ। আপনি মহান যে আমাকে কথা বলতে দিতে রাজি হয়েছেন। তা না হলে আমি তো মরেই গেছিলাম।”
রাযীন প্রথমটায় বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো পরক্ষণেই হো হো করে হেসে দিলো-
“আরে, তুমি তো জবরদস্ত অভিনয় জানো? নাটক করতে নাকি?”
রাযীনের কথা রুহির গা জ্বলে-
“শুনুন, আপনার হয়তো কোনো নীতি বা আদর্শ নেই জীবনে কিন্তু আমার আছে। আমি বলেছি আপনাকে সু্যোগ দেবো আর সেটা ভালো মতোই দেবো। কোনো লুকোচুরি করবোনা যদিও জানি এতো সততার পুরস্কার ভালো হবে না।”
রাযীন চোখ গোল করলো-
“তুমি জানো সততা দেখিয়ে লাভ নেই তবুও তুমি সৎ থাকবে। ব্যাপারটা খুব দারুণ। দেখো আমি কিন্তু বাপু এতো সৎ থাকতে পারবোনা। আমার প্রেমিকা আছে একটা স্প্যানীশ। ওকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না। নেহাৎ বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এসেছি।”
রুহি সরু চোখে রাযীনকে দেখলো-
“বাহ, তাহলে যে সেদিন আমাকে প্রেমিক নিয়ে নানা নীতিবাক্য ঝারলেন সেটা কি ছিলো?”
“ওতো একটু বলতে হয় বলে বলা। না বললে স্বামী সুলভ ব্যাপারটা থাকে না যে।”
রুহি অপ্রসন্ন মুখে রাযীনের কথা শুনলো। ভাবলো এ কেমন সম্পর্ক? দু’জনাই আরেকজনকে ভালবাসে তাহলে দু’জন একসাথে আছে কেন?
“কি ভাবছো এতো?”
“ভাবছি এসব রঙ তামাশার মানে কি? আপনি আপনার স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে শান্তিতে থাকুক আমি আমার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে। শুধু শুধু এই নাটকের মানে দেখি না কোন?”
রুহি প্রশ্নবোধক চাহনি দিতেই রাযীন চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বেশ নরম গলায় বললো-
“দেখো ব্যাপারটা তোমার কিংবা আমার নয়। আমি মোটেও চাই না তোমাকে জোর করে বেঁধে রাখতে। ইভেন তোমাকে পুনরায় জীবনে আনারও কোন ইচ্ছে ছিলোনা আমার। কিন্তু বাবার অবস্থা তো দেখছোই। এটা ছাড়াও বাবা কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত। গলায় ক্যান্সারা বাসা বেঁধেছে। কেমো আর রেডিও থেরাপি দিয়ে এখন কিছুটা ভালো হলেও ডাক্তার আশাব্যন্জক কিছু বলেনি। তার কথা তিনি তোমার প্রতি অন্যায় করেছেন তাই তার সাজা পাচ্ছেন। তোমাকে এই বাড়িতে যথাযথ সম্মান দিয়ে কিছু প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। তার যে অবস্থা তাতে তাকে থামানোটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। একজন মৃত্যু পথযাত্রীর শেষ ইচ্ছে পূরণ করাটা সন্তান হিসেবে আমার দায়িত্ব। তুমি বলো আর কিছু কি করার আছে আমার?”
“বুঝলাম। কথাগুলো তো আগেই বলতে পারতেন আমাকে? এতো নাটক কেন করলেন?”
রাযীন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো-
“সরি।”
“সরি! তাতে কি এই সমস্যার সমাধান হবে?”
রুহির রুক্ষ কন্ঠ শোনা গেলো।
“আচ্ছা, তোমার সাথে একটা ডিল করি এসো। আমরা দু’জনে মিলে সুন্দর একটা নাটক করি। ভালো স্বামী স্ত্রী সেজে অভিনয়। বাবা যতদিন জীবিত আছে ততদিন। তারপর তুমি তোমার রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়।”
রাযীন কন্ঠ যথেষ্ট মোলায়েম করে বলতেই রুহি দু’হাত ভাজ করে পেটের উপর রাখলো-
“সেটা কতোদিন?”
রা্যীন বেশ চিন্তিত হলো-
“কতোদিন? সেটা কিভাবে বলি? উপর ওয়ালা ছাড়া এর উত্তর কারো জানা আছে বলে মনেহয় না।”
“আপনার কাছে কি মনেহয় এটা খুব ভালো পরিকল্পনা?”
“তোমার কাছে বেটার কিছু থাকলে বলো৷ এখন তো সব জানলেই।”
রাযীন হাল ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গিতে বললো।
“আমি বরং আঙ্কেলের সাথে কথা বলি। তাকে বুঝিয়ে বলি আমি এখানে বউয়ের মর্যাদা চাই না। বরং ডিভোর্স হলেই আমাদের জন্য ভালো হবে।”
“এতো অসুস্থ একজন মানুষকে তুমি এসব বলবে? আর ইউ ম্যাড?”
রাযীন উত্তেজিত হয়ে গেলো। রুহি ঠান্ডা গলায় বললো-
“সত্য কথার চাইতে ভালো কিছু হয়না। এখন ওনার ইচ্ছে পূরণে চারটে জীবন নষ্ট হবে সেটা তো আরো খারাপ। তারচাইতে ওনাকে বুঝিয়ে বললে উনি নিশ্চয়ই বুঝবে?”
রাযীন নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো-
“তোমার বাবার এমন কিছু হলে কি এতোটা কঠোর হতে?”
রুহি স্থানুর ন্যায় বসে রইলো। এমন প্রশ্নের কি উত্তর হয় তার জানা নেই। রাযীন কন্ঠে মধু ঢালে-
“প্লিজ রুহি, এমন কিছু করোনা প্লিজ। আমি তো তোমাকে বিরক্ত করছি না। কিছুই চাই না আমার, শুধু শেষ মুহূর্তে বাবার এই মনস্কামনা পূর্ণ করায় আমায় সাহায্য করো। আমি কথা দিচ্ছি, তুমি যেভাবে চাইবে সেভাবেই সব হবে। আমি তোমার সাথে একটুও বাজে ব্যবহার করবোনা, তোমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো। যদি বাবার কিছু হয় তুমি না হয় তোমার সেই মনের মানুষের কাছেই ফেরত যেয়ো?”
রুহি কোন জবাব দিলো না। তার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে সব চোখের সামনে। নিয়তি এই নাটকের প্ল্যান আগেই করে ফেলেছে। তারা কেবল অভিনয় শিল্পী অভিনয় করে যাচ্ছে। হঠাৎ মাথায় প্রশ্নটা উকি দিয়ে গেলো।
“আচ্ছা, আপনি কি আমার কারনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন?”
আচমকা রুহির প্রশ্নে টালমাটাল হয় রাযীন। ওর দেশ ছাড়ার কারনটা ও নিজে কি ঠিকঠাক জানে যে রুহিকে জানাবে? হ্যা, বিয়েটা তখন মনের উপর একটা আলাদা চাপ তৈরি করেছিলো এটা ঠিক তবে বাড়ি ছাড়ার এটা মুল কারন না। সেই কারনটা রাযীনের একান্ত ব্যক্তিগত যা কাউকে বলা হয়নি কখনো।

চলবে—

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-১২

রাযীনের দাদা শাহরিয়ার নাজিম ছিলেন ছোটখাটো ঠিকাদার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই জাহাজ ভাঙা শিল্পে নাম লেখান। গড়ে তোলেন এস এন্ড এস নামক শিল্প প্রতিষ্ঠান। সেই সময় এই শিল্পের খোঁজ হাতে গোনা যে দু’একজন জানতেন তাদের মধ্যে রাযীনের দাদা অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন ছিলো বলে সকলের আকন্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন ব্যবসার কাজে। কঠোর পরিশ্রমী শাহরিয়ার নাজিম ব্যবসায়ী হিসেবে দ্রুত নাম কামালেন। দু’হাতে টাকা আসতে লাগলো হুর হুর করে। কয়েক বছরের মধ্যেই শাহরিয়ার নাজিম চিটাগং এর অন্যতম বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন।
রা্যীনের বাবা আশরাফ শাহরিয়ার তখন ব্যরিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে লন্ডন। শাহরিয়ার নাজিমের খুব ইচ্ছে তার বড় ছেলে ব্যরিস্টারি পড়ে দেশে ফিরুক।
সেই সময় ব্যরিস্টারি পড়াটা পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে শাহরিয়ার নাজিম মারা যাওয়ার পর তার ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। কর্নধার না থাকার কারণে এস এন্ড এস এর ব্যবসা দ্রুত দেনার দায়ে মুখে পড়লো। ফলে আশরাফকে দেশে ফিরে ব্যবসার হাল ধরতে হয়। আশরাফ সেই মৃত প্রায় ব্যবসাকে শুধু জীবিত করলেন না উপরন্তু ব্যবসার শাখা প্রশাখা বাড়লো। নতুন ব্যবসা হিসেবে জাহাজ তৈরির কারখানা স্হাপন করলেন নিজের উদ্যোগে। পরিবার বাড়ার সাথে সাথে ব্যবসার পরিধি দিন দিন বেড়েছে বই কমেনি।

শাহরিয়ার নাজিম মারা যাওয়ার সময় স্ত্রী তাহেরা, তিনকন্যা আর দুই পুত্র রেখে যান। আশরাফ নিজ উদ্যোগে তিনবোনের বিয়ে দেন, ছোট ভাই আফজালকে ব্যরিস্টারি পড়িয়েছেন মায়ের পচ্ছন্দে বিয়ে দিয়েছেন নিজে। বড়বোন খুকুর স্বামী অকালে রোড এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর মা তাহেরা মেয়ের বিধবার জীবনের শোক সইতে না পেরে মারা যায়। যদিও আশরাফ বোনকে আরেকবার পাত্রস্থ করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু খুকু আর বিয়ে করবেনা বলে কঠিন ব্রত নেওয়ার পর আর জোর করেননি। সেই থেকে খুকু এই সংসারের অলিখিত মুরুব্বির জায়গা নিয়েছেন। আশরাফ একগুঁয়ে, সংসার আর ব্যবসায় একক কতৃত্ব চালিয়েছেন। কখনো কারো মতামত শোনার প্রয়োজন মনে করেননি। নিজে যতদিন সুস্থ ছিলেন ততদিন এরকমই চলেছে। হঠাৎ করে ব্রেন স্ট্রোক করে পক্ষঘাতগ্রস্থ হওয়ার পর থেকে যেন ধীরে ধীরে সবকিছু পাল্টে যাচ্ছিলো। বিছানায় শুয়ে থাকলেও বেশ টের পাচ্ছিলেন আশরাফ। ব্যবসাগুলো কে নেতৃত্ব দেবে সেটা নিয়ে সুক্ষ দ্বন্দ হয়তো আগে থেকেই ছিলো, সেটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। তার নিজের সন্তান ব্যবসায় আগ্রহ বোধ করে না। ছোট ভাই আর তার সন্তান নিজের মতো ব্যবসা চালায়। মাঝে মাঝে আশরাফের খুব কাছের লোকজন দু’একটা কথা বলে যায়। বিছানায় শুয়ে থাকা আশরাফের কিছু করার থাকে না। এই পরিবারকে একসাথে বেঁধে রাখতে তার ত্যাগ কম নয়। অনেক কিছু হারাতে হয়েছে তাকে। স্ত্রী সন্তানের চক্ষুশুল হয়েছেন। বাকীরাও হয়তো তাকে খুব একটা পচ্ছন্দ করে না। তবুও চেয়েছেন পরিবার একত্রে থাক। কিন্তু এবার মনেহচ্ছে সব ভেঙে যাবে। তার এতোদিনের চেষ্টা, পরিশ্রম সব পণ্ডশ্রম হয়ে যাবে। জীবনের শেষ কালে এসে এতোদিনের সাধনায় গড়ে তোলা ইমারত ভেঙ্গে পড়বে ভাবতেই বুক কাঁপে তার। শেষ চেষ্টা হিসেবে একটা ট্র্যাম্পকার্ড হাতে রেখেছিলেন। সেটারই চাল দিতে জাল ছড়িয়েছেন। শেষ পর্যন্ড ট্র্যম্পকার্ডে কাজ হবে কিনা তিনি জানেননা।

★★★

পুরো বাড়ি জুড়ে উৎসবের আমেজ। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, বড়রা হলরুমের অর্ধেক জুড়ে বসে কাপড় বাছাই করছে। কে কি পরবে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে। আগামী কালকের অনুষ্ঠানের আলোচনা চলছে বলেই মনেহয় আজ মোটামুটি সবাই বাড়িতে। রুহির সময় কাটছিলো না। রাযীন ভোরেই কোথায় বা বেড়িয়ে গেছে। তারপর থেকে রুহি একা একা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এ বাড়ির সবার সাথে আলাপ হলেও কার কাছে যেয়ে আলাপ জুড়বে তা ভেবে পেলোনা। একা একা কতক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরলো। রুহির অবস্থা বুঝেই হয়তো রোজী মর্জিনাকে পাঠালো রুহিকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। রুহির সাথে থেকে মর্জিনা বকবক করে ওকে বাড়ির ফিরিস্তি দিচ্ছিলো। নিচতলায় হলরুম, রান্নাঘর আর দুটো শোবার ঘর যার একটাতে খুকু নানী থাকে। দোতলায় বাড়ির বাকী সবার থাকার ব্যবস্থা। ছাদে এসে সবচেয়ে বেশি চমৎকৃত হলো রুহি। খুব সুন্দর করে বসার বেদী বানানো আছে। সুইমিংপুল আর সাথে ঝোলা দোলনা যা দেখলেই বসে দোল খেতে মন চাইবে। একেবারে দক্ষিণ কোনে একটা রুম গ্রামের বাড়ির মতোন করে তৈরি করা। রুহি কৌতুহলে এগিয়ে যেতেই মর্জিনা হাত ধরে থামালো-
“ওদিকে যাইতে মানা নতুন ভাবি।”
“কেন?”
রুহি চোখ ফিরায় না। মর্জিনা ঠোঁট উল্টে জানায়-
“আমি তো এতো কিছু জানিনা। এইখানে আসার পর থেকেই এই ঘর তালা দেওয়াই দেখছি। সব্বাইকে মানা করা আছে এই ঘরের আশেপাশে না যাইতে।”
“ওহহহ। আচ্ছা চলো ফেরত যাই।”
রুহি ছাদ থেকে নেমে আসতেই রোজীর সাথে দেখা-
“সবাই তোমার খোঁজ করছে। তোমার হাতের চা খেতে চাইছে। চা বানাতে পারো তো?”
রুহি মাথা নাড়তেই রোজী মর্জিনাকে ইশারা করে-
“মর্জিনা ওকে রান্নাঘর দেখিয়ে দে।”

রুহি সবার জন্য চা বানিয়ে আনতেই ঝিলিক সবার আগে ট্রে থেকে চায়েরকাপ তুলে নিলো-
“ভাবি, সুগার দাও নিতো?”
রুহি মাথা নেড়ে না করতেই ঝিলিকের মুখে হাসি ফুটলো-
“থ্যাংক ইউ। আমি চায়ে সুগার খাই না ফ্যাট হয় বলে। একচুলি এ বাড়ির কেউই খায় না দু একজন বাদে। তোমার স্বামী সেই দু’একজনের একজন।”
ঝিলিক মুখচোরা হাসি হাসলো।
“ওহহহ।”
রুহি বাকীদের চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো এক এক করে। বেনু চায়ে চুমুক দিতেই ওর মুখে চোখে উচ্ছলতা ফুটে উঠলো-
“আরে ভাবি, তুমি তো দারুণ চা বানাও?”
“উমমম ভাবি, এককথায় অসাধারণ। তোমার হাতের রান্নাও নিশ্চয়ই ভালো হবে। যারা চা ভালো বানায় তারা রান্নাও ভালো পারে।”
রেনু আন্তরিক গলায় বললো। রুহি চলে যাচ্ছিলো বেনু ডাকলো-
“ভাবি, এখানে এসে বসো না। আমরা কালকের অনুষ্ঠানের জন্য কাপড় সিলেক্ট করছি। তোমার জন্য এই লেহেঙ্গাটা পচ্ছন্দ করেছি। দেখতো পচ্ছন্দ হয় কিনা।”
একটা সোনালী জরী কাজের লেহেঙ্গা এগিয়ে দিলো রুহির দিকে। রুহি সবসময় সুতি কাপড় পড়ে অভস্ত্য। অফিসে ব্যবহারের জন্য ভারী জর্জেট। শখের বশে শাড়ী পরলে জামদানী অথবা তাত। এতো ভারী পোশাক কি সে সামলাতে পারবে? রুহি দীর্ঘ শ্বাস গোপন করলো। এতো ভারী জীবন যখন সামলে নিতে পেরেছে তখন ভারী পোশাক আর কি।
অনিচ্ছায় প্রশংসা করে-
“হ্যা, বেশ সুন্দর।”
রেনু নিজের জন্য পচ্ছন্দ করা সবুজ রঙের ভারী কাতানটা এগিয়ে দিলো-
“এটা কেমন বলতো ভাবি?”
“এটাও সুন্দর। আপনাকে মানাবে।”
“হায় হায় ভাবি আপনি? আপনি কেন? তুমি করে বলো। আমি তো ভাইয়ার ছোট। বেনু আপা বড় তাকে আপনি বলতে পারো। আমাকে তুমি তুমি করে বলবে।”
রুহি হেসে দিলো-
“আচ্ছা।”
“বউমা, চাকরি করতে নাকি? সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে এলে নাকি এ বাড়ির বউ হতে?”
ওপাশ থেকে শিখা এগিয়ে এসে বসলো রুহির পাশে। রুহি ভেবে পেলোনা কি বলবে। তবে এখন কিছু না বললে আরো কথা শুনতে হবে ভেবে চুপ থাকতেও রাজি নয় সে। একটু মুচকি হেসে শিখার দিকে তাকালো-
“না ছোটমা, চাকরি ছাড়িনি। ওটা নিজ যোগ্যতায় পাওয়া চাকরি তাই ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। ছুটি নিয়ে এসেছি।”
“বলো কি? তোমার শশুর তো ভেবেই নিয়েছে তুমি এখানে স্থায়ী হবে।”
“আর আপনি? আপনি কি ভেবেছেন?”
শিখা পাল্টা প্রশ্নে একটু থতমত খেলো-
“আমি! আমি কি ভাববো?”
“মানে আমার থাকা নিয়ে কি ভেবেছেন? থাকবো না চলে যাবো?”
শিখা এমন প্রশ্নে একটু দমে গেলো-
“আরে আমার ভাবনায় কিছু এসে যায়? তোমার জীবন, তুমি যা ভাববে তাই করবে। কি বলো ঝিলিক?”
“হ্যা মামনী, সেটাই। তবে চাকরি জিনিসটা আমার অপচ্ছন্দের। চাকরি মানেই চাকর। এর চাইতে বিজনেস ভালো, নিজের স্বাধীন জীবন। এইজন্যই আমি বুটিক হাউজ দিয়েছি।”
রুহি অবাক হলো, এই মেয়েকে দেখে মনে হয়না কিছু করে। সারাদিন মুখে মেকাপ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
“তোমার বুটিক আছে? বাহ বেশ ভালো তো?”
ঝিলিক খুশি হয়ে গেলো-
“হ্যা, তোমাকে একদিন নিয়ে যাবো আমার দোকানে।”
“তুমি নিজে ডিজাইন করো?”
“আরে না। ইন্ডিয়া থেকে কিনে এনে সেল করি। আমার অবশ্য কিছু করতে হয় না। লোক আছে তারাই করে।”
ঝিলিক মুখের ওপর থেকে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ে। রুহি হাসলো-
“এটা কেমন হলো? নিজে মাথা না খাটালে সেটা নিজের হয় কি করে? তোমার ডিজাইন করা পোশাক হলে অন্য রকম হতোনা ব্যপারটা? ধার করা জিনিসে কতোদিন টিকে থাকবে?”
চট করে ঝিলিকের মুখ কালো হয়ে গেলো। সে উঠে দাড়িয়ে গেলো-
“মামনী আমি গেলাম। মুখে উপটান দেওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
এ কথা শুনে রুহি ফিক করে হেসে দিলো।

রাতে খেয়ে দেয়ে রুমে ঢুকতেই কিছুক্ষন পরে দরজায় নক। দরজা খুলতেই রেনু এসে জড়িয়ে ধরলো রুহিকে। রুহি এতোটা বিস্মিত কখনো হয়নি।সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। কিছু বলবে তার আগেই রেনু হাতের ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললো। ভালোমতো দরজা আঁটকে ওকে নিয়ে বিছানায় এসে বসলো-
“ভাইয়া নেই?”
“আছে পাশের রুমে।”
রুহি ইশারা করে দেখিয়ে দিলো। রেনু ওর হাত চেপে ধরলো-
“আমি যে আজ কি খুশি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা। তুমি আজ জব্বর জবাব দিয়েছো ছোটমা আর ঝিলিক ভাবিকে। এদের জ্বালায় আমরা কোনঠাসা হয়ে গেছি। বাবা যতদিন সুস্থ ছিলো ততদিন তাও একটু ভালো ছিলাম কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই এরা ভীষণ এগ্রেসিভ।
মা তো কিছুই বলে নাই কোনদিন। ভাইয়াও ছিলোনা, আমি একা অসহায় ওদের সব হ্যা তে হ্যা মিলাতে হয়।”
“মানে!”
রুহি অবাক হয়ে রেনুর মুখপানে তাকায়।
“মানে, আমি তোমার আপন ননদ আর বেনু আপা চাচাতো। দু’দিন ধরে ভাবছি তুমি কেমন মানুষ তাই কথা বলতে আসার সাহস হয়নি। আজ বুঝলাম তুমি ওদের মতো না। আমার না খুব ভালো লাগছে জানো? মনেহচ্ছে এতোদিন আপন কাউকে পেলাম।”
রুহি হা করে রেনুর দিকে তাকিয়ে রইলো। পরিচয় দেওয়ার সময় রোজী অবশ্য নির্দিস্ট করে কিছু বলেনি রুহিও মাথা ঘামায়নি।
“তুমি এতো অবাক হচ্ছ কেন ভাবি? আমার কথা জানতে না আগে?”
রুহি না বোধক বলতেই রেনুর চোখ বড় বড় হলো-
“বলো কি? ভাইয়া কিছু বলেনি?”
“কি বলবে? আমি আসলে তোমাদের সম্পর্কে কিছু জানতে চাই নি কখনো। সম্পর্কটা তো ছিলো না থাকার মতো।”
রেনুর মন খারাপ ভাব মুখে ফুটে উঠলো-
“ওহহহ। তাও ঠিক বলেছো।”
দু’মিনিট চুপ করে বসে রইলো রেনু। হঠাৎ মুখ তুলে বললো-
“অতীতে যাইহোক ভাবি, তুমি প্লিজ এখন আর ফিরে যাওয়ার কথা ভেবোনা। ভাইয়ার কাছ থেকে কিছু আশা করি না। ও আমাদের নিয়ে ভাবেনা বলেই পালিয়ে ছিলো। আমার খুব একলা লাগে গো। এ বাড়িতে আসতে ইচ্ছে করে না। আর যখন তখন আসাও যায় না। বেনু আপা না এলে আমারও আশা হয় না। একা এলে এমন ভাব করে যেন আমি মেহমান। তুমি থাকলে অন্তত আমার নিজের কেউ আছে মনে হবে।”
“আরে কি বলো। আমি তো এই দু’দিন হলো এলাম। না জেনে এতো ভরসা করা ঠিক না।”
রুহি নিজেকে সামলে নিলো। রেনু ওর হাত চেপে ধরলো-
“প্লিজ ভাবি, তুমি থেকে যাও। একমাত্র তুমিই পারবে এই সংসার..”
“তুই এখানে কি করছিস?”
বোনকে দেখে সে ভীষণ অবাক।
“কিছু না। ভাবির সাথে গল্প করছি।”
রেনু জরসর হয়ে জবাব দিলো। রা্যীন যেন আকাশ থেকে পড়লো-
“গল্প!”
রেনু আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়-
“আমি যাই ভাবি।”
জবাবের অপেক্ষা না করেই রেনু চলে গেলো। রুহি ভাবলো হঠাৎ কি হলো এই মেয়ের? ভাইকে ভয় পায় নাকি অন্য কিছু? এ বাড়ির মানুষগুলো সবাই অদ্ভুত। বাইরে একরকম ভেতরে আরেকরকম। মুখে একটা বললেও মনে আরেকটা চলছে। মনেহচ্ছে সবাই মুখোশ পরে ঘুরছে।

চলবে—
© Farhana_Yesmin