নিশুতি রাতের কান্না ৫ম এবং শেষ পর্ব

0
1060

#নিশুতি_রাতের_কান্না
#৫ম_এবং_শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক




নেহাল আমার কথা শুনে কেমন থতমত খেয়ে গেল।সে আমতা আমতা করে বললো,’কই বাঁদী ডেকেছি হু? মিথ্যে বকছো!’
আমি অদ্ভুত ভাবে হেসে বললাম,’ঠিক আছে ডাকেননি বাঁদী কিন্তু বউ বলেও তো ডাকেননি একবার। কেন বউ বলে ডাকলে কী পাপ হয়?’
নেহালের মুখে এবার বিরক্তির ছাপ।সে এবার নিশ্চিত আমার এসব আধিক্ষেতার জবাব ধমকে পরিশোধ করবে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো সে আমায় ধমক না দিয়ে উল্টো আমার একটা হাত টেনে ধরলো। আমি লজ্জায় সড়ে যেতে লাগালাম দূরে।আর ও একটানে নিয়ে এলো আমায় তার বুকের কাছে। তারপর আমার নাকের সাথে তার নাক ঘষে বললো,’আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কোনদিন কোন মেয়ের প্রেমে পড়বো না! কোনদিন না! কিন্তু—‘
আমি কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,’কিন্তু? কিন্তু কী?’
নেহাল আমার পিঠে আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বললো,’কিন্তু কী আমি জানি না। তবে তোমার প্রতি আমার কেমন মায়া বেড়ে যাচ্ছে। এই দেখো না এখন ঘর থেকে একদম বেড়ুতে মন চায় না। কেন এমন হচ্ছে বল তো?’
‘কেন আমি কী জানি?আপনি বলে দিলেই তো হয়!’
‘তোমার জন্য। তোমার কাছাকাছি সব সময় থাকতে ইচ্ছে হয় বলে।’
‘শুধু কী আমার কাছাকাছি নাকি কাজের মেয়েটারও?’
নেহালের চোখ কেমন বড় হয়ে গেল হঠাৎ। মুখ গেল নিভে।সে খুব দ্রুত তার চোখে মুখে আলো ফিরিয়ে এনে বললো,’তুমি যদি বলো এই মেয়েকে আমি আজই বিদায় করে দিবো।’
‘ওকে বিদায় করে দিলে চলবে কী করে ওর?ওর কে আছে আর?কে কাজ দেবে ওকে?’
নেহাল বললো,’তুমি চাইলে ও এখানে থাকবে সমস্যা নাই।’
‘থাকুক। শুনুন, এই মেয়েটা অভাবী।অনাথ। আপনার কাছে আশ্রয় নিয়েছে শুধু একটু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে। আপনার ধন দৌলত আছে।ওখান থেকে তাকে সাহায্য করবেন। খাওয়াবেন পড়াবেন। কিন্তু তার উপর তো জুলুম করা যাবে না। তাকে শারীরিক অত‍্যাচার করা যাবে না। আল্লাহ পাক সীমালঙ্গন কারীকে পছন্দ করেন না!’
নেহাল খানিক সময় চুপ করে রইলো। তারপর বললো,’তুমি কী আমায় জাদু টাদু করেছো নাকি ?’
আমি শব্দ করে হেসে বললাম,’করেছি তো।’
‘আমার না এখন তোমার বশ মানতে ইচ্ছে করে।’
‘গতকাল না বললেন আপনি আমার প্রভু?’
‘ধুর, মিথ্যে বকো না তো। তুমি শুধু বানিয়ে কথা বলো!’
আমি বুঝতে পারছি নেহাল আমার প্রতি দূর্বল হয়ে এসেছে তাই সে গতকাল করা তার অপরাধগুলো স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে।তাই সে অকপটে এসব কথা লুকিয়ে ফেলছে। কিন্তু আমি এটা জানি একদিন সে তার সব ভুল স্বীকার করে কাঁদবে। সেদিন সে সত‍্যিকার মানুষ হবে। পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই তার ভুল স্বীকার করে।অন‍্য কোন প্রাণী নয়।

রাতে নেহাল কিছুই খেতে চাইলো না। কিন্তু আমি বললাম,’আপনি যদি রাতের খাবার না খান তবে কিন্তু আমি আর গান গাইবো না!’
নেহাল এবার বললো,’খাবার আনো।খাবো।’
আমি চোরা হাসি হেসে ওর জন্য খাবার নিয়ে এলাম।
তারপর আমি গান ধরলাম,

‘ভালোবাসি,ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি।’


রাতে নেহাল শু’য়ার আগেই আমি ফ্লোরে কাঁথা বালিশ নামিয়ে নিলাম। নেহাল আমায় কাঁথা বালিশ নামাতে দেখে অবাক হয়ে বললো,’নীচে কাঁথা বালিশ নামাচ্ছো কেন?’
‘ঘুমাতে হবে না?’
নেহাল হেসে বললো,’খাটে কী জায়গা কম পড়েছে?’
জায়গা থাকলেই কী? আমার তো ফ্লোরে থাকার নিয়ম।গরীব মানুষ কী আর পালঙ্কে থাকতে পারে?’
নেহাল এবার নিজে নেমে এলো খাট থেকে। তারপর আমায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো খাটের উপর। আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে ওর বুকে মুখ গুঁজে নিলাম। নেহাল আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’আরেকটা গান গাও না?’
আমি ওর বুকের কালো কালো লোমের ভেতর হাতের আঙ্গুল ডুবিয়ে বললাম,’না এখন আপনার মাথা টিপে দিবো।আজ আপনি সকাল সকাল ঘুমিয়ে যাবেন।আর ভোর সকালে উঠবেন।’
নেহাল বললো,’আমি তো সকাল সকাল ঘুমাতে পারি না?’
‘পারবেন।না ঘুমাতে পারলেও কিন্তু ভোর সকালে সজাগ থাকতে হবে!’
‘ভোর সকালে এমন কী হবে যে সজাগ থাকতে হবে?’
‘সজাগ থাকলেই বুঝবেন। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করুন তো।’
নেহালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আমি। নেহাল ঘুমানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা।তার বদলে আমিই ঘুমিয়ে গেছি।

সকাল বেলা নেহালের ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো।ঘুম থেকে উঠে দেখি ফজরের আজান হচ্ছে। নেহাল আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ওর চোখ লাল।দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখনও ঘুমায়নি ও।
আমি মায়াভরা গলায় ওকে জিজ্ঞেস করলাম,’আপনি এখনও জেগে আছেন?’
‘তুমিই তো বললে জেগে থাকতে।’
আমি মৃদু হেসে বললাম,’উঠুন।’
নেহাল চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে এলো।
তারপর বললাম,’অজু করে আসুন। নামাজের অজু।’
নেহাল খানিক সময় চুপ থেকে বাথরুমে ঢুকে গেল অজু করতে। আমিও অজু করতে গেলাম।
অজু করে এসে নেহালকে বললাম,’পাঞ্জাবি পরে নিন। মাথায় টুপি দিন।’
নেহাল লজ্জিত গলায় বললো,’আমার পাঞ্জাবি আছে কিন্তু টুপি নাই!’
আমি বললাম,’আমার একটা সাদা রুমাল আছে। সেই রুমাল দিয়ে মাথা ঢাকলেই হবে।’
এবার আমি আমার রুমালটা ব‍্যাগ থেকে বের করে নেহালের কাছে দিলাম। নেহাল আলনা থেকে নামিয়ে পাঞ্জাবি পরে তার মাথা ঢেকে নিলো রুমাল দিয়ে। তারপর আমরা দুজন গিয়ে দাঁড়ালাম জায়নামাজে। এবার আমি বললাম,’নামাজ পড়ান।আপনি ইমাম আমি আপনার মুক্তাদি।’
নেহাল বললো,’আমি মাত্র তিনটে সুরাই জানি।’
আমি হেসে বললাম,’তিনটা সুরাই যথেষ্ট।’
তারপর নেহালকে নামাজের কায়দা কানুন সম্পর্কে বুঝিয়ে দিলাম।সে এবার আমার ডানে আমার থেকে একটু সামনে দাঁড়ালো।
তারপর আল্লহু আকবার বলে কানে হাত তুলে বুকে হাত বাঁধতেই আমার চোখে নেমে এলো প্রশান্তির জল। খুশিতে আমার হৃদয় জমিনে পুলক বয়ে গেল।
নামাজ শেষে নেহাল দু হাত উঠালো খোদার দরবারে। তারপর সে কান্নাভেজা গলায় বললো,’হে পরম করুণাময়,আমি বড় অপরাধী, আজীবন ভুল করে এসেছি শুধু,পূণ‍্যের ধারে কাছেও যায়নি। আমার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। খারাপ ব্যবহার করেছি এক পূণ‍্যময়ী রমণী সাথে।সে আমার স্ত্রী। আমার স্ত্রী আমার চোখ খুলে দিয়েছে।আমায় আলো দেখিয়ে নিয়ে এসেছে তোমার আরশের কাছে। আল্লাহ,আমি আর্জি পেশ করছি তোমার কাছে, আমার স্ত্রী আমাকে যেভাবে তার করে নিয়েছে এবং তোমায় চেনার পথ দেখিয়ে দিয়েছে ঠিক সেভাবে তুমিও তাকে তোমার প্রিয় করে নাও।’
নেহাল দোয়ায় কাঁদছে। নেহাল কাঁদছে তার ভুলের জন্য আর আমি কাঁদছি তার প্রত‍্যাবর্তনের আনন্দে।
আর মনে করছি একটি নিশুতি রাতের কান্নার কথা । সেই রাতে নেহালের অত‍্যাচার সয়ে আমি মনে মনে কেঁদে ছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভেবেছিলাম ঠিক একদিন ও মানুষ হবে। কিন্তু এতো দ্রুত হবে তা আমার কল্পনায়ও ছিল না।

দোয়া শেষে আমি কুরআন পড়তে শুরু করলাম শব্দ করে। নেহাল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে গালের উপর। সেই জলে নতুন সূর্যের আলো এসে চিকচিক করছে।
এবার আমি ওর গালে বসে থাকা একফোটা জল আঙুলের মাথায় তুলে এনে বললাম,’এই জল পবিত্র জল। এই জল পাপ ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়ার জল।’
নেহাল তার ভিজে থাকা গলায় বললো,’আমিও কুরআন পড়বো। আমাকে শিখিয়ে দাও!’
আমি বললাম,’পড়ুন তবে আলিপ।’
নেহাল পড়লো,’আলিফ।’
নেহালের সেই ‘আলিফ’বর্ণে উচ্চারিত সুর আকাশ বাতাসে গিয়ে ছন্দ তুললো।আর ঝুম ঝুম করে নেমে এলো বৃষ্টি।যেন বৃষ্টি দলও শুনতে এসেছে আমার নেহালের কুরআন তেলাওয়াত।
আর ওদিকে বারান্দার এক পাশে দাঁড়িয়ে আমার শাশুড়ি মা বললেন,’নারীরা পুরুষদের ভেঙে ভেঙে একেবারে নতুন করে সৃষ্টি করতে পারে।’
শাশুড়ি মার কথা শুনে আমি মিষ্টি করে হেসে উঠলাম।

–সমাপ্ত–