নিষিদ্ধ সে পর্ব-১২

0
5558

#নিষিদ্ধ_সে

(১২)

মধ্যরাত্রি চোখ দুটো মেলে বাসার সিলিং এর দিকে চেয়ে আছি। রিধিতা আপু পাশে নেই। হয়তো ভাইয়ার সাথে প্রেমালাপনে ব্যস্ত। সায়র ভাইকে নিয়ে মগজের এক একটা নিউরন যুদ্ধ বাজিয়ে দিয়েছে মনে হয়। একচিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় পদার্পণ করছি তবু চিন্তার রেশ কাটছে না। সারাদিনের সায়র ভাইয়ের সাথে করা খুনসুটি ঝগড়াগুলো চোখের পাতায় ভাসছে। কিছুক্ষন পরই আবার নির্মা আপুর চেহেরা ভেসে উঠে অপরাধবোধ জাগ্রত করছে মনে। এতোদিনে এটা দেখেছি আপু সায়র ভাইয়ের প্রতি বেশ পজেসিভ থাকলেও ইগনোর করে বেশি। সম্পর্কটা ওদের কেমন নদীতে ভাসমান ভেলার মতো। ভেলার কাঠামো ঠিক রেখে তৈরি করলে ভাসবে নয়তো ডুবে যাবে একসময়। নির্মা আপু রিলেশনে হিট দিচ্ছে না। আরেকদিকে মনে হচ্ছে সায়র ভাইও হাল ছেড়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু আর শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য আমি এখন ওদের বিচ্ছেদ চাইছি। খারাপ আমি বড্ড! যে আপু আমার প্রতি এতো ভালো ব্যবহার করে তারই বিচ্ছেদ চাইছি। স্মৃতির পাতা বন্ধ করার প্রচেষ্টায় আস্তে আস্তে ঘুমে তলিয়ে যেতে লাগলাম। আলোর ঝলকানি তীব্র হয়ে চোখে পরায় চোখ মেলে তাকালাম। আম্মু রুমের পর্দা টেনে দিচ্ছে। উঠে বসলাম চোখে হাত দিয়ে।

“আম্মু আজকে সকাল সকাল এতো কড়া রোদ উঠেছে যে বাইরে?”

“কয়টা বাজে দেখে নে!”

অলসহাতে বালিশের পাশে হাতড়ালাম। ফোন হাতে এসে বারি খেতে তাকিয়ে দেখি বারোটা বাজে! আম্মুর দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালাম। আম্মু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে বিছানা থেকে উঠতে বলে চাদর ঝেরে ঠিক করতে লাগলো। এখন ঘটে এলো আজকে সায়রির বিয়ে আর মা কেন আমাকে আগে আগে ডাকেনি।

“আম্মু আগে আগে ডাকোনি কেন? আজকে না সায়রির বিয়ে!”

আম্মু স্বাভাবিক চেহারায় আমার দিকে তাকালো, “কারন ঘুম থেকে উঠেই তুই বিয়ে বাড়িতে দৌড় দিবি। সায়রির চাচির কথাগুলো কালকে শুনিসনি? বেয়াদবের মতো তো কিছু কথা শুনিয়ে দিলি! আজকে গেলে তোর হাড় ভেঙে দেওয়া কথা শুনাবে!”

মুখটা বিকৃত করে তাকালাম, “এর ভয়ে তুমি আমাকে ডাকোনি? আমার রেডি হতে হবে। বিয়ে বাড়িতে কি কি করবো প্ল্যানিং করতে হবে। সায়রিকে সাপোর্ট দিতে হবে। এটা ভুলে গেলে?”

আম্মু বিছানা ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ অসন্তুষ্টি চেহেরায় খেলা করছে, “বিয়ে রাতের বেলা। এতো তাড়াতাড়ি যাবি তুই?”

“সায়রির পাশে থাকবো না? বেস্টফ্রেন্ড আমি সবসময়।”

আম্মু আমার কথাগুলো মাঝপথে থামিয়ে দিলো, “ফ্রেন্ডশিপের নীতি শুনাতে হবে না।” রুম থেকে যেতে যেতে, “ওনাদের শক্ত খোটা শুনতে চাইলে রেডি হয়ে চলে যা।”

ফ্রেশ হয়ে সোফার রুমে বসে আছি। আম্মুর শক্তচোখ মুখের ভয়ে বিয়ে বাড়িতে যাবার নাম তুলতে পারছি না। ভাইয়া দিব্যি চলে গেছে রিধিতা আপুকে নিয়ে। আমিই সে অভাগা যে কিনা বিয়ে বাড়িতে যেতে ভয় পাচ্ছি।

“বসে আছিস কেন তুই না বিয়ে বাড়িতে যাবি!”

রিমোট দিয়ে চ্যানেল বদলাতে বদলাতে, “যাবো তো। টিভি দেখে নেই আগে!”

খালা রান্নার কাজ ছেড়ে হাত মুছতে মুছতে সোফার রুমে এসে গেলো। আমায় বাসায় অলস ভঙ্গিতে রিমোট হাতে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো, “নিষ্ঠা, তোর না বান্ধবীর বিয়ে। এখানে এমন করে বসে আছিস যে? রিহাম তো চলে গেলো আরো সকাল সকাল!”

গাল ফুলিয়ে আম্মুর দিকে তাকালাম। তিনি একধ্যানে রান্নার জন্য আদা বেটে দিচ্ছে।

“পরে যাবো খালা। আম্মু।”

আমার কথাটুকু থামিয়ে দিয়ে আম্মু গর্জে উঠলো, “খবরদার, আমার নাম নিয়ে মিথ্যে বলবি না।” রেগে ভ্রু কুচকে, “আমি তোকে আটকে রেখেছি?”

“ওহ আপা, বাচ্চা মানুষ। বান্ধবীর বিয়েতে মজা করবে ইচ্ছে মতো আর তুমি ওকে আটকে রেখেছো।” আমার দিকে ফিরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, “যাও মা, তুমি রেডি হয়ে চলে যাও বিয়েতে।”

“হ্যা, হ্যা লায় দিয়ে যেতে দাও! ঐখানে গিয়ে যখন শক্ত খোটা শুনে কাঁদতে কাঁদতে আসবে তখন আবার কিছু বলো না!”

খালা আম্মুর দিকে তাকিয়ে কিছুটা গর্বিত ভঙ্গিমায় বলতে লাগলেন, “আপা, ও তোমার মেয়ে। মনে নেই তুমি সামান্তা আপার বিয়েতে তার ভাবিকে কি জবাবটাই না দিয়েছিলে?”

উৎসুকচোখে আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মু খালাকে মৃদুস্বরে ধমক দিলেন। খালা হাসতে লাগলো।

“আমি কি যাবো তাহলে?”

আম্মু আমার দিকে একবার চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। খালা মৃদু হেসে আমাকে যেতে বললেন। ড্রেস চেঞ্জ করে চুলগুলো নিচু খোপা করে রুম থেকে বেরিয়েছি। আম্মু চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন, “সাজলি না?”

“এখন সেজে কি করবো? বিয়ে তো রাতে তখন সাজবো!”

“বিয়ে বাড়িতে তাই এমন করে যাবি? কেউ তাকাবে তোর দিকে?”

খালা রান্নাঘর থেকেই আম্মুকে জবাব দিলো, “আপা তোমার মেয়ে ন্যাচারাল বিউটি। না সাজলেও ছেলেরা ঘুরে ঘুরে তাকাবে!” কথা শেষে রান্নাঘর থেকে চোখ টিপ দিলো আমাকে।

“যা ডায়লগ দিলা খালা!”

আম্মুকে একহাতে জড়িয়ে গালে চুমু দিয়ে দাঁত ভেটকানি দিয়ে বেরিয়ে পরলাম। আম্মু উপর থেকে সিড়ির রেলিঙ ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন,”কেউ খোটা শোনালে আবার কেঁদে দিস না যেনো!”

বিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখি কিছু পিচ্চি নতুন জামা পরে ছোটাছুটি করছে। বড়রা রান্নার কাজ করছে। সায়র ভাই হ্যাল্প করছেন আঙ্কেলকে। চেয়ার রেখে কপালের ঘাম একহাতে মুছে ঝেরে ফেললেন। অতিথিদের ভিড় জমে গেছে বাসাটায়। গুটিগুটি পায়ে বাড়ির অবস্থা পরখ করতে করতে এগুচ্ছি দেখি রনক ভাইয়াও কাজে লেগে গেছেন। আমাকে দেখে হাসলেন। উনার কাছে এগিয়ে গেলাম।

রনক ভাইয়া নিজের কাজ ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, “এতো দেরিতে এলে যে?”

“আম্মু ঘুম থেকে ডেকে তুলেনি সকাল সকাল।”

“তুমি তো সাজোনি দেখছি। আজকের দিনেও না সাজলে চলে?”

“আরে ভাইয়া, রাতে সাজবো। বরপক্ষের মাথা একদম ঘুরিয়ে দিতে হবে না?”

উনি হেসে আবারো কাজে লেগে গেলেন। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে গামছা খুজতে লাগলাম। আমাকে চারপাশে তাকাতে দেখে কাজ করতে করতে প্রশ্ন ছুড়লেন, “কি খুজো?”

“দাঁড়াও আসছি।”

আন্টির কাছে গিয়ে গামছা চাইলাম। আন্টি প্রশ্ন না জিজ্ঞেসা করে রুমের দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। সেখানে গেলে নাকি ইনটেক গামছা পাবো। আমিও কোন বারতি কথা না বলে গামছার লোকেশন অনুসারে গিয়ে গামছা হাতে সুরসুর করে বেরিয়ে এলাম। গামছা হাতে রনক ভাইয়ার কাজের জায়গার কিছুটা আগে দাঁড়ালাম।

“ভাইয়া কাজ থামিয়ে এদিকটায় আসেন তো!”

সপ্রশ্ন চোখে আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। হাত নেড়ে তাকে আবারো কাছে আসতে ডাকলাম। উনি এগিয়ে এলেন।

“এক হাটু ভাজ করে নিচু হোন!”

উনি কিছু না বলে নিচু হলেন। গামছা ভাজ করে উনার মাথায় পেচিয়ে গিট্টু দিলাম কয়েকটা। উনি অবাকচোখে আমার কাজগুলো দেখছেন।

“এখন দুইহাটুই ভাজ করে বসেন তো।”

কথানুসারে উনি দুইহাটু ভাজ করে বসলে ফোন বের করে সেলফি তুলতে লাগলাম। ব্যাপারটা যখন বুঝলেন তখন তিনি হাসতে লাগলেন সেই শব্দহীন টোলপরা হাসি। হঠাৎ সায়র ভাই এসে রনক ভাইয়ার মাথার গামছা খুলতে লাগলেন।

বাধা দিতে লাগলাম হাতে ছাড়াতে চেয়ে, “আরে আরে খুলছেন কেন?”

সায়র ভাই গিট খুলতে খুলতে আমার দিকে তাকিয়ে একহাতে বাতাস করার মতো নাড়িয়ে বলতে লাগলেন, “আজকে প্রচুর গরম পরেছে!”

কাহিনী না বুঝে হাত সরিয়ে উনার দিকে চেয়ে আছি। উনি রনক ভাইয়ার মাথার গামছা খুলে নিয়ে নিজের কপাল আর মুখের ঘাম মুছছেন। মোছা শেষে গামছাটা হাতে ধরিয়ে দিলেন।

“নে এবার ব্যবহার কর। ঘামে ভেজা ঘামছা ওকে পরিয়ে ছবি তুললে তোর সেলফিটা আরো সুন্দর হবে!”

সায়র ভাই হেলেদুলে চলে গেলেন। আমি হাত থেকে ফেলে দিলাম গামছাটা। রনক ভাইয়া মৃদু হেসে গামছা উঠিয়ে তিনিও নিজের ঘাম মুছছেন। ঘাম মুছে আমার দিকে বাড়ালে আমি নাক মুখ কুচকে সরে গেলাম সামনে থেকে। সায়রি বেশ ততস্থ হয়ে বসে কাজিনদের মাঝে। চোখে-মুখে বিব্রতভাব। কিছুটা ভয়। কিছুটা অনিশ্চয়তার রেখা। আমি গেলে আমাকে হাত চেপে বসিয়ে দিলো। ওর কাজিনগুলো এক সময় চলে গেলো রুম থেকে। সায়রি আমার হাত চেপে ধরলো।

“নিষ্ঠা, ভয় লাগছে রে।”

“বোইন আমি শান্তনা দেওয়ায় খুব কাঁচা। কিন্তু তুই যদি এখন ভয়ে কান্না করিস আমি তোকে মাথায় পিঠে বারি মেরে আশ্বাস দিতে পারবো!”

“হুর মাইয়া, মজা করিস না। সত্যি ভয় লাগছে।”

একহাতে সায়রিকে জড়িয়ে ধরলাম, “ভয় পাস না সব ঠিকঠাকই হবে।” চোখ টিপ মেরে, “তুইও বাসরে ঢুকে যাবি সবশেষে!”

সায়রি হাত ঝারা মেরে সরিয়ে দিলো, “তুই আরো কেমন!”

মাথা চুলকে, “বোন আমার তো বিয়ে হয় নাই শান্তনা কিভাবে দেয়? তোর হাত ধরে আছি তুই আশ্বাস নে আমার থেকে!”

সায়রিকে রেখে বিকেল দিকে খালার বাসায় এসে গেলাম। রেডি হয়ে সেজে আবারো এসেছি বিয়ে বাড়িতে। আমাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে আবারো হেসে উঠলেন সায়র ভাই। তড়িঘড়ি নিজের দিকে তাকালাম। না ঠিকই আছে শাড়ি। উনি তবু হাসছেন। ভেংচি কেটে সায়রিকে দেখতে উপরে চলে এলাম। সায়রিকে সাজানো শেষ। বরযাত্রী আসার পালা। রুমটাতে সায়রি একা বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আমি গিয়ে কাধে হাত রাখতে ম্লান হাসি হাসলো।

“নার্ভাস হচ্ছিস কেন আমি আছি! দরকার পরলে আমাকে নিয়েই তুই তোর বাসরে ঢুকিস!”

“উফ, নিষ্ঠা আশ্বাস তো ঠিক মতো দিতে শিখ!”

হাসতে লাগলাম, “তোর ২য় বিয়েতে দেখিস ঝাকানাকা শ্বান্তনা দিবো! এবারেরটা অভিজ্ঞতায় যোগ করে নিচ্ছি।”

বরপক্ষ এসেছে গুঞ্জন নিচ থেকে আসছে। নিচে যেতে গেলে সায়রি হাত চেপে ধরলো।

“ভয় পাস না সাইফ ভাইয়া আছে তো।”

সায়রি হাত ধরে আমার দিকে চেয়ে আছে। কি জানি বলতে চেয়েও থেমে যাচ্ছে। জানালার কাছ থেকে এসে এর এমন গম্ভির মুখাবয়ব দেখে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘কি?”

“তুই কি সায়র ভাইয়ার প্রতি দূর্বল? না আমি তোকে যতোটুকু চিনি তুই সবার সাথেই ফ্রি হয়ে মিশিস ঠিক আছে। কিন্তু তোর বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে আমার মনে হচ্ছে সায়র ভাইয়াকে তুই পছন্দ করতে শুরু করেছিস। হয়তো পছন্দ থেকেও_”

থেমে অন্যদিকে তাকালো। এই মূহূর্তে এই প্রশ্নটার আশা করিনি। থতমত খেয়ে ওর দিকে চেয়ে আছি। মিথ্যে বলতে যেয়েও থেমে গেলাম। আজ পর্যন্ত আমার সব সিক্রেটগুলো কাউকে না বললেও সায়রিকে বলেছি। চোখ বন্ধ করে লম্বা দম নিলাম। সত্যিটা বলে দিবো। বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে আমার খারাপ দিকটাও ওর জানা উচিত। আচ যেহেতু করেছে মিথ্যে বলে কি লাভ!

“হ্যা আমি সায়র ভাইকে পছন্দ করি।”

কথাটা বলে সায়রির দিকে তাকালাম। সে বিস্মিতচোখে আমাকে দেখছে। কিছু না বলে সেখান থেকে চলে আসার জন্য পিছনে ঘুরলে নির্মা আপুকে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।

চলবে__________❤

#এ্যাগ্নেস_মার্টেল