নীল সীমানার শেষপ্রান্তে পর্ব-০৬

0
6085

#নীল_সীমানার_শেষপ্রান্তে
#Writer_Mahfuza_Akter
||পর্ব_০৬||
;
;
;

—“কেন মেনে নিতে গেলি জয়ের দেওয়া শর্ত? বিয়ে শব্দটা আপাতদৃষ্টিতে খুব ছোট হলেও এটার গভীরতা সম্পর্কে তুই নিশ্চয়ই জানিস! কেন এই বিয়েতে রাজী হয়েছিস তুই?”

আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবি এসব কিছু কীভাবে জানলো। এখন যদি সবাইকে বলে দেয় তাহলে কী হবে?

—“ভাবি, তুমি এসব কী বলছো? বিয়েতে রাজী না হবার কী আছে? ”

অদ্রি দরজা লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“আমার কাছ থেকে লুকিয়ে কোনো লাভ নেই, মুন। কাল রাতে আমি তোদের সবকথাই শুনে ফেলেছি। সো, আমায় সবকিছু ক্লিয়ার করে বল।”

তার মানে এখন আর লুকিয়ে কোনো কাজ হবে না। সবকিছু আমায় স্বীকার করতেই হবে। আমি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
—“তুমি কাউকে কিছু বলো না, প্লিজ। জয় আমায় অনেক বিশ্বাস করে, আমি যদি তোমায় বলি তাহলে আগে তোমায় কথা দিতে হবে তুমি কাউকে কিছু জানাবে না।”

অদ্রি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মুনের দিকে। এই মেয়েটার মধ্যে কী নেই যে, জয় এখনো তনিমাকে ধরে বসে আছে? এরা দুই ভাই একই। মাথায় কোনো বুদ্ধি নেই।

অদ্রি ভাবি আমার গালে হাত রেখে বললো,
—“বলবো না কাউকে কিছু। এবার তো বল।”

আমি বেডে বসে ভাবিকে সবকিছু খুলে বললাম।
—“জয় অনেক আশা করে আমায় বিয়ে করেছে। ওর ধারনা, আমায় ডিভোর্স দেবার পর ও কোনো রকমে তনিমাকে বিয়ে করতে পারবে। হয়তো ওনি এতে সুখী হবেন। আমিও চাই যে, ওনি সুখে থাক।”

অদ্রি মুনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
—“তুই জয়ের সুখের জন্য এতো ডেস্পারেট কেন? তুই জয়কে কি ভালোবাসিস?”

আমি ভাবির দিকে তাকালাম। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে ডানে-বামে মাথা নাড়ালাম।
—“তুই যে মিথ্যে বলছিস সেটা আমার জানা হয়ে গেছে। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে তুই জয়কে সুখী দেখতে চাস। এটার মানে কী দাঁড়ায়? যাইহোক, তুই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে একবার ভেবে দেখেছিস ডিভোর্স হয়ে যাবার পর তুই কী করবি? একটা মেয়ের জন্য এটা কত বড় ডাউন সাইড তুই ভাবতে পারছিস?”

—“পারছি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। বলে না ভাগ্যে যদি সুখ না লেখা থাকে তাহলে সেটা সহজে পাওয়া যায় না। আমিও তাই আমার ভবিষ্যৎ ভাগ্যের কাছে সঁপে দিয়েছি। জানি না কী হবে। হয়তো তনিমা অনেক লাকি, আমি ততোটা নই।”

অদ্রি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
—“সত্যিই মেয়েটা অনেক লাকি! নয়তো ওর মতো একটা দুশ্চরিত্রের মেয়েকে জয় এমন করে ভালো বাসতে পারতো না। ”

আমি অবাক হয়ে বললাম,
—“দুশ্চরিত্র!! তনিমা কীভাবে দুশ্চরিত্র? ”

অদ্রি বলতে শুরু করলো,
—“তুই জানিস না, তনিমা অনেক চালাক। ওর সাথে জয়ের তিন বছরের রিলেশন। কিন্তু আমরা জানি মাত্র একবছর ধরে। জয়ের কাছ থেকে আমরা তনিমার ছবি দেখেছি, মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী। কিন্তু ওর মনটা তার থেকেও বেশি জঘন্য বলে আমি মনে করি। একদিন আমি আর জায়েদ শপিং করতে গিয়েছিলাম, তখন দেখি তনিমা একটা ছেলের হাত ধরে আবার গলায় ঝুলে কেনাকাটা করছে। আমরা জয়কে এ ব্যাপারে বললে ও তনিমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। তনিমা কী বলেছিল জানিস? ও নাকি অসুস্থ, তাই সারাদিন বাসায় ছিল। আমরা নাকি ভুল দেখেছি। ঐ মেয়েটা নাকি তনিমা ছিলো না। আরেকদিন আমি আমার একফ্রেন্ডের সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম, তখনও ওকে দেখেছিলাম ঐ সেইম ছেলেটার সাথেই। আমি ওদের ছবি তুলেছিলাম কিন্তু রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই আমার পার্সটা ছিনতাই হয়ে যায়। এটা তনিমাই করিয়েছিল আমি শিয়র। আমি জায়েদকে এসব জানাই, ও অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু তনিমা বিরুদ্ধে কোনো প্রুফ পায়নি।”

আমি শকড হয়ে বসে আছি। তার মানে, জয় একটা ভুলের মধ্যে আছে। কিন্তু এ থেকে তো ও অনেক কষ্ট পাবে।

—“ভাবি, তোমরা জয়কে বোঝাওনি?”

অদ্রি ব্যর্থ যোদ্ধার মতো হতাশ হয়ে বললো,
—“আমরা কতো ভাবে যে ওকে বুঝিয়েছি, কিন্তু তনিমা এমনভাবে ওকে কনভেন্স করত কী বলবো!! শেষে জয় তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে বলে আমরা সবাই কতো খুশি হয়েছিলাম, জানিস? এখন সবকিছু শোনার পর আমি পুরাই ডিপ্রেসড্।”
বলেই অদ্রি চলে গেল। আমি এসব নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আজ আমার কাছে সব কিছু পরিষ্কার।

—“চিন্তা করো না, আমি একটা শেষ চেষ্টা করবো আর সেটা শুধু তোর মুখের দিকে তাকিয়ে। তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ”

আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম,অদ্রি ভাবি দাঁড়িয়ে এই কথাটা বলে চলে গেল।
———–

—“তনিমা, এই নাও তোমার চেক। টাকার এমাউন্টটা বসিয়ে নিও।”

তনিমা খুশিতে লাফিয়ে উঠে জয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
—“থ্যাংক ইউ! চলো না আজকে ডেটে যাই।”

জয় নিজের গলা থেকে তনিমার হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো
—” হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? তোমায় বলেছি না এসব হাতাহাতি আমার পছন্দ না। তাও বারবার একি কাজ করো। আর কী বললে, ডেটিং! তোমার মাথা ঠিক আছে। তোমায় ভালোবাসি তোমার সাথে এসব ক্ষণিকের জঘন্য আনন্দের জন্য না, বরং বিয়ে করে আজীবন বৈধ একটা সম্পর্কের জন্য যেখানে থাকবে সম্মান, বিশ্বাস ও ভালোবাসার সমান অস্তিত্ব। ”

—“তোমার সাথে ওসবের কোনো ইচ্ছেও আমার নেই । আমি তো শুধু এমনি বললাম!!”(তনিমা বিড়বিড় করে)

জয় ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“কিছু বললে?”

তনিমা জোরপূর্বক হেসে বললো,
—“না, না। আমি এখন বাসায় যাবো। আসি।”

জয় চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললো,
—“ওকে দেন, চলো তোমায় বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসি। আমি তো শুধু তোমার জন্য আজ অফিসে এলাম। চলো তাহলে যাওয়া যাক।”

তনিমা আমতা আমতা করে বললো,
—“জয়, তুমি বাসায় চলে যাও। আমায় তো ব্যাংকেও যেতে হবে। তুমি চিন্তা করো না, আমি একাই যেতে পারবো।”

—“আমি সাথে গেলে কী সমস্যা? ”

—“আরে, সমস্যা হবে কেন? আমিও তো গাড়ি নিয়ে এসেছি। সেজন্য বললাম। ”

—“ওওও, আচ্ছা। ”
———–

এদিকে,
—“হ্যালো, আহিল বলছো?”

ফোনের অপর পাশ থেকে একজন ব্যক্তি বলে উঠলো,
—“জ্বি, আমি ডিটেক্টিভ আহিল আহরার বলছি। আপনি কে? পরিচয় দিন।”

—“আমি তোমার বন্ধু জয় মাহমুদের ভাবী বলছি, জায়েদ মাহমুদের স্ত্রী। ভুলে গেছো নাকি আমাদের?”

আহিল খুশি হয়ে বললো,
—“আরে ভুলবো কেন? তোমরাই তো আমার সাথে তেমন একটা যোগাযোগ করো না। আমিও অনেক ব্যস্ত থাকি।”

অদ্রি বললো,
—“তোমার জয়ের সাথে কথা হয়?”

—“না, তেমন একটা না। আসলে সত্যি কথা বলতে এই গোয়েন্দাগিরিতে ঢোকার পর থেকে আমি কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ করার সময় পাই না। সারাক্ষণ এই কেস, ওই কেস নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে অনেক বিরক্ত হয়ে পড়েছি। যাইহোক, জয়ের খবর কী বলো তো? বিয়ে – টিয়ে করে ফেলেছে নাকি?”

অদ্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“অনেক বড় একটা ভুলের মধ্যে পড়ে গেছে জয়। সেজন্যই তোমাকে ফোন দেওয়া। তুমিই এখন আমাদের শেষ ভরসা। ”
অদ্রি আহিলকে জয়, মুন ও তনিমার ব্যাপারে সবকিছু খুলে বললো।

—“এখন কী করবে সেটা তুমি জানো। তনিমা জয়ের চোখে যে কালোপর্দা লাগিয়েছে সেটা খোলার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে। ”

আহিল রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বললো,
—“টেনশান করো না, ভাবী। আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। আমায় শুধু তনিমার একটা ছবি আর ও কোথায় পড়াশোনা করেছে সেটা জানাতে হবে। ঠিকানা যদি দিতে পারো তাহলে আরো ভালো।”

—“ছবি আর এডুুকেশনাল ইন্সটিটিউট এর নাম দিতে পারবো। কিন্তু ঠিকানা পাবো না মনে হয়। তাও আমি যতটুকু পারবো তোমায় হোয়াটসঅ্যাপ এ পাঠিয়ে দিব।”

—“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি পাঠানোর সাথে সাথেই আমি কাজ শুরু করে দিব। ”

—“আচ্ছা, আমি দেখছি তাহলে। রাখি।”
বলে পিছনে ঘুরে তাকাতেই দরজায় দাড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখে অদ্রির হাত থেকে ফোনটা ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল।

-চলবে……..