নীড়ভাঙ্গা ভালবাসা পর্ব-০৩

0
379

#পর্বঃ০৩
#নীড়ভাঙ্গা_ভালবাসা
#লেখকঃমুহাম্মদ_রাফি

ফেরিতে উঠে আমরা উপরে দাড়িয়ে আছি, তখন সে এক ঝালমুড়ি ওয়ালাকে দেখে বললো
– ঝালমুড়ি নিয়ে আসবো?
– না
– কেনো? ঝালমুড়ি দেখলেইতো পাগল হয়ে যাও। আমার উপরের রাগ ঝালমুড়ির উপর দেখায় লস করলে আমি কিন্তু দায়ি নই।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে ভাবতেছি, এই ব্যাটা আজ এত কথা বলছে কাহিনি কি? জীবনেও ২/১ কথা আর হা হু ছাড়া মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। সে এত কথা তখনই বলে যখন সে ভয়াবহ কোনো কান্ড ঘটায়। খুলনা যাই তারপর দেখতেছি ব্যাপারটা। এত লং বাইক জার্নিতে ওকে রাগাবো না।
চুপচাপ আছি দেখে মুখটা ভার করে বললো
– তুমি কি অনেক বেশি রেগে গেছো?
– তাতে তোমার কি?
– কথা ঘুরিয়ে বললো, তোমার প্রেমে কেন পড়েছিলাম জানো?
– নতুন কারো সাথে সংসার করতে পারবা বলে। এমন ঠান্ডা মেয়ে তো আর ২টা বানায়নি আল্লাহ্, যে হাজারবার তোমার সব অপরাধ মাফ করে তোমাকে কাছে টেনে নেবে।
– উল্টাপাল্টা কথা না বলে একটা গল্প শোনো,
আমাদের ব্যাচের সবার নাম্বার ম্যানেজ করে আমি সবাইকে প্রথম কল দিয়ে পরিচিত হই। একটা মেয়ের সাথে কথা বলে তার গলা শুনে মনে হলো মেয়েটা অনেক ম্যাচিউর।

কিন্তু ওরিয়েনটেশনের দিন খুব ছোটো ১৬ কি ১৭ বছর বয়স হবে এমন একটা মেয়ে আসলো তার ভাইয়ের সাথে। কালো খয়েরি রংয়ের থ্রিপিস আর কোমর অব্দি লম্বা চুলের হলুদ ফর্সা মেয়েটাকে প্রথমবারে দেখে খুব সাদামাটা মনে হলেও কাছে যেতেই তার চোখের দিকে চোখ পড়তে বুঝলাম, মেয়েটার চোখ ঠিক নর্মাল বাঙালিদের মতো নয়। ব্রাউন, ব্ল্যাক আর সাদার কম্বিনেশনে খুব ইউনিক কালারের চোখের মণি, ইংরেজরা যেটাকে hazel eyes বলে ঠিক তেমন। আরও গভীরভাবে তাকিয়ে বুঝলাম, ডাগর ডাগর চোখ বলতে কবিরা যা বুঝায় তা বলতে বাস্তবে হয়তো এমন চোখকেই বুঝায়। এত সুন্দর চোখ আমি কখনো দেখিনি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে, মেয়েটা তার বামগালে টোল ফেলে ভুবন ভুলানো একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো, তার সাথেই আমার কথা হয়েছে। গলা শুনে বুঝলাম এই সেই মেয়ে যার কন্ঠটা ঠিক সুমধুর নয় বলেই ফোনে তাকে ম্যাচিউর মনে হলেও সে দেখতে খুবই পিচ্চি। আর হাসলে গালে গর্ত হওয়া মেয়েরা যে এত সুন্দর দেখতে লাগে তাকে না দেখলে আমি জানতেই পারতাম না!
জানো গালে টোল পড়া অনেক মেয়ে দেখেছি কিন্তু তার টোলটা না সবার থেকে আলাদা ছিলো। এত গভীরভাবে গালে টোল পড়তে আমি কাউকে দেখিনি। Instantly, প্রেমে পড়েছিলাম তার ডাগর চোখের আর হাসির।
তার মনটা যে তার হাসির চেয়েও সুন্দর হবে তখনকি আর জানতাম! দেখলাম ক্লাসে হয়তো কেউ প্রজেক্ট, অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করতে পারিনি সে সব ফেলে তাকে হেল্প করতে লেগে যেতো। পরীক্ষার আগ পর্যন্ত সে ক্লাসের যারা ফেল করবে এমন সব ব্যাচমেটদের তার নোটস দেওয়া থেকে শুরু করে, পড়া বুঝানো সবই করতো। সবাইকে পাস করানো যেন তার অলিখিত দায়িত্ব হয়ে গেলো। বিনা কোনো স্বার্থে মানুষের উপকার করাটা যেন তার দায়িত্ব।
প্রথমে হয়তো আমি তার সৌন্দর্য দেখে প্রেমে পড়েছিলাম কিন্তু ভালবাসার শুরুটা হয় তার সুন্দর মনের সান্নিধ্যে এসে।

পারিবারিকভাবে আমি কখনো নিঃস্বার্থ ভালবাসা পাইনি। বুঝিওনি ভালবাসা নিঃস্বার্থও হতে পারে। আব্বু আম্মু ছোটোবেলা থেকে আমাকে এমনভাবে মানুষ করেছে যেন আমি তাদের নিঃস্বার্থ ভালবাসা দেখে না, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে তাদেরকে ভালবাসি।ছোটো থেকে কোটি টাকার সম্পত্তির মূলা ঝুলায় আমার আপি আর আমার মাঝে তারা অলিখিত দেয়াল তুলে দিয়েছিলো। যে আব্বু আম্মুর গুড উইলে থাকবে সে বেশি সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পাবে। ছোটোবেলা থেকেই আম্মু আমাদের ২ ভাইবোনকে খুব ভালবাসলেও আমাদের ২ ভাইবোনের মাঝে কখনো বন্ধন গড়ে উঠতে দেয়নি। ছোটোবেলা থেকেই আম্মুর নেওটা ছিলাম বলে সেটাকে সে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ইউজ করতো। এমন ভাবে সে আমাকে মানুষ করলো যেন আম্মু আব্বু ছাড়া আমি নিজেকে ভাবতে পারিনা। আমার সকল কনফিডেন্স ছোটোবেলা থেকেই ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়া হলো। তারা আমার মাথার মধ্যে এটা ঢুকাতে সক্ষম হলো যে তাদের সম্পদ ছাড়া I am nothing but a big zero.
একটা সময় আমার ভালবাসার ডাকে সাড়া দিয়ে গালে টোল পড়া মেয়েটা এলো আমার জীবনে। তার ভালবাসার ঢেউয়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। আমি খুব করে চাইলাম আমার টক্সিক ফ্যামিলি যেন আমার প্রতি তার ভালবাসার innocence টাকে কেড়ে নিতে না পারে। আমার ব্রেনওয়াস করে তার ভালবাসাকে সন্দেহ করতে না শেখায়। কিন্তু কিভাবে তারা জেনে গেলো আমাদের ভালবাসার কথা।
প্রথম প্রথম আমাদের ভালবাসাটাকে বাঁচাতে আমি ডিনাই করলাম আমাদের সম্পর্কের কথা। চাইনি তাকে তারা কেড়ে নিক আমার থেকে। একদিন সাহস করে স্বীকার করলাম তার কথা। ব্যাস শুরু হয়ে গেলো ইমোশনাল টর্চার, ব্রেইন ওয়াশ। সে নাকি আমায় ভালবাসেনি, আমার বাপের সম্পত্তির লোভে আমার সাথে নাটক করছে। আব্বু আম্মু তাদের পছন্দ ছাড়া বিয়ে করলে এককানা কড়িও দেবেনা জানিয়ে দিলো।
প্রাচুর্যের মাঝে মানুষ হওয়া আমি হঠাৎই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তাদের কথায় রাজি হয়ে খুব বাজেভাবে ছেড়ে দিলাম তাকে, এই পৃথিবীতে শুধুমাত্র যে আমাকে আমি হিসেবে ভালবেসেছে। আমার সকল দূর্বলতা জেনেও যে সেই দূর্বলতাকেও আমার সবলতার মতোই ভালবেসেছে। আমাকে বুঝিয়েছে,
“ভালবাসা মানে শুধু ভালটাকে ভালবাসা না। তার খারাপটাকেও সমান ভালবাসা।”
৬ টা মাস তাকে ছাড়া কাটিয়ে বুঝলাম কোনোভাবেই তাকে হারিয়ে বাঁচা সম্ভব না। অনেক কসরতের পর আবার তার ভালবাসা পাওয়ার সাথে সাথেই তার কথায় বিয়েটা সেরে ফেললাম। কিন্তু তাকে তার যোগ্য সম্মানটা আমি দিতে পারলাম না৷ পুরুষ হিসেবে নিজেকে কতটা ব্যর্থ মনে হয় জানো! নিজের স্ত্রীকে তার জায়গায় বসাতে না পারলে?
কিন্তু বিশ্বাস করো তাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মেয়ের দিকে আমি কখনো ঠিক করে তাকাইনি। আমি অনেক দিক থেকে ব্যর্থ আমি মানতেছি কিন্তু তার প্রতি আমি always loyal ছিলাম এবং থাকবোও। এবার বাসায় যেয়ে আমি একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব।

সে কখনো এত ডিটেিলসে বাসার সমস্যার কথা আমাকে জানায়নি৷ আমার গুরুত্বটাও কখনো স্বীকার করেনি। তাই আজ তার কথায়, আমি যে তার জীবনে কি সেটা জেনে অজানা ভাললাগায় মনটা ছুঁয়ে গেলো।
সে দম না নিয়েই বলে উঠলো,
– আমি তোমার সামনে অনেক কঠোর থাকি মানেই কি আমার কষ্ট হয়না! তুমি না বুঝলে কে বুঝবে বলো! তোমার কথা জানার পর থেকে আম্মু আমাকে কি পরিমাণ যন্ত্রণায় রাখে তুমি জানো না? কতবার সে সুইসাইড অ্যাটেম্ট করতে গেছে, প্রতিটা ফ্যামিলি মেম্বারকে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানিয়ে আমাকে সবাইকে দিয়ে কি পরিমাণ চাপে রাখে, তুমি তো সবই জানো!সবাই আমার আম্মু আব্বু আমার জন্যে কি করছে, আমাকে ছাড়া তাদের কেউ নেই, সেলফিস হয়ে আমি শুধু নিজের সুখের কথাই ভাবছি। Blah blah blah…আমি মেন্টালি সিক হয়ে যাচ্ছি সোনাপাখি। এত ইমশনাল টর্চার আমি আর নিতে পারছিনা।
– অনেক সহজ একটা সল্যুশন আছে, বিয়ের কথা আমার ভাই আর আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেল ছাড়া কেউ জানেনা। চুপচাপ ডিভোর্স দিয়ে তুমি তোমার ফ্যামিলির মতে বিয়ে করে সুখী হও।
– তুমিও প্লীজ শুরু করোনা৷ আমাকে এত বছর টাইম দিয়েছো, সামান্য কটাদিন আরও দাও। এবারও যদি আম্মুকে মানাতে না পারি তাহলে আমি সব ছেড়ে বের হয়ে আসবো। আর কোনো অন্যায় তোমার সাথে হতে দেব না।
-আমার আসলে হুটহাট রাগ উঠে যাচ্ছে বলে উল্টা পাল্টা কথা বলে ফেলছি। স্যরি
– আমার উপর আর একটু ভরসা রাখো। এতদিন তোমাকে তোমার প্রাপ্য জায়গা দিতে পারিনি কিন্তু আমার বাচ্চাকে আমি তোমার মতো কষ্ট পেতে দেবনা।

কথায় কথায় আমরা নদী পার হয়ে আসলাম। পদ্মাসেতুর লিংক রোডে পৌছালেই আমার মনে হয় আমরা কোনো ফরেন কান্ট্রিতে আসছি। এত সুন্দর! দুইপাশে উচু রাস্তার মাঝখান দিয়ে আমরা নিচু সরু লেন দিয়ে ছুটে চলেছি। দুইপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম কখন আমি বুঝতেই পারিনি।

চলবে…