নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-০৫

0
5976

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_০৫||
;
;
;

ভোরে,,,,
আযানের ধ্বনি শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। সোফায় ঘুমালেও ঘুমটা মন্দ হয়নি; বরং মনে মনে এটা ভেবে একটু স্বস্তি লাগছে যে, একবছর এই সোফায় ঘুমাতে আমার তেমন সমস্যা হবে না।

হাত দুটো মোচড়ামুচড়ি করতে যাবো, তখনি বাঁ হাতের কাটা জায়গাতেই টান লাগলো। আমি হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকাতেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। হাতের দিকে তাকিয়েই ভাবতে লাগলাম,
—“আমার এই স্বল্পপরিসরের জীবনে মা-বাবা ছাড়া কেউ কখনো কোনো কেয়ার করেনি। আপনিই সেই তৃতীয়বারের ব্যক্তি, যার কেয়ার পাওয়ার জন্য আমি এতোদিন ওয়েট করতাম; তবে সে জায়গাটায় আপনাকে বসাতে হবে ভাবিনি। সত্যি, জীবনটা বড়োই অদ্ভুত! তবে আমারটা একটু বেশিই অদ্ভুত। কেন যে আপনার রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারলাম না? ভয়ানক একটা অসুখে পরিণত হয়েছেন আপনি! বড্ড ভয়ানক, জয়!”

হাতের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছিলাম, তখনই চোখ গেল আমার ডান সাইডের বেডের দিকে যেখানে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে জয়। ওনাকে দেখে আজ বড়ই আফসোস হচ্ছে। সেদিন আমায় কন্ট্রোল বিয়ে করার প্রস্তাব দেওয়াতে এই ব্যক্তিটার প্রতি একটা চাপা ঘৃণা চলে এসেছিল। কিন্তু আজ! আজ এটা ভেবে আফসোস হচ্ছে যে, তনিমা কতো লাকি! এমন একজন ব্রোডেন মাইন্ডেড, এনলাইটেনড মেন্টালিটির মানুষ ওকে ভালোবাসে। আমি যদি আপনার একটু ভালোবাসা পেতাম, সেটাকে সারাজীবন যত্ন করে আগলে রাখতাম। জানি না, তনিমা কী করবে। কিন্তু আপনি সুখে থাকুন এটাই চাই।

চোখ দুটো কচলাতে কচলাতে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে নামাজ পরলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, পাখির কলরব জানান দিচ্ছে সকালের আগমন বার্তা। আমি জায়নামাজ উঠিয়ে বারান্দায় চলে গেলাম। এই বাড়িটা ডুপ্লেক্স, আর জয়ের রুমটা দোতলায় হওয়ায় বারান্দা থেকে নিচে ও আশেপাশে খুব অনায়াসে দেখা যাচ্ছে। আর বারান্দাটাও অনেক লম্বা ও প্রশস্ত হওয়ায় মর্নিং ওয়াকের জন্য বাইরে যাওয়ার দরকারই হবে না! আমি এমন পরিবেশ পেয়ে খুশি মনে সুরা ইয়াসিন পড়তে লাগলাম। এটা আমার বহু বছরের অভ্যাস, ফজরের নামাজের পর সুরা ইয়াসিন পড়া। আমি প্রায় একঘন্টার মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। রুমে ফিরে দেখলাম, জয় এখনো উঠে নি। আচ্ছা, ওনি কি নামাজ পড়েন না নাকি? কালকে এতো হাদিস কোরান শোনালেন, তাকে মনে তো হয় নামাজ পড়েন। কিন্তু আমি ওনাকে ভুলেও ডাক দিবো না। যদি আবার রেগেমেগে যায়, এমনি দুনিয়ার রগচটা আর খিটখিটে। তবুও এই মানুষটাকেই #নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে থাকলেও খুঁজবো আমি। জানি না ধরা দিবে কিনা!

হলরুমে এসে দেখলাম সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে অলরেডি। এই বাড়ির সবাই বোধ হয় তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে। আমি সিড়ি দিয়ে নামতেই একটা পাঁচ -ছয় বছর বয়সী ছেলে আমার সামনে এসে দাড়ালো। এই ছেলেটাকে আমি কালকে জায়েদ স্যারের কোলে দেখেছিলাম। আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই মশাই কোমরে হাত দিয়ে আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো,
—“কে তুমি’ হুম? আমাদের বাড়িতে কী করছো? নিশ্চয়ই চুরি করতে এসেছো! ”

আমি মুখ হা করে তাকিয়ে আছি। তখনই অদ্রি ভাবি এসে ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বললো,
—“এসব কী ধরনের কথাবার্তা, জুনায়েদ? ওনি তোমার থেকে বড়, সুতরাং তার সাথে না জেনে না বুঝে এভাবে কথা বলছো?”

জুনায়েদ কিছু না ভেবেই আমায় ঝাপটে ধরে বললো,
—“আমি আর কখনো এমন করবো না। অনেক সরি। আর তুমি (আমি), আমায় মাম্মামের হাত থেকে বাঁচাও, প্লিজ। ”

আমি জুনায়েদের সামনে হাটু গেড়ে বসে ওর মাথায় যেন বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
—“কিছু করবে না তোমার মাম্মাম তোমাকে। আমি আছি না! সো ডোন্ট ওয়ারি।”

অদ্রি একবুক হতাশা নিয়ে বললো,
—“এই নে, চলে এসেছে তোর আরেক উকিল। এতোদিন তো আমি বকা দিলেই দাদু, দাদুন, পাপা, ছোট পাপা করতি৷ আর এখন থেকে ছোট মাম্মাম বলে ডাকবি। ”
বলেই কিচেনের দিকে চলে গেল।

জুনায়েদ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“তার মানে তুমিই আমার ছোট মাম্মাম। তুমি না অনেক ভালো, আমার সাথে তোমাকে খেলতে হবে, মজা করতে হবে। করবে তো?”

আমি ওর নাক টেনে দিয়ে বললাম,
—“আমি এই কিউটিটার আবদার না রেখে থাকতে পারি নাকি, হুম! ”
আমার কথায় জুনায়েদ খিলখিল করে হাসতে লাগলো। সত্যিই একটা আস্ত কিউটের ডিব্বা মনে হচ্ছে ওকে দেখে।
——–

সকলে ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাইনিং রুমে বসে আছি, শুধু জয় বাদে।
আয়েশা মুনকে জিজ্ঞেস করল,
—“আচ্ছা মুন, জয় কোথায়? ও কি আজ ব্রেকফাস্ট করবে না, নাকি?”

—“ম্যাম, উনি এখনো ঘুমাচ্ছে। আমি ডাকিনি।”

আয়েশা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—“কে তোমার ম্যাম, হুম? তুমি এখন এ বাড়ির বউ। সুতরাং আগে কী বলে ডাকতে না ডাকতে তা ভুলে যাও। আমাকে তুই মা বলে ডাকবি, আর তুমি করে বলবি।”

জাহিদ বললো,
—“আমাকেও তুই বাবা বলে ডাকবি প্লাস তুমি করে বলবি যেভাবে নিজের বাবাকে বলিস ঠিক সেভাবে।”

জায়েদ এক্সাইটেড হয়ে বললো,
—“আমিও বলতে চাই আমায় মুন কী বলে ডাকবে।”

অদ্রি মুখ বাকিয়ে বললো,
—“আইসে সবজায়গায় বাঁ হাত ডুকানেওয়ালা!”

জায়েদ অদ্রির কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,
—“শোনো মুন, আমার না কোনো বোন নেই। এটা আমার অনেক বড় একটা আক্ষেপ। যদিও জয়কে দিয়ে বোনের অভাব পূরণের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ও তো একটা বেয়ারা ছেলে। তাই আজ থেকে তুইই আমার ছোট বোন। আমার কিন্তু অনেক কেয়ার চাই, যেটা ছোট বোনেরা বড় ভাইদের জন্য করে। কী, করবি তো?”

সবার এসব কথা শুনে আমার চোখ দুটো বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি যে এই পরিবারের শিকলে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি, আবদ্ধ হয়ে গেছি। কী করবো আমি তখন, যখন এদের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমায়? চোখের জল লুকানোর বৃথা চেষ্টায় যখন আমি ব্যস্ত, তখন আয়েশা বলে উঠলো,
—“দেখো, দেখো, বোকা মেয়ের কান্ড! আরে কাঁদছিস কেন তুই? ”

আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম,
—“না, মা, এমনি একটু ইমোশনাল হয়ে গেছিলাম। তেমন কিছু না, আমি ঠিক আছি।”

এরপর আমরা সবাই খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছি, কিন্তু মুখে দিতে পারছি না। কেন জানিনা শুধু জয়ের কথা মনে আসছে। অদ্রি এটা লক্ষ করল, কিন্তু কিছু বললো না। ভেতর থেকে শুধু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

—“মা, আজ আমি এতো বেলা করে উঠলাম। একটু ডেকে তো দিতে পারতে!”

আমরা সবাই তাকিয়ে দেখলাম জয় দাঁড়িয়ে আছে আর মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। মা ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বললো,
—“তোমায় সকাল বেলা ঘুম থেকে জাগানো এখন আর আমার দায়িত্ব না। বিয়েটা তোমায় এমনি এমনি দেইনি। তাই এখন থেকে আমার উপর রাগ ঝাড়াটা বাদ দিয়ে দাও।”

জয় আর কিছু না বলে খাবার খেতে শুরু করলো।
———

বিকেলে,,,
আমি জুনায়েদের সাথে কার্টুন দেখে তারপর রুমে এসে দেখি জয় রেডি হচ্ছে। ওনার গেট আপ দেখে মনে হচ্ছে অফিসে যাবেন। বিয়ের পরের দিনই অফিস!!! যেতেও পারে, কিন্তু সবাই তো বিয়ের পরের দিন শশুড় বাড়ি যায়। তবে উনি যাবেন না, আর এজন্য আমারও যাওয়া হবে না।

জয় নিজের চুল ঠিক করতে করতে বললো,
—“মুন শোনো, কাছে এসো।”

আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম,
—“ম,,,ম,,মানে,,, ”

—“বলছি যে, আমার সামনে এসো।”

—“ওহ্হ! ”
বলে আমি ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওনি আমার হাত ধরে হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিলেন। আমি একবার কার্ডের দিকে আর একবার ওনার দিকে তাকাচ্ছি।
—“এটা তো এটিএম কার্ড। এটা দিয়ে আমি কী করবো?”

—“তেমন কিছুই নয়। জাস্ট তোমার যখন টাকার দরকার পরবে, এটা দিয়ে উঠিয়ে নিবে। আমি কার্ডের ওপর পাসওয়ার্ড লিখে দিয়েছি।”

—“আমার লাগবে না। আমি কাল থেকে না হয় অফিসে জয়েন করবো। আর সামনের সপ্তাহে আমার রেজাল্ট দিলে আমার ভালো জব পেতে কোনো সমস্যা হবে না। ”

—“সবাই যখন জানবে জয় মাহমুদ এর স্ত্রী অন্য একটা কোম্পানিতে চাকরি করে, সেটা কি খুব স্বাভাবিক লাগবে তোমার কাছে। আর আমাদের কোম্পানি তে বাবা আর ভাইয়া তোমায় চাকরি করতে দিবে কোনোদিন। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে এই ডেবিট কার্ডটা ইউজ করাটাই তোমার জন্য ভালো হবে।”

বলেই হাত ঘড়ি পরতে পরতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমি ডেবিট কার্ডটা ড্রয়ারে রেখে দিলাম। যদি খুব বেশি প্রয়োজন হয় তখন ইউজ করবো। জয় তো ঠিকই বলেছে। আর আমার ফ্যামিলির কথাও তো ভাবতে হবে।

এদিকে জয় ভাবছে,,
আমি কোনো ভুল করছি না তো! আজ মুনের জায়গায় যদি তনিমা থাকতো, তাহলে কি আমায় কার্ডটা ফিরিয়ে দিতো? কোনোদিন ও না। কিন্তু মুন কী করলো? ও নিরুপায় হয়ে যে কার্ডটা নিয়েছে সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝেছি আমি।
———-

আমি বাবার সাথে কথা বলে ফোনটা টেবিলে রাখবো এমন সময় অদ্রি ভাবি এসে বললো,
—“কী রে, বিজি আছিস নাকি? ”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
—“কী যে বলো, ভাবি! আমি কেন বিজি থাকবো?”

—-“কী করে পারিস নিজের মনের সব দুঃখ কষ্ট আড়াল করে বাইরে থেকে হাসি খুশি থাকতে? এতো ধৈর্য কোত্থেকে পাস বলবি আমায়?”

আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
—-“মানে?”

-চলবে…….