না চাহিলে যারে পাওয়া যায় পর্ব-১৭+১৮

0
293

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-১৭

“হ্যা রু, আমি নিয়াজ আমিই শুভ।”
রুহি কষ্টে উঠে বসলো। শুভ ওকে ধরতে যেতেই রুহি হাত দেখিয়ে থামায়-
“সেদিন সত্যি তাহলে তোকেই দেখেছিলাম আমি?”
“আমি ছিলাম আমাকেই তো দেখবি। রু, কতোদিন পরে তোকে দেখলাম আমার যে কি ভালো লাগছে না বলে বোঝাতে পারবোনা। কিন্তু তুই পড়ে গেলি কেন বলতো?”
শুভকে বাস্তবিকই ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। রুহি অবাক চোখে শুভকে দেখলো। শুভর কি কিছুই মনে হচ্ছে না? এতো বড় মিথ্যে এতোগুলা বছর ধরে লালন করেছে তবুও ওর কোন বিকার নেই দেখা যাচ্ছে। রুহি এতো বিস্মিত হলো যে কি বলবে কথা খুঁজে পেলো না।
“ইশশশ, কি অবস্থা হয়েছে। কতোটা কষ্ট সইতে হয়েছে তোকে তাই ভাবছি।”
“তুই আমার সাথে এতো নরমাল হয়ে কথা বলছিস কি করে শুভ? নিজের কৃতকর্ম নিয়ে কি একটুও ভয় পাচ্ছিস না তুই?”
রুহি তীব্র বিতৃষ্ণা ভরে শুভকে দেখলো। শুভর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো দ্রুত। রুহি আবার বললো-
“নিজের পরিচয় লুকিয়ে আমার সাথে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টাটা কি তোর ইচ্ছে নাকি অন্য কেউ বলেছে? আমি ভাবতেও পারছি না শুভ তুই এমন একটা কাজ করেছিস। কিভাবে পারলি? তুই নাকি আমাকে ভালোবাসিস? এই তোর ভালোবাসা? প্রতারনা, ধোঁকাবাজি করে আমাকে ফাঁসানো। তোর প্ল্যানটা কি ছিলো আমাকে বলবি?”
রুহি একনাগাড়ে কথা বলে হাফায়। শুভ ছলছল চোখে ওর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো-
“রু তুই ঠান্ডা হ। সব বলবো তোকে। শুধু অনুরোধ আমাকে কোনক্রমেই ভুল বুঝিস না। আমি সত্যিই তোকে ভালোবাসি, এ ভালোবাসায় একফোঁটা খাদ নেই। আমার জীবনে আমি নিজের পরে একজনকেই ভালোবেসেছি আর সে হলো তুই। কাজেই তোর কোন ক্ষতি করবো বা চাইবো এমনটা একবারের জন্যও ভাবিস না প্লিজ।”
শুভ কাতর গলায় মিনতি করলো। রুহি ঠোঁট বাকিয়ে অসহায় চোখে হাসলো-
“কি ভাববো আর কি ভাববো না সেটাই তো বুঝতে পারছি না শুভ। চারিদিকে মুখোশধারী, কে সত্যি কে মিথ্যা কার মনে কি চলছে সব সব কিছু ধোয়াষা। সবচেয়ে দুঃখ হলো যে মানুষটাকে বিশ্বাস করতে চাইতাম সেও আমার সাথে প্রতারনা করলো। আচ্ছা বলতো তুই কি জানতি না আমি তোর ভাবী? জেনেশুনে আমার এতোবড় ক্ষতি করে তোর লাভটা কি শুভ?”
“রু আমি তোর কোন ক্ষতি করিনি। বরং তোকে মৃত থেকে জীবিত করেছি। তুই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলিস আমি তোর হাত ধরে টেনে তুলেছি।”
শুভর কন্ঠ কেমন ফ্যাসফ্যাসে শোনায়। রুহি চুপ করে তাকিয়ে শুভকে দেখছে-
“বড় উপকার করেছিস শুভ। সেই উপকারের প্রতিদান যে এভাবে দিতে হবে ভাবিনি। আমার ইমোশন নিয়ে আমার মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার তোকে কে দিয়েছে শুভ? আমি তোদের কাছে একটা ফুটবল যেটাকে যার মন চাইলো লাথি দেবে? তোর ভাই বিয়ে করে পালাবে, তুই সহানুভূতি দেখিয়ে প্রেম করবি। মানে কি এসবের?”
“দেখ রু, ভাইয়ার তো ফেরত আসার কথা ছিলোনা। ও কেন এসেছে তাও জানি না। যে কারনেই আসুক না কেন তুই কিছুতেই ওর সাথে জীবন কাটাতে পারিস না। যে মানুষ এতোদিন তোর খোজ করেনি তাকে কেন তুই সুযোগ দিবি? আমি আছি তো তোর জন্য তোর ভালোবাসার মানুষ।”
“ছিহ শুভ ছিহ। তোদের সব ভাইদের দেখি পরস্ত্রীর দিকে নজর। আমি না চাইতেও তোকে ভালোবেসে ফেলেছি দেখে নিজের উপরই ঘৃনা হচ্ছে।”
ঘৃনায় রুহির মুখচোখ কুঁচকে উঠলো। শুভ কাতর হয়ে রুহির হাত ধরে-
“তুই ভুল বুঝছিস। ভাইয়া তোকে ফেলে চলে গেলে। বড় আব্বু অনেক দুঃখ করতো। তোর জীবন নষ্ট হবার জন্য নিজেকে দায়ী করতো। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত করতে চাইতো কিন্তু কিভাবে সেটা জানতো না।”
রুহি এক ঝটকায় শুভর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো-
“তাই তোকে লেলিয়ে দিয়েছিলো আমার পেছনে?”
রুহি হতবাক হয়ে শুভকে দেখে।
“এভাবে বলছিস কেন রু? পুরো কথাটা তো শোন।”
“না শুনবো না। এখন যে তুই সত্যি বলছিস তার গ্যারান্টি কি? তোর চাইতে তো রাজ ভালো। ও আমার কোন ক্ষতি না করে চলে গেছিলো। আর তুইতো আমার মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিস। এতো বড় কান্ড ঘটানোর পরে তোকে কি বিশ্বাস করা উচিত বল তো আমাকে?”
রুহি চাপা কন্ঠে গর্জন করলো।
“এভাবে বলিস না রু। আমাকে ভুল বুঝে কোন ভুল ডিসিশন নিস না। আমার পুরো কথা মন দিয়ে শোন তারপর যেটা ভালো মনেহয় সেটা করিস।”
“আমি তোর কোন কথা শুনবো না। তুই এখন যা শুভ, আর কখনো আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করিস না। আমি জাস্ট তোকে নিতে পারছি না। তোরা সবাই এক, কেউ ভালো না।”
বলতে বলতে রুহি ঝরঝর করে কাঁদে। শুভ এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত রাখতে চায়। রুহি ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে শুভকে ধাক্কা দিলো-
“ডোন্ট টাচ মি। এখনই বেড়িয়ে যা আমার রুম থেকে। না হলে আমি চিৎকার করবো।”
“রু প্লিজ একবার শুধু আমার কথা শোন।”
“না একবারও না। আমি আর তোদের খেলার পুতুল হবো না। যা করেছিস করেছিস আর সুযোগ পাবি না। প্লিজ চলে যা।”
শুভ তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। রুহির চোখ থেকে সমানে শ্রাবনধারা বইছে।
“এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? তুই যাবি না আমি চিৎকার করবো?”
“রু!”
“ঠিক আছে আমিই চলে যাচ্ছি।”
রুহি পা বাড়াতেই শুভ এগিয়ে এলো-
“তুই থাক আমিই চলে যাচ্ছি।”
শুভ গেট খুলে বেরুতেই রুহি বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। এদিকে শুভকে রুম থেকে বেরুতে দেখেই দরজার আড়াল থেকে কেউ সরে গেলো দ্রুত।

★★★

“রাজ আজকাল একটু বেশি ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে বিজনেসে।”
আফজাল শিখার নরম পেলব হাতে হাত বুলায়।
“হিসাব দেখতে চাইছে।”
“হুমমম।”
শিখা চোখ বুজে আফজালের স্পর্শ উপভোগ করছে।
“ও হিসাব দেখলে বুঝে ফেলবে গড়মিল। আজকাল রেনুর বর খুব ভাব করছে রাজের সাথে। সেই কানপড়া দিচ্ছে কিনা কে জানে।”
শিখার গায়ে আফজালের স্পর্শ গভীর হলো।
“তা দিকনা। ভাইজান তো আর কিছু করার অবস্থায় নেই। একা রাজ আর কতো কি করবে। তবে বউটা ত্যাদর আছে। যতদিন রাজের সাথে মিল না হয় ততদিন কোন ভাবনা নেই। মিল হলেই বিপদ।”
“মিল যাতে না হয় সেজন্য তো তুমি আছো।”
আফজাল শিখার গালে হাত বুলিয়ে চুমে দিলো। বাহুতে চাপ দিতেই শিখা তাকালো। ওর চোখ দুটো লাল টকটকে-
“সে আছি। ভাইজানের বংশকে ছাটাই করতে যা করা লাগবে করবো। পাঁচ বছর আগে যেভাবে রাজকে বাড়িছাড়া করেছিলাম দরকার হলে আবার সেরকম কিছু করবো। তুমি একদম ভেবোনা এসব নিয়ে।”
“ভাবছি না। তুমি থাকলে ভাবনা কি?”
আফজাল হাসলো, শিখাকে কাছে টানলো। শিখা আদূরে বেড়ালের মতো আফজালের বুকে মুখ গুজলো। আফজাল ক্লান্ত গলায় বললো-
“শিখা, ভাবছি এতো কিছু করে আদৌও কি কোন লাভ আছে? যা হারিয়ে যাওয়ার তা তো গেছেই। এখন এসব করে কি লাভ হবে?”
শিখা তৎক্ষনাৎ মুখ তুলে আফজালকে দেখলো-
“তোমার বুকের আগুন এতো তাড়াতাড়ি নিভে গেলো? কিন্তু আমার যে নেভেনি? আমি তো তিলে তিলে জ্বলছি। ভাইজানকেও ততটুকু জ্বলতে হবে।”
“তুমি ভুলে যাচ্ছ ভাইজান আমাদের চাইতে বেশি হারিয়েছে।”
“আমি এতোকিছু জানতে চাই না আফজাল। প্লিজ এসব বলে আমার মেজাজটা খারাপ করে দিয়ো না। সেসব আবার নতুন করে মনে করতে চাই না যা মনে করলে মরে যেতে মনচায়। যা হচ্ছে হতে দাও।”
আফজাল কিছু না বলে চুপ করে গেলো। শিখার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বারান্দায় এসে সিগারেট জ্বালালো। শুরুতে বারকয়েক কাশলো তারপর ক্রমাগত কয়েকটা খেলো। হঠাৎ ছাঁদের কার্নিশে চোখ পড়লো। কে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে? শুভ না? এতো রাতে ছাঁদে কি করছে শুভ? কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে কেন? আফজালের বুক ধরাস ধরাস করে। সে প্রায় ছুটে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

চলবে—
©Farhana_Yesmin

#না চাহিলে যারে পাওয়া যায়
#পর্ব-১৮

“তোমার আজকাল কি হয়েছে বলো তো? আমার সাথে কোন ঝগড়া টগড়া করছো না। সবসময় মনমরা হয়ে থাকছো। বাড়ির কথা মনে পড়ছে নাকি? ঢাকায় বেড়াতে যাবে?”
রুহি জানালার পাশে বসে বাইরেটা দেখছিলো। ঘরে এসি চলে বলে সবসময় জানালা বন্ধ থাকে। ইদানীং রুমে বেশি সময় থাকা হয় বলে রুহির হাফ ধরে যায়। ক’দিন ধরে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ঘরের সবকটা জানালা খুলে দেয় সে। প্রথম প্রথম রাযীন ভ্রু কুঁচকে তাকালেও কিছু বলতো না। মাথায় আঘাত পাওয়ার পর থেকে এই পরিবর্তনটা দেখছে রুহি। সহজে ওকে কিছু বলে না রাযীন। বললেও ভাষা খুব নরম আর সংযত। কথা শুনে রুহি রাযীনের পানে চাইলো। সকাল সকাল গোসল করে পরিপাটি কাপড় পরে একদম ফুলবাবু হয়ে আছে। গা দিয়ে দারুণ সুগন্ধির স্মেল ভেসে আসছে।
“আপনি এতো সকালে কোথায় চললেন?”
রুহি রাযীনকে নিরীক্ষা করলো।
“একটা জরুরি কাজ পরে গেছে কক্সবাজারে।”
কক্সবাজার শুনেই রুহির চোখ চিকচিক করে উঠলো-
“কক্সবাজার যাচ্ছেন আপনি? তাহলে আমিও যাবো। ঘরবন্দী হয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার।”
“আরে আমি তো ব্যস্ত থাকবো। তুমি একা একা কি করবে?”
রাযীন ইতস্তত করলো। রুহি সন্দিগ্ধ চোখে চাইলো-
“আমি একা একা সমুদ্র দেখবো।”
“তাই হয় নাকি? তুমি সাথে থাকলে আমার মনোযোগ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে। অর্ধেক কাজে অর্ধেক তোমার উপর। তাতে কোন কাজই ঠিক মতো হবে না।”
“দেখুন ছুতো দেবেন না। আপনি আমাকে নেবেন কিনা বলুন। সারাদিন এ বাড়িতে বসে থেকে আমি করিটা কি? আসার পর থেকে বেরুনো হয়নি কোথাও। আমার সাফোকেশন লাগছে।”
দ্বিতীয়বার মানা করতে যেয়ে রাযীন থমকায়-
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি তৈরী হয়ে নাও আমি বাবা মাকে বলে আসছি।”
রুহিকে এবার বেশ চনমনে দেখালো। সে দ্রুত আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। সেলাই এর দিকে চোখ যেতেই রুহি আনমনে তাতে আঙুল বুলিয়ে দেয়, একজন বিশ্বাসঘাতকের জন্য পাওয়া আঘাত। মনটা চিরবিরিয়ে ওঠে রুহির। কপালের সেলাইটা শুকিয়ে গেছে। সেলাই কাটাতে যাওয়ার কথা, রুহির ইচ্ছে করে না। কি হবে সেলাই কাটিয়ে, কার জন্য নিজেকে সাজানো? সবকিছু অর্থহীন লাগে ওর কাছে। শুভর কথা ভাবতে ভাবতে তৈরী হলো রুহি। হাতের কাছে যা পেলো তাই পড়লো, খুব মন দিয়ে কিছু দেখলো না। হাতে ছোট্ট হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে যখন পুরোপুরি তৈরী তখনই রাযীন রুমে এলো-
“চলো। তোমার শাশুড়ী তো বেশ খুশি হলো তোমার বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে। বললো পারলে যেন দু’দিন থেকে আসি।”
রুহি চমকে রাযীনের পানে ফিরে চাইলো। রুহির উপর নজর পড়তেই রাযীনের মুখের ভাষা হারিয়ে গেলো। এই মেয়ে করেছে কি এসব? একেতো পুরো অগ্নিগোলক মনেহচ্ছে। কমলা আর নীলের কম্বিনেশনে শাড়ীটা যেন রুহির জন্যই বোনা হয়েছে। এতো সুন্দর শাড়ী পরা কোন মেয়েকে আজপর্যন্ত দেখেনি রাযীন। আর রুহি যে এতো মায়াবী সেটা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। অবশ্য রুহিকে মন দিয়ে দেখেছেই বা কতটুকু?
“আরে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? চলুন যাওয়া যাক।”
রুহির বিরক্ত কন্ঠ কানে আসতেই রাযীন চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিজের ওয়ালেট আর ল্যাপটপের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে এলো।

অনেকদিন পরে বাইরে বেড়িয়ে রুহির ভালো লাগছে। সে বুভুক্ষুর মতো গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে। ঠান্ডা বাতাসে তার চুল উড়ছে পতপত করে। রাযীন মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখে আবার গাড়ি চালানোয় মন দিলো। কক্সবাজার পৌছুতে সাড়ে চার ঘন্টা মতোন লাগবে। রাযীন ঘড়ি দেখলো। এখন সকাল দশটা, তারমানে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর তিনটা। রুহিকে হোটেলে নামিয়ে দিয়েই ছুটতে হবে। রাযীন সময়ের হিসেব মিলিয়ে সন্তুষ্ট হলো।
“জানালাটা লাগিয়ে দাও। তা না হলে কিছুক্ষণ পর তোমার চুলগুলো পাখির বাসা হয়ে যাবে। দেখতে পাচ্ছ তো রাস্তায় প্রচুর ধুলো।”
রুহি অনিচ্ছায় জানালার কাঁচ তুলে দিলো-
“আপনার সাথে জরুরি কথা ছিলো।”
রাযীন অবাক হয়ে তাকালো-
“বলো কি বলবে।”
“আমি আবার অফিসে জয়েন করতে চাই। এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”
“তারমানে ঢাকায় যেতে চাইছো?”
রুহি মাথা নাড়তেই রাযীনের চেহারায় চিন্তার রেখা।
“কিন্তু ঢাকায় কি যাওয়া সম্ভব? মা রাজী হবে না।”
“ছুটি আর এক্সটেন্ড করবে না আর জবটা আমি কিছুতেই ছাড়বোনা। এবার অন্য কোন সলুশন থাকলে বলুন।”
“আচ্ছা তুমি আমাকে ক’দিন সময় দাও দেখি কিছু করা যায় কিনা।”
রাযীনের মনোযোগ সামনের রাস্তায়।
“তিনদিনের মধ্যে জানাবেন। আমার ছুটি শেষ হচ্ছে তিনদিন পরে।”
“আচ্ছা। শোন, তোমাকে আমি আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে যাবো। আমি হোটেলে বলে রেখেছি তোমার যা দরকার সব ব্যবস্থা করে দেবে। আর আমি সন্ধ্যা নাগাদ চলে আসতে পারবো আশারাখি। ততক্ষণ একা একা থাকতে পারবে তো? দরকার হলে আজ রাতে আমরা এখানেই থেকে যাবো। কাল একটু ঘুরে বিকেলে বাড়ি ফিরবো।”
রুহি অবাক হয়ে জানতে চাইলো-
“আপনাদের হোটেলও আছে?”
রাযীন মনভোলানো হাসি দিলো-
“হ্যা, বাবা ইনভেস্টের কোন খাত বাদ রাখেনি।”
“আর আপনি এসব ফেলে দেশের বাইরে পড়ে রয়েছেন?”
রুহি বিস্মিত কন্ঠে জানতে চাইলো। প্রশ্ন শুনে রাযীনের চেহারার কাঠিন্যে ফুটে উঠলো-
“যা জানোনা তা নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো।”
রুহি চুপ করে রইলো। কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হলোনা।
“বাবা বিজনেস করেছে বলে আমারও করতে হবে এমন কোন রুলস তো নেই। বিজনেসে আমার ইন্টারেস্ট কম তাই…”
কিছুক্ষণ পর রাযীনই কৈফিয়ত দেওয়ার ঢংয়ে কথাগুলো বললেও শেষ করে না। রুহি কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তিনটে নাগাত রুহিকে হোটেল সি ভিউ ইন্টারন্যাশনাল এর সামনে নামিয়ে দিয়ে রাযীন চলে গেলো মিটিং এ্যাটেন্ড করতে। রুহি বিস্মিত হয়ে দেখছিলো পাঁচ তারকা হোটেলটি। এতো সুন্দর হোটেল থাকতে রাযীন কেন অন্য কোথাও মিটিং করবে সেটাই ভেবে পেলোনা রুহি। নিজেদের হোটেলে কি মিটিং করা যায় না?

শাওয়ার নিয়ে বেরুতেই লাঞ্চের জন্য ফোন এলো। কিন্তু রাস্তায় দু’বার থেমে থেমে খেয়েছিলো বলে ততটা খিদে নেই রুহির। সে এককাপ চায়ের কথা বলে সামনের থাইগ্লাসের পর্দা সরিয়ে দিতেই বিমোহিত হয়ে গেলো। চোখের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের নীল জলের রাশি। তাতে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো পড়ে সমুদ্রের জল এমন চিকচিক করছে যে চোখ মেলে তাকাতেই চোখ ঝলসে যায়। রুহি সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কি মনে হতেই রুহি দ্রুত হাতে নিজেকে তৈরী করে রোদচশমা চোখে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। হোটেলের ম্যানেজার ওকে দেখেই দৌড়ে আসে-
“ম্যাম, কোথায় যাচ্ছেন?”
“একটু সামনে থেকে হেঁটে আসি।”
“ম্যাম, বাইরে এখনো রোদ। কাউকে সাথে নিন, ছাতা ধরে থাকবে।”
রুহি হাসলো-
“লাগবে না। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।”
ম্যানেজার আর কথা না বাড়িয়ে সরে দাঁড়ায়। রুহি একা একাই হেঁটে চলে সাগরের পানে। বালি এখনো উতপ্ত হয়ে আছে। এখনো রোদ বলেই হয়তো লোকের ভীড় কম। রুহি সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে দাঁড়ায়। দু’হাত ছড়িয়ে দেয় পাখির ডানার মতো করে। মনেহয় যেন এখনি ওই নীল আকাশে উড়াল দেবে। রুহি সমুদ্র জলের আরো একটু গভীরে যেতেই কেউ একজন এসে পেছন থেকে ওকে জাপ্টে ধরে প্রায় শুন্যে তুলে বিচের ধারে সাজানো বড় ছাতার তলায় নিয়ে এলো।
“তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? মরতে যাচ্ছিলে কেন তুমি?”
রুহি সামনে শুভকে দেখে হতবাক হয়ে গেলো-
“তুমি! তুমি এখানে কি করছো? তুমি আমার পিছু নিয়েছো? হাউ ডেয়ার ইউ শুভ?”
শুভ চোরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“কথা বলছো না কেন? বলো তুমি কেন আমার পিছু নিয়েছো?”
“ভাগ্যিস পিছু নিয়েছি। তা না হলে আজ কি হতো?”
শুভ বিরবির করে। রুহি চিৎকার করে ওঠে-
“কি হতো? তুমি কি ভেবেছো? তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকের জন্য আমি আত্মহত্যা করবো? নিজেকে এখনো এতোটা সস্তা বানাইনি যে তোমাদের মতো পুরুষদের জন্য মরবো। এখন তুমি আমার কথার স্পষ্ট করে জবাব দাও। তুমি আমার পিছু নিয়েছো কেন?”
“তুমি ভাইয়ের সাথে আসলে কেন বেড়াতে? বাসায় আমি ছিলাম তো তোমাকে একা ফিল করতেই দিতাম না।”
শুভ রুহির চোখে চোখ রাখে। ওর চোখে মাতলামো ভর করেছে। রুহি ঘেন্নায় চোখ ফিরিয়ে নেয়-
“আর ইউ ম্যাড শুভ? তোমাকে আমি বলিনি আমার থেকে দূরে থাকতে? তুমি যদি আমার কথা না শোনো তবে কিন্তু সত্যি সত্যি আমায় মরতে হবে। আমার তোমাকে মোটেও সহ্য হচ্ছে না। একজন প্রতারককে সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি এখনি বাড়ি ফিরে যাও।”
“না আমি যাবো না। ভাই যদি তোমাকে কিছু করে দেয়?”
শুভ গোঁয়ারের মতো ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে। রুহির যেন রাগে জ্ঞান শুন্য অবস্থা।
“মানে! কি বলতে চাইছো তুমি?”
বলেই শুভর ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে হতবাক হয়ে তাকালো-
“তোমার ভাইয়া চাইলে বাসাতেও সবকিছু করতে পারে। আফটারঅল সে আমার হাজবেন্ড আমার উপর অধিকার আছে তার। আমি কি বলি জানো? তোমার ভাইয়া তোমার চাইতে অনেক বেটার। সে তোমার মতো আমার সাথে কোন প্রতারনা করেনি।”
বলেই রুহি আর দাঁড়ায় না হোটেলের দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে শুভ চিৎকার দিলো-
“রাগের মাথায় কোন ভুল করে ফেলো না রুহি। ভাইকে বিশ্বাস করো না।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin