নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-১০

0
5711

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_১০||
;
;
;

রুমের ভেতর হালকা অন্ধকার, কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে কিছু কিছু আলোর ঝলক রুমে অনায়াসে ঢোকায় আবছা আবছা সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে হিমের সুদর্শন মুখটাও বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না মুনের।

মুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“এসবের মানে কী, হিম? এভাবে টেনে এনে একটা রুমে ঢুকিয়ে দরজা কেন লাগিয়ে দিলি?”

হিম শীতল কণ্ঠে বললো,
—“আমার তোর সাথে কিছু কথা আছে।”

মুন রেগে বললো,
—“কথা আছে বুঝলাম। তাই বলে এখানে এভাবে কথা বলার কী দরকার? বাইরে কি কোনো জায়গা নেই নাকি? যত্তসব! ”
বলেই হিমকে পাশ কাটিয়ে দরজা খোলার জন্য এগিয়ে যেতে লাগলো। ওমনি হিম হাত ধরে টেনে নিজের সামনে ধাক্কা দিয়ে দাঁড় করালো।

—“আমার কথা না শুনে কোথাও যেতে পারবি না তুই। আচ্ছা, আমায় এই সাত বছর ধরে দেখে কি তুই কিছুই বুঝতে পারিসনি? আমার ফিলিংস গুলো আমি কখনো মুখে প্রকাশ করিনি, বাট তোর কি কখনো এটা মনে আসেনি যে, আমি তোকে ভালোবাসতে পারি?”

মুন কপাল কুঁচকে বললো,
—“কী যা তা বলছিস তুই? তোকে শুধু আমি আমার বন্ধু ভেবেছি সারাজীবন। অর্ণব, রাদিফ যেমন আমার ভাই-ব্রাদার-বন্ধু, তুইও আমার কাছে ঠিক তাই। কিন্তু সেটা ছিলি, আজ থেকে তোকে আমি চিনি না।”

হিম আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“আমার দিকটা তুই একবার ভাববি না, মুন? তোকে আমি ভালোবাসি, সেই সাতবছর আগে থেকে। কখনো বলিনি আমাদের বন্ধুত্ব ভেঙে যাবে এই ভয়ে। ভেবেছিলাম, নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দ্যান বলবো।

—“তো আমি এখন কী করবো? আমি এখন আর কুমারী নেই, আমি এখন অন্য কারো স্ত্রী। আর আমার হাসবেন্ডকেই আমি ভালোবাসি, অন্য কাউকে সে জায়গাটায় বসাতে পারবোনা। ”

—“তোর হাসবেন্ড কি তোকে ভালোবাসে? বাসলে বাসুক, তুই তাকে ডিভোর্স দিয়ে দে, প্লিজ। আমি তোকে তার থেকেও বেশি সুখে রাখবো।”

ওর মুখে এসব কথা শুনে মুনের প্রচুর রাগ উঠছে, মন চাইছে কষিয়ে কতোগুলো চড় লাগাতে। নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো,
—“তোর কথা শুনে আমি কেন চলবো। তোকে আমি কোনোদিন ভালোবাসতে পারবো না। আমার সামনে আর কখনো আসবি না তুই। ”

এবার ঝট করে নিজের রূপ বদলে আসল রূপে ফিরে এলো হিম। হিমের চোখ মুখ দেখে ভীষণ হিংস্র মনে হচ্ছে। মুন আশে-পাশে একবার তাকালো, তারপর হিমের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগলো। হিম ওর হাত ধরে একটানে একটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো এবং ওর সাথে পুরো ঘেষেঁ দাঁড়ালো। মুন ওকে নিজের কাছ থেকে সরাতে সরাতে বললো,
—“ছাড় আমায়, হিম। কী করছিস তুই? যেতে দে আমায়। আমি কিন্তু চিৎকার করবো!!”

হিম দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো,
—“কর, যতো জোরে ইচ্ছে হয় চিৎকার কর। আজ কে তোকে বাঁচাতে আসে আমিও দেখবো। এই জায়গায় এখন কেউ আসবে না, আর তোর চিৎকারও শুনতে পাবে না।”

এদিকে,,,,
অর্ণব নিজের ঘড়ি দেখতে দেখতে বললো,
—“সেই কখন গেছে মেয়েটা! কোনো হদিস আছে ওর? এতো টাইম তো লাগার কথা না! কী কস তোরা?”

রুহি বললো,
—“আসলেই তো! চল এগিয়ে যেতে দেখি। ”
বাকিরা ‘চল’ বলে এগুতে লাগলো।

মুন বারবার হিমকে নিজের থেকে ধাক্কিয়ে দূরে সরাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। এতো ধাক্কা ধাক্কিতে বিরক্ত হয়ে হিম মুনের দুই হাত পিছনে নিয়ে মুচড়ে একহাত দিয়ে চেপে ধরলো। মুন নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে, এতে হিমের নখের আঁচড় লাগছে অনবরত। এতোক্ষণ নিজেকে শক্ত রাখলেও এখন অনেক নিস্তেজ লাগছে নিজেকে।
—“তুই এতোটাও জঘন্য আর নোংরা, আমার ভাবতেও ঘৃণা করছে! আমায় তুই কী ভালোবাসিস এটাই তার নমুনা। ছিহ্!!”
মুনের চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি পড়ছে। কিন্তু হিমের পাষাণ হৃদয় তাতে গলবার নয়।

হিম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“আমার যেটা একবার চাই, সেটা আমার চাইই চাই। তোকে ভালোভাবে বলেছিলাম, শুনিসনি। এখন তাই এ পদ্ধতি অবলম্বন করছি।”
বলেই মুনের হিজাবের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ঘাড়ে খামচে ধরলো, এতে হিজাবে জোরে টান লাগে ও পিনগুলো মুনের কানে, গালে ও মাথায় হালকা ঢুকে যায়। মুন জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে।

এদিকে মুনের চিৎকার শুনে অনিতা বললো,
—“আমার মনে হয়, কেউ ওদিক থেকে জোরে চিৎকার দিলো। কেন যেন মনে হচ্ছে, ওটা মুনের গলা ছিলো। ”

রাদিফ দৌড় দিতে দিতে বললো,
—“মনে হয় না, ওটা মুনের গলাই ছিল। ঐ ভবন থেকে আসছে। কাম ফাস্ট, গাইস।”

সবাই ঐ বিল্ডিং এর বারান্দায় গিয়ে দেখলো, সবগুলো রুমের দরজা তালা দেয়া হলেও একটা রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অর্ণব সবার দিকে একবার তাকিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো,
—“কে ভেতরে? দরজা খোল।।”

মুন অর্ণবের গলার স্বরে চিনে ফেলে ও জোরে বললো,
—“অর্ণব, হেল্প মিইইইই!”
হিম মুনের মুখ চেপে ধরে, এতে গালে মুখে নখ ঢুকে যায়।

এবার রাদিফ বলে উঠলো,
—“ভেতরেই মুন আছে। অর্ণব দোস্ত, দরজা ভাঙ্গ।”

হিম অনেকটাই ঘাবড়ে গেলেও ওর হিংস্রতা আগের চেয়েও বেড়ে গেছে। ও মুনের দিকে নিজের মুখ এগিয়ে নিবে এমন সময় বিকট শব্দে দরজায় দু-তিনটা ধাক্কা পড়ায় দরজা ভেঙে যায় আর সবাই ভেতরে ঢুকে হিমকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে তাকিয়ে আছে।

সবাইকে দেখে হিম মুনকে ছেড়ে দিলো আর মুন দৌড়ে অর্ণব ও রাদিফের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—“দোস্ত, আমাকে বাঁচা। ওর মতো পশুর হাত রেখে আমায় বাচা প্লিজ। ”

অনিতা আর রুহি মুনকে নিয়ে বাইরে গেল। রাদিফ হিমের কাছে গিয়ে সজোরে একটা ঘুষি মারে ওর নাকে আর হিম দুরে ছিটকে পড়ে।

অর্ণব হিমের গাল চেপে ধরে বলে,
—“তোর সাহস কী করে হয় মুনের সাথে নোংরামি করার চেষ্টা করার? কেন করলি এমনটা? ”

হিম কাপা কাপা গলায় বলল,
—“আমি আ,আ,আমি মুনকে ভালোবাসি। ”

রাদিফ ওকে থাপ্রাতে থাপ্রাতে বললো,
—“শালা, ভালোবাসিস ওকে? তুই ভালোবাসিস? বা*** ভালোবাসিস তুই? আজ তো তোরে আমি মেরেই ফেলমু। কুত্তা কোথাকার!!!”
_______________

বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হিমকে পুলিশ এসে নিয়ে গেছে, রাদিফের ভাই নিকটবর্তী থানার এস. আই. হওয়ায় কোনো ঝামেলার মুখে পড়তে হয়নি। আর কেউ জানতেও পারেনি।

আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মুন। মুখে খামচির দাগ গুলো লাল হয়ে আছে, কানে, গালের সাইড দিয়েও পিনের আঁচড়। ঘাড়ের দিকে দাগ গুলো তেমন বোঝা যাচ্ছে না। সবাই এটা দেখলে কী উত্তর দিবে সে? চোখ দুটো ফুলে গেছে, তাও গড়গড় করে পানি ঝরছে শুধু। এমনটা কখনো ভাবেনি যে, তার সাথে এমন কিছু ঘটবে। হিমকে তো ও রাদিফ আর অর্ণবের চেয়েও বেশি আপন ভাবতো, কারণ হিম ওর সব কিছুতে অনেক বেশি হেল্প করতো। আর আজ সেই কিনা!! ভাবলেই কান্নার বেগ বেড়ে যায়।

এমন সময় জয় রুমে ঢুকলো। সারাদিনের কাজ শেষে এখন বাড়ি ফিরলো সে। এখনো জানে না তার ব্যবসায়ের ভবিষ্যৎ কী হবে? তবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

এদিকে মুনের কোনো খেয়াল নেই। সে আয়নার সামনে দাড়িয়ে অনবরত ফোঁপাচ্ছে, এমন পরিস্থতির সম্মুখীন হলে কারোরই স্বাভাবিক থাকার কথা না।

জয় মুনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। ও এভাবে কাঁদছে কেন?

সে মুনের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে দেখে ওর হাত, গাল ও গলায় কেমন যেন লাল লাল দাগ যেটা একদমই স্বাভাবিক দেখায় না। জয় ওর দুবাহুতে হাত রেখে বললো,
—“কী হয়েছে, মুন? তুমি কাদছো কেন? আর তোমার এই অবস্থা কেন?”

মুন হকচকিয়ে গিয়ে জয়ের দিকে তাকলো। কী বলবে সে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। জয় বারবার জিজ্ঞেস করছে, কিন্তু মুন মাথা নিচু করে কাঁদছে। জয় এবার বিরক্ত হয়ে বললো,
—“আরে এভাবে কাঁদলে আমি বুঝবো কীভাবে কী হয়েছে? আমাকে ব্যাপারটা খুলে,,,,

কথাটা শেষ হবার আগেই জয়ের ফোন বেজে ওঠে আর সে গিয়ে ফোনটা ধরে। যদি অফিসের কারো কল হয়!!
ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
—“মি. জয় মাহমুদ, নিজের ভালোবাসার মানুষের আসল রূপটা দেখতে এখনি ড্রিমলাইন ক্লাবে চলে আসুন। তনিমা ইজ হেয়ার, ড্যুড। ”
বলেই ফোন কেটে দিলো। জয় নাম্বারটায় আবার কল দিলো, কিন্তু সুইচড অফ বলছে। জয় ভাবছে, তনিমা কি সত্যিই ক্লাবে গেছে। কিন্তু কেন? আর এটা কার নাম্বার? কী চলছে আমার জীবনে কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। আমায় এখনি গিয়ে দেখতে হবে, তনিমা ক্লাবে কী করছে? আর ওর আসল রূপটাই বা কী?

জয় মুনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“কান্নাকাটি অফ করো, আমি একটা কাজে বাইরে যাচ্ছি। এসে যেন তোমায় স্বাভাবিক দেখি।”
বলে জয় একপ্রকার দৌড়ে চলে গেল।
ক্লাবে ঢুকে এমন দৃশ্য দেখবে আশা করেনি জয়।

-চলবে………