নীল কণ্ঠ পর্ব-০৭

0
489

#নীল_কণ্ঠ💜
#পর্ব-০৭
#সাদিয়া

নীল-কণ্ঠ কক্সবাজার এসেছে আজ দুই দিন। প্রথম দিন তারা কেউ হোটেল থেকে বের হয় নি খুব একটা। জার্নির ফলে তারা দুজনেই ভীষণ ক্লান্ত ছিলো যার দরুন প্রথম দিন কিছুক্ষণ ঘুরে টুরে বাকি সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে তারা। প্রথম দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে আজ তারা স্থানীয় মার্কেটে একটু ঘুরলো। তারপর তারা গেলো সি বিচে। সমুদ্রে পানি ঢেউ খেলছে। কণ্ঠ ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে একবার সামনে যাচ্ছে আবার পিছনে যাচ্ছে। খেলাটা যে কণ্ঠ দারুণ উপভোগ করছে তা তার খিলখিল হাসির শব্দেই প্রকাশ পাচ্ছে। কণ্ঠের ঝংকার তোলা হাসির শব্দে নীলের বুকে ঢোল বাজছে। নীল যেন নিজের কয়েকটা হৃৎস্পন্দন মিস করে গেলো। এই প্রথম নীল ভালো করে কণ্ঠকে খেয়াল করলো। লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফিট মতন হবে। নাকটা একটু চ্যপ্টা। কিন্তু চোখ দুটো মায়ায় ভরা। গায়ের রং একটু চাপা। এই মূহুর্তে নীলের মনে হলো শ্যমবতী আর শ্যামলতা শব্দ দুটো কণ্ঠের জন্যই প্রযোজ্য। পরক্ষণেই তার মনে হলো, নাহ্! শ্যামবতী বা শ্যমলতা উপাধি কণ্ঠের সাথে ঠিক যায় না। শ্যামবতী মেয়েদের সর্বাঙ্গে দয়া-মায়ার বিচরণ থাকবে। যা কণ্ঠের মধ্যে ছিটেফোঁটাও নেই। নীল কণ্ঠের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনেও আছে হাসি। এক সময় নীল অনুভব করলো কণ্ঠের হাসিমুখ দেখতে তার ভালো লাগছে। মানের মধ্যে অন্যরকম এক প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। আগে তো এমন কখনো হয় নি। তবে আজ কেন হচ্ছে? উত্তরটা নীলের জানা নেই। নীল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

নীল দেখলো কণ্ঠ বালুতে কিছু আঁকছে। কণ্ঠের কান্ডে নীলের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। কি করছে এই মেয়ে? আর আজকে এমন বাচ্চাদের মতো আচরণ কেন করছে? কণ্ঠ কি আঁকছে তা দেখতে নীল এগিয়ে গেলো কণ্ঠের দিকে। গিয়ে দেখলো কণ্ঠ একটা মানুষের ছবি এঁকেছে। না না ঠিক মানুষ নয়। এটাকে মানুষের চিত্র বললে মানুষের সকল চিত্র চরম ভাবে অপমানিত হবে। আর নীল সেটা করতে চায় না বলে সে এটার নাম মানুষের চিত্র দিলো না। নীলের চোখ আটকালো চিত্রের নিচে থাকা তিন অক্ষরের ইংরেজি লেখার দিকে। যেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে ❝Nil❞। নীল পূনরায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নীলকে দেখে কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
–দেখতো ছবিটা কেমন হয়েছে? একদম তোর মতো তাই না?
নীল কিছু না বলে সমুদ্রের পানির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
–তোর কি মন খারাপ নীল?
কণ্ঠ নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো। নীল এবারো নিরুত্তর।
–নীল তুই ঠিক আছিস?

–মনে হয় না।
বেশ সময় নিয়ে উত্তর দিলো নীল।

–মানে?

–জানি না রে। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। কি হচ্ছে আমার সাথে। কেমন অগোছালো লাগছে নিজেকে।

–এই জন্যই বলি গাঁ’জা টাজা কম গিল। কিন্তু আমার কথা শোনা তো তোর ধাঁচে নেই।
নীল শান্ত দৃষ্টিতে একবার কণ্ঠের দিকে তাকালো। সূর্যাস্তের কমলা আভায় কণ্ঠের মুখশ্রী কেমন স্নিগ্ধ লাগছে। কণ্ঠের ঘর্মাক্ত মুখটা অনেক বেশি মোহনীয় লাগছে নীলের কাছে। নীলের বুকের বা পাশটা ধক করে উঠলো। তার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসছে।

–এমন হাঁ’দার মতন তাকিয়ে আছিস কেন?

হাঁ’দা শব্দটা শুনে নাক সিটকালো নীল। নীলকে নাক কুঁচকাতে দেখে কণ্ঠ দুষ্টু হেসে বললো,
–এমনিতে তো আমার দিকে তাকাস না আর আজকে তাকিয়ে-ই আছিস। আমার প্রেমে পড়েছিস নাকি নীল?

–প্রেমে? তাও তোর? ইন ইউর ড্রিম। আমার এতটাও খারাপ সময় আসেনি আমি তোর প্রেমে পড়বো।

–আমার প্রেমে কেন পড়বি তুই? তুই তো পড়বি নীরার প্রেমে। যে তোকে মাঝরাস্তায় ফেলে চলে যাবে। হাহ্!

নীল মুখ বাঁকালো। সন্ধ্যার পরে তারা সমুদ্রের তীরে বারবিকিউ এর আয়োজন করলো। কণ্ঠ দক্ষ হাতে শুকনো কাঠ এনে তাতে আগুন জ্বালালো। বারবিকিউ প্রোগ্রাম শেষ করে তারা রিসোর্টে ফিরলো।
কণ্ঠ রিসোর্টে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। শাওয়ার নিয়ে বাইরে এসে রুমে নীলকে না দেখে একটু অবাক হলো কণ্ঠ। কোথায় গেলো সে? কণ্ঠ ভাবনার মাঝেই নীলের আওয়াজ পাওয়া গেলো,
–আমি বারান্দায়।

কণ্ঠ মুচকি হাসলো। তোয়ালেটা চেয়ারে মেলে দিয়ে কণ্ঠও বারান্দায় গেলো। নীল চোখ বন্ধ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কণ্ঠ একবার নীলের দিকে তাকিয়ে অন্ধকারে মন। কিছুক্ষণ বারান্দায় সময় কাটিয়ে কণ্ঠ রুমে চলে আসলো। তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কণ্ঠ রুমে আসার বেশ কিছুক্ষণ পর নীল রুমে আসলো। কণ্ঠ তখন ঘুমে বিভোর। ঘুমের মধ্যে কণ্ঠকে দেখতে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। নীল আলতো হেসে কণ্ঠের গায়ে ব্ল্যাংকেট চাপা দিয়ে কণ্ঠের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লো। নীল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কণ্ঠের দিকে। বাতাসে কণ্ঠের অবাধ্য চুল গুলো তার বার তার মুখে এসে পড়ছে। নীল আলতো হাতে কণ্ঠের চুলগুলো ওর কানের পেছনে গুজে দিলো। বাকিটা রাত নীল কণ্ঠকে দেখে কাটিয়ে দিলো।

কক্সবাজারে আরো দুইদিন কা’টিয়ে ঢাকায় ফিরে নীল আর কণ্ঠ। ঢাকায় ফিরতেই শুরু হয় তাদের ব্যস্ততা। আবারো সেই রোজকার রুটিন। এর মধ্যে রাফাতও তার প্রেমিকার সাথে সাজেক ট্যুর থেকে ফিরে এসেছে। রাফাত ঢাকায় পা রাখতে না রাখতেই শৈবাল তাকে নিজস্ব কায়দায় তুলে আনে। তাকে আপাতত নীরার পাশের রুমে ব’ন্দী করে রাখা হয়েছে। অফিস থেকে কণ্ঠ সেখানে-ই যাবে। কণ্ঠের আজকে অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু কাব্য একটা গন্ডগোল পাকিয়েছে। সেটা ঠিক করতেই তাকে যেতে হচ্ছে।
কণ্ঠ অফিসে এসে দেখলো কাব্য নিজের কেবিনে মাথা নিচু করে বসে আছে। কণ্ঠ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ভাইয়ে দিকে। কাব্যের কাঁধে হাত রাখতেই কাব্য কণ্ঠকে জারিয়ে ধরলো। কিয়ৎক্ষণ পর কণ্ঠ নিজের কাঁধে ভেজা অনুভব করলো। তার মানে কাব্য কাঁদছে। কণ্ঠ একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। তারপর কাব্যকে সোজা করে বসালো।

–কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই?
কাব্য অস্পষ্ট সুরে উত্তর দিলো,
–আমি ইচ্ছে করে করি নি।

–কাউকে খু’ন টুন করেছিস?

কাব্য না বোধক মাথা ঝাকালো।
–তাহলে এমন মেয়েদের মতো কাঁদছিস কেন? আর সামান্য এক্সি’ডেন্ট হয়েছে বেশি কিছু না। আর আমি আসার সময় মেয়েটাকে হাসপাতালে দেখে এসেছি। সে এখন ঠিক আছে। তুই প্যারা নিস না। আমি আছি তো।

–বিশ্বাস করো আপু আমি ইচ্ছে করে করি নি।

–আমি জানি আমার ভাই ইচ্ছে করে কারো ক্ষতি করতে পারে না। চিনি আমি আমার ভাইকে। তাই রিল্যাক্স। আর মেয়েদের মতো এতো কাঁদতে হবে না। মেয়েদের মতো এতো কাঁদলে পরে তোর বিয়ের জন্য মেয়ে পাবো না রে ছাগল।
কণ্ঠের কথায় এবার কাব্য হেসে ফেললো। হেসে কণ্ঠকে জরিয়ে ধরলো। কণ্ঠও ভাইকে পরম যত্নে জরিয়ে ধরলো।

–আব্বু কোথায় আপু?

–আব্বু হাসপাতালে। মেয়েটার রিলিজ করিয়ে একেবারে আসবে।

–রিলিজ? আজকে?

–হ্যাঁ। ও বেশি ব্যথা পায়নি তো। শুধু ডান হাতে একটু ফ্যাকচার হয়েছে আর কপাল সামান্য কে’টে গেছে। তুই টেনশন নিস না।
কাব্য মাথা দুলালো।
–শোন তুই এখন বাড়ি চলে যা। বাড়ি গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিবি। তারপর ঘুমাবি। এর বাইরে কিছু করলে কঠিন মা’ইর। চল তোকে বাসায় দিয়ে এসে আমি এক জায়গায় যাবো।

–তুমি কোথায় যাবা?

–আমিও চলে যাবো। আমার একটু কাজ আছে।

–আচ্ছা চলো।
কণ্ঠ কাব্যকে তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিলো।
–আপু ভেতরে আসো।

–আজ না। আজ আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। অন্য একদিন আসবো পাক্কা।

–ঠিক আছে। সাবধানে যেও।

কণ্ঠ মুচকি হেঁসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিছুদূর যেতেই কণ্ঠের ফোন বেজে উঠলো। কণ্ঠ গাড়িটা এক সাইডে পার্ক করে ফোনটা রিসিভ করলো।

–আস্সলামু আলাইকুম মামনি।

নীলিমা সালামের উত্তর দিয়ে বললো তারা আর্জেন্ট নীলের নানু বাড়িতে যাচ্ছে। সে যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে কেউ নেই। তিনি নীলকেও আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেতে বলেছেন। কণ্ঠ ঠিক আছে বলে ফোন কেটে দিলো। আজ আর রাফাতের এখানে যাওয়া হলো না। কাজটা আধুরা রয়ে গেলো। কণ্ঠ ফোন করে শৈবালকে বলে দিলো সে আজ যেতে পারবে না। রাফাত আর নীরাকে যেন ঘুমের ইন’জেকশন দিয়ে দেওয়া হয়।
শৈবালের সাথে কথা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো কণ্ঠ। নিজের আপন মানুষগুলোকে বাঁচাতে কতো কিছু করতে হয়।

#চলবে….ইনশাআল্লাহ