নিরালায় ভালোবাসি পর্ব-১৬+১৭

0
298

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
১৬ .

– ” এ কী দাদা, গাড়িটা এই রাস্তা দিয়ে কেনো নিয়ে যাচ্ছেন? শর্টকার্ট দিয়ে গেলেই তো ভালো হতো।”

গাড়ি ভর্তি সকলে হাহা করে হেসে ওঠে। ধীরের এক বন্ধু তো বলেই দেয়, বিয়ে করার জন্যে কি তোর আর তরসইছে না? এই দাদা আপনি যেখান দিয়ে যাচ্ছেন সেখান দিয়েই চলুন। পারলে আরও আধা ঘন্টা লেট করে চলুন। আমরাও সকলে একটু দেখি বন্ধুর কষ্ট।

আবারও গাড়িতে হাসির রোল পড়ে গেলো। তারা সকলে বিয়ে দিতে চলেছে। যে রোড দিয়ে যাবার কথা সেই রাস্তা দিয়ে কেনো যে নিয়ে যাচ্ছে না, তাতেই টেনশন ধীরের। যদিও বা এই গাড়িটা বোধহয় একাই এই রোড দিয়ে যাচ্ছে। বাকি গাড়ি গুলো শর্টকার্ট রাস্তা দিয়েই নিশ্চয় যাবে! কিন্তু ধীরের ভাবনাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ির ড্রাইভার বলে উঠলো, শর্টকার্ট রোডে তো কাজ চলছে। তাই সব গাড়ি এইখান দিয়েই যাচ্ছে।

– ” কী? ”
– ” হ্যাঁ স্যার, এই রোড দিয়েই আমাদের যেতে হবে।”

থেমে গেল ধীর,তারমানে ইচ্ছেও এক রোড দিয়েই যাবে। কিন্তু ইচ্ছে যদি ভুলেও এই রোড, সেই বাড়িটার টের পায় তবে তো, না না কি হবে এবার? ধীরের খুব রাগ হয়। নিজের উপর নয়, তপতীর বাবার উপর। কতো করে বলেছিল, বিয়েটা যেনো বাড়ি থেকে দেওয়া হয়। কী দরকার আধা ঘণ্টার রাস্তা ছেড়ে তিন ঘণ্টা জার্নি করার। কিন্তু রিটায়ার আর্মি অফিসারের ইচ্ছে বিয়ের জন্যে বড়ো একটা লজ তো ভাড়া করতেই হবে। ধীর মাঝে মাঝে ভেবে পায় না, ওর বোনের নামের সাথে মানুষের অদ্ভুত ইচ্ছের কী দরকার। যার নাম ইচ্ছে সেই নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করবে। বাকিরা কেনো করবে। এখন তো তার জন্যে ওর চিন্তা হচ্ছে নাকি।
—————-

সকল বরযাত্রী বিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেছে। বিয়ে এখনও শুরু হয়নি। রাত আটটা নাগাদ বিয়ের লগ্ন। নীরব দের গাড়িটা সবার শেষে লজের সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। চারিদিকে নানান লাইটের কারুকার্যে সকলের পোশাক থেকে শুরু করে শরীরের রঙটাও সেই রঙের ন্যায় হয়ে গিয়েছে। নীরব ইচ্ছেকে রাস্তার এক ধারে দাঁড় করিয়ে সামনের দিকে কিছু কারণে গিয়েছে। সেঁজুতি পাশের এক অজ্ঞাত ব্যক্তির রয়েল এন্ড ফিল্ড গাড়িতে বসে বসে ইচ্ছে কে দেখছে। নীরব যাওয়ার আগে ওকেই দায়িত্ত্ব দিয়েছে ইচ্ছেকে যেনো দেখে রাখে।

– ” ইচ্ছে দি!”

পিছন ফিরে সেঁজুতির দিকে তাকায় ইচ্ছে। চোখের ইশারায় জানতে চায় , কিছু বলবি?

– ” বিয়ে করার জন্যে এই ঘাড় তেঁড়াকেই পেলে। পৃথিবীতে কতো সুন্দর সুন্দর ব্যাক্তি রয়েছে। যেমন, এই যে আমি যে এই গাড়ির উপর বসে রয়েছি, এই লোকটাকেই দেখো না। ওই যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে কিন্তু দেখতে পাচ্ছে এক অচেনা মেয়ে এই গাড়িতে বসে রয়েছে। কিন্তু সে কিছুই বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ”

সেঁজুতির দেখানো পথে ইচ্ছে তাকালো কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না। তবে সেখানে যে কেউ ছিল তা কিছুক্ষণ আগেই ইচ্ছে তের পেয়েছে।

– ” ওই এসে গেছে তোমার বর, সরি বর্বর। ”

– ” আমি বর্বর নয়, তোমার বর হবে বর্বর। রোজ মদ খেয়ে এসে তোমাকে ঠাঙ্গাবে, তোমার শাশুড়ি তোমাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করাবে। আমি তোমার বরকে বলে দেবো, তোমাকে যেনো সবসময় মারের মধ্যে রাখে। তাহলেই তখন বুঝবে, কে বর, আর কে বর্বর! ”

নীরবের কথায় সেঁজুতি হাঁ করে নীরবের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফুলিয়ে নিলো। যে বিয়ে করবে না তার বর কিনা বর্বর। হুই।

নীরব ইচ্ছের হাত ধরে সামনে হাঁটা দিলো।
-“ইচ্ছে চল এখান থেকে।” একবার পিছন ফিরে সেঁজুতি কে বললো, “আর এই যে বর্বর পত্নী বর্বরি যাও ভিতরে যাও। এখন থেকে দেখে রাখো কিভাবে বিয়ে হয়। ”

নীরব, ইচ্ছের যাবার দিকে তাকিয়ে সেঁজুতি বসে থাকা প্রিয় গাড়ির মিররের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো, ” ফালতু লোক।”

– ” এই যে মিস!”

কারোর ডাকে পিছনে ফিরতেই কারোর রাগী চোখ দেখে সেঁজুতি ভয় পেলো না, তবে বিস্মিত হয়েছে বটে। এই লোকটি আর কেউ নয় এই গাড়ির মালিক।

– ” গাড়ি থেকে আপনি নেমে দাঁড়ালে আমার খুব ভালো লাগতো। সো প্লিজ,”

ছিটকে সরে দাঁড়ালো সেঁজুতি। হুট করেই লোকটাকে বড্ড ভয়ংকর লাগছে। মনে হচ্ছে এক নিমেষে কাউকে খুন করতেও পিছু পা হবে না। লোকটি কোনো কথা না বলেই গাড়ি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। মুখে তার বিরাজ করছে এক ভয়ঙ্কর হাসি, যে হাসিতে কারোর জন্যে মুগ্ধতা না, রয়েছে গভীর এক রহস্যের গন্ধ।
———–
নীরব আর ধীর যেই মুহূর্তে বিয়ের আসরে গেলো, তখন মালা বদল হচ্ছে। ধীর খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে তপতীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আসলে মনে মনে বড্ড তার লজ্জা লাগছে। প্রেয়সিকে বুঝি এতো লোকের ভিড়ে প্রাণ খুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখা যায়। হয়তো হুট করেই কেউ এখন বলে উঠবে, এতো দেখিস না, তোরই বউ। তপতী লাজুক দৃষ্টিতে একবার ধীর কে দেখে চোখের পাতা নামিয়ে নিলো। হুট করেই যেনো বুকের মাঝে কেমন একটা হচ্ছে। বিয়েটা পারিবারিক ভাবে ঠিক হলেও, দুজনেই দুইজনকে ভালো মতো চিনে নিয়েছে। একে একে বিয়ের প্রতিটা অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। নীরব ইচ্ছের হাত ধরে বিয়ের মণ্ডপের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইচ্ছের অপর পাশে রয়েছে সেঁজুতি।

– ” ইস, এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা এই ভাবে ধুমধাম করে করলেও হতো। কী বলিস? ”

নীরবের কথায় ইচ্ছে বেশ লজ্জা পেলো। তবে সেঁজুতি ফট করে বললো, হ্যাঁ করুন না কে মানা করেছে। তবে ইচ্ছে দি কে আপনাকে আর দেবো না। আপনি ঠিক মত তার খেয়াল রাখেন না।

খেঁপে গেলো নীরব, ইচ্ছের হাত ধরে ওকে ওর অপর পাশে জড়িয়ে ধরে বললো, বললেই হলো। আমার বউ আর আমারই থাকবে। তুমি বেশি ফটর ফটর করো না। না হলে কাউকে একটা ধরে এই মুহুর্তেই তোমার গলায় তাকে ঝুলিয়ে দেবো। দেন আমি বলবো, বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা। সরি ওটা বাঁদরী হবে।

নীরবের কথায় প্রতিবারই সেঁজুতি হেরে যায়। এই বারেও তাই। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু এই সবের মাঝেও ইচ্ছের কী হলো কে জানে। নীরবের এতক্ষণ জড়িয়ে থাকায় অসম্ভব ভালো লাগা তৈরি হলো। আবেশে নীরবের এক হাত জড়িয়ে ধরলো। নীরব ভাবছিল ইচ্ছের কথা। এতো দিনে এটুকু ও বুঝেছে ইচ্ছেকে ছেঁড়ে ও থাকতেই পারবে না। আর আলাদা হবার চিন্তা অনেক দূর। হঠাৎই ইচ্ছের হাত জড়িয়ে ধরায় নীরবের কী হলো কে জানে। ইচ্ছের মাথায় পরম যত্নে, পরম অনুভূতির সংমিশ্রণে নিজের অধর স্পর্শ করলো। আর ইচ্ছে সে তো কেঁপে উঠলো। যা দেখে নীরব না হেসে পারলো না।

————

বিকেলের এক ঝড়ো হাওয়ার মাঝে ইরার সঙ্গে ইচ্ছে ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা সপ্তাহ হলো নীরবকে ঠিক মতো কাছেই পায় না সে। নীরব কেমন যেনো অন্যরকম হয়ে গেছে। ইচ্ছেকে দেখেও যেনো দেখে না। এই যে ইচ্ছে আজ নিজের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে নীরবের বারান্দার দিকে তাকিয়ে নীরবকে দেখছে, সেই খেয়াল বোধহয় নীরবের নেই। হয়তো ও জানেও না যে ইচ্ছে কাল রাতে এই বাড়িতে এসেছে। এখনও ফিরে যায়নি। নীরব হয়তো এটাও ভুলে গেছে ইচ্ছে এই কদিনের মতো হাসি খুশি আর নেই। হারিয়ে গিয়েছে আগের অন্ধকারে। অথচ সেই বিয়ের রাতে নীরবকে মনে হয়েছিল সে হয়তো ইচ্ছেকে খুব খুব ভালোবাসে। কফি কাপে চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালো নীরব। রেলিঙে হেলান দিয়ে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠল ইচ্ছের সঙ্গে কাটানো সময় গুলো। এই বারান্দায় তারা দুজনে এই দুই মাস কতো স্মৃতি কাটিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরব। মন বলে সত্যের মুখোমুখি না হলেই তুই পারতিস নীরব। যদিবা হলি আবেগে ভেসে যাবার পর। তলিয়ে যাবার আগে উঠে আয়, সেইটাই বোধহয় ভালো।

ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা ইচ্ছের চোখে চোখ পড়তেই ঘুরে গেলো নীরব। কিন্তু ইচ্ছে সে তাকিয়ে রইলো নীরবের দিকে। শব্দহীন অনুভূতি গুলো বলে উঠলো ,

“আমার হৃদয়ের লুকানো বারিধারার স্রোত তোমাতেই আবদ্ধ। তোমার হৃদয়ের খরস্রোতা নদী আমি। ভালোবেসে যত্ন করে আগলে রাখতে পারো না! কষ্ট দিতে বুঝি ভালো লাগে? তুমি কি বোঝো না আমারও কষ্ট হয়!”

(চলবে)

নিরালায় ভালোবাসি
কলমে : তুহিনা পাকিরা
১৭ .

ইচ্ছের মন এই কয়দিনে একটা কথাই বলেছে, যে কোনো মানুষ একটা বোবা মানুষের সঙ্গে থাকতে পারে না। আর এটা তো সত্যি যে, নীরব কতকটা না জেনেই ইচ্ছে কে বিয়ে করেছে। কিন্তু যদি ও জানত যে ইচ্ছে বোবা, কথা বলতে পারে না, ইভেন কখনো পারবেনা তাহলে কি আর ওকে বিয়ে করতো। কখনো করতো না। একটা বিয়ে ইচ্ছের জীবনকে পুরো পরিবর্তন করে দিয়েছে। আরেকটা বিয়েতে ওই কিনা একজনের জীবন নষ্ট করবে এটা কীকরে হয়? হয়তো ওদের দুইজনের সংসারটা দায়িত্ত্ব কর্তব্যের মধ্যে দিয়ে ঠিক চলে যাবে ঠিক কিন্তু ভালোবাসাটা কোনোদিন থাকবেই না।

আকাশে অন্ধকার নেমেছে, সন্ধ্যার শুরু। ইরা নিজের একান্ত আপন বারান্দায় যাবে বলে অনেকক্ষণ ধরে
‘ পিকু ‘ বলে ডেকে চলেছে। কিন্তু ইচ্ছের ধ্যান নেই বললেই চলে। জীবনের পাতা গুলো বড্ড বেদনা দায়ক, চাইলেও ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া যায় না। বই প্রেমিরা নিজের বইগুলো একটু বেশিই যত্ন করে রাখে ঠিকই কিন্তু তাতে দাগ লাগলে সেই দাগ মুছতে যেমন পারে না, তেমনি পাতাটা বাদ দিতেও পারে না। ইচ্ছের জীবনটাও বুঝি তেমন। পুরোনো পৃষ্ঠাটা যে আবার এইভাবে খুলে যাবে তা ও ভাবেই নি। নাহলে আর ধীরের বিয়ের পরের দিন সেই বাড়িটার দিকে নজর যায় ইচ্ছের। সেই বাড়ি যেখানে বিয়ে হয়ে যাবার আগে নিজের জন্যে কোনো নতুন সংসারের স্বপ্ন ইচ্ছে দেখেনি। দেখেনি স্বামী নামক মানুষটাকে ভালোবেসে যত্ন করে একসঙ্গে বাঁচার তাগিদ। তবুও বিয়ের পর আপন করতে চেয়েছিল সব কিছু। কিন্তু বিয়ের একটা সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই বুঝতে পারে যাদের আপন করতে ও চায় তারা তো শুধু কয়েকদিনের জন্য এই বাড়িতে ওকে স্থান দিয়েছে। আসলে ইচ্ছে এসেছিল সুবীরের ঠাম্মার পছন্দ হয়ে। রিনু দেবী তখন বিছানায় শয্যাশায়ী। ইচ্ছের শাশুড়ি আর ননদ ছিল যারা কোনোদিন ইচ্ছেকে দেখতে পারতো না। শ্বশুরকে এসে থেকে ইচ্ছে কোনো দিনই দেখেনি। আর সুবীর, তাকেও ইচ্ছে দেখেনি। আসলে বিয়ের দিন নিজের কষ্টে বিয়ের আসরে বরের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে সে পারেনি। তবে ইচ্ছে নীরবের মুখটা দেখেছিল, মানুষটাকে দেখেই বুঝেছিল ঘাড় থেকে একটা বোঝা নেমেছে।

বিয়ের পরের দিন রাতেই সুবীর গিয়েছিল রানীগঞ্জ। সেই খানেই ছিল তার কর্মস্থল। শুধু কি কর্মস্থল! যা ইচ্ছে বুঝেছিল মাস কয়েক পরে। ইচ্ছেকে প্রতিদিন সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠতে হতো। ঘরের কাজ তো শুধু না, ছিল শয্যাশায়ী রিনু দেবীর দেখাশোনা। তাকে ঠিক সময়ে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করানো, খাওয়ানো, ঔষুধ থেকে শুরু করে আরও কতো কী। এছাড়াও ছিল শাশুড়ির সেবা থেকে শুরু করে ননদের প্রতিটা ফাইফরমাশ। ইচ্ছে কাজ যে একেবারেই জানত না তা নয়। জানতো কিছুটা। কিন্তু সেই জানা দিয়ে এতো কাজ সে সামলে উঠতে কোনো কালেই পারতো না। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠলেও সব কাজ সেরে যে একটু রেস্ট সে পাবে সেটুকুও ছিল না। রাতে ঘুমাতো ননদের ঘরের বারান্দায়। স্বামীর ঘরে সে কোনোদিনই যেতে পারে নি। আর ননদ, সে তো তাকে নিজের ঘরে বিছানা তো দুরস্থ মেঝেতেও শুতে দেয়নি। ঘরে কোনো বাইরের লোকের অনুপস্থিতে সে তো তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না।

সারাদিনের খাটা খাটুনির পর নিজের শরীর এলিয়ে দিতো ইচ্ছে ওই বারান্দার মেঝেতে। চোখ বন্ধ করলেও কোনো দিন ঘুম হানা দিতো না। হানা দিতো অজস্র চোখের জল, ভিজে যাওয়া স্যাঁতস্যাঁতে বালিশে শুতেও অসস্তি হতো। মনে পড়ে যেত নিষ্ঠুর মানুষটার চোখদুটো, মনে পড়তো তার হাসি মুখ। যা দেখলেই মনে হতো, সে খুব ভালো আছে। পিঠের উপর থাকা বোঝা নামলে সকলের খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন ইচ্ছে নিজেকে শাঁসিয়ে যেতো। নিজের স্বামী ছেড়ে অপর এক পুরুষকে চিন্তা করতে রোজ তার গায়ে লাগতো। রোজ নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হতো। কিন্তু প্রতিদিন গভীর রাতে ওই পরপুরুষ নীরবের মুখটাই ভেসে উঠতো।

এই সবের মাঝেও ইচ্ছে থেকে গিয়েছিল সুবীরের বাড়িতে। ততদিনে সে বুঝেও গিয়েছিল ও শুধু মাত্র একটা বাড়তি ঝামেলা। যাকে সবাই নিজের ঘাড় থেকে দূর করতে চায়। বুঝেছিল সুবীর কর্মসূত্রের জন্যই কেবল রানীগঞ্জ থাকে না। থাকে নিজের সংসারের জন্যে, নিজের স্ত্রী, সন্তানের জন্যে। ইচ্ছের ভাবলে আজও খুব হাসি পায়, শুধু মাত্র ওকে তাড়ানোর জন্যে সবাই এমন জায়গায় ওকে বিয়ে দিয়েছে যেখানে তারা দেখেও নি সেই পরিবারটা আদৌ ভালো কী না! এখন কার দিনে বাড়িতে কাজের লোক রাখলেও যেখানে তার সকল তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেখানে নিজের বাড়ির মেয়েটাকে কোথায় পাঠিয়েছিল তারা জানেনি, আর না ইচ্ছে জানিয়েছিল। আসলে ও সেচ্ছায় জানায়নি, কারণ ও জানতো হয়তো এটাই শুনতে হবে যে, সুবীরের দোষ দিয়ে নীরবের কাছে ফিরে আসার চেষ্টা করছে ইচ্ছে।

রিনু দেবী জানতেন তার নাতি বিবাহিত। কিন্তু সুপ্তিকে তিনি কোনোদিন মানতে পারে নি। তাই সুবীর নিজের স্ত্রী কে নিয়ে রানীগঞ্জ থাকতো, যা রিনু দেবীকে জানায়নি কেউ। কিন্তু তিনি মারা যাবার আগে যখন জানতে পারেন যে তার একটা বংশধর ও রয়েছে, তখন তিনি গলে যান নতির উপর। তার তো ইচ্ছে ছিল নাতির ছেলে দেখে মরার। আর তাই হয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছের জীবন নষ্ট করার কোনো শোক তার মধ্যে ইচ্ছে দেখেনি। সেই মুহূর্তে ইচ্ছে ছিল বাড়তি এক সমস্যা। যা মাথা চারা দিয়ে তো আগে থেকেই ছিল। তবে আজ থেকে বেশি হলো। আর সেই সমস্যাকে তাড়ানোর প্রক্রিয়াও ছিল অসাধারণ। যা ইচ্ছের জীবনের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে আজও, এবং আগামী দিনেও তাই করবে।

– ” দিদি , তাড়াতাড়ি নীচে আয় নীরব দা এসেছে। ”

এই নিয়ে কম করে অনেকবারই নীর ইচ্ছেকে নীচে যেতে ডেকেছে। কিন্তু এইবারই কেবল বললো, নীরব এসেছে। ইচ্ছে খুশি হলো নীরব এসেছে শুনে। তাই পুরোনো স্মৃতির বক্সটা বন্ধ করে ও ইরাকে নিয়ে নীচে ছুটলো। নীচে তখন নীরব আর নীর কথা বলছে।

– ” শোনো নীরব দা, আমরা সকলে তপতী বৌদিদের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি, তুমি জানো তো? ”

পাশ থেকে ধীর ধমকে উঠল, নাম ধরে বৌদি কি, শুধু বৌদি বল।

– ” ওহ হ্যাঁ, বৌদি। সে যাইহোক। নীরব দা তুমি কিন্তু ইচ্ছে দিদিকে দেখে রাখবে। আমরা তো কেউ কয়দিন থাকবোনা। মনে থাকবে? ”

নীরকে পাশে এনে বসিয়ে দেয় নীরব।

– ” আচ্ছা, আমি তোর দিদিকে সাবধানে দেখে রাখবো হয়েছে। ”

ইচ্ছেকে নীচে নামতে দেখে তপতী ওকে ডাকে ওকে, ” এই তো ইচ্ছে এসে গেছে। দেখো তোমাকে নীরব নিতে এসেছে। না দেখে থাকতে পারছে না তো।”

লজ্জা পেয়ে যায় ইচ্ছে। নীরব উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ” তেমন কিছু না বৌদি। আসলে মা ও তো তোমাদের সাথে যাবে। মায়ের তো প্যাকিং এখনও হয়নি তাই ইচ্ছেকে ডাকলো। ”

নীরবের পিছু পিছু ইচ্ছেও বেরিয়ে যায়। এগিয়ে যায় নিজের সংসারের দিকে।

( চলবে )