নিষিদ্ধ বরণ পর্ব-০৫

0
311

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৫)

মাহদী একটু থামল। নায়রার চোখ দুটোতে চেয়ে আচমকা বলল,
” তুমি কিন্তু আমার হাতে চড় খাওয়া প্রথম মেয়ে নও। তুমি কত নাম্বারে আছ নিশ্চিত বলতে পারছি না। তবে দশের পরে একটা হবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই প্রথম কোনো মেয়েকে চড় দেওয়ার পর আমার দুঃখ হচ্ছে, খারাপ লাগছে। মনের ভেতর অশান্তি হচ্ছে। কেন বলো তো? ”

নায়রা নিরুত্তর। চোখের তারায় ভয় আর বিস্ময়ের লড়ালড়ি চলছে। নায়রা চোখ ফিরিয়ে নিলে মাহদী নিজ থেকে বলল,
” তুমি কি ভাবছ আমি মেয়েদের এমনি এমনি চড়িয়ে বেড়াই? মোটেও না। প্রত্যেকটা চড়ের পেছনে একটা কারণ আছে। শুনবে? ”

নায়রা এবারও চুপ। তার হাব-ভাবে অস্থিরতা। ঘাড় বাঁকিয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে বার বার। মাহদী ভ্রু বাঁকাল। চোখে-মুখে অসন্তোষ্টির ছাপ! নায়রার মনোযোগ নিজের দিকে আনার জন্য বেশ শক্ত স্বরে বলল,
” কী সমস্যা? ঐ দিকে কী দেখছ? ”

নায়রা খানিকটা চমকাল। হালকা কেঁপেও উঠল। দূর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল নিকটে। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকল সবুজ ঘাসের ডগায়। মাহদীর বিরক্ত কমার বদলে বেড়ে গেল। নায়রার থুঁতনি চেপে মুখ উঁচু করে শাসিয়ে বলল,
” আমার দিকে তাকাও। কী বলছি শুনো। রাগিও না। তোমার বাবার উপর থেকে রাগটা এখনও পড়েনি। তার জন্য আমার একটা দিন নষ্ট! চাকরিটা যদি চলে যায়? ”

মাহদীর এমন অনমনীয় স্পর্শে নায়রা চোখ বন্ধ করে ফেলল। বন্ধ চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তবুও মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করল না। মাহদী সেই বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” চোখ খুলো বলছি। আজ সারা দিন তুমি আমার সাথে থাকবে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। যতক্ষণ না আমার রাগ পড়ছে ততক্ষণ তুমি আমাকে সময় দিবে। এর আগে তোমাকে ছাড়ছি না। দিনাজপুর ও না৷ এটাই তোমার বাবার শাস্তি। ”

নায়রার নরম শরীর এবার নড়ে উঠল। হাত-পায়ে জোর এলো কিছুটা। নিজের শরীর থেকে মাহদীর হাতটা সরানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। নায়রার চেষ্টা সফল হলো। তার থুঁতনি ছেড়ে দিল মাহদী। উঠে দাঁড়াল। কিন্তু একা নয়। নায়রার ডান হাতের কনুই চেপে ধরে তাকেও উঠাল। মাঠ ছাড়তে ছাড়তে বলল,
” রাত থেকে বাসে ছিলাম। খাওয়া হয়নি কিছু। তোমাদের ক্যান্টিন কোন দিকে? ”

নায়রা ফুঁপিয়ে উঠল। নিজ জায়গা থেকে নড়তে চাইল না। অস্ফুটে বললও বুঝি কিছু! সেই অস্পষ্ট শব্দগুলো মাহদীর কানে পৌঁছাল না। সে কয়েক কদম এগিয়ে হঠাৎ কাউকে ডেকে উঠল। নায়রা অশ্রুসিক্ত নয়নে সামনে তাকাল। সাথে সাথে পরিচিত মেয়েটি বলে উঠল,
” নায়রা, তুমি এখানে? ক্লাস করছ না? ”

নায়রা উত্তর দিতে পারল না। তার আগেই মাহদী বলল,
” তোমাদের ক্যান্টিন কোন দিকে? ”

মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ থাকল। মাহদীর দিকে চেয়ে থেকে বলল,
” ইনি কে? চিনতে পারছি না তো। নায়রা, তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে? ”

মেয়েটি দূর থেকে এদিকে আসতে আসতে বলল,
” নিহিতার মুখে শুনছিলাম বিয়ের কথা চলছে। এর মধ্যে হয়ে গেল? বর নিয়ে কলেজেও চলে আসছ? ”

মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে নায়রার কাছে চলে আসছিল প্রায়। অকস্মাৎ সামনে চলে এলো মাহদী। নায়রাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে কাঠ স্বরে বলল,
” হ্যাঁ, হয়ে গেছে। ”

মাহদীর এমন আচরণে মেয়েটি থেমে যেতে বাধ্য হলো। কপাল কুঁচকে ফেললে মাহদী পেছন ঘুরে তাকাল। নায়রার উদ্দেশ্যে বলল,
” এই মেয়েকে বলো, আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে নাহলে কিন্তু চড় মেরে বসব। আমার মাথার সাথে পেটও জ্বলছে। মরে গেলে তোমার বাবার অবশ্যই ফাঁসি হবে। এত কিছুর জন্য সেই দায়ী! ”

মাহদীর কথায় সামনের মেয়েটির চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মাহদী চোখ ফিরিয়ে আনল মেয়েটির দিকে। তার রক্তবর্ণ চোখে চেয়ে মেয়েটি ভয়ে ভয়ে ক্যান্টিন দেখিয়ে দিল।

ক্যান্টিনের কাছাকাছি পৌঁছাতে ঘন্টা বাজার শব্দ হলো। মনে হয় টিফিন পড়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাস থেকে ছড়িয়ে পড়ছে কলেজের চারপাশে। মাহদীকে পাশ কাটিয়ে দুজন ক্যান্টিনের ভেতর ঢুকে গেল। বাঁধা পেয়ে রক্ত চোখে তাকাল তাদের দিকে। তারপরে এক বার পুরো কলেজে চোখ বুলিয়ে নায়রাকে নিয়ে উল্টো হাঁটা ধরল। গেইটের কাছাকাছি পৌঁছাতে নায়রা প্রথম কথা বলল,
” আমি কোথাও যাব না। ছেড়ে দিন,প্লিজ! ”

মাহদী দাঁড়াল। নায়রার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টেনে হাসল। বিদ্রুপ করে বলল,
” তুমি কথা বলতে পার? আমি তো ভেবেছিলাম বোবা। ”

মাহদীর কথা গায়ে মাখল না নায়রা। তার হাত থেকে ছোটার জন্য জোরাজুরি শুরু করল। গেইটে বসে থাকা দাড়োয়ান এদিকে লক্য করছিল। কিছু একটা আঁচ করতে পারলেন বোধ হয়। লাঠি নিয়ে এদিকে গড়ি-মসি ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছেন। নায়রা সেদিকে তাকিয়ে বলল,
” সবাই দেখছে। খুব খারাপ হয়ে যাবে। ছাড়ুন! বাবার হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। ”

নায়রার কথায় মাহদীর মন গলল না। নিজের জেদ ঠিক রেখে বলল,
” হবে না। আমি ঠিক করে ফেলেছি আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরব। ”

নায়রাও নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই একটা অপরিচিত ছেলের সাথে বাইরে যাবে না। আশেপাশের প্রায় অনেকেই তাকে চিনে। বিয়ের আগে একটা পর পুরুষের সাথে ঘুরে বেড়ানো মানে বাবার সম্মানে হাত দেওয়া। নায়রা ভাবনার মধ্যেও বার বার দাড়োয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। ঝামেলা যে কত দূর গড়াতে পারে অনুমান করছে।

মাহদী নায়রার হাত ছেড়ে বলল,
” কথা যখন বলেছই তখন নিজ ইচ্ছেতে চলো। এসব জোড়াজুড়ি পছন্দ হচ্ছে না আমার। ”

হাত ছাড়া পেয়ে সুযোগটা লুফে নিল নায়রা। ছুটে পালানোর জন্য ছোটা শুরু করল। বেশি দূর এগোতে পারল না। বোরকায় টান খেল। টান অপেক্ষা করে ছুটতে গিয়ে ঘটনাটা ঘটে গেল। মুখের নেকাব সহ হিজাব খুলে গেছে। লজ্জায় সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল নায়রা। বোধশক্তি হারিয়ে ধপাস শব্দে সেখানে বসে পড়ল। এই ব্যাপারটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না মাহদী। আকস্মিক ঘটে যাওয়া ঘটনায় সে নিজেও স্তম্ভিত। কোনো রকম পদক্ষেপ ছাড়াই নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। সে অবস্থায় দেখল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা এদিকে দৌড়ে এসে জড়ো হচ্ছে। সকলের উৎসুক দৃষ্টি তাদের দুজনের উপর। দু-একজন শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এগিয়ে আসছেন। কী হতে চলেছে বুঝতে পারল না মাহদী। কিন্তু এই সকল চোখের দৃষ্টি থেকে যে নায়রা আড়াল হওয়ার চেষ্টা করছে সেটা বুঝতে পারল। তাই দ্রুত এগিয়ে এসে হিজাব দিয়ে নায়রার মাথা ঢেকে দিতে চাইল। ঠিক সে সময় আরেকটা ঘটনা ঘটে গেল। ধীর, শান্ত, নীরব, সরল ও অনুদ্ধত মেয়েটি চড় বসিয়ে দিল মাহদীর গালে। এরপর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না সেখানে। সকলের সামনে থেকে পালিয়ে গেল। ততক্ষণে দাড়োয়ানও এসে পৌঁছেছে। আচমকা কলার চেপে ধরল মাহদীর। মার দেওয়ার উদযোগ করতে ভিড়ের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে বলল,
” ইনি নায়রার স্বামী! ”

রিক্সা থেমে গেছে। রিক্সাওয়ালা বলল,
” চলি আইছি ভাই, নামি যান। ”

মাহদীর উদাসীন চোখ দুটো কলেজের গেইটে নিবদ্ধ হলো।
আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ রাগ করে বলে ফেলা কথাটার জন্যই সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম, নায়রা। এরপরও বলবে, রাগ ধ্বংসের কারণ? ‘

চলবে

বিঃদ্র-১ঃ উপন্যাসের শুরুতে লিখেছিলাম ‘ পরিণতির আগ মুহূর্ত ‘ এর মানেটা অনেকেই বুঝতে পারেননি। ফলে কাহিনি প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলেছেন। এটার মানে হলো উপন্যাসের সমাপ্তির আগ মুহূর্তের ঘটনা। আমি উপন্যাসের শুরুতে যেখানে ‘নিহিতা আর মাহদীর’ বিয়ের বর্ণনা করেছি। ঐ ঘটনায় এই গল্প শেষ হবে। নায়রা ও মাহদীর বিয়ের আসরে পৌঁছানোর যাত্রাটাই ধীরে ধীরে খোলাসা করছি।

বিঃদ্র-২ঃ আপনারা আমার উপন্যাসের কাহিনি ধরতে না পারলে অনেক কষ্ট হয়। নিজের উপর রাগ হয়। এবারও হয়েছে। ভেবেছিলাম আপনারা বুঝতে পারবেন। কিন্তু পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে বলে দিচ্ছি ‘নায়রা’ কে কেন্দ্র করে যতগুলে দৃশ্য হবে সবগুলোই অতীত। এখন প্রশ্ন হতে পারে অতীত কেন টেনে আনছি? নিহিতাকে নিয়েই একটা উপন্যাস হতে পারে। তাহলে বলব, আমি যে বিষয় আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাচ্ছি তার জন্য নায়রা ও নিহিতার দুজনকেই দরকার।

আশা করি ধৈর্য্য নিয়ে সাথে থাকবেন।