নীড় হারা পাখি পর্ব-১৫+১৬

0
295

#নীড়_হারা_পাখি
#১৫তম_পর্ব

নিজের বাড়ি মুখী রাস্তার মধ্যিখানেই থেমে গেলো পা। চোখ আটকে গেলো গোধুলী রাঙ্গা মেয়েটির এলোকেশে। স্কার্ট এর তলদেশে ঘষছে ময়লা রাস্তায়। কিন্তু বেপরোয়া নারীর সেদিকে নজর নেই। সে ব্যস্ত সামনের কুকুর ছানাকে পাউরুটি খাওয়াতে। শীতকালে বিনা নোটিশেই বেশ কটা ক্ষুদে কুকুর ছানা পাড়ায় ঘেঊ ঘেঊ করতে দেখা যায়। তাদের মায়ের খোঁজ নেই। উদ্দেশ্য একটু খাবারের। হয়তো তারা খাবারের খোঁজ ও পেয়ে গেছে। উৎফুল্ল মুখখানা বেশ আগ্রহেই তাকে খাওয়াচ্ছে। অথচ তার মানুষে কত ভয়। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রোদ্দুর। হাটু গেড়ে বসলো তার পাশে। গাঢ় কন্ঠে বললো,
“মাঝে মাঝে তোমাকে আড়াল করতে ইচ্ছে করে, লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে সকলের অগোচরে। কিন্তু আফসোস, আমার সেই অধিকার নেই”

কথাটা শেষ হবার পূর্বেই অবুঝ নারী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রোদ্দুরের দিকে। নীরব দৃষ্টিতে দেখলো কিছুক্ষণ। ঘোলাটে চোখজোড়া কি বুঝলো জানা নেই। শিরশিরে শীতল বাতাসে কাঁপছে তার পাতলা ঠোঁট। হবে না কেনো! ম্যাডাম যে এই শীতেও কোনো গরমকাপড়ের সুতোও পরেন নি। হুট করেই শহরের ইট পাথরের জগতে শীত নামক ঋতুটি নেমে পড়েছে। শহরের গায়ে নাকি ঠান্ডা লাগে না, কথাটি এবছর খাটছে না। সকাল হলেই হাড়মজ্জা কাঁপানো শীতল বাতাস রন্ধ্রে প্রবেশ করে। পানিতে হাত দিলেই গায়ে কাঁটা দেয়। অথচ মেয়েটি এই আবহাওয়াতেও বিনা গরম কাপড়ে বসে রয়েছে। রোদ্দুরের ঘোর কাটলো যখন উৎকুন্ঠিত কন্ঠ কানে আসলো,
“কিছু বললেন?”
“না তো, তুমি কিছু শুনেছো?”

তুলিকা মাথা নাড়ালো, সে শুনে নি। রোদ্দুর ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস গোপন করলো। তারপর বললো,
“ঠান্ডা বাড়ছে”
“তো?”
“তো কি? বাসায় যাবে। সন্ধ্যা নামবে। জানো ক’ভি’ডের সংখ্যা বাড়ছে। ঠান্ডা লাগলে? এই বড় বড় ইঞ্জেকশন দিতে হবে”

রোদ্দুর তুলিকাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো, নিজের হাতের কনুই অবধি দেখালো ইঞ্জেকশনের সাইজ। কিন্তু ভয়ের বদলে মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠলো। যে নারীর হাসি সুন্দর, সেই নারী সত্যি মায়াবতী—- কথাখানার যথার্থতা খুজে পেলো রোদ্দুর। অবাক কন্ঠে বললো,
“হাসছো কেনো?”
“আপনি আমাকে বোকা ভেবেছেন? হতে পারেন আপনি ডাক্তারবাবু, তবে আমি বোকাটি নই। ইঞ্জেকশন এতো বড় হয় ই না। আমি তো ঘোড়া নই, মানুষ। তাহলে এতো বড় ইঞ্জেকশন কেনো দিবে আমায়? এমনিতেও আমার ইঞ্জেকশনে ভয় লাগে না”
“তাই বুঝি?”
“হ্যা, আমাকে বোকা ভাবার ভুল করো না”

বলেই জিভ কাটলো সে। আবার ঠিক করে বললো,
“ভুল করবেন না”
“তুমিটাই তো ভালো ছিলো, আবার আপনিকে টেনে আনলে কেনো?”
“ইশ! তুমি কি সবাইকে বলা যায়? আপনদের তুমি বলতে হয়। আপনি আমার আপন নন”
“পরিচিত তো”
“পরিচিত হলেই তুমি বলতে হয়?”
“হ্যা, যেমন আমি তোমায় তুমি বলি”
“সে তো আমি ছোট বলে”
“বড়দের ও তুমি বলা যায়। এই ধরো তিতির আমাকে তুমি বলে”
“সে তো তোমাকে রোদ্দুর ভাই বলে”
“তুমিও বললে, আমি তো বাধা দেই নি”

তুলিকা একটু চিন্তায় পড়লো। ক্ষুদ্র মস্তিষ্কটিকে অনেক ভাবালো। রোদ্দুরের ঠোঁটে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। মেয়েটিকে নিজেকে নিয়ে ভাবতে দেখে ভালো লাগছে। তুলিকা আকাশ পাতাল ভেবে বললো,
“আমি ভেবে জানাবো”
“বেশ, বাড়ি যাও তবে”

তুলিকার মনটা খারাপ হলো কিঞ্চিত। মিয়ে গেলো কন্ঠ, উদাস দৃষ্টিতে তাকালো ছোট্ট কুকুরছানাটির দিকে। তার যে কুকুরছানাটিকে মনে ধরেছে এতে সন্দেহ নেই। মেয়েটির কাতর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো রোদ্দুর। ধীর কন্ঠে শুধালো,
“ভালো লেগেছে?”
“হু”
“সাথে নিতে মন চাইছে?”
“মা বকবে, এমনিতে মার মাথায় আ’গু’ন জ্বলছে”
“তোমার উপর রেগে আছেন?”
“না, ছোট ভাবীর উপর। মা শুধু ছোট্ ছোট বিষয়ে রাগ করে। ছোট ভাবীকে বকে শুধু, আমার ভালো লাগে না। কিন্তু আমার কথার তো দাম নেই। তাই এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকি”
“দাম নেই কে বলেছে?”

রোদ্দুরের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো তুলিকা। তার চোখ জোড়ায় বিস্ময়। অবাক স্বরে বললো,
“আছে?”
“আছে তো”
“তুমি আমাকে বোকা কথায় ভুলাচ্ছো”
“আমি তোমাকে মিথ্যে বলছি না কিন্তু। কোনোদিন পরখ করে দেখো। এখন বাড়ি যাও”

তুলিকা মাথা দোলালো। তারপর উঠে দাঁড়ালো সে। রোদ্দুর তার স্কার্টের ধুলো ঝেড়ে দিলো। তুলিকা নিজ বাড়ির ভেতর চলে গেলো। রোদ্দুর রমনীর চলে যাওয়া দেখলো। মুচকি হাসলো আনমনে। তারপর ছোট্ট কুকুরছানাকে দেখে বলল,
“কি রে, যাবি নাকি আমার সাথে?”

কুকুরছানাটি তার কথা বুঝলো কি! কে জানে! তবে লেজটা দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। রোদ্দুর ছোট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে তাকে তুলে নিলো কোলে। মৃদু স্বরে বললো,
“ম্যাডামের তোকে খুব পছন্দ। কিন্তু আমার মায়ের চোখে তুই চক্ষুশুল। কপালে সুখ জুটবে বলে মনে হচ্ছে না”

বলেই আবার হেসে উঠলো। তারপর পা বাড়ালো নিজ বাড়ির মুখে_________________

*******

হিমা বেগমের মুখখানা ভার, খুব একটা প্রসন্ন লাগছে না তাকে। এই কারণটি অবশ্য অভিলাষা। অভিলাষা মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজকে শ্বাশুড়ি মা কেনো তার উপর ক্ষেপে আছে সে জানে না। তার মতে সে কোনো ভুল করে নি। তবুও শ্বাশুড়ি মার মুখভার। ঘটনাটি ঘটেছে দুপুর নাগাদ। অভিলাষা তখন পাটায় মশলা বাটছিলো। অতর্কিতে হিমা বেগমের আগমন। অভিলাষাকে যেভাবে দেখেই তিনি রেগে গেলেন। তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“তোমার বাড়ি থেকেই কিছুই শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠান নি?”

শ্বাশুড়ি মায়ের এহেন কথায় চমকে উঠলো অভিলাষা। হিমা বেগম উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
“সুরভী কোথায়?”
“ভাবী তিতিরের কোচিং এ গেছে, আজ তো বেতনের দিন। কিন্তু এ মাসে দেরি হবে, সেটাই বলতে গেছে”
“উঠো বলছি। উঠো”

বলেই টেনে তুললেন অভিলাষাকে। তারপর কড়া স্বরে বললেন,
“বাচ্চা বাচ্চা করে তো পাগল করছিলে, তুমি আর আমার অকর্মন্য ছেলে। এটাও জানো না এই সময় পেটে চাপ দিতে হয় না”
“কিন্তু মশলাটা না বাটলে তো রান্না হবে না”
“তোমাকে আমার অপছন্দ কেনো জানো?”

শ্বাশুড়ি মায়ের কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো অভিলাষা। খানিকটা লজ্জিত ও হলো। মাথা নামিয়ে নিলো সাথে সাথে। হিমা বেগম তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“তুমি উচ্চ পর্যায়ের বেয়াদব, যা খুশি কর”

বলেই হনহন করে নিজ ঘরে চলে গেলেন তিনি। অভিলাষার চোখের কোনায় জমলো অভিমানী অশ্রু। শ্বাশুড়ি মায়ের কথাগুলো ধারালো সুই এর মতো বিধলো। তবুও চুপ করে রইলো সেই। রান্নাঘরের দোয়ারে দাঁড়ালো তুলিকার মোটেই মায়ের এমন আচারণ ভালো লাগলো না। সে পা টিপে টিপে সেখানে এলো। অভিলাষার গালে আলতো হাত বুলিয়ে বললো,
“ছোট ভাবী, কেঁদো না। আসলে পায়ের মাথায় তার কাটা। শুধু শুধু চিল্লায়। চিল্লাতে ভালো লাগে তাই চিল্লায়, কিন্তু নিজেও জানে না কেনো চিল্লায়।”

সেই থেকেই হিমা বেগমের মুখভার। এমনকি তার হাতের চাও খান নি। অভিলাষা অধৈর্য্য কন্ঠে বললো,
“মা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না। আমি আর বসে কাজ করবো না।”
“আমাকে শুনাচ্ছো কেনো?”
“শুনাচ্ছি না মা, সত্যি বলছি আর হবে না। আপনি চা টা খেয়ে নিন”
“শোনো মেয়ে, যেহেতু ঠিক করেছো বাচ্চাটা রাখবে তাহলে একটু যত্নশীল হও। বাচ্চার মা হওয়া এতো সোজা নয়। অঘটন ঘটলে কেঁদে কুল পাবে না। সব কিছুকে ছেলেমানুষী বানিয়ে রেখেছে। ইচ্ছে হলো বাচ্চা নিলো, ইচ্ছে হলো বাচ্চার প্রতি অবহেলা শুরু করলো। যতসব”

শ্বাশুড়ি মায়ের কথাগুলো শানিত হলেও যথার্থ। মানুষ বিচিত্র প্রাণী, তাদের অনুভূতি প্রকাশের ধরণ ভিন্ন, কেউ মিঠাবাক্যে প্রকাশ করে তো কেউ তিক্তবানীতে। কিন্তু উদ্দেশ্য একটাই যেনো অপর মানুষটি নিরাপদ থাকে। হিমা বেগমের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা নেই। তিনি অভিলাষাকে নিতান্ত অপছন্দ করলেও তার নিরাপত্তা সর্বদা কামনা করে। যতই হোক এটাই তার পরিবার। শত বাসনের টুংটাং এর মতো পরিবারেও কলহ লেগেই থাকে, কিন্তু সেখানে বন্ধন ও থাকে জোড়ালো________

*****

খাবারের পাঠ চুকিয়ে নিজ ঘরে এসে বসেছে সুরভী। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসছে শরীর। বয়সের দোষ কি না জানা নেই, তবে আজকাল ক্লান্তির পরিমাণ যেনো বেড়ে গেছে। ঘাড়, মাথায় অসহনীয় ব্যাথা হয়। অবশ্য আজ মধ্যদুপুরে বেরিয়েছিলো, ছাতাও নেয় নি। ফলে কড়া রোদের মাঝে হেটে যেতে হয়েছিলো বহু পথ। মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বুঝি সে কারণেই প্রবল হয়েছে। সুরভী টেবিলের ড্রয়ার খুজলো। টাফনিলের পাতাটা খুজে পেলেও ঘুমের ঔষধের পাতা পাচ্ছে না। ফলে খোঁজার মাত্রা বাড়ালো। তখন ই গাঢ় কন্ঠ কানে এলো,
“আমি ফেলে দিয়েছি”

ভ্রু কুচকে তাকালো সুরভী। দরজার কাছে তুরান দাঁড়িয়ে আছে। নির্বিকার মুখশ্রী। সোয়াটারের হাটা গুটিয়ে রেখেছে কনুই অবধি। বাহু উন্মুক্ত। গাঢ় নজরে দেখছে সে সুরভীকে। সুরভী চোখ মুখ খিঁচিয়ে অবাক স্বরে শুধালো,
“মানে?”
“বিনা প্রেসক্রিপশনে ঘুমের ঔষধ খাওয়া ঠিক নয়”
“তোমাকে আমার ঠিক বেঠিক ভাবতে কে বলেছে?”

বলেই উঠে দাঁড়ালো। তার কন্ঠে রোষের উপস্থিতি স্পষ্ট। সুরভী বর্তমানে প্রচন্ড রেগে আছে। তুরান জানে তার ঘুমের ঔষধ ব্যাতীত ঘুম আসে না। তবুও সে ঘুমের ঔষধের পাতা ফেলে দিয়েছে। এখন অভিলাষার কাছে চাইতে হবে। ডাক্তার তাকে ঘুমানোর জন্য ঔষধ দিয়েছে। এখন তার কাছে থেকে ধার আনতে হবে। সুরভী পা বাড়ালেই তুরান গম্ভীর স্বরে বললো,
“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
“ঔষধ আনতে”
“তুমি ঘুমের ঔষধ আর খাবে না”

সুরভী কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো তুরানের দিকে। শীতল কন্ঠে শুধালো,
“আমি কি খাবো না খাবো তা বলে দিবে?”

তুরান এবার একটু কাছে এগিয়ে এলো। সুরভীর চোখে চোখ রেখে ধীর কন্ঠে বললো,
“অবশ্যই, ভুলে যেও না তুমি আমার দায়িত্ব। তোমার ভালো মন্দ সবটা আমার উপর বর্তায়, কেবল উপর ই বর্তায়”………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

#নীড়_হারা_পাখি
#১৬তম_পর্ব

সুরভী কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো তুরানের দিকে। শীতল কন্ঠে শুধালো,
“আমি কি খাবো না খাবো তা বলে দিবে?”

তুরান এবার একটু কাছে এগিয়ে এলো। সুরভীর চোখে চোখ রেখে ধীর কন্ঠে বললো,
“অবশ্যই, ভুলে যেও না তুমি আমার দায়িত্ব। তোমার ভালো মন্দ সবটা আমার উপর বর্তায়, কেবল উপর ই বর্তায়”
“আমি দায়িত্ব হতে চেয়েছি কখনো? কখনো বলেছি কি, আমার দায়িত্ব না নিলে আমি বুড়িগঙ্গায় ভেসে যাবো? বলি নি তো, তাহলে অযাচিত দায়িত্ব কেনো পালন করছো?”

সুরভীর কন্ঠে বিদ্রোহের ছাপ। তার চোখে মুখে বিরক্তি। ক্ষোভে কালো চোখজোড়া ছেয়ে এসেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। কোথাও না কোথাও গাঢ় অভিমানও অনুভূতি হলো তুরানের। তুরান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“স্ত্রী তুমি আমার, তাই তুমি দায়িত্ব হতে না চাইলেও তুমি আমার দায়িত্ব”
“স্বামীর কোন দায়িত্বটা পালন করেছো? বাকিগুলো যখন এড়িয়ে যেতে পেরেছো, এটাও পারবে। পথ ছাড়ো। ভালো লাগছে না”

তুরান কথা বাড়ালো না, ছেড়ে দিলো সুরভীর পথ। সুরভী চলে গেলো অভিলাষার ঘরে। তুরান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো জানালার ধারে। বুকে হাতজোড়া বেঁধে বিষন্ন নজরে চাইলো কালো আকাশটির দিকে। রুপালী অর্ধচাঁদটি ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। ফলে তার স্নিগ্ধ আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ধরনী। হয়তো কোনো কপোত কপোতী চন্দ্রমার স্নিগ্ধ আলোতে গা ভাসাবে বিধায় বসে রয়েছে খোলা আকাশের নিচে, কিন্তু মেঘদলের নিষ্ঠুরতার জন্য বঞ্চিত হচ্ছে আলো হতে। যেমনটা সুরভীও বঞ্চিত তুরানের স্নিগ্ধ ভালোবাসা থেকে। হয়তো আজ তুরান যদি বলতো,
“আমার তোমার জন্য চিন্তা হয়, আমি চাই না তুমি ঘুমের ঔষধের অভ্যাস করো”

তাহলে হয়তো সুরভী তার সাথে বিদ্রোহ করতো না, জেদ করতো না। কিন্তু তুরান তা বলে নি। ভালোবাসাটা দায়িত্বের কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে। থাকুক কিছু জিনিস লুকায়িত, যদি কোনোদিন সুখের নীড়ের খোঁজ পায় তবে নাহয় সেই ভালোবাসাটা উন্মুক্ত করবে। তত দিন কি খুব দেরি হয়ে যাবে, হয়তো হবে।

রাতের গাঢ়ত্ব বাড়ছে। কম্বল টা গলা অবধি টেনে শুয়ে পড়েছে সুরভী। চোখ বন্ধ করতেই ঘুমের ঔষধ তার কার্যকারিতা দেখালো। ঘুমের সাগরে হারিয়ে গেলো সে। যখন ঘুম ভাঙ্গলো বাহিরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সব। তীব্র বর্ষনের শব্দ কানে আসছে। গাছগুলো একে অন্যের সাথে সংঘর্ষ করছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষায়। শীতকালে এমন বৃষ্টি হয় বুঝি! জানা ছিলো না সুরভীর। সেই সাথে মেঘের তীব্র গর্জন কানে এলো। তীব্র হুংকার জানাচ্ছে ক্রোধিত মেঘের দল। জানালার গ্রিল গলে প্রবেশ করলো আলোর ঝলকানী। ছোটবেলা থেকে ভীতু সুরভী, তীব্র আওয়াজে তার ভয় হয়। ফলে বজ্রপাতের প্রবল শব্দে কেঁপে উঠলো সে। পাশ ফিরতেই তুরানের ঘুমন্ত শান্ত মুখখানা দেখতে পারলো। আলোর ঝলকানিতে আরোও শান্ত ঠেকলো মুখখানা। সুরভী খানিকটা এগিয়ে ভীতু বিড়াল ছানার মতো তার বুকে ঠাঁয় নিলো। পিঠের দিকটা খামচে ধরলো। থেমে থাকা মেঘেদের গর্জন আবারো কানে এলো। মুখ লুকালো বলিষ্ঠ বুকখানায়। তখন অনুভূত হলো তুরানের হাতের বাধন দৃঢ় হলো। এ কি কেবল ই ঘুমের ঘোর! নাকি ইচ্ছাকৃত বুঝলো না সুরভী। তবে বুকের মাঝে উঁকি দেওয়া ভয়টা ক্ষীণ হলো, নেত্রপল্লব নেমে এলো ঘুমের তীব্রতায়। নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্ক চিন্তা ছেড়ে দিলো। তলিয়ে গেলো ঘুমের সাগরে__________

******

শেফালী বেগমের মুখখানা ভীড় জমিয়েছে আষাঢ়ের মেঘমেদুর। ভীষণ উত্যোক্তবোধ করছেন তিনি। কোথা থেকে একটি কুকুরছানা এনে জুটিয়েছে রোদ্দুর, সারা ঘর তছনছ করে দিচ্ছে। এখানে পায়খানা করছে, ওখানে প্রসাব। ছিঃছিঃ কি অবস্থা। এই তো গত পরশুদিন, ইস্ত্রী করা কাপড় এনেছিলেন। গুনে গুনে পয়ষট্টিটি কাপড়। অতর্কিতে প্রসাব করে দিলো! ভাবা যায়। রোদ্দুরকে বলতেই সে নির্বিকার। যেনো তার কিছু যায় ই আসে না। আজও একই কাজ করেছে ব’জ্জা’ত কুকুরটা। সাধের কার্পেট নষ্ট করে দিলো। আজ এর একখানা বিহিত করবেন ই শেফালী বেগম। ঘুম থেকে উঠুক রোদ্দুর।

আজ ডিউটি নেই, রবিন ভাইকে জানিয়ে দিয়েছে রোদ্দুর। বহুদিন পর বেলা অবধি ঘুমিয়েছে সে। ডাক্তার মানেই সকল ঘুমের জ্বলাঞ্জলি দেওয়া। রাত নেই দিন নেই ডিউটি, মনোরোগবিষেশজ্ঞদের যন্ত্রণা আরোও অধিক। মস্তিষ্কের ব্যামোদের সাথে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে নিজেদের ই মস্তিষ্ক ই খারাপ হয়ে যাবার যোগাঢ় হয়। এই যেনো রুম নম্বর তিনশত তিন কেবিনের রোগী। বৃদ্ধার ডিসোসিয়েটিভ এমনেশিয়া হয়েছে। সেকারণে তার মনে হয় তিনি একজন পর্বতআরোহী। সেদিন তো এতোটাই ক্ষেপে উঠেছিলো যে মোটামোটি তিনি এভারেস্ট জয় করেই দম নিবেন। তারপর কোনোমতে রোদ্দুর এবং রবিন তাকে থামালো। কিছু কিছু রোগী মা’র’তে তেড়ে আসে। এদের নিয়েই রোদ্দুরের দিন কাটে। এদের থেকে তুলিকা ঢের ভালো। তুলিকার কথা মনে পড়তেই ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠলো রোদ্দুরের। ঘর থেকে বের হতেই কুকুরছানাটা লেজ উঠিয়ে তার পায়ের কাছে ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। রোদ্দুর তার একটি নাম দিয়েছে, যেহেতু সে মেয়ে তাই তার নাম “তুলতুল”। “তুলতুল” বললেই সে ছুটে আসে। তুলতুলকে আদর করতেই মায়ের তীক্ষ্ণ কন্ঠ কানে এলো,
“এই আপদকে কবে বের করছো?”

রোদ্দুর চোখ তুলে চাইলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“কি করেছে আজ?”
“আমার কার্পেট নষ্ট করেছে”
“আচ্ছা, আমি কিনে এনে দিবো”
“এসব কি শুরু করেছো তুমি। আগে তো কোনো দিন এমন অভ্যাস ছিলো না। রাস্তা থেকে কুকুর তুলে আনার স্বভাব কি নতুন চাষ করছো?”

রোদ্দুর হাত ধুলো, তারপর খাবার টেবিলে বসতে বসতে বললো,
“স্বভাব চাষ করে জানতাম না”
“ফাজলামি করবে না, রোদ্দুর”
“করলাম না”
“এই আপদ বের করো তুমি”
“পারলাম না, বড়জোর তাকে অন্যথায় রাখতে পারবো। আর মা, একটু ঠান্ডা হও। একটি নির্বাক নিরীহকে এতো ঘৃণা না করলেই পারো। এই নির্বাক প্রাণের থেকে তো কার্পেট বেশি জরুরি নয়”

রোদ্দুরের দায় সাড়া কথায় রীতিমতো অপ্রসন্নই হলেই শেফালী বেগম। ভীষণ রাগান্বিত স্বরে বললেন,
“এই থামো তো। জ্ঞান দিও না”
“দিলাম না”

বলেই পাউরুটিতে কামড় বসালো রোদ্দুর। শেফালী বেগম তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। নাকের কাছে চামড়া টেনে ধরে মাথা যন্ত্রণা উপশম করার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন,
“বড় খালা আসছে”
“ভালো কথা”
“মোটেই নয়, এবার যদি তুমি তার সাথে বাজে ব্যবহার করো আমি কিন্তু ঘর ছেড়ে চলে যাবো”
“আমার কি দোষ, কে বলেছে উনাকে আমার জন্য মেয়ে খুঁজতে”
“অদ্ভুত খুঁজবে না? বয়স কত হলো জানা আছে? চুলেও পাঁক ধরলো বলে”

রোদ্দুরের মাঝে ভ্রুক্ষেপ দেখা গেলো না। সে নির্লিপ্ত গলায় বললো,
“বাবা যখন তোমায় বিয়ে করেছিলো শুনেছিলাম তার একটি চুলও কালো ছিলো না। তাহলে বলা যেতেই পারে এটা বয়স নয়, জেনেটিক্যাল সমস্যা”
“রোদ্দুর, থা’প্প’ড় খাবে কিন্তু। এবার যার সম্মন্ধ এনেছে আপা, মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে”
“কংগ্রেচুলেশন, বিয়ে করে ফেলো। যদিও রংধনুর ব্যাপারটায় আমার আপত্তি আছে। সমাজ ও ভালো চোখে দেখে না। রীতিমতো বাসায় ভাঙ্গচুর ও হবার সম্ভবনা রয়েছে। কিন্তু ছেলে হিসেবে আমি মেনে নিবো নে”
“রোদ্দুর”

এবার ক্ষেপে উঠলেন শেফালী বেগম। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
“ফাজলামি বন্ধ করবে?”
“আই এম ড্যাম সিরিয়াস মা, আমার মুখ দেখ। আমি কি হাসছি? তারমানে আমি ফাজলামি করছি না। তুমি করছো। মেয়েটিকে তোমার পছন্দ আমার নয়। আমার যখন কোনো মেয়ে ভালো লাগবে তোমার বলা লাগবে না। নাচতে নাচতেই বিয়ে করে নিবো”
“তোমার পছন্দ আমার ঢের জানা আছে। কি ভেবেছো, বুঝি না আমি। ওই পাগলিটার সাথে মেলামেশা তো বেড়েছে দেখছি”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি