নীড়ভাঙ্গা ভালবাসা পর্ব-৪+৫

0
300

#পর্ব_৪
#নীড়ভাঙ্গা_ভালবাসা
#লেখকঃমুহাম্মদ_রাফি

কিছুসময় পরে সে আলতো ঝাঁকিয়ে আমাকে ঘুমাতে নিষেধ করলো। একটা দোকানে দাড়িয়ে চা খেলাম দুজন, যেন আমি আর না ঘুমাই। দুপুরের দিক আমরা খুলনা পৌঁছে গেলাম। সে আমার হাত দুটো ধরে বললো, যাই হয়ে যাক প্লীজ সোনাপাখি আমার ভালবাসার উপর ভরসা হারিয়ো না। আমি সব ঠিক করে ফেলবো। প্রতিউত্তরে আমি তার হাতদুটো আরো শক্ত করে চেপে ধরলাম। সময়টা কি এখানেই থেমে যেতে পারতো না!
কিছু সময় পর দুইজন দুইদিকে পা বাড়ালাম। বাসায় বললাম আপাতত কোন পরীক্ষা নেই তাই চলে আসছি কিছুদিন বাড়িতেই থাকবো। তার সাথে আমার আর কথাই হলো না।

সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি তান, আমার ছোটো ভাই, আমার পাশে বসে আছে। আমার চোখ খোলা দেখে বললো, সায়শা আপু আর নাবিল ভাই আসছে। তুই হাতমুখ ধো আমি তাদেরকে তোর রুমে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
– খারাপ কিছু হয়েছে!
– না মনে হয়, ভাইয়া মে বি তাদের পাঠাইছে।
বলে ভাই বেরিয়ে গেলে আমি ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি দুইটা মুখভার করে আমার বেডে বসে আছে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সায়শা আর নীড়ের বেস্ট ফ্রেন্ড নাবিল। দুজনে হ্যাপিলি ম্যারেড একটা কাপল। কিন্তু ২জনই আমাদের ২ জনের ব্যাপারে খুব পজেসিভ। নীড় কেন আমাদের বিয়ের কথা ফ্যামিলিতে বলছে না সেটা নিয়ে সবসময় সায়শা নাবিলকে কথা শোনায়। ছেলেরা এমন চরিত্রের কেনো হয় সেটা নিয়েও ২টা টম & জেরির মতো ঝগড়া লাগায়। সায়শা কখনোই চুপ করে থাকতে পারে না। বকবক করে আমার মাথা ধরায় দেয়। সে যখন চুপ করে আছে তখনই বুঝলাম ২ টা ভয়াবহ ঝগড়া লাগাইছে।
সায়শার মাথায় গাট্টা মেরে বললাম,
– কি নিয়ে লাগছিস নাবিলের সাথে?
– নাবিলের সাথে কিছু হয়নি। অনেকদিন পর তোর সাথে দেখা তাই খুশীতে ইমোশনাল হয়ে গেছি। চল্ আন্টি নাস্তা দিছে খেয়ে এসে গল্প করি।
কিছু একটা যে ওরা লুকাচ্ছে সেটা বুঝেও কিছু বললাম না। চুপচাপ খেয়ে এসে রুমের দরজা লাগায় দিয়ে বললাম,
– এবার বল কি হয়েছে?
সায়শা নাবিলকে ইশারা করতে নাবিল আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– নীড়ের সাথে রাতে কথা হয়েছে তোর?
– গতকাল দুপুরের পর আর হয়নি। কেনো? কি হয়েছে ওর?
– তুই মাথা গরম করবি না বল্!
– কোনো খারাপ কিছু হয়েছে দোস্ত!
– আরে না। এখনও কিছু হয়নি তবে হবে।
– কি হবে?
– তোর শাশুড়ী রাতে আম্মুকে ফোন দিয়ে তোর শ্বশুরবাড়ি যেতে বলছে, অনেক মেহমান আসবে নাকি! পরে আম্মুর পীড়াপীড়িতে সত্য ঘটনা বের হয়ে গেলো। তোমার জামাইয়ের নাকি আজ বিয়া! আম্মু নাকি জিজ্ঞেস করছে তোকে রেখে নীড় বিয়ে করতে রাজি হয়েছে? তোর শাশুড়ী নাকি বলছে যে তার হাতে এবার মোক্ষম অস্ত্র আছে নীড়কে বিয়ে দেওয়ার। কোনোকিছুতেই এবার আর নীড় বিয়েটা আটকাতে পারবে না। আম্মু যে তোকে খুব ভালবাসে তাতো আর আন্টি জানে না তাই আম্মুকে এসব বলেছে!
আমি ঘটনা শোনার পর থেকেই ওকে ফোন দিচ্ছি রিসিভ করছে না। তোর সাথে মেবি কন্ট্রাক্ট করতে পারছে না। জুম্মার পর বিয়ে, তুই চল্ আমাদের সাথে বিয়ে আটকাতে হবে।
আমি চুপচাপ বসে ২+২= ৪ মিলায় বুঝলাম কেন আমার মিতভাষী স্বামীর মুখে কাল এত কথা ফুটছিলো! সেও জানতো আজ তাকে অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে অথচ কি সুন্দর অভিনয় করলো! ভালবাসার উপর বিশ্বাস রাখতে বললো! এইভাবে আমাকে না ঠকালেও তো পারতো! আমি তো কালই বলেছিলাম আমাকে ডিভোর্স দিতে। মাথাটা টনটন করে উঠলো।

নাবিল আবার বলে উঠলো,
-সময় নষ্ট করিস না। ওঠ্।
– সে যদি পুরুষ মানুষ হয়ে বিয়ে আটকাতে না পারে, আমি বেহায়ার মতো সেখানে যেয়ে কি করবো? করুক বিয়ে তোর দোস্ত৷ বিয়ে করে সুখী হোক।
– তুই এইসময় রাগ করে সময় নষ্ট করিস না। ৪ বছর ধরে তোকে তোর অধিকার নীড় দিতে পারেনি। এবার নিজে আদায় করে নে দোস্ত। কাউকে মাফ করিস না, এমনকি নীড়কেও না। আমিও ভেবে দেখলাম নীড় কাপুরুষের মতো আচরণ করছে সো তোকেই শক্ত হয়ে এইবার সবাইকে টাইট দিতে হবে।
– বাবা মা কে কি বলবো?
– আঙ্কেল আন্টিকে সায়শা ম্যানেজ করবে, তুই জলদি রেডি হ্।
কথা না বাড়িয়ে আমি একটা ভালো শাড়ি বের করে, সাথে ম্যাচিং হিজাব পরে মা কে সায়শার সাথে বেরোচ্ছি বলে বাসা থেকে বের হলাম। ৩০ মিনিট পর তিনতলা বাড়িটার সামনে এসে যখন দাড়াই তখন বেলা ১১ টা বাজে। অনেকবারই এবাড়িতে এসেছি৷ থাকাও হয়েছে অনেকবার। শ্বশুর – শাশুড়ী বাইরে গেলেই সে আমাকে বাসায় নিয়ে আসতো। কিন্তু আজ কেন জানি এইবাড়িটাতে আমার ঢুকতে মন চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে করুক সে তার পরিবারের মতে বিয়ে৷ কিন্তু আমাকে হেরে গেলে চলবে না। আমার সন্তানের অধিকার আমাকেই আদায় করতে হবে। ভালবাসার মানুষটাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার দিন এসে গেছে। তার ভূলের আর কোনো ক্ষমা হবে না। তার ভালবাসা আর আমাকে ভূলাতে পারবে না।

আমার সাথে থাকা চাবি দিয়ে গেট খুলে আমরা ৩জন তরতর করে ৩ তলায় উঠে বেল বাজাতেই বুয়া এসে দরজা খুলে দিলে আমরা ঢুকে দেখি ড্রইংয়ে সবাই বসে বিয়ের বিষয়ে আলাপ করতেছে। সব মুরুব্বিদের মাঝে সে বসে আছে চুপচাপ। আজ প্রথম তার দিকে তাকাতে আমার প্রচন্ড ঘৃণাবোধ হলো।
আমার শাশুড়ী পা্ক্কা খিলাড়ি। আমাকে দেখে হটাৎ ভীত হলেও ক্ষণিকের মধ্যেই নিজেকে সংবরণ করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো,
– আরে নাবিল, সায়শা, পাখি! তোমরা চলে এসেছো! এত দেরি করলে কেনো তোমরা! আমার বয়স হয়েছে আমি কি একা পারি সব সামলাতে! আসো তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেই সবার সাথে।
আমার নাম শুনে নীড় কেমন জানি খুব লজ্জাবোধ করলো। নীচু মাথাটা তার আরো নীচু হয়ে গেলো। একবার আমার চোখে চোখ মেলানোর সাহসটুকুও জোটাতে পারলো না। আমার চোখদুটো হঠাৎ করে জ্বলে উঠলো। খুব কষ্টে নিজের কান্না থামালাম। এই বিশ্বাসঘাতকটার জন্যে আর চোখের পানি ফেলবো না। ওকে ওর উপযুক্ত শাস্তি এইবার আমি দেবো।
শাশুড়ী সবার সাথে পরিচয় করায় দিতে যেয়ে বললো,
– ওরা ৩ জন নীড়ের বেষ্ট ফ্রেন্ড। ৪ জন সবসময় মানিকজোড়ের মত একসাথে থাকতো।
তারপর হঠাৎ আমার হাত ধরে নিয়ে সবার সামনে দাড় করায় বললো,
– পাখি তো সবার থেকে স্পেশাল। এই মেয়েটা না থাকলে আমার ছেলেটা পড়াশুনাই শেষ করতে পারতো না। ওরা ২জন একদম আপন ভাই বোনের মতো।
মনে মনে ভাবতেছি, বিটি তুই কোস্ কি! নাউজুবিল্লাহ! এদিকে নিজের মায়ের ডাহা মিথ্যা কথা শুনে নীড়ের হিচকি উঠে গেলো। আমি একটু ওর কাছে আগায় যেয়ে বললাম,
– ভাইয়া! আন্টি কি ভূল কিছু বলেছে? আমরা ভাই বোন নই? তো কি আমরা?
ও হিচকি দিচ্ছে আর ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
নাবিল হঠাৎ বলে উঠলো,
– নীড়, মামা! পাখি কি তোমার বউ লাগে নাকি যে বোন শুনে ছ্যাকা খাইলা!
এই কথায় তার হিচকি হঠাৎ থেমে গেলে নাবিল আবার বললো,
– আমাদের গ্রামে হিচকি সারাতে এই শক থেরাপিটা খুব ইউজ করা হয়। মানে চরম অবাক করা কোনো কথা বললে হিচকি থেমে যায়। আমিও আজ ট্রাই করে দেখলাম আসলেই খুব কাজে দেয়। আপনারা প্লীজ কিছু মনে করবেন না। ওরা একটু স্পেশাল টাইপের ভাইবোন আর কি! আন্টি একদম ঠিক কথা বলেছে। আপনারা খাওয়া দাওয়া করুন, কথা বলুন, আমরা ভিতরে যেয়ে বসতেছি।
বলেই নাবিলের সাথে আমি আর সায়শা, হতভম্ব হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে থাকা মা ছেলেকে, অবাক করে দিয়ে নীড়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

চলবে..

#ভালবাসার_স্পর্শ
পর্বঃ ০৫
লেখকঃ আবির খান
বুঝলাম মায়া আবার বারান্দায় গিয়েছে। আমি খাবার গুলো রেখে আমার রুমে গিয়ে বারান্দায় উঁকি মারতেই পুরো থ। আমি দেখি মায়া তার লম্বা ঘন কালো চুলগুলো পিছন থেকে সামনে এনে রোদে শুকাচ্ছে। মায়ার চুলগুলো যে এত লম্বা তা আমি বুঝতে পারিনি। আমি অপলক দৃষ্টিতে শব্দহীন ভাবে দাঁড়িয়ে শুধু তাকেই দেখছিলাম। সে আনমনে তার চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছেই যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত এভাবেই কেটে গেল। হঠাৎই মায়া চুল মুছতে মুছতে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে আমি দাঁড়িয়ে আছি। ও পুরো হতভম্ব হয়ে যায়। আমিও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। কি বলবো এখন ওকে? ও কি না কি ভাবছে মনে মনে কে জানে! মায়া কোন কিছু বলার আগেই আমি ওকে বললাম,

– খাবার এনেছি আপনার জন্য। তাড়াতাড়ি আসুন৷ নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।

বলেই রুমের ভিতর চলে আসি। বাইরের জামা পরিবর্তন করার জন্য ওয়াশরুমে গেলাম। বেড়িয়ে এসে সোজা ডাইনিং রুমে এসে খাবার গুলো প্যাকেট থেকে বের করতে থাকি। এরমধ্যে মায়াও গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আমি শুধু এক নজর ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম সে নীল কালারের একটা কামিজ পরেছে। এত্তো বেশি সুন্দরী লাগছিল তাকে আমি বলে বুঝাতে পারবো না। কিন্তু একবারের বেশি তাকাতে পারলাম না। কারণ খুবই লজ্জাজনক কাজ করেছি একটু আগে। মায়া এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলল,

~ আপনি বসুন। মেয়েদের কাজ মেয়েদেরই মানায়৷ আমি বেড়ে দিচ্ছি আপনাকে।
– আরে সমস্যা নেই। আমিও সাহায্য করি।

মায়া আবার সেই ভ্রুকুচকে আমার দিকে রাগী ভাবে তাকায়। আমি ভয়ে চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ি। সে সুন্দর করে খাবার গুলো পরিবেশন করে দেয়৷ আমি তাকে বললাম,

– আপনার জন্য অনেক বড়ো রেস্টুরেন্ট থেকে মজার মজার সব খাবার এনেছি। সবগুলো খাবেন কিন্তু।

মায়া চেয়ারে বসে খাবার গুলো দেখে বলে,

~ এতগুলো খাবার একা কিভাবে খাবো?
– হাহা! একা কই? আমাকে দিয়ে খাবেন না বুঝি?

মায়া লজ্জা পায় আর মুচকি একটা হাসি দিয়ে ফেলে। আমি প্রথম তার মুখে হাসি দেখলাম। বিশ্বাস করুন এই হাসি দিয়ে যেন মুক্তা ঝরছিল মনে হচ্ছে। কি অমায়িক হাসি তার। আহ! মনটাই ভরে গেল। আমি মনের অজান্তেই বলে ফেললাম,

– আপনার মুচকি হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। সবসময় হাসিখুশি থাকবেন। দেখবেন সবকিছু ভালো হবে।

মায়া খেতে খেতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

~ একটা সময় অনেক হাসতাম। কিন্তু এখন হাসিটা বোঝার মতো লাগে। হাসতে খুব কষ্ট হয়।

তার কষ্টমাখা কথা শুনে বুঝলাম,, প্রেমিকের জন্য বোধহয় মনে কষ্ট জমেছে অনেক। তাই তাকে কিছুটা স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বললাম,

– আপনি যাকে মনে প্রাণে ভালবাসতেন, সে খুবই হতভাগা। আপনার কোন দোষ নেই। আজকাল কজনই বা এরকম অন্ধ ভাবে কাউকে ভালবাসে বলেন। আপনি বেসেছিলেন তাই ধরাও খেয়েছেন। সত্যি বলতে যারা মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে জানে তাদের কেউ ভালবাসে না। আপনি পারবেন না জানি, তবে তাও বলছি, তাকে ভুলে যান। মনের মধ্যে কষ্ট পুষে রাখবেন না। নাহলে এই কষ্টগুলো জমে মনটা পাথর হয়ে যাবে৷

কথাগুলো শেষ করে মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সে কাঁদছে আর আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তার কান্না দেখে অস্থির হয়ে বললাম,

– আরে আরব কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে? আচ্ছা আচ্ছা তাকে ভুলতে হবে না। আপনি প্লিজ কান্না করবেন না। আমি আর কিছু বলব না। সরি…

মায়া চোখ মুছে বলে,

~ আরে শান্ত হন। আপনার কথা শুনে কাঁদছি না। কিছু অব্যক্ত কষ্টের কথা মনে পড়েছে। তাই অজান্তেই কখন যেন চোখগুলো ভিজে গিয়েছে। যাইহোক, আপনি খুব ভালো মানুষ। আর বেশ পঁচাও।

আমি মায়ার লাস্টের কথা শুনে পুরো আশ্চর্য্য! তাকে সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলাম,

– আমি পঁচা! কিন্তু কেন? কি করলাম আবার?
~ আপনি পঁচা নাতো কি? তখন ওভাবে চুপচাপ চোরের মতো আমাকে দেখছিলেন কেন?

আমি মায়ার কথা শুনে লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। কি বলবো ওকে! তাই মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে থাকি। সে আবার বলে,

~ ভালো হয়ে যান বুঝছেন, নাহলে কিন্তু আপনার খবর আছে। আবার এমন করলে দেইখেন আপনাকে কি করি।
– আচ্ছা হয়েছে সরি। আপনি এত সুন্দর হলে কি করবো আমি! আপনার চুলগুলো এত লম্বা আর ঘন, আমি আগে কখনো সরাসরি এমন দেখিনি। তাই কি যেন….
~ হয়েছে হয়েছে থামুন তো। লজ্জা শরম নেই আপনার দেখছি। উফফ! চুপচাপ খাওয়া শেষ করেন।
– ঠিক আছে।

আমি খেতে খেতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মায়ার মুখখানায় আবার সেই গোলাপি আভা ধরেছে। মানে সে লজ্জায় একদম নাস্তানাবুদ। এরপর আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে মায়া আবার সব গুছিয়ে ফেলে। মনে মনে ভাবছি, এই মেয়েকে যে বিয়ে করবে তার পুরো রাজ কপাল। আজকাল সাংসারিক মেয়ে পাওয়া আর সোনার হরিণ পাওয়া একই। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে হলরুমে এসে বসলাম। টিভিটা ছাড়লাম খবর দেখবো বলে। এরমধ্যেই ফোনটা বেজে উঠলো। আর সাথে সাথেই পেলাম ভয়। কারণ মা কল দিয়েছে। আমি মায়ার দিকে তাকাতেই দেখি মায়া আগে থেকেই ঠোঁটের উপর আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় চুপ হয়ে আছে বুঝাচ্ছে। আমি হেসেই দিলাম ওর কান্ড দেখে। তারপর গলাটে ঝেড়ে কলটা রিসিভ করলাম।

– হ্যাঁ মা বলো….
~ কিরে এতক্ষণ লাগে কল ধরতে? কইছিলি?
– সরি সরি। (প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম)
~ খাওয়া দাওয়া করেছিস বাবা?
– হ্যাঁ মা মাত্রই খেলাম। ওই যে আমাদের এখানে বড়ো রেস্টুরেন্টটা আছে না ওইখান থেকেই খাবার এনেছি।
~ ওহহ! যাক ভালো করেছিস। আমি তো ভেবেছি তুই নিজেই রান্না করবি।
– না আজকে করিনি। তুমি খাওয়া দাওয়া করেছো?
~ হ্যাঁ খেয়েই তোকে কল দিলাম।
– ওহ। তুমি চিন্তা করো না মা। আমি তো আর সেই ছোট না, নিজেকে সামলাতে পারবো।
~ মায়ের মন বুঝবিনা। সন্তান যতই বড়ো হোক না কেন মা বাবার কাছে সে ছোটই থাকে।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
~ ঘুমা তাহলে। আজকে তো অনেক সকালে উঠেছিস। আমি রাখছি।
– আচ্ছা। তুমি সাবধানে চলাফেরা কইরো। আর কোন সমস্যা হলে আমাকে জানিও।
~ ঠিক আছে।

মা কল রেখে দেয়। আমি যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। ফোন পাশে রাখতেই মায়া এখনো সেই ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখেই আমার সামনে এসে বসলো। আমি হাসতে হাসতে তাকে বলি,

– এখন কথা বলতে পারেন সমস্যা নেই। হাহা।

মায়াও মুচকি হেসে আঙ্গুল সরালো। আর বলল,

~ আমি ঠিক করেছি, আপনার কল আসলেই আমি চুপ করে থাকবো এভাবে। নাহলে সকালে মতো আবার রাগ দেখাবেন আপনি। সাথে একগাদা লজ্জাও দিবেন।
– আহহা আপনি এখনো মাইন্ড করে আছে। সরি সকালের জন্য।
~ আচ্ছা ঠিক আছে।
– আপনি টিভি দেখবেন? তাহলে দেখতে পারুন। আমি ঘুমাবো, মা ঘুমাতে বলেছে আমকে।
~ বাহ! আপনি তো একদম আপনার মায়ের বাধ্য ছেলে।
– হুম বলতে পারেন। কারণ এই দুনিয়াতে মা ছাড়া যে আপন আর কেউ নেই আমার। তাই মাকে অনেক বেশি ভালবাসি৷ জানেন, বাবা যখন মারা যায় মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড়ো করে। আমি নিজের চোখ দিয়ে মাকে কষ্ট করতে দেখেছি। সে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে আমাকে আজ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছেন। আমি মাসে এখন লাখ লাখ টাকা ইনকাম করি। আমার মা আজ আরামে আছে। বাবা-মার কষ্ট যদি সন্তানরা না বুঝতে পারে তাহলে কোন দিন সেই সন্তান তাদের মর্ম বুঝবে না। বাবা-মায়ের মতো আপন আর কেউ নেই পৃথিবীতে। আমার মা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু আমি কোন ভাবেই রাজি হইনি। তাই সে এক প্রকার রাগ করেই গ্রামে ঘুরতে গিয়েছে। কেন বিয়ে করতে চাইনা জানেন?
~ কেন?
– আমি অনেক দেখেছি অনেক। আজকালকার শিক্ষিত মেয়েরা বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি এসে সবার আগে ছেলে আর মায়ের মধ্যে দন্দ লাগায়। তারপর ছেলেকে ম্যানুপ্লেট করে মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে বাধ্য করে। আমি এটা কখনো হতে দিব না৷ আমার কোন মেয়েকেই বিশ্বাস হয়না৷ তারা কিভাবে এমনটা করতে পারে! তাদেরও তো বাবা-মা আছে তাইনা। তাদের বাবা-মাদেরও যদি এমন অবস্থা হয় তখন কেমন হবে?
~ সত্যি আপনার মতো সন্তান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। একটা কথা ঠিকই বলেছেন, বাবা-মা সবচেয়ে বেশি আপন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপন হলো মা। আপনি খুবই ভাগ্যবান আপনার আপন মা আছে। যে আপনাকে অনেক ভালবাসে।

আমি অবাক হয়ে বললাম,

– কেন আপনার নেই?
~ না না আছে তো। তবে আপনা না, সৎ মা। হাহা।

মায়া অদ্ভুত একটা হাসি দিল। আমি ওর হাসি আর কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। সৎ মা! মানে কি! আমি নড়েচড়ে বসে মায়াকে আবার জিজ্ঞেস করলাম,

– আমি ঠিক বুঝলাম না কিছুই। আমাকে একটু খুলে বলবেন আপনার সম্পর্কে?

মায়া আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,

~ আপনাকে এখন কিছু কথা বলবো। তবে আপনি আমাকে প্রমিজ করুন যে আমাকে খারাপ ভাববেন না কিংবা বের করে দিবেন না।
– প্রমিজ প্রমিজ। আপনি শুধু বলুন। আমি সব শুনতে চাই। প্লিজ বলুন।

দেখলাম মায়ার চোখজোড়া অশ্রুতে ভরে এসেছে। সে একবার মুছে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলো…

চলবে…?