নিরালায় ভালোবাসি পর্ব-১২+১৩

0
269

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
১২ .

আজকের দিনটা ইচ্ছের অন্যরকম ভাবেই শুরু হয়েছে। সকালে চোখ খুলেই সে আজ নীরবকে দেখেনি ঠিকই তবে নীরবের পরিবর্তে পাশের টেবিলে দুই কাপ চা ও ঠিকই দেখেছে। এতে অবশ্য অবাকও খুব হয়েছে। তবে ইচ্ছের মনে আছে নীরব আগেও ছুটির দিনে টুকটাক রেসিপি রান্না করতো। রুমা দেবী আগে যখন ওয়ার্কিং ওমেন ছিলেন তখনও সে তার মাকে অনেক কাজে হেল্প করেছে। রুমা দেবীর আসতে দেরী হলে কতো দিন নিজেই রান্না করেছে, বাসন পর্যন্ত মেজেছে। সময়টা ছিল এমন নীরব মায়ের এসে কাজ করতে কষ্ট হবে বলে বিকেলে খেলতে না গিয়ে রান্না করতো, আর ধীর আর ইচ্ছে এসে ওকে তাড়া মারত খেলতে যাবার জন্যে। মাঝে মাঝে ওর হাতে হাতে অনেক কাজও করে দিতো।
কিন্তু এখন নীরবকে কিছুই করতে হয় না। সব আশা, রুমা দেবী আর ইচ্ছে মিলেই করে। কিন্তু আজ যেই সুযোগ পেয়েছে ঠিক কাজে লেগে গেছে।

ইচ্ছেকে সংয়ের মতো বসে থাকতে দেখে নীরব গিয়ে ওর মাথায় টোকা মেরে বললো,

– ” কোন খেয়ালে আছেন ম্যাম? উঠুন! সকাল হয়েছে। ইউনিভার্সিটি যেতে হবে তো নাকি!”

ইচ্ছে চুপচাপ উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফিরে আসতেই নীরব নিজেই গিয়ে তোয়ালে দিয়ে ইচ্ছের মুখটা পরম যত্নে মুছিয়ে দিয়ে ইচ্ছের হাতে তুলে দিলো, আধ কাপ সবুজ রঙের জল। ইচ্ছে তাই মুখে পুরে নিলো। সেই জল মুখের মধ্যে যেতেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো ইচ্ছে। কোনো মতেই যেনো তেতো রসটা ইচ্ছে ঘিটতে পারলো না। মুখ দিয়ে বের হতে চাইলেই নীরব মুখটা চেপে ধরলো, যাতে ইচ্ছে খেয়ে নেয়। কিন্তু পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের জিহ্বা যে ততক্ষনে ইচ্ছেকে ভালো মতোই বুঝিয়ে দিয়েছে, সবুজ জলটা ছিল বাসক পাতার রস। নির্ঘাত পাশের বোস কাকুদের বাড়ি থেকে চুরি করে এনেছে। কারণ পাড়ায় ওই একজনের বাড়িতেই এই গাছ আছে। কেউ জানতে পেরে তার থেকে কয়েকটা পাতা চাইলেও তিনি তা দেওয়া তো দূর, উল্টে অস্বীকার করেন।

– ” আমি কতো কষ্ট করে এইগুলো এনেছি তুই কী আর জানবি। উল্টে ফেলে দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি খা। ”

পুরো মুখটা যেনো তেতোতে ভরে গেছে ইচ্ছের। এতোটাই তেতো যে সাড়া শরীর ইচ্ছের কাঁটা দিয়ে উঠছে। নীরব ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে এক চামচ চিনি ওর মুখে পুরে দিলে ইচ্ছের একটু ভালো লাগে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো নীরব আজ হঠাৎ করেই এই তেতো রসটা খাওয়ালো কেনো?

– ” কী ভাবছিস?”
ঘাড় নারলো ইচ্ছে না করলো। কিছুই ভাবেনি ও।
– ” আজ ওই ভোলুর তাড়া খেয়ে তবে এই বাসক পাতা আমি আনতে পেরেছি। ভাবছি নিজেই একটা চারা কিনে বসাবো। ” নীরবের বলতে দেরি ইচ্ছে গোল গোল চোখ করে কেশে দিলো।
– ” ভয় পেতে হবে না। বসাবো না। পাগল নাকি, তখন দেখবো আমাকেই ঐটা গিলতে হবে। থাক দরকার নেই। নেহাত কাল বৃষ্টিতে ভিজেছিলি। নাহলে কী আর এই তেতো তোকে সকালে খাওয়াতাম নাকি! তারপর বউয়ের মুখ দিয়ে তেতো বুলি বেরোলে আমারই কষ্ট। যদিবা তুই তো আমার সাথে কথাই বলিস না। মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানিস, তুই আবার বোবা হয়ে যাসনি তো! ”

ইচ্ছে চুপ করে এক জায়গায় বসে রইলো। একটা কথা বললো না। যেনো কোনো স্ট্যাচু। নীরব ওকে চা দিয়ে আলমারির কাছে গেলো জামাকাপড় নিতে, রেডি হতে হবে। ইচ্ছেকে কলেজে দিয়ে আসতে হবে। ওখান থেকে একবার গিয়ে রুমা দেবীকেও আনতে হবে।

————————

কলেজে ঢুকেই ইচ্ছে ক্লাসে যাইনি। মাঠেই বসে রয়েছে। গাড়িতে আসার সময় হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এর গ্রুপে তরুণ স্যার টেক্সট করে জানিয়েছেন যে, তিনি আজ কলেজে আসবেন না। 9,30 টার ক্লাসটা এস, কে স্যার নেবে। তাই আর ক্লাসের দিকে পা বাড়ায় নি ইচ্ছে। হয়তো আজকেও তিনি কিছু বলবেন ইচ্ছেকে। কথায় বলে, ফার্স্ট ইমপ্রেশন ইস দি লাস্ট ইমপ্রেশন। এটাই হয়তো এখন ইচ্ছের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। স্যার হয়তো এটাই ভাববে এই মেয়েটা কাউকে গুরুত্ব দেয় না। এই 9;30 ক্লাস টা একটু তাড়াতাড়িই হয়। তাই এখনও তেমন কেউ আসেনি। দুই একজনকে কেবল দেখা যাচ্ছে যারা বাইরে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে।

অপর দিকে নীরব আজ দারুন আছে। অফিস তো ছুটি। এই নিয়ে অবশ্য ও ইচ্ছেকে বলেছে যে, “দেখ এখন আমি ছুটিতে আছি। তোর তো ছুটিও নেই। খালি পড় আর পড়েই যা। আহা কি আরাম। আজ আমি সারাদিন ঘুমোবো, বিকেলে যখন ফুচকা কাকু আসবে ফুচকাও খাবো। কিন্তু তোর তা হবে না। তোর তো গলায় ব্যথা। টক জল খাওয়া বারণ। তুই আমার হাতের হালুয়া খাস, আমি করেছি।” কিন্তু নীরব জানে ডক্টর এখন অল্প ছাড় দিয়েছে। কিন্তু নীরব চায় ইচ্ছে পুরোপুরি আগে সুস্থ্য হোক।

নীরবের একেকটা কাজে ইচ্ছের যখন তখন এখন হাসি পায়। এখনও পাচ্ছে। কিন্তু হাসতে ঠিক মতো পারলো না। তার আগেই এস, কে স্যারকে দেখলো ইচ্ছে। এই তিনি কলেজে আসছেন। অলরেডি 9, 45 হয়ে গেছে। এটা উনি বলে ঠিক আছে। ওনার ক্লাসের কোনো স্টুডেন্ট হলে সোজা বলতেন, ” যেখানে এতক্ষণ ছিলে সেইখানেই যাও। ক্লাসে তোমার কোনো দরকার নেই। ”

এস, কে স্যারকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে একটু অবাক হয় ইচ্ছে। নিশ্চয়ই কালকের মতো বকবে। কিন্তু ইচ্ছে অবাক করে তিনি বললেন, ” এখানে কী? ক্লাস কে করবে? চলো। ”

স্যারের গলায় কোনো গাম্ভীর্যের ছোঁয়া ইচ্ছে আজ পায়নি। তবুও ভয়ে ভয়ে ক্লাসে গেলো। কিন্তু আরও বেশি অবাক হলো যখন ক্লাসে স্যার সবার সামনে ইচ্ছের
সামনে সকল স্টুডেন্টকে বকে ইচ্ছের অসুবিধার কথা বলেছে। এমনকি ইচ্ছেকে বলেছে, ” আমার কথায় কিছু মনে করো না ইচ্ছে। আমি বুঝিনি। সারাজীবন ছাত্র ঠেঙ্গিয়েছি বলে মনে হয় চোখ কখনো ভুল করবে না আমার। তাই তোমাকে কাল ওইভাবে বলেছিলাম। কাল ছুটির আগে আমার সিনিয়র দের একটা ক্লাস ছিল ওই ক্লাসেই তোমাদের সকলকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। তখনই আমি তোমার ব্যাপারটা জানতে পারি।

——————————

দুপুর 12,45 নাগাদ নীরবের ঘুম ভাঙ্গলো। রুমা দেবী কে বাড়িতে এনেই ও গিয়ে ঘুমিয়েছে। এখনও স্নান অবধি করেনি। নীচ থেকে রুমা দেবী অনেকক্ষণ থেকেই ডাকছে। নীরব আজ একটু অঘোরেই ঘুমাচ্ছিল। তাই মায়ের ডাকে হুট করেই জেগে ওঠে। নীচে নামতেই চোখে পড়ে ইপশি আর রজতকে। ওরা দুই জনে রুমা দেবীর সঙ্গে গল্প করছে। কিন্তু এরা এখানে ঠিক কী জন্যে এসেছে কথাটা ভাবতেই কয়েকদিন আগের ঘটনাটা মনে পড়লো। মাথা গরম হয়ে গেল। কিন্তু মা কে দেখে নীরব কিছু বলেনি। ওর মা জানলে খুব বকবে ওকে।

– ” তোমরা দুজন?”

– ” ওরা ইচ্ছের কাছে এসেছে নীরব। ” রুমা দেবীর মুখ দেখেই নীরব বুঝে গেছে ওর মা সব জেনে গেছে।
– ” ইচ্ছের কাছে কী জন্য?”
ইপশি চুপ করে রইল। রজত বললো, ” ইপশি কিছু বলতে চায়। ”

ভ্রু কুঁচকে নীরব ইপশিকে পর্যবেক্ষণ করলো।

– ” সরি নীরব, আমি সেইদিনের বিহেবে খুব দুঃখিত। অপরাধ বোধে ভুগছিলাম। তখন রজত বললো, ইচ্ছের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে। তাই আমি আজ এখানে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে আমি ইচ্ছের কাছে আরও লজ্জিত হয়ে গেলাম। কী বলে ক্ষমা চাইবো কে জানে? ইচ্ছের আগের স্বামী…… ” থামলো ইপশি। নীরব ও গভীর শ্বাস ফেললো। আবারও ইপশি বললো, ” ও যে কথা বলতে পারে না আর সেটা শুনে আমি শকড বিশ্বাস কর। ওর মতো ছট্ফটে, সারাক্ষণ বকা মেয়েটা কিনা,,,,,”

ইপশি কী শকড তার থেকে বেশি হাই পাওয়ারের শকড বোধহয় নীরব পেলো। রেগে গিয়ে বললো, ” কী যা তা বলছিস। ইচ্ছে কথা বলতে পারে না মানে? কী সব বলছিস? কে বলেছে এইসব ফালতু কথা?”

রুমা দেবী শক্ত গলায় নীরবের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ” আমি বলেছি। আমার যতদূর মনে পড়ে আমি তোকেও বলেছিলাম। ”
চমকে ওঠে নীরব। কই ও তো শোনে নি। কখন বললো?
তাই রুমা দেবী নিজেই মনে করিয়ে দিলো। সেইদিন বিয়ের কথা বলার সময় নীরব অনেকক্ষণ কানে হেডফোন লাগিয়ে ছিল। আর তখনই কথা গুলো রুমা দেবী বলেছিল ওকে। কিন্তু ও তো শোনেই নি।

এতদিন এই কথাটা জানা থাকলে ও কখনোই ইচ্ছেকে কেনো কথা বলে না জিজ্ঞেস করতো না। এমনকি কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ও ইচ্ছেকে, ইরাকে কথা শেখাতে বলেছে। আর আজ ইচ্ছেকে তো সরাসরি বলেছে, ইচ্ছে মনে হয় বোবা হয়ে গেছে।
নীরব আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ওর এক্ষুনি ইচ্ছের কাছে যেতে হবে। নির্ঘাত সকালের কথায় ওর খুব কষ্ট হয়েছে। কোনো দিক বেদিক না দেখেই নীরব বাইরের দিকে দৌড় দিয়ে বললো, ” মা আমি ইচ্ছের কাছে যাচ্ছি।”

পিছন থেকে রজত হেসে বললো, ” তার আগে এই হাফ প্যান্টটা একটু ছেড়ে যেও।”

নীরব দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর তো মনেই নে। ওর পরনে এখন হাফ প্যান্ট আর টিশার্ট রয়েছে। তাই আগে নীরব উপরের দিকে ছুট দিলো। লাঁফিয়ে লাঁফিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি বাদ দিয়ে নিজের ঘরে গেলো রেডি হতে।

নীরব অপরাধ বোধে জর্জরিত। ও তো কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ইচ্ছেকে। ইচ্ছের কষ্ট ওর আর এখন সহ্য হয় না। কই আগে তো হয়নি? এখন কি তবে ওদের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন হয়েছে বলে এই পরিবর্তন? নাকি এই কষ্ট প্রিয় জনকে দুঃখ দেবার জন্যে? নাকি নীরব সত্যিই ভালোবেসে ফেলল তার ইচ্ছেকে?

(চলবে)

# নিরালায় ভালোবাসি
তুহিনা পাকিরা
১৩ .

নীরব যখন কলেজে পৌঁছায় ইচ্ছে তখন ক্লাসে। তাই নীরব ক্যাম্পাসের মাঠে একাই বসে থাকে। এই একই কলেজে এক সময় ওউ পড়াশোনা করেছে। এখন অবশ্য অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ওই যে কিছুটা দূরে টবে থাকা কুন্দ ফুল গুলো এখন বোধহয় সংখ্যায় বেড়েছে। বকুল ফুল গাছটা আর দেখা যাচ্ছে না। গাছটা বোধহয় কেটে দিয়েছে। ওই গাছটা ওদের বন্ধুদের যে কতো নাম লেখা আছে তার হিসেব নেই। হয়তো সেই বেঞ্চ গুলোও নীরবকে ডেকে উঠে বলতে পারে, কী রে কী রকম চলছে দিনকাল? আমাদের মনে পড়ে তোর? এখনও কতো স্যার এক ঝটকায় দেখলেই বলে দেবে, আরে তুই নীরব না! কেমন আছিস?

ইচ্ছের ক্লাস শেষ হয় প্রায় আধা ঘন্টা পর। ক্লাস থেকে বেরোতেই সর্বপ্রথম নিতু এসে ওকে আর রক্তিমা কে ডাকে। নিতু বলে, ” চল ক্যান্টিনে চল। আমি যেহেতু তোদের বড়ো দিদি তাহলে আজকের ট্রিট আমার তরফ থেকে। তোদের জিজুর জন্ম দিন আজ। কিন্তু তিনি তো বহুত ব্যস্ত। ব্যাস আমিও, পকেট থেকে তিন হাজার বার করে কথা বলেছি।”

রক্তিমা ইচ্ছের কাঁধে হাত রেখে হাসতে যাচ্ছিল তার আগেই নীরব গিয়ে ইচ্ছেকে সাইডে নিয়ে যায়। ব্যাস এর ফলে যা হবার তাই হলো। রক্তিমা গিয়ে সোজা ইউনিয়ন কে ধাক্কা। ইউনিয়ন এর ছেলেটা সেই মুহূর্তে হাঁ করে জল খাচ্ছিল। কিন্তু ধাক্কার ফলে পুরো মুখময় জলে জলময়। তার মধ্যে নাকে মুখে জল ঢুকে যাওয়ার দরুন সে খুকখুক করে কেশে উঠলো। নিতু পুরোটাই হাঁ করে দেখলো। কিছুই করতে পারলো না। বেচারি রক্তিমা যে কান্ডটা করলো তাতে তার হাত পা কাঁপছে। শুনেছে এই ইউনিয়ন মারাত্মক রাগী। একটা বকা দিলেই হয়তো ও ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেই দেবে।

– ” ওই কে রে? ” রক্তিমাকে চোখের সামনে দেখেই নিখিল বুঝেছে এই মেয়েই কাজ টা করেছে। তাই গম্ভীর গলায় বলল, ” এই মেয়ে ঠেললে কেনো আমাকে?”
রক্তিমাও ভয়ের চোটে ফাঁকা হলের দিকে হাত দেখিয়ে বলে, ” আমি না তো, ওই যে ঐখানের লোকটা।”

নিখিল হলের দিকে তাকিয়ে দেখে কেউ একটা দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। ওকে জলে ভিজিয়ে আরামে কথা বলা নিখিলের সহ্য হলো না। রক্তিমার স্কার্ফের শেষ অংশ দিয়ে মুখের বড়ো দাঁড়ি গুলো কোনো মতে মুছে নিখিল এগিয়ে গেল সেই দিকে। রক্তিমার ইচ্ছে করলো এই ইউনিয়নের মাথা ফাটিয়ে দিতে। ওর পছন্দের স্কার্টটা ভিজিয়ে দিল। ” যতসব” বলেই ও নিতুর কাছে চলে গেলো।

নিখিল গিয়ে ফোনে কথা বলা লোকটার হাতের বোতলটা কেড়ে বোতলের ক্যাপ খুলতেই অবাক, এ যে নিউ লাইবেরিয়ান। পিছন থেকে দেখলে মনে হবে কোনো স্টুডেন্ট। অবশ্য সামনে থেকেও তাই মনে হয়। কিন্তু মাথার মধ্যে দুই একটা পাঁকা চুল দেখলে বোঝা যায়, অবিবাহিত এই স্যারের বিয়ে হওয়া মুশকিল। কিংবা হলেও হতে পারে।

– ” কী করছো এটা? বোতলটা এই ভাবে হাতে নিলে কেনো?”

স্যারের ধমকে ইউনিয়নের ভয় হলো বটে। ” আসলে স্যার দেখলাম আপনার জলের বোতল খালি তাই ভাবলাম একটু জল এনে দিই।”

– ” চোখে দেখো না এতে জল ভর্তি। তবে আনলে এনে দাও। এই ঠাণ্ডা কনকনে জল আমি খেতে পারছি না। যাও নিয়ে যাও।”
কোনো মতে নিখিল ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। অপরকে এতদিন হুকুম করে কতো কি করানো ছেলেটা শেষে জল আনতে ক্যান্টিনে যায়।

অপর দিকে ইচ্ছে আর নীরব বসে রয়েছে ক্যাম্পাসের মাঠে। ইচ্ছে চুপ চাপ ঘাসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর নীরব ইচ্ছের হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করে যাচ্ছে। কখনো আঙ্গুল দিয়ে হাতে আঁকি বুঁকি করছে, কখনো বারবার ইচ্ছের হাতের পাঁচ আঙুলকে গুনে সংখ্যা বাড়াচ্ছে। যেমন এই মুহূর্তে নীরবের গোনা মতে ইচ্ছের আঙ্গুলের সংখ্যা 75 টা।

-” এই ইচ্ছে তোর কী শরীর খারাপ?”

মাথা তুলে নীরবের দিকে দেখে ইচ্ছে। হ্যাঁ ওর শরীর একটু খারাপ বৈকি। গা হাত গুলো কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, কেমন একটা জ্বর জ্বর ভাব। গলাও ব্যথা করছে। একটু আগেই ক্লাসে খুব কাশছিল। কিন্তু নীরবকে সে কিছুই বলতে পারলো না। ইচ্ছে এতদিনে এটুকু বুঝেছে যে নীরব ওর কথা না বলার কারণ টা এখনও জানে না। আর যখন থেকে বুঝেছে তখন থেকেই একটা ভয় ওকে জড়িয়ে রয়েছে। নীরব যদি কখনো সেই কারণ জানতে পারে তাহলে নির্ঘাত ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। কিন্তু বিয়ের আগে ও ভেবেছিল নীরব ওকে দয়া করে বিয়ে করছে। যদিবা নীরব ওকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছে, তা ইচ্ছে জানে। কিন্তু কোনো দিন তার সিকি ভাগ ও ইচ্ছেকে বুঝিয়ে দেইনি।

– ” কী রে কী জানতে চাই….”
কথাটা নীরবের মুখ দিয়ে আর বেরোতে পারলো না। হুট করেই মনে পড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগে বাড়ির ঘটনা।

– ” ইচ্ছে শোন, ”
ইচ্ছে কী শুনবে তার আগেই নীরব নিজের দুই হাতের মুঠোয় ইচ্ছের মুখ ধরে নিলো। অবাক তো ইচ্ছে হলো তবে কোথাও যেনো আনন্দ হলো, ভালো লাগলো। মনে হলো আজ সে খুব খুব খুশি।

– ” আমি তোকে এতদিন কথা না বলার জন্যে খুব বকেছি তাই না। আসলে কী বলতো আমি জানতাম না যে তুই কথা বলতে …, ”

ইচ্ছের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় নীরব। ইচ্ছের মনটা হুট করেই কেঁদে উঠলো। নীরব নিশ্চয়ই তাকে আর মানবে না। বোবা মেয়েকে নিয়ে কেই বা সংসার করে। কিন্তু নীরব এর মনের কথা গুলো হয়তো ইচ্ছে জানে না। যেই ছেলেটা ইচ্ছে কথা বলতে পারে না শুনে শুধু এটা ভেবেছে যে সে ইচ্ছেকে কথা না বলার জন্যে কতো বকেছে। যার মনে একবারও এটা আসেনি যে একটা বোবা মেয়েকে নিয়ে সে কীকরে থাকবে। সে আর যাই হোক কারোর খুঁত সে ধরবে না।

– ” এই ইচ্ছে তুই কি এখন কাঁদবি নাকি? একদম কাঁদবি না, সবাই ভাববে আমি তোকে বকেছি। আর নাহলে আমার অদেখা শালী এসে বলবে , ” এই আপনি বুঝি আমার বন্ধুকে মারধর করেন?”

নীরবের বলার ভঙ্গিতে না চাইতেও ইচ্ছে হেসে ফেলে। নিস্তব্ধ হাসি, তবে প্রাণবন্ত। নীরব একভাবে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই ওর মাথায় নিজের ঠোঁট ঠেকিয়ে বলে, ” এইভাবে হাসবি তুই। তোকে মন খারাপ দেখলে কেমন যেনো পেঁচি পেঁচি লাগে। আর শোন তোর কথা বলার দরকার নেই। তোর ভাব ধারা দেখে তোকে বোঝার দায়িত্ব আমার। তুই খালি সারাদিন হাসিখুশি থাকবি। আর একটু বউ বউ হবি। তুই বউদের মতো ঝগড়া করিস না আমার সাথে। সে ঠিক আছে। কিন্তু আমি চাই তুই আমার সঙ্গে মারপিট করবি। চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বাজারে পাঠাবি, ছুটির দিনে ঘর পরিষ্কার করতে হেল্প করাবি, তোকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া করাবি। মনে থাকবে?

ইচ্ছে হাঁ করে নীরবের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই মুহূর্তে নিতু আর রক্তিমা ওদের সামনে গিয়ে বসে। নিতু বললো, ” শুধু চুল কেনো মাঝে মাঝে ঘুরতে না নিয়ে গেলে কি অফিস থেকে রাত করে বাড়ি ফিরলে ঘরের দরজা খুলতে ভুলে যাবি। ”

রক্তিমা বললো, ” বাহ্ জিজু বাহ্।”

– ” আরে তোমরাই আমার শালিক পাখি মানে শালী আরকি।”

নিতু মাউন্টেন ডিউ এর ক্যান খুলে নিজের গলা ভিজিয়ে ইচ্ছের দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু ইচ্ছে নীরবের দিকে তাকিয়ে ঠিক ক্যান টা নিতে পারলো না। উল্টে নীরবই হাতে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ” কবে থেকে এইসব ইচ্ছে খাচ্ছে শালিক পাখিরা?”

– ” কেনো? ওর কী খাওয়া বারণ নাকি? ” নিতুর কথায় রক্তিমা বলে,

– ” হ্যাঁ। তুমি জানোনা নিতু দি?”
মাথা নাড়ে নিতু, যার মানে ও জানে না। কী করে জানবে ইচ্ছে কে দিলে ও তো না বলেনি কোনো দিন। ”

নীরব চোখ গরম করে ইচ্ছের দিকে তাকালো।

– ” কাল থেকে রোজ বাসক পাতার রস তোর খাদ্য তালিকায় বাড়লো। এখন বাড়ি চল। বাড়িতে গেস্ট এসেছে। আসার সময় তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। ”

কথা টুকু বলেই নীরব উঠে দাঁড়ালো। ইচ্ছেও ঠোঁট ফুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ও কী করবে মাউন্টেন ডিউ পেলে ওর আর কিছুই লাগে না। তাই তো মাঝে মাঝেই খেয়েছে। তবে বেশি না অল্প। দুই ঢোক। নিতু আর রক্তিমা ইচ্ছেকে বাই বলে বিদায় দিলো।

নীরব আর ইচ্ছে ক্যাম্পাস থেকে বেরোনোর আগে নীরব হাত বাড়িয়ে কারোর চোখ পড়ার আগেই টপাটপ চার পাঁচটা কুন্দ ফুল তুলেই হাত বন্ধ করে নিলো। তার পাশেই ফুল গাছে হাত দিতে নিষেধ করা সাইন বোর্ড যেনো নীরবের কাজে অখুশি হয়ে বলে দিলো, তোর পুরোনো অভ্যেস এখনও যাইনি ফুল চোর?

কিন্তু জড় বস্তু আজ পর্যন্ত কথা বলতে পারেনি। তাই কথা গুলো নীরব কী আশেপাশের কেউই শুনলো না। তবে ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে নীরবের দিকে তাকিয়ে ইশারায় ওকে বোর্ডের দিকে তাকাতে বোঝালো। কিন্তু নীরব স্মার্টলি এগিয়ে গিয়ে বলে,

– ” বই চুরি, ফুল চুরি কোনো চুরিই নয়। তুই জানিস না?”
ইচ্ছে ঘাড় নাড়ে, যার মানে সে জানে না। নীরব ওর মাথায় টোকা দিয়ে বললো, ” বউ আপনি কিচ্ছু দেখেননি। এখন বাড়ি চলুন। ”

(চলবে)