নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-০৯

0
4249

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_০৯||
;
;
;

ভালোবাসে? তাও আবার আমাকে, হাহ!! এতো ভাগ্য করে এসেছি নাকি পৃথিবীতে? আমার জীবনটা এতোটাই নিষ্ঠুর হবে, সেটা জানলে তো ভালোই হতো!! আগে থেকে জানা থাকলে তাও ধাক্কা গুলো সামলিয়ে উঠতে পারতাম। এই হুট করে পাওয়া কষ্ট গুলো বুকের ভেতর খচখচ করে আঘাত করে, যেটা না পারি সইতে আর না পারি কাউকে দেখাতে।

—“কী রে, কই হারিয়ে গেলি? আমাদের জিজুকে আবার মিস করতে শুরু করলি নাকি? ”
রুহির কথায় ভাবনা থেকে বাস্তবতায় ফিরে এলাম। মলিন হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“না, মিস কেন করতে যাবো? ওনি সত্যিই অনেক ভালো একজন মানুষ! আমি আসলেই ভাগ্য করে এমন একটা ভালোবাসার মানুষ পেয়েছি।”

চোখ দুটো নিমিষেই জলে ভরে উঠলো। আমি তা আড়াল করার চেষ্টায় লেগে পড়লাম। চোখের পানি লুকানোর ক্ষমতা এখন আমার আছে। ঐ যে বলে না, ‘যে কাজ মানুষ বেশি বেশি করে, সে কাজে তার ততই দক্ষতা বাড়ে।’ আমার হয়েছে সেই অবস্থা।

মুনের বরের কথা শুনে হিম যেন আকাশ থেকে পড়লো। এ কী শুনছে সে! পরীক্ষার পর একমাসের জন্য ট্যুরে যাওয়ায় এর মধ্যে মুনের বিয়ে হয়ে গেছে?? হিম আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“কীসব বলছিস তোরা? মুনের বর কোথা থেকে আসলো? আর তোর ভালোবাসার মানুষ টাই বা কে?”

অর্ণব হিমের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“আহা, আইসে গো আমাগো সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটা! কিচ্ছু জানে না তিনি! বহুত আফসোস হইতাসে কী কমু?”

রাদিফ কিটকিটিয়ে হেসে বললো,
—“চল একটা স্কুল বানাই। সেখানে হিমরে সবকিছু শিখাইয়া দিমু। হিম দোস্ত, অনার্সের রেজাল্ট দেওয়ার পর আমাদের স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়ে যাস।”

অর্ণব, রাদিফ, অনিতা আর রুহি জোরে জোরে হাসতে লাগলো। এদিকে হিম রেগে বললো,
—“হইসে তোদের প্যানপ্যানানি, এবার আমায় বলবি নাকি আমি,,,,”

অনিতা বললো,
—“তোর আর কিছু করতে হবে না। আমিই বলছি। আসলে গত সপ্তাহে মুনের বিয়ে হয়ে গেছে। তুই তো আউট অফ কান্ট্রি ছিলি, তাই জানিস না।”

রাদিফ বললো,
—“আমরা তো ফেসবুক, ইন্সটাতে পিক আপলোড দিসিলাম। কিন্তু তোর তো সবকিছু ডিএক্টিভেটেড ছিল, তাই জানিস না।”

হঠাৎ রুহি হাতের ঘড়ি দেখতে দেখতে তাড়া দিয়ে বললো,
—“লেট’স গো, গাইস। অনেক কথা হয়েছে, এবার চল গিয়ে প্রেজেন্টেশন এর জন্য অডিটোরিয়ামে যাই। নয়টা থেকে প্রেজেন্টেশন শুরু, অলরেডি ৮:৫৫ বাজে।”

আমি বললাম,
—“হ্যাঁ, চল। অনেক গল্প হয়েছে। ”

আমরা সবাই অডিটোরিয়ামের দিকে এগুতে লাগলাম। আর এদিকে হিম মুনের যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে ব্যর্থতার হাসি দিয়ে নিজেই নিজেকে বলতে লাগলো,
—“যদি জানতাম যে এবারের সিঙ্গাপুরের ট্যুরে যাওয়ায় আমি তোকে আজীবনের মতো হারিয়ে ফেলবো, বিশ্বাস কর আমি কোনোদিন সেখানে যেতাম না। আমার সাত বছরের ভালোবাসা আজ অন্য কারো স্ত্রী, আমার সব স্বপ্ন আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সহ্য হচ্ছে না আমার, একদম সহ্য হচ্ছে না। ”
____________

—“যতই চেষ্টা করো না কেন, এবার নিজের কোম্পানিকে আর বাচাতে পারবে না। জাস্ট নেক্সট মান্থে আমার হাতে তোর টাকাগুলো আসলেই খেল খাতাম।”
বলেই ডেভিল হাসি দিতে লাগলো নিবিড়।

তনিমা নিবিড়ের এমন কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“কিছু কি হয়েছে? কী ব্যাপারে কথা বলছো তুমি?”

—“জয় নিজের কোম্পানি রক্ষা করার জন্য এখন নিজে ডিরেক্টলি সব কাজ কন্ট্রোল করার ডিসিশন নিয়েছে। তাই আপনমনে হাসছি!!”

—“ওহহ, তাই বলো। আমি আরো ভাবলাম কী না কী! সে যাই হোক, সামনের মাসে জয়ের কাছ থেকে টাকা মেনেজ করে দিলেই তো আর কাজ নেই, তাই না?”

নিবিড় তনিমার নাক টেনে দিয়ে বললো,
—“নো ডার্লিং! তখন আমাদের প্রজেক্ট পুরোপুরি দাঁড়িয়ে যাবে। আমি হয়ে যাবো সেই আগের মতো বিজনেস টাইকুন নিবিড় শিকদার আর জয় হয়ে যাবে এখনকার আমার মতো ব্যাংকরাপ্ট। ”
ভাবতেই দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো নিবিড়।

তনিমা নিবিড়ের বুকে মাথা রেখে বললো,
—“জয় নিজেও জানে না ওর দুর্ভাগ্যের জন্য ও নিজেই দায়ী। আমরা বলতে গেলে ওর টাকা গুলো দিয়েই আমাদের কোম্পানি গড়ে তুলেছি, আর ওর টাকা দিয়েই ওর সর্বনাশ করছি।”

নিবিড় বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললো,
—“প্ল্যানটা এতো কাজে দিবে ভাবিনি। তবে সম্পুর্ণ ক্রেডিট কিন্তু তোমার। তুমি না থাকলে আমি এতো সুন্দর ভাবে সব কিছু গোছাতে পারতাম না।”

তনিমা অভিমানী সুরে বললো,
—“আমায় তো কিছু দিলেও না তুমি!”

—“দেইনি তো কী হয়েছে? আজ দিবো। আজ আমরা ক্লাবে যাবো আর সারা রাত অনেক আনন্দ করবো।”

তনিমা লাফিয়ে উঠে বললো,
—“ইয়েএএএএএ।”
________________

সবার প্রেজেন্টেশন দেওয়া শেষ হতে হতে বিকেল চারটা বেজে গেছে। এখন সবার অ্যাসাইনমেন্ট ও সার্ভে রিপোর্ট জমা দেওয়ার পালা। আমরা আমাদের ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছি, শুধু হিম ছাড়া। একটু আগে দেখেছিলাম, এখন কোথায় গেছে কে জানে?

আজ কেন জানি না মনটা খালি ছটফট করছে। জয়ের কোনো সমস্যা হলো না তো? নাকি এটা আমার জন্য কোনো বিপদের আভাস? কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছি না। ওদের চারজনকে বললাম,
—“দোস্ত, তোরা যা। আমি আসছি একটু পরে। আমার একটা কাজ আছে।”

অনিতা ব্যস্ত হয়ে বললো,
—“কোনো প্রব্লেম হয়েছে নাকি? আমাদের বল কিছু হলে।”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
—“আরে না! কোনো সমস্যা হয়নি। আমি একজনকে ফোন দিবো। তাই একটু পরে যাবো। তোরা সবকিছু সাবমিট করে আয়, আমি এখানেই আছি। ”

সবাই ‘ও আচ্ছা ‘ বলে চলে গেল। আমি ফোন বের করে জয়কে কল করলাম। রিং হতে হতে কেটে গেল। আবার দিলাম, এবারো সেইম অবস্থা। আরেকবার দিলাম, এটাই লাস্ট টাইম হিসেবে মনে মনে ভেবে নিলাম। কিন্তু দুবার রিং হবার পর ওপাশ থেকে তিনটা বাক্য শোনা গেল,
—“The number you have call is busy now. Please, call after then sometime. Thank you. ”

আমার বোঝা শেষ যে, ওনি এখন ব্যস্ত আছেন বলেই আমার কল কেটে দিয়েছেন। হয়তো কাজে ব্যস্ত, নয়তো তনিমার সাথে। আমিও কতো বোকা! কারো কাছ থেকে কখনো কোনো কিছু আশা করা উচিত নয়। আর আমি বারবার সেই কাজটাই করি। ভাবলেই মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে।

আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি সেই একি জায়গায়, একটুও নড়িনি। অর্ণব, রাদিফ, রুহি, অনিতা ফিরে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। অর্ণব আমায় হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
—“কি রে বইন, কী ভাবছিস বলতো? আজ তোরে কেমন জানি অন্য রকম লাগতাছে। তুই আগে অনেক হাসিখুশি থাকতি, আর আজ তোর মুখের হাসিটা কেন জানি কৃত্রিম লাগে।”

রাদিফ অর্ণবের কথায় সহমত প্রকাশ করে বললো,
—“আমারো তেমনই লাগে রে, বইন। তোরে সাত বছর ধরে দেখতেছি। তোর হাবভাব আমাদের ভালো করে জানা আছে। কী হয়েছে তাড়াতাড়ি পেটের ভেতর থেকে আমাদের ওপর ঢেলে দে তো।”

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যিই আল্লাহ আমায় এই মানুষ গুলোর সাথে এমনি এমনি বন্ধুত্ব সৃষ্টি করাননি। আমার কোনো ভাই বোন নেই, এটা ওরা কোনোদিন আমায় বুঝতেই দেয়নি। সত্যিকারের ভালোবাসা তো আমি মা-বাবার পর ওদের থেকেই পেয়েছি।

—“আমার কিছুই হয়নি। তোরা শুধু শুধু এতো ডেস্পারেট হচ্ছিস। তোরা এখানে দাঁড়া। আমি এখনি ফাইলগুলো সাবমিট করে আসছি।”
বলে জোরে জোরে হাঁটা শুরু করে দিলাম।

ডিপার্টমেন্টের সামনে একটা দোতলা বিল্ডিং আছে। এখানে মুলত ফার্স্ট ইয়ারের নিউ স্টুডেন্টরা ক্লাস করে। এখন তো সবার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ, তাই আগের ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টরা সেকেন্ড ইয়ারে উঠবে আর ফার্স্ট ইয়ারে নতুন করে ভর্তি নিবে। এজন্য এই বিল্ডিং টা এখন পুরোই খালি, কোনো মানুষজন নেই। আমি এখন এই বিল্ডিং এর নিচ তলার বারান্দা দিয়ে হেটে যাচ্ছি। সবাই মুলত এখান দিয়েই হেঁটে যায়।

এদিকে একজোড়া চোখ একটা রুম থেকে মুনকে লক্ষ করছে, সেটা মুনের অজানা। মুন ডিপার্টমেন্ট থেকে ফিরে এসে এই বিল্ডিং এর বারান্দা দিয়ে হেটে যেতেই একটা ক্লাস রুম থেকে একজোড়া হাত ওকে টেনে রুমে ঢুকিয়ে দিল আর দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলো। ঘটনা টা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, তার আকস্মিকতায় মুন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। কে তাকে টেনে ধরে এখানে আনলো সেটা বোঝার জন্য সেই ব্যক্তির দিকে তাকাতেই মুনের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,
—“হিম, তুই? ”
এই জন্যই কি তার মন বিপদের আভাস দিচ্ছিলো? কী করতে চাইছে হিম?
________________

—“কী খবর আহিল? কোনো কিছু করতে পারলে?”

আহিল বাঁকা হেসে বললো,
—“একটা বিগ নিউজ আছে, ভাবী। হজম করতে পারবে তো?”

অদ্রি ভ্রুকুটি করে বললো,
—“আগে বলো তো কী বিগ নিউজ! ”

—“তনিমা বিবাহিতা।”

অদ্রি চক্ষু চড়কগাছ করে বললো,
—“কীইইইইইই?”

—“কী না জ্বি। ”

—“আমি আজই সবাইকে জানাবো এটা। এই মেয়ে তো দেখছি আস্ত একটা ছ্যাসড়ি! জয়কে এখনি জানাতে হবে। ”

আহিল বাধা দিয়ে বললো,
—“আরে ভাবী, এতো তাড়াহুড়ো করলে কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। তোমার কি আদৌও মনে হয় জয় তোমার মুখের কথা বিশ্বাস করবে? আমি তো ওকে আজ হাতে নাতে প্রমাণ দেখাবো।”

অদ্রি এক্সাইটেড হয়ে বললো,
—“সত্যিইইইইই!”

আহিল হেসে বললো,
—“আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করবো। ”

-চলবে………….