না চাহিলে যারে পাওয়া যায় পর্ব-১৩+১৪

0
287

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-১৩

“বড়পা, তুমি কেমন মানুষ বলোতো? সেই যে ফোন বন্ধ করেছো আর খবর নেই। শুভ ভাইয়া রোজ মন খারাপ করে ফোন দেয় আমায়। মানুষটা তোমাকে কি ভালোই না বাসে আর তুমি কিনা এই বড় বাড়িতে এসে তাকে ভুলে বসে আছো। তাহলে কি তুমিও অন্য সকলের মতো হয়ে গেলা? যারা টাকা দেখলে চোখ উল্টে ফেলে তেমন?”
রুমির কথা শুনে রুহির মনটা হুহু করে উঠলো। সব দিক দিয়ে সেই কেন দোষী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। এদিকে বাবা বলে বিয়েকে একটা সুযোগ দাও ওদিকে শুভটা কষ্ট পাচ্ছে। এসে পড়েছে এক সার্কাসে যেখানে এখনো সবকিছু ধোয়াসা। রুহির ভীষণ হাসফাস লাগে। কি করবে না করবে মাথা কাজ করছে না।
“আরে রুমি, তোরও যা কথা? এতো আলিশান বাড়ি, এতো চাকচিক্যময় জীবনের লোভ কেউ কাটাতে পারে সহজে? শুভভাই কি এসব দিতে পারবে? সে বড়জোর একটা তিন বেডরুমের ফ্ল্যাটে রাখতে পারবে আপুকে। কোথায় শুভ কোথায় রাজ ভাইয়া। আপু বুদ্ধিমতী তাই বুঝে গেছে আগেই। আমিও তাই করতাম। তুই তোর শুভ ভাইয়ার গল্প বাদ দে।”
রুনির কথায় মেজাজ প্রচন্ড খিঁচে গেলেও শশুর বাড়িতে কোন সিনক্রিয়েট চায়না বলে চুপ করে রইল রুহি। রুমি অবশ্য চুপ থাকলোনা-
“ছোটপা, তুমি নিজে যেমন সবাইকে তা ভাবলে তো হবে না। বড়পা মোটেও তেমন নয় তা তুমিও ভালো মতোই জানো। উল্টো পাল্টা বলে রাগিয়ে দিয় না।”
“তোর বড়পাকে রাগিয়ে দিতে আমার বয়েই গেছে।”
বলেই রুনি ঠোঁট উল্টে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। রুমি বোনের কাছে এসে বসলো-
“বড়পা, প্লিজ ভাইয়ার সাথে কথা বলো। মানুষটা পাগল মতো হয়ে আছে।”
“এখন না রুমি। অনুষ্ঠান শেষ হোক তারপর বলবো।”
“ঠিক আছে তুমি যেমন ভালো বোঝো।”
রুমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। বাবামাকে ঢুকতে দেখে আর কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
“মারে, আমার উপর এখনো রাগ করে আছিস নাকি?”
ইয়াকুব আলী মেয়েকে কাছে ডেকে নিজের পাশে বসালেন। রুহির মায়ের সাথে চোখাচোখি হলো।দিলারা মেয়ের মুখপানে চেয়ে আছেন। ইয়াকুব আলী জবাব না পেয়ে রুহির মাথায় হাত রাখেন-
“বন্ধু মানুষ, তার এই অবস্থা শুনে সহ্য হয় নাই। এখন নিজের চোখে দেখে মনে হলো তোকে পাঠিয়ে ঠিক করেছি। মানুষটার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। কতোদিন বা বাঁচবে লোকটা? ততদিন না হয় তুই কষ্ট করে থাক? না থাকলে আমার বলার কিছু নেই। তারপর যেমনটা তোর মর্জি হবে করিস।”

★★★

সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে রাযীন যখন এ্যাশ কালার স্যুট পরে রুহির পাশে এসে দাঁড়ালো রুহির যেন চোখ ঝলসে গেলো। সবসময় রেগে থাকার কারনে রাযীনকে সেভাবে দেখা হয়নি কখনো। এই ছেলে দেখা যায় মারাত্মক হ্যান্ডসাম। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামা, একটু বড় বড় চুলগুলো ঘাড় অবধি এসে আছে। সেগুলো জেল দিয়ে সেট করা। ফিট বডিতে আঁটো পোশাক ওর সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছে। রুহি পাক্কা একমিনিট তাকিয়ে রইলো।
“এই মেয়ে, এভাবে কি দেখছো?”
“নট ব্যাড। আপনার স্প্যানীশ গার্লফ্রেন্ড এখন দেখলে ফিদা হয়ে যেতো।”
রুহি ভ্রু নাচায়।
“তাই? তুমি হয়েছো?”
রুহি ভ্যাবাচ্যাকা খায়-
“কি?”
“ফিদা হয়েছো? তোমার সেই প্রেমিক সুন্দর না আমি?”
“এ আবার কেমন প্রশ্ম? কারো সাথে কারো তুলনা হয়? তাছাড়া যাকে ভালোবাসি তার জায়গা অনেক উপরে।”
“বাব্বাহ। বেশ কথা জানো দেখছি।”
“সে জানি।”
রুহি প্রফুল্ল চিত্তে উত্তর দেয়। রাযীন মুখ টিপে হাসে। মেয়েটা মাঝে মাঝে নরমাল কথা যখন বলে তখন ভালোই লাগে।
“তোমরা জামাই বউ এতো গুটুর গুটুর করে কি গল্প করছো বলোতো? দূর থেকে দেখতে বেশ লাগছে। সবাই বলছে তোমাদের দুটিতে বেশ মানিয়েছে।”
বেনু এসে আলাপ জুড়ে দিলো। রুহি বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো। আসলেই কি সে গল্প জুড়ে দিয়েছে?
“আরে লজ্জা পাচ্ছ কেন? চালিয়ে যাও। আচ্ছা শোন, আমি এলাম একটা খবর দিতে। ফুপুমারা এসেছে। বড়মা তাদের নিয়ে আসছে। রুহি ভাবি, তোমায় কিন্তু পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হবে। কোন ভুল যেন না হয়।”
রুহির কোমড়ে অলরেডি প্রচন্ড ব্যাথা। তবুও সে রুহি মাথা নাড়লো।
“বউ তো মাশাল্লাহ রোজী। দু’জনকেই ভালো মানিয়েছে। এবার যদি তোমার ছেলে ঘরে বসে। নাকি আবার পালাবে?”
“রোজীরও কপাল। দূর্ভাগ্য না হলে কি আর এমন হয়? কতো সুন্দর সাজানো গোছানো সংসারটা এখন এলোমেলো হয়ে গেছে। বেচারি একা একা কতোদিন সামলাবে?”
“ভাই সাহেব ছেলেদের দূরে রেখে রেখে বাজে অভ্যাস করে ফেলেছে। তাদের বাবার ব্যবসা কিংবা সংসারে কোনো টান হয়নি।”
টুকরো টুকরো মন্তব্য কানে আসছিলো রুহির। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এসবই ভাবছিলো। রাযীনকে কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিলো তার। প্রশ্নের উপর জানা জরুরি। কিন্তু রাযীন তার পুরনো বন্ধুদের পেয়ে হাওয়া হয়ে গেছে।

“রুহি, শেষ পর্যন্ত ফোনটা খুললি? আজ যদি তুই কথা না বলতি আমি কি করতাম জানি না।”
শুভর কাতর কন্ঠ শোনা গেলো। রুহি দাঁতে ঠোঁট কামড়ে ধরে-
“এসব কি কথা শুভ? এমনকি কথা হয়েছিল?”
“কথার গুল্লি মারি। আমি কিছু শুনবো না আর। এভাবে চলতে পারে না রুহি হয় তুই আমার কাছে আয় নয়তো আমাকে আসতে বল।”
“অসম্ভব কথা বলছিস শুভ। আমাকে ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হবে ভরসা করতে হবে অপেক্ষা করতে হবে শুভ।”
“অপেক্ষা! কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে? অনন্তকাল?”
“যদি বলি তাই?”
“এভাবে বলিস না রুহি। এভাবে জীবন চলবে না। অনিশ্চিত পথে কি যাত্রা করা যায়? তোকে ভালোবাসি, এতোগুলো দিন একসাথে কাটিয়েছি। ভীষণ কষ্ট হয় তোকে না দেখে থাকতে। তুই যদি এমন করে বলিস তাহলে ভাববো এসব বলে আমায় ঝেড়ে ফেলতে চাস?”
শুভর কথায় স্পষ্ট ক্ষোভের আভাস। রুহি নিশ্চুপ রইলো কিছু সময়। তারপর গভীর শ্বাস ফেলে বললো-
“আমার শশুর ক্যান্সারে আক্রান্ত, প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তার শেষ ইচ্ছে এ বাড়িতে আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আমি তার ইচ্ছেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেড়িয়ে পড়তে পারি এ বাড়ি থেকে। কিন্তু তুইই বল এটা কি ভালো দেখায়? একজন মৃতপ্রায় মানুষকে এভাবে আঘাত দেওয়া কি মানুষের কাজ হবে?”
শুভ নিশ্চুপ শুনলো তারপর কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো।

★★★

সকালে বাবা মাকে বিদায় জানিয়ে দোতলায় নিজের ঘরে ফিরতে ফিরতে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আবিষ্কার করলো রুহি। গত কয়েকদিনে ব্যাপারটা নজরে এলেও প্রশ্ন আসেনি। আজ ভালোমতো লক্ষ করে বেশ অবাক হলো। ব্যাপারটা কেমন যেন অস্বাভাবিক। এইরকম একটা পরিবারের সাথে খুবই বেমানান ব্যাপার। রুহি সকালে নাস্তার টেবিলে ভরা মজলিসে প্রশ্নটা করেই ফেললো-
“আচ্ছা, আপনাদের কোন পারিবারিক ছবি নেই কেন? এই যে দেয়ালজুড়ে এতো এতো সম্মাননা, সার্টিফিকেটের ফ্রেম ঝুলছে কিন্তু কোথাও পরিবারের সকলে মিলে একসাথে ছবি দেখলাম না।”
পুরো টেবিল জুড়ে পিনপতন নিরবতা নেমে এলো। সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো কিন্তু কেউই মুখ খুললো না। অবশেষে খুকু বললো-
“তোমার শশুর পচ্ছন্দ করে ছবি দেওয়ালে ঝুলানো। তবে সবার নিজের নিজের পচ্ছন্দ মতো ছবি আছে তাদের নিজেদের ঘরে। সব জায়গায় ছবি রেখে ঘরকে ফটো এগজিবিশন সেন্টার বানানোর দরকার কি?”
রোজী অত্যন্ত বিরক্ত রুহির উপর সেটা টেবিল ছেড়ে প্রমান করে দিলেন। ছেলেরা অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো এক রাযীন ছাড়া। শিখা অবশ্য ফোড়ন কাটতে ভুললো না-
“তোমার কৌতূহল অনেক বেশি বৌমা। এতো কৌতুহল কিন্তু ভালো না। খামোখাই বিপদ ডেকে আনে।”
বলে আর দাঁড়ায় না শিখা। রুহি বোকা চাহুনি দিয়ে বসে থাকে। সে কি এমন কিছু জানতে চেয়েছে যেটা জানলে পাপ হবে? নরমাল একটা প্রশ্ন অথচ এমন ভাব করলো সবাই যেন কাউকে খুন করার কথা বলেছে। আজব!
“শোন, তোমার কিছু জানার ইচ্ছে হলে আমাকে প্রশ্ন করবে। এভাবে সবার সামনে জানতে চাইবে না।”
রুহি জানতে চাইলো সে কি এমন বলেছে যে এমন রিয়্যাকশন করলো সবাই? কিন্তু রাযীন সে সুযোগ দিলো না। সে কথা শেষ করেই গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেলো।

চলবে—
© Farhana_য়েস্মিন

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-১৪

“মা, আমি কি বাবাকে মাঝে মাঝে খাওয়াতে পারি?”
রুহি বাস্তবিকই খাওয়াতে চাইছিলো আশরাফ আঙ্কেলকে। তাই আন্তরিকতার সাথেই জানতে চাইলো। রোজীর মুখটা উজ্জ্বল হলো-
“শুনে খুশি হলাম বউমা। তোমার শশুরও খুব খুশি হবেন। সমস্যা না হলে কাল থেকে সকালে তুমিই খাইয়ে দিয়।”
“জ্বি মা।”
রুহি ফিরে যাচ্ছিলো রোজী পূনরায় ডাকলো ওকে-
“কাল সন্ধ্যায় মনু বুবুর বাসায় দাওয়াত আছে তোমাদের। রাজকে বলে দিয়ো কাল যেনো মনে করে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে মা।”
রুহি ভাবলো রুমে ফিরে অফিসে একবার কথা বলবে। উইথআউট পেতে ছুটি বাড়িয়ে নেওয়া গেলে খুব ভালো হবে। কিন্তু কতোদিন যাবে এভাবে? নাকি এখানেই কোন ব্রান্চে ট্রান্সফার নেবে? চাকরিটা খুব প্রিয় রুহির। নিজের যোগ্যতায় পাওয়া চাকরি হারানো চলবে না কিছুতেই।
“আউচ।”
মাথায় প্রচন্ড গুঁতো খেয়ে রুহি চোখে অন্ধকার দেখলো।
“ভাবি, কি ভাবছিলে গো? এতো অন্যমনস্ক যে আমার মতোন সুন্দরীকে চোখে পড়লোনা?”
ঝিলিক এর নাকি কন্ঠ শোনা গেলো।
“সরি ভাবি দেখতে পাইনি তোমায়। কিন্তু তুমি আজ বাসায় যে? তোমার বুটিকে যাওনি ভাবি?”
রুহি মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জানতে চাইলো।
“আরে দেখোনা, কেমন পিম্পল উঠেছে মুখে। এতো ফুলে আছে যে মেকাপেও ঢাকবে না। এভাবে কি বাইরে যাওয়া যায় বলো?”
ঝিলিক মুখ বাড়িয়ে সদ্য গজানো ব্রনটা দেখালো।
“ন্যাকা ষষ্ঠী। ব্রনকে বলে পিম্পল।”
রুহি বিরবির করে মুখ বাকায়।
“কিছু বললে নাকি ভাবি?”
ঝিলিক কান এগিয়ে দিয়েছে। রুহি আঁতকে উঠে-
“আরে না না কিছু বলিনি। বলছিলাম এই ছোট এত্তটুকুন জিনিসের কি ক্ষমতা তোমার সৌন্দর্য কমায়। পিম্পল নিয়ে তোমাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে।”
“সত্যি! তুমিও না ভাবি। আচ্ছা শোনো, চলো আমার রুমে যেয়ে বসি। তোমার সাথে অনেক গল্প করবো আজ।”
ঝিলিকের চোখেমুখে খুশি ঠিকরে পড়ে। রুহি রাজি হয়ে যায় ঝিলিকের প্রস্তাবে।
“বেশতো চলো।”

রুমে ঢুকে চারপাশ খুঁটিয়ে দেখলো রুহি। এ বাড়ির প্রতিটা কামড়া এতো বড় যে সেটা তাদের ঢাকার বাড়ির সমান প্রায়। এই কামড়াটাও ব্যতিক্রম নয়। সুন্দর বাহারি ফার্নিচার দিয়ে ডেকরেট করা ঘর দেখে রুহি মুগ্ধ হয়। ঝিলিক রুহির হাত টানে, বিছানায় নিজের কাছে বসায়-
“জানোতো, তোমার বর আর আমি খুব বন্ধু ছিলাম এককালে?”
“নাতো। সত্যি?”
রুহি সত্যিই অবাক হলো।
“হ্যা। তোমার বর কিছু বলেনি বুঝি? আমি আরো ভাবলাম বুঝি বলেছে সেই সাথে আমার সাথে কথা বলতেও মানা করেছে ভেবেছি।”
“না ভাই, সে তোমার সম্পর্কে কিছু বলেনি কথা বলতেও মানা করেনি।”
“যাক তাও ভালো। আসলে বড় আব্বুর সাথে বাবার একটা পার্টনারশিপ বিজনেস ছিলো। সেই সূত্রে একেবারে ন্যাদা কাল থেকে পরিচয় আমাদের। একটু বড় হতে হতে বন্ধুত্ব। একক্লাস ছোট বড় ছিলাম কিন্তু তবুও বেশ জমে গেছিলো আমাদের।”
রুহি বিস্মিত হলো। আসার পর থেকে একবারের জন্যও ঝিলিকের সাথে কথা বলতে দেখেনি রাযীনকে। উল্টো বিরক্ত মনে হয়েছে ওকে। ঝিলিক নিজ থেকে বকবক করছে-
“তোমার বর অনেক গোঁয়ার মানুষ ভীষণ জেদি। নিজে যা ভাবে সেটাই ঠিক মনে করে। আর কারো কোন কথা শোনার প্রয়োজন মনে করে না। তাইতো আমাদের…”
“ভাবি খুকু খালাম্মা ডাকে আপনাকে।”
দোরগোড়ায় মর্জিনাকে দেখা গেলো। রুহি উঠে এলো-
“শুনে আসি ফুপু কি বলে?”
ঝিলিক অনিচ্ছায় মাথা নাড়ে। ইশশ, কি সুন্দর গল্পের ঝাপিটা খুলে বসেছিলো। মর্জিনা শয়তানটার এখনই আসতে হবে? তুমি আজকেও বেঁচে গেলে রাজ তবে বেশিদিন না। মনে মনে বিরবির করে কথাগুলো বলে দাঁতে দাঁত চাপে ঝিলিক।

★★★

“মনুফুপুর একটু বেশি কথা বলা স্বভাব, তুমি কিছু মনে করো না।”
রাযীন গাড়ি চালাতে চালাতে জবাব দিলো।
“মনে করার কি আছে। আমার বরং ভালোই লেগেছে। যারা বেশি কথা বলে তাদের মন ভালো হয়। আইমিন মনে কোন ক্লেদ থাকে না।”
রাযীন উত্তর না দিয়ে চুপ রইলো। মনুফুপুর বাসা কাজির দেউরিতে। এ বাড়িতে আসার পর রুহির একমাত্র মনুফুপুর পরিবারকেই ভালো লেগেছে। ওই পরিবারের সবাই বেশ মিশুক। কেউই রুহি বা রা্যীনের অতীত নিয়ে কিছু বলেনি কোন ঠেসমারা কথা কানে আসেনি তার। এই প্রথম এদের কাউকে একটু আপন মনে হয়েছে। ভাবতে ভাবতে রুহি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এই এলাকায় প্রচুর খাবারের দোকান আছে মনেহয়। এই প্রায় মধ্যরাতে দোকানীরা সব কেবল দোকান বন্ধ করছে। রুহি গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে মানুষের ঘরে ফেরার দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগে রুহির। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে আপনজনের কাছে ফেরার সময় সবার চোখে মুখে যে অপার্থিব আনন্দ থাকে এই আনন্দটুকুই আনন্দ দেয় রুহিকে। ভাবে নিজের পরিবারের কাছে ফেরার চাইতে সুখের আর কিছু হতে পারে না।
“ঝিলিক ভাবীর সাথে কি আপনার বিশেষ কোন সম্পর্ক ছিলো?”
আচমকা এমন প্রশ্নে প্রচন্ড জোরে গাড়ির স্পিড থামানোর চেষ্টা করে রাযীন। থেমে যাওয়া গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো রুহির পানে-
“ঝিলিক কিছু বলেছে তোমায়?”
“নাহ। সে তেমন কিছু না বললেও আপনি যেভাবে গাড়ি থামালেন তাতে এখন সিওর হলাম যা ভাবছি তা সত্যি।”
“নিশ্চয়ই বলেছে না হলে এমন প্রশ্ন করলে কেন?”
রাযীনের চোয়াল শক্ত হলো। রুহি হাসলো-
“কাল বলছিলো আপনারা খুব ছোট কাল থেকে বন্ধু ছিলেন নাকি। অথচ আমি খেয়াল করে দেখলাম আপনি কখনো তার সাথে কথা বলেন না ঠিকঠাক। উল্টো তাকে দেখলে এড়িয়ে যায়। সেটা থেকেই অনুমান করলাম।”
রাযীন এবার বেশ জোরে গাড়ি স্টার্ট দিলো-
“তুমি তো দেখছি মহিলা শার্লকহোমস হয়েছ। না বলতেই সবকিছু বুঝে যাও।”
“এটা বোঝার জন্য শার্লক হোমস হওয়ার প্রয়োজন হয় না মিস্টার। একটু আচরণ লক্ষ করলেই বোঝা যায়। আমি অবশ্য অন্য কিছু ভাবছি।”
বলতে বলতে রুহি ঠোঁট টিপে হাসলো। রাযীম লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে সে হাসি দেখলো, তাতে তার মেজাজ খারাপ হলো-
“কি ভাবছো?”
“ভাবছি আপনি ভালোই প্রেমবাজ লোক আছেন। প্রথম প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে পালিয়ে গেলেন অথচ দোষ হলো আমার, কপাল পুরলো আমার। এদিকে পালিয়ে গিয়ে আরেকটা ধরতেও আপনার সময় লাগেনি। পারেন বটে।”
রাযীন দাঁত কামড়ে রাগ সামলালো-
“তুমি শিওর যে ঝিলিকের সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক ছিলো?”
“আলবৎ ছিলো।”
“তাহলে তো ভালোই। এখন কথা হলো আমি তো একা পারিনি তুমিও পেরেছো। তুমিও যে বেশ একটা প্রেমিক জুটিয়ে নিয়েছো সেটা চোখে দেখা যাচ্ছে না বুঝি? দোষ তাহলে আমার একার কেন?”
“কারন আমি আপনাকে ছেড়ে যাইনি আপনি আমাকে ছেড়ে গেছিলেন। ভুক্তভোগীও আমি আপনি না তাও এক দু’বছর না পাঁচ বছর। এখন যখন সামনে পাওয়া গেছে তখন ছেড়ে দেবো কেন? আমার কষ্টের সমান না হলেও কিছুটা তো উসুল হোক।”
“বটে! কথা ঠিক ছেড়ে দেবে কেন? সু্যোগ পাওয়া গেছে সেটা কাজে লাগাতে তো হবেই।”
রাযীন চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করে। রুহি গা জ্বালানো হাসি হাসলো-
“শুনুন, আপনার স্প্যানিশ গার্লফেন্ড কি জানে আপনার বিয়ের ব্যাপারটা কিংবা পুরনো প্রেমিকার কথা? কি যেন নাম তার? আপনি বরং ওর সাথে আমার কথা বলিয়ে দিন। আমি নিজের পরিচয় দিয়ে ওকে সব বুঝিয়ে বলবো।”
রাযীন এমনভাবে রুহির দিকে তাকালো যেন ওকে চোখের আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেবে।

★★★

সকাল থেকে কাজের লোকদের মধ্যে ব্যস্ততা দেখে রুহি মর্জিনাকে ডাকে-
“কি হয়েছে মর্জিনা? ও পাশের রুমে কে এলো?”
“এখনো আসে নাই নয়া ভাবি তবে আসবে, ছোট ভাইজান আসবে। সেও আপনাদের মতো মেলাদিন বাদে আসতেছে।”
“কে?”
“ছোট ভাইজান। সৌরভ ভাইয়ের ছোট ভাই, পলায়ে গেছিলো। এতোদিন কোন খোঁজ ছিলো না আজকে আসবে বলে ফোন দিছিলো শিখা ম্যাডামকে।”
রুহি হেসে দিলো-
“এ বাড়ির ছেলেদের কি পলানো রোগ আছে নাকি? সবাই পালায় যায় এ আবার কেমন কথা?”
মর্জিনা বেশ ভাবনায় পড়ে গেলো-
“আপনার কথা ঠিকই আছে নয়া ভাবি। তবে আমি তো সব জানি না তাই কিছু বলা ঠিক হবে না।”
“আচ্ছা। নাম কি তোমার ছোট ভাইজানের?”
“নিয়াজ ভাইজান।”
“ওহহহ। কখন আসবে?”
“তা বলতে পারি না ভাবি।”
রুহি শশুরের কামড়ার দিকে পা বাড়ায়। সকালে নাস্তা খাওয়ানোর দায়িত্ব তার। আশরাফ খায় কম ফেলে বেশি। লিকুইড জাউ ভাত অথবা দুধ দিয়ে পাউরুটি অথবা মাঝে মাঝে গলা খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। বেশির ভাগ সময়ই আশরাফ রুহির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে অনেক কষ্টে বাম হাতটা তুলে রুহির মাথায় রাখে চোখের পানি ফেলে। কিছু একটা বলতে চায় তবে সেটা কথা না হয়ে জান্তব আওয়াজ হয়ে যায়। ভালো না লাগলেও রুহি ধৈর্য্য ধরে বসে থাকে। কারন এই পরিবারে তার থাকার কারনটাই তো এই মানুষটা।

নিজের কামরায় ফিরে যেতে যেয়েই হলরুমে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। নিয়াজ নামের মানুষটা কি চলে এসেছে? কৌতূহল নিয়ে রুহি হলরুমের দিকে এগুলো। আরে বাবা! সবাই দেখা যাচ্ছে এখানে? রুহি আরেকটু এগিয়ে যেতেই থমকে গেলো। পৃথিবী দূলছে তার, নিজের চোখের ভুল ভেবে চোখটা ভালোমতো ডলে নিলো। ঘনঘন চোখের পল্লব পড়ছে রুহির, বুকের ভেতর ধরাস ধরাস শব্দে হৃদয় দামামা বাজাচ্ছে। মাথার দুলুনিতে চোখে আঁধার নেমে আসতেই রুহি অস্ফুটে উচ্চারণ করলো-
“শুভ!”

চলবে—
©Farhana_Yesmin