নীড় হারা পাখি পর্ব-১৭+১৮

0
285

#নীড়_হারা_পাখি
#১৭তম_পর্ব

রোদ্দুরের কথায় এবার ক্ষেপে উঠলেন শেফালী বেগম। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,
“ফাজলামি বন্ধ করবে?”
“আই এম ড্যাম সিরিয়াস মা, আমার মুখ দেখ। আমি কি হাসছি? তারমানে আমি ফাজলামি করছি না। তুমি করছো। মেয়েটিকে তোমার পছন্দ আমার নয়। আমার যখন কোনো মেয়ে ভালো লাগবে তোমার বলা লাগবে না। নাচতে নাচতেই বিয়ে করে নিবো”
“তোমার পছন্দ আমার ঢের জানা আছে। কি ভেবেছো? বুঝি না আমি। ওই পাগলিটার সাথে মেলামেশা তো বেড়েছে দেখছি”

এবার চোখ তুললো রোদ্দুর। চোয়াল তার চর্বণ থামালো। দৃষ্টি স্থির। হাতে থাকা আধখাওয়া পাউরুটিটা প্লেটে রেখে দিলো। ধীর কন্ঠে বললো,
“সে পাগলি নয়, তার একটি নাম আছে। তুলিকা, এতো সুন্দর নাম থাকতে পাগলীটা শুনতে ভালো লাগছে না”

রোদ্দুরের ভনীতাবিহীন কথাটা মনে ধরলো না শেফালী বেগমের। অপ্রসন্নতা ফুটে উঠলো মুখে। শ্যামা মুখখানায় জমলো আষাঢ়ের মেঘমেদুর। ভ্রু কুঞ্চিত হলো। হিনহিনে স্বরে বললেন,
“এতো দূর নাকি? পাগলীকে পাগলী বলা যাবে না। তাহলে কি বলবো ম্যাডাম তুলিকা?”
“বলতে পারো, আমার আপত্তি নেই”

রোদ্দুরের ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে আরোও তেতে উঠলেন শেফালী বেগম। ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
“তুমি কি ঐ মেয়ে ভালো টালো বাসো? আমি কিন্তু ঘর ছাড়বো বলে দিলাম। সারাজীবন মানুষ করবো আর শেষ অবধি পাগল বউ ঘরে আনবে, আমি মানছি না”
“মা, তুমি ওভাররিয়েক্ট করছো না?”
“আমি ওভাররিয়েক্ট করছি? আমি? বেশ করছি। কারণ তুমি আন্ডাররিয়েক্ট করছো? সত্যি করে বলো ভালো টালো বাসো নাকি মেয়েটিকে?”

এবার একটু নড়ে চড়ে বসলো রোদ্দুর। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় প্লেটের দিকে। কিছুসময় ভাবলো। নিজের অন্তস্থলে খুঁজলো মায়ের প্রশ্নের উত্তর। অপরদিকে শেফালী বেগমের মুখখানায় উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেলো প্রবল ভাবে। তিনি ছেলের মুখে উত্তর শোনার জন্য অধীর হয়ে যাচ্ছেন। মিনিট পাঁচেক পর রোদ্দুর হাসলো। দূর্বোধ্য হাসি। তার হাসি আরোও উদ্বিগ্ন করে তুললো শেফালী বেগমকে। রোদ্দুর হাসি অক্ষত রেখে বললো,
“ভালোবাসা কি মা? যদি কোনো ব্যাক্তিকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া, তাকে নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তা করা, তার ব্যথিত হৃদয় নিজের বিষাদের কারণ হওয়া, তার স্নিগ্ধ মুখখানায় ক্লান্তি ভোলা, হৃদস্পন্দনের গাঢ়ত্ব তার একটি স্পর্শ ভালোবাসা হয়; তবে আমি তুলিকাকে ভালোবাসি”

বলেই উঠে দাঁড়ালো রোদ্দুর। তুলতুলকে কোলে তুলে নিলো। তার গায়ে আদর আদর করতে করতে বললো,
“আমি ওকে নিচে রাখার ব্যবস্থা করবো। সুতরাং তোমার কুঞ্চিত ভ্রুজোড়াকে একটু সোজা করতে পারো”

রোদ্দুরের কথা কানে তুললেন না শেফালী বেগম। কারণ তার মস্তিষ্কে একটি বাক্য পর্যাবৃত্ত গতিতে ঘুরছে “রোদ্দুর তুলিকাকে ভালোবাসে”। এই বিষয়টা প্রচন্ড ভাবাচ্ছে। চিন্তায় ঘামছেন তিনি। নিজের ছেলের স্বভাব তার খুব ভালো করে জানা। সে যে তুলিকাকে বিয়ে করেও বাড়ি তুলতে পারে তারও সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। নিজের ছেলের পাশে ওই পাগলীকে কিছুতেই চিন্তা করতে পারছেন না শেফালী বেগম। এই ব্যাপারটার একটা সমাধান করতেই হবে। যেভাবেই হোক_________

******

দেখতে দেখতে আরোও একটি বছর মিলিয়ে গেলো কালগহ্বরের গভীরতায়। নতুন বছরের নতুন দিবালোকের ছোঁয়ায় মিশে ছিলো তীব্র শীতের ছোঁয়া। হাড়কম্পন শীতের নতুন সকালে হুডিটা কপাল অবধি টেনে হেটে চলেছে তিতির, শৈত্য প্রবাহের কবলে যখন সারা শহর ঘুমন্ত, তার পা জোড়া এগিয়ে যাচ্ছে কোচিং এর দিকে। মোটা জ্যাকেটের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করছে হীমময়ী সূক্ষ্ণ হাওয়া। ঠোঁটজোড়া কাঁপছে মৃদু। শীতল হাত দুটো ঘষে উষ্ণ ফু দিলো। কিন্তু গরম হলো না। শিশির ভেজা সকালের মৃদু গন্ধ নাকে ঠেকছে, শুকনো পাতা গুলো জানান নিচ্ছে, “বছর শেষ, সব জীর্ণতা কেটে নতুন ভোর এসেছে”। এর মাঝেই মোটরবাইক শাই করে পাশ কাটলো। ফলে তীব্র হীম বাতাসের প্রহার থেকে রক্ষা পেলো না তিতির। হুডিটা পড়ে গেলো, অর্ধখোলা চুলগুলো আরোও অবিন্যস্ত হয়ে গেলো। বিরক্ত নিয়ে তাকাতেই দেখলো বাইকটা আর কারোর নয় সৌভিকের। একটা কালো জ্যাকেট পড়ে বেশ ধুম মাচালে স্টাইলে লিটনের বাইক উড়ালো সে। মূহুর্তেই মিলিয়ে গেলো দৃষ্টি সীমার বাহিরে। ফলে বিরক্তিটা গিলে ফেললো তিতির। এই পুরুষটিকে আজকাল খুব বেশী ই নজরে পরছে। প্রতিটি কোচিং এর বাহিরে বন্ধুকে ব’গ’ল’দা’বা করে নিয়ে হাজির হয়। প্রথম কয়েকদিন ভেবেছে এটা হয়তো কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু আল্লাহ এর তিরিশ দিন কি কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে? তিতির ফোঁস করে বক্ষস্থলে জমা দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়লো। এখন এই মানুষকে নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। কোচিং এ দেরি হচ্ছে।

কোচিং থেকে মুখভার করে বের হলো তিতির। আজ স্যার ক্লাস নিবেন না। কারণ তার শরীর ভালো নেই। কিন্তু মহাশয় আগে জানান নি। জানলে হয়তো সকাল সাতটায় ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আসতে হতো না। লোকটি এই সর্বদা কাজ করে। কখনোই সে আগ থেকে জানায় না। এসে এসে ফিরে যেতে হয়। নেহাৎ এটা রসায়ন, নয়তো কখনোই আসতো না ঘুম মাটি করে। রসায়ন একটি অদ্ভুত বিষয়। এর সন্ধি বিচ্ছেদ করলে হবে রস+আয়ন কিন্তু তিতির এই বিষয়ে রসের “র” ও খুঁজে পায় না। কিসব নিয়ম দুটি মৌল একত্রে মিলিতো হয়ে যৌগ তৈরি করবে, মৌলদ্বয় অষ্টক নিয়ম মানবে। কিন্তু ফসফরাস পেন্টাক্লোরাইডের বেলায় শেষ কক্ষপথে হয় ১০টি ইলেক্ট্রন। কথা বললেই ব্যাতিক্রম নিয়ম। কোনো কথা? তিতিরের ক্ষমতা থাকলে এই বিষয়ের নাম দিতো রসবিহীন আয়ন। চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো বান্ধবীর কন্ঠে। সামনে তাকাতেই তিতিরের মুখখানা বিকৃত হলো। স্যারের বাসার বিপরীতে অর্ধখুড়া ড্রেইনের বাসে বাইকের উপর বসে আছে সৌভিক। লিটন সিগারেটে থেকে থেকে সুখটান দিচ্ছে। তিতিরের সাথে চোখাচোখি হতেই সৌভিক দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কিন্তু তিতিরের দৃঢ় বিশ্বাস সে তাকেই দেখছিলো। তিতির সময় নষ্ট করলো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। তিতিরকে আসতে দেখেই সৌভিক দাঁড়িয়ে গেলো। বা হাত দিয়ে ঘাড় চুলকাতে লাগলো সে। বিনা ভনিতায় তিতির বলে উঠলো,
“আচ্ছা, আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো? যেখানে যাই না কেনো, ছা’গ’লের কান মু’লে, বন্ধুকে ব’গ’ল’দা’বা করে হাজির হন! কি সমস্যা? আজ একটা রফাদফা হোক”

তিতিরের প্রশ্নের বানে কুপোকাত সৌভিক। সে চমকালো, ভড়কালো। কিন্তু প্রকাশ করলো না। সমান আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বললো,
“এহ! রাস্তা কি তোমার আব্বার কেনা?সেখানে তার একমাত্র কন্যা তিতির ব্যা’তীত আর কেউ চলতেই পারবে না। শোনোমেয়ে আমি হলাম স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। এই সব রাস্তায় বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অধিকার আছে আমার”
“তাই বলে শুধু আমার কোচিং এর সামনেই? সকাল সাতটায়?”

তিতিরের পাল্টা প্রশ্ন পুনরায় ভ্যাবাচেকা খেলো সৌভিক। উত্তর হাতড়ালো কিছু সময়। চোটপাট ক্ষীন হলো, কিন্তু থেমে গেলে তো ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে তাই দ্বিগুন চেত দেখিয়ে বললো,
“উন্নয়নের জোয়ার দেখতে এসেছি কোনো সমস্যা? এই যে ড্রেইন খুড়ছে, এটা দেখতে এসেছি। নাগরিক হিসেবে দেশের উন্নয়ন দেখা আমাদের কর্তব্য! তোমার সমস্যা আছে?”

তিতির কিছু সময় চেয়ে রইলো। চোখে তার বিস্ময়। এই লোক সাতসকালে ড্রেইন খুড়া দেখতে এসেছে সত্যি! সন্দিহান স্বরে বললো,
“ড্রেইন খুঁড়া দেখছেন?”
“হ্যা, এতেও আপত্তি?”
“দাঁড়িয়ে আছেন কেনো, একটু ঝাপ দিন। হয়তো হারিয়ে যাওয়া মস্তিষ্ককোষগুলো খুঁজে পাবেন”

বলেই উলটো দিকে পা বাড়ালো তিতির। পেছন থেকে সৌভিকের ফাঁটা গলায় গান কানে এলো,
“চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
হার মেনেছে দিনের আলো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো
চুমকি চলেছে একা পথে”

গানটি কর্নপাত হতেই ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করলো তিতির। কিন্তু তাতে ভাবোদয় হলো না সৌভিকের। সে অন্যদিকে তাকিয়ে তার গান চালিয়ে গেলো। কি বিশ্রী কন্ঠ, রাস্তায় শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা কুকুরগুলোও উঠে পালালো_________

******

তিমিরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মস্তিষ্ক অচল, ক্লান্ত পা জোড়া হাটছে গন্তব্যহীন। এই তীব্র শীতেও ঘামছে সে। তবে কি শেষ অবধি জেলে যেতে হবে………………..

চলবে

#নীড়_হারা_পাখি
#১৮তম_পর্ব

তিমিরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মস্তিষ্ক অচল, ক্লান্ত পা জোড়া হাটছে গন্তব্যহীন। এই তীব্র শীতেও ঘামছে সে। তবে কি শেষ অবধি জেলে যেতে হবে! জেল নামক শব্দটা দুই অক্ষরের হলেও মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে সেটা একটি তীব্র ত্রাশের কারণ। এই জেল নামক শব্দটির সাথে আসে অপরাধী সিল। এই সমাজে মানুষ কখনো পরখ করে না কে দোষী বা অপরাধী। তারা শুধু দেখে তাদের চাক্ষুশ দৃশ্যটি। অথচ এটি যে বানোয়াট ও হতে পারে সেদিকে তাদের আগ্রহ থাকে না। ফলে জমাপুঞ্জি সম্মানটুকু বিসর্জন দিতে হয় মধ্যবিত্ত পরিবারটিকে। মধ্যবিত্ত মানুষের অর্থ থাকে না, তবে তাদের নিকট তাদের আত্মমর্যাদাটি সর্বদাই মূল্যবান বস্তু। অস্পৃশ্য বস্তুটাই তাদের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে উঠে। তিমিরের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমটি হলো না। শফিক সাহেব ইহজীবনে ঘুষ খান নি, তার বেতন ছিলো স্বল্প। চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে জুতোর তলা খসে যাবার মতো অবস্থা হএলো তিনি ঘুষ খান নি। হয়তো ঘুষ খেলে তার অট্টলিকা থাকতো। মাসের শেষে টুথপেষ্টের জন্য মারামারি হতো না, একটি রাবার ভাগ করে ব্যাবহার করতো না তিমির, তুলিকা, তিতির। আচমকা সিলিন্ডার শেষ হবার জন্য চুলো বন্ধ করে বসে রইতে হতো না তাদের। কারণ শফিক সাহেবের কাছে তার আত্মসম্মানটি বড় ছিলো। অর্থ বিভবের মাঝে কাঁধ বাকিয়ে নিজের চোখে ছোট হয়ে থাকার চেয়ে মধ্যবিত্ত ট্যাগটুকুকে আলিঙ্গন করে বাঁচা ঢের ভালো। তার এই মনোভাবটি তুরানের মাঝেও রয়েছে। তুলিকার সাথে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার পর থেকে যখন সব খুঁইয়ে এখানে সংসারের হাল ধরেছিলো সে চাইলেই তার পকেট ভারী করতে পারতো। কিন্তু ঘুষখোরের ট্যাগ নিজের ঘাড়ে লাগানোর ইচ্ছে তার ছিলো না। অথচ আজ তিমিরের ভেতরে উঁকি দিয়ে তীব্র ভয়। ভয়টি প্রচন্ড গাঢ়।

অভাবে জর্জরিত হয়ে নিজ বন্ধু বিশালের মতামতে একটি ফার্মে চাকরি নিয়েছিলো সে। বিশাল বলেছিলো এটি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কলসেন্টার। ভালো বেতন। ভালোই তো চলছিলো তিমিরের জীবন। অভিলাষার ভেতরে নিজেদের স্বত্তার বৃদ্ধিও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটছিলো। কিন্তু আলোর মাঝেও কোথাও না কোথাও আঁধার লুকিয়ে থাকে। এমন কিছুটাই ঘটলো তিমিরের সাথে। যে কোম্পানিতে সে কাজ করছে তারা হয়তো বেআইনি কাজের সাথে জড়িত। গতকাল রাত সে এই ঘটনাটি জানতে পেরেছে। গতকাল সে যখন কাজে ব্যস্ত তখন তার কাছে একটি ফোন আসে। লোকটি ইংরেজী ছেড়ে অন্য একটি ভাষায় কথা বলছিলো। ভাষাগত অদক্ষতার জন্য তিমির বেশ ঝামেলাতেই পরে। তবে কথার ধরণে এতোটুকু বুঝতে বাকি রইলো না, লোকটি তাকে গালমন্দ করছে। বেশ তীব্র কন্ঠে শাসাচ্ছে। একটা সময় ফোনটি কেটে যায়। নিয়মগত কারণে ফোনকলটি রেকর্ড করা ছিলো। কৌতুহল বশত ট্রান্সলেটর দিয়ে যখন সেই বাক্যগুলো অনুবাদ করেছিলো সে, তখন জানতে পারলো। লোকটা ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলছিলো। এবং সে রেগে রয়েছে। এই রাগের কারণ এবার তারা সে পন্য কিনেছিলো সেটি ব্যাবহারের মাধ্যমে পাঁচজন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়েছে। সে লিগ্যাল একশন নিবে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে। কথাটি বিশালকে জানাতেই সে বলে,
“চিন্তা করিস না, শিপমেন্টটা ভুল হয়েছে। উনি আমাদের কাস্টোমার নন”
“আরে, তবুও অসুস্থ হবে কেনো?”

তিমিরের প্রশ্ন রীতিমতো এড়িয়ে যায় সে। তারপর বসের সাথে গোপনীয় ভাবে কিছু আলোচনা করে। তিমির পুনরায় তাকে শুধায়। কিন্তু তখন ও বিশাল কোনো উত্তর দেয় না। শুধু বলে,
“আম খা না, গুটি কেনো গুনছিস। টাকা পাচ্ছিস ভালো আর কি?”

সেখান থেকেই তীব্র সন্দেহের বীজ বপিত হয় তিমিরের হৃদয়ে। তার ক্ষীণ ধারণা হয়তো দুধের মোড়কে তারা অন্যকিছু দেশের বাহিরে পাঁচার করছে। সেই সাথে ভয়টাও গাঢ় হচ্ছে। এই চাকরিটা নিজ জিদেই নিয়েছে। অনাগত সন্তান এবং অভিলাষাকে টুকরো সুখের মুখ দেখাতেই এই প্রচেষ্টা কিন্তু সবকিছু ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সে কোনো চোরাবালিতে পা দিয়ে ফেলে নি তো! চিন্তার ঘোরে ছেদ পড়লো তিতিরের তীক্ষ্ণ কন্ঠে,
“এখানে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস ভাই? কলিংবেল দে”

তিমির কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। হকচকিত কন্ঠে বলল,
“কোথায়?”
“আমি বিগত পাঁচ মিনিট ধরে তোকে দেখছি। মিথ্যে বলছিস কেনো? তোর কি শরীর খারাপ কোনো কারণে? মুখে ফ্যাকাশে লাগছে কেনো?”

তিতিরের প্রশ্নের তীর বাড়লো। তিমির কিছুটা অস্প্রস্তুত হলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
“ঠান্ডা পরেছে তো, হয়তো সেজন্য এমন লাগছে”
“ঠিক বলেছিস, যে ঠান্ডা। বাড়ি যেয়ে বড়ভাবীকে বলবো এক কাপ গরম চা দিতে। ভেতরটাও কাঁপছে”

তিতিরের কথাগুলো কানে ঢুকছে না। তার মাথায় কেবল একটি চিন্তাই, তার কিছু হলে অনাগত বাচ্চাটির কি হবে! অভিলাষার কি হবে! মা কি করে নিজেকে সামলাবে?

মেয়েরা যখন মা হয় তখন তাদের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায়। অভিলাষার ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হলো না। শরীরে মেদ জমেছে। জীর্ণ শরীরটা এখন বেশ নাদুসনুদুস দেখায়। পেটটাও বেড়েছে খানিকটা। পুরোনো জামাগুলো শরীরে লাগে না। হিমা বেগম তাকে দু-তিনটে মেক্সি বানিয়ে দিয়েছেন। এতে করে শরীরটাও আঁটসাঁট হবে না, একটু শান্তিও লাগবে। গর্ভাবস্থায় শরীরে তাপ বেড়ে যায়। অভিলাষার ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম হলো না। রান্নাঘরে কিছুসময় থাকলে ঘেমে নেয়ে হাল খারাপ হয়ে যায়। হাড়কাঁপা শীতেও সে ফ্যানটা চালিয়ে রাখে। ভাগ্যিস তিমির থাকে না। নয়তো নির্ঘাত নিউমোনিয়া বেঁধে যেতো। গতকাল থেকে আরোও একটি মজার ঘটনা ঘটেছে। ভেতরে বাড়তে থাকা জীবনটা হাতপা ছুড়ে জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। রাতে হুট করেই পেটে তীব্র আঘাত অনুভূতি হয় অভিলাষার। ব্যাপারটা ঘুমের ভেতর প্রথমে বুঝতে পারে নি। দ্বিতীয়বার যখন অনুভূত হয়েছে তখন ই বুঝতে পারলো, রক্ত মাংসের মানুষটি তার অস্তিত্ব জাহির করছে। গদগদ হয়ে আশপাশ দেখতেই দেখলো ঘরে সে একা, তিমির নেই। সে তো তখন কাজে। তাকে ফোন করেছিলো। কিন্তু ফোন ধরে নি। অভিলাষাও ঘাটায় নি। কাজ করছে মানুষটা। সব তো তাদের জন্যই। তাই মনে মনে ঠিক করলো তিমির ফিরলেই তাকে জানাবে। তাই তো তিমির ফিরতেই নিজ হাতেই কড়া করে চা বানিয়েছে। ঘরে যেতেই দেখলো কপালে হাত দিয়ে শুয়ে রয়েছে তিমির। পা টিপে এগিয়ে গেলো সে। গলা খাকারি দিলো মৃদুভাবে। কপাল থেকে হাত সরালো তিমির। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো অভিলাষা চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার গালজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ঘন চুলগুলো খোঁপায় বাঁধা। পড়নে কমলা রঙ্গের মেক্সি, ওড়নাটা শালের মতো ঘিরে রয়েছে। ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি। তার শুভ্র গোলাপকে আজ কৃষ্ণচূড়ার মতো লাগছে। বসন্তে ফোঁটা প্রথম রক্তিম কৃষ্ণচূড়া। তিমির ক্লান্ত স্বরে বললো,
“কিছু বলবে?”

অভিলাষা মাথা দোলালো। তিমির উঠে বসতেই তার সম্মুখে বসলো। তার ডানহাতটা নিজের পেটের উপর রাখলো। আদুরে কন্ঠে বললো,
“একটা সারপ্রাইজ আছে”
“কি?”
“তুমি ওকে ডাকো। ও সাড়া দিবে”
“যাহ! ও কি শুনতে পারে নাকি?”
“ডেকেই দেখো না, সত্যি বলছি সাড়া দিবে”

অভিলাষার মাঝে সেই বাচ্চাটির প্রতিচ্ছবি লক্ষিত হলো সে বহু বায়নার পর প্রিয় পুতুলটি পেয়েছে। তিমির হাসলো। বউ এর বাচ্চামিটা মন্দ লাগছে না। তাই গাঢ় কন্ঠে বললো,
“আম্মাজান”

মূহুর্তেই হাতে অনুভূত হলো ছোট্ট একটি ধাক্কা, ধাক্কাটির বল খুব কম। তবুও সেই ধাক্কায় কেঁপে উঠলো তিমির। অবাক চোখে তাকালো অভিলাষার মুখোপানে। অভিলাষার চোখজোড়া টলমল করছে। কাঁপা স্বরে বললো,
“বলেছিলাম না, সাড়া দিবে”
“ও শুনতে পাচ্ছে অভিলাষা”
“হ্যা, এখন জানান দিচ্ছে। আমাদের স্বত্তা জানান দিচ্ছে”

অভিলাষা কথাটি শেষ হবার পূর্বেই শত চুমুতে ভরিয়ে দিলো তার মুখ। তিমির চোখে জমেছে সুখের ঢেউ নোনাজলের রুপে। হৃদয় কাঁপছে তার। অভিলাষা মৃদু স্বরে বললো,
“কাউকে জানাই নি, তোমাকে প্রথম জানাবো বলে”

তিমির তার পেটেও চুমু আঁকলো পাগলের মতো। অভিলাষা মানুষটির পাগলামি দেখলো। তারপর জড়িয়ে ধরলো তাকে গভীর আলিঙ্গনে। অভিলাষা বাঁধা দিলো না। এটা যে তাদের সুখের মূহুর্ত। হঠাৎ ই অভিলাষাকে ছেড়ে দিলো তিমির। তার হাতজোড়া নিজ হাতের ভেতর শক্ত করে ধরে ভয়ার্ত স্বরে বললো,
“কখনো যদি জানতে পারো আমি মানুষটাকে নিষ্ঠুর ভাগ্যের চোরাবালির কামড় প্রতিনিয়ত গিলছে, পাশে থাকবে?”

তিমিরের কন্ঠে ভয়ের ছাপ। অভিলাষা বুঝলো না ঠিক। চিন্তিত হলো কিছুটা। বিস্মিত স্বরে বলল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“ভাগ্যের কোনো ঠিক কি আছে? কখন কি হয়”
“আমি তোমার পাশে আছি, থাকবো। একসাথেই নাহয় ডুবলাম চোরাবালিতে, ক্ষতি কি?”

কিছু না ভেবেই কথাটা বললো অভিলাষা। তিমির হাসলো। মলিন, উদাস হাসি। সুখগুলো কি এতোটাই নিষ্ঠুর?

******

বারান্দার রেলিং মাথা দিয়ে বসে রয়েছে তুলিকা। ক্ষীন হিম বায়ুতে উড়ছে তার প্যাচানো কৃষ্ণচুল। পড়ন্ত বিকেলের কিরণ আছড়ে পড়ছে তার মুখে। তেজহীন আলোটা মন্দ লাগছে না। মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি কানে আসছে। ওড়নাটা টেনে দিলো সে। নিষ্প্রভ দৃষ্টি বাহিরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাতরাচ্ছে কিছু। বিগত সপ্তাহ দুয়েক ঘর থেকে বের হওয়া বারণ করে দিয়েছে মা। ধিঙ্গি মেয়ে রাস্তায় বের হয় ব্যাপারটি তার পছন্দ নয়। এদিকে ঘরের ভেতর ও যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেন অবাধ গগনে উড়তে থাকা কোনো বিহঙ্গিনীকে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয়েছে চার দেওয়ালের খাঁচায়। সে শ্বাস নিচ্ছে ঠিক ই, কিন্তু কোথাও যেনো দম আটকে আসছে। এর মাঝেই ছোট্ট কুকুরের ঘেউ ঘেউ কানে আসলো। তুলিকা নিচে তাকাতেই দেখলো সেদিনের এই কুকুরটি বারান্দার দিকে মুখ তুলে তাকে ডাকছে। তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আছে রোদ্দুর। সাদা একটি হুডি জ্যাকেট পরে আছে সে। তুলিকা তার দিকে তাকাতেই সে হাতের ইশারা করলো। তুলিকা বুঝলো না প্রথমে। কিছু সময় বাদে বুঝলো তাকে নিচে নামার কথা বলছে সে…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি