নীড়ভাঙ্গা ভালবাসা পর্ব-০৮

0
269

#পর্ব_৮
#নীড়ভাঙ্গা_ভালবাসা
#লেখকঃমুহাম্মদ_রাফি

– মানে তুমি প্লান করে বেবি নিয়েছো?
– তা নয়তো কি? আমি কি জানতাম না, আমার আম্মু বিয়ের কথা বললেই ডিভোর্স করাবে যে করেই হোক!
– তোমরা মা, ছেলে মিলে আমাকে আর আমার বাচ্চাকে তোমাদের প্রতিযোগিতার অস্ত্র পেয়েছো?
– সবকিছু নিয়ে ভুলভাল ঝামেলা করা শুরু করছো তুমি। আমার সেই মিষ্টি, ঠান্ডা বউটা কোথায় গেলো?
– বাচ্চার রেসপনসিবিলিটি কতো ভাস্ট বোঝো সেটা? তোমার আম্মুকে হারাতে তুমি আমার অনাগত বাচ্চাটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছো?you are a selfish prick.
– আম্মু যত খারাপই হোক আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি করবে না৷ তুমি টেনশন করো না৷ একটা বাচ্চা স্বামী – স্ত্রীর ঝামেলা মিটায়, আমাদের বাচ্চাটা যদি ওর দাদা দাদিকে আমাদের সম্পর্ক accept করাতে পারে তাহলে সমস্যা কোথায়?
হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দ হতেই নীড় দরজা খুলে দেখে বুয়া ওকে আর আমাকে ড্রইংয়ে ডাকছে। নীড় এসে আমার মাথায় কাপড় উঠায় দিয়ে বললো,
– এইবার আমার বউ বউ লাগছে। এতক্ষণ ঝগড়াটে জংলী বিল্লী লাগছিলো। চলো আব্বু ডাকছে।
আমি কথা না বাড়িয়ে ওর সাথে ড্রইংয়ে গেলাম। আব্বু তার পাশের সোফা দেখিয়ে আমাকে তার পাশে বসতে বলে নীড়কে বললো,
-এত মিষ্টি একটা মেয়েকে আমার ঘরে আনার জন্য নীড় তোমায় আমি শেষবারের মতো মাফ করলাম যাও। বউ – বাচ্চা নিয়ে এবার ঠিক করে সংসারটা করো। আমার বৌমার থেকে যদি তোমার নামে কখনো কোনো কমপ্লেইন শুনি তাহলে তোমাকে আমি সত্যি সত্যি বাসা থেকে বের করে দেবো।
সে এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– মা, তোমার বাবা মার সাথে আমি নিজে যেয়ে কথা বলবো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ছেলেটা একটু মায়ের ন্যাওটা ছাড়া ওর আর কোনো দোষ নেই। আমি আসলে ছোটোবেলা থেকে কখনো ওকে সময় দিতে পারিনি তাই ও মায়ের লেজে লেজে ঘুরে এমন হয়েছে। এখন তুমি আসছো সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার ছেলেমেয়ে দুটোর সাথে আমার অনেক দূরত্ব। প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে ওরা কথাই বলে না বলতে পারো। তুমি আমার আরেকটা মেয়ে, তাই আমি চাই এ বাসায় একটা সন্তানের সাথে অন্তত আমার সম্পর্কটা স্বাভাবিক হোক। তুমি কি বলো?
-আমি আমার তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
– তোমার শাশুড়ী একটু রেগে আছে, সেই দুপুর থেকে না খেয়ে আছে। একমাত্র ছেলে না জানিয়ে হুট করে এত কান্ড ঘটিয়েছে জানার পর এটুকু রাগ করাটা স্বাভাবিক। নীড়, তুমি একটু দেখো তো তোমার আম্মুকে খাওয়াতে পারো কিনা! ওনার কথায় নীড় আব্বু আম্মুর রুমে গেলো আম্মুকে খাওয়ার জন্য আনতে৷ এর মাঝে আব্বু আমাকে বললো,
– তুমি চা বানাতে পারো?
– হ্যা, পারি।
– আমি কিন্তু তোমাকে একটা কাজে জ্বালবো তাহলে। সারাদিন আমার চা টা তুমি বানাবে৷ বুয়ার হাতে চা খেতে খেতে আমার মুখটা পচে গেছে।
– জ্বি আচ্ছা, আব্বু।
– আমার মেয়েটার সাথে তোমার পরিচয় আছে?
– হাই, হ্যালো এটুকুই হয়েছে। আসলে উনি তো সেভাবে খুলনা থাকেন না।
– হ্যা, মেয়েটা আমাদের উপর অভিমান করেই ঢাকা মেডিকেলে পোস্টিং নিলো। আসলে ওর মা সবসময় ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে আর আমি ব্যবসা নিয়ে। মেয়েটা বড্ড অভিমানে ওতদূরে চলে গেছে। ও যেহেতু গাইনোকলজিস্ট, নীড়কে বলো ওর কাছ থেকে ক্লিনিক্যাল সাজেশন গুলো নিতে। আমিও বলে দেবো। তুমি একটু ওর সাথেও আপন হওয়ার চেষ্টা করো মা। এটা তোমার সংসার। আমি জেনেও আমার স্ত্রীর অনেক দোষ ভালবেসে অন্ধ হয়ে না দেখার ভান করেছি। যেটা আজ তোমার সামনে আমার মাথা তুলে কথা বলার অধিকার হারিয়েছে। ক্ষমা করে দিও। আমি জানলে কখনো এত বড় অন্যায় হতে দিতাম না।
– আব্বু, আপনি আমায় প্লিজ লজ্জা,দিবেন না আর৷
– তুমিও একটু যাও মা তোমার শাশুড়ীর কাছে। সে তোমার গুরুজন, তাকে ভালবেসে তার ভূলগুলো শোধরাতে হবে মা।
শ্বশুরের কথায় তাদের ঘরে যেয়ে দেখি নীড় ওর মায়ের কোলে মাথা রেখে কান্না করছে আর ওর মা ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আমি যেতেই নীড় উঠে বসলো আর শাশুড়ী তো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বললো,
– এই মেয়ে, তুমি আমার ঘরে কেন এসেছো?
– আচ্ছা আমাকে নিয়ে আপনার সমস্যাটা কি বলবেন?
– তুমিই একটা সমস্যা, সেটা বোঝাতে পারিনি আমি তোমাকে?
– হ্যা পেরেছেন। কিন্তু আমাকে ভালবাসতে বলছি না। ফ্ল্যাটমেট হিসাবে জাস্ট একটু সহ্য করেন। বাচ্চাটা হলে আমি চলে যাবো। আমার জাস্ট আপনার ছেলের নামটা দরকার, আর কিচ্ছু চাইনা।
নীড় এবার রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে আবার বললাম,
– শোনেন আপনার স্বামী কিন্তু এবার সত্যিই সন্দেহ করবে আপনার ব্যবহারে। কেন আমার মতো এতো ভালো একটা মেয়েকে আপনার বিনা কারণে এত অপছন্দ! তার সামনে অন্তত খারাপ হওয়ার চেষ্টা করেন না! চলেন আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। দুপুরের ওই রিচ ফুড আমি খেতেই পারিনা। খাইতে চলেন।
– তোমার সাথে আমি খাবো ভাবলে কিভাবে!
– ভাবিনাই তো। আপনি থাকেন তাহলে। আমি আমার শ্বশুরের সাথে খাবো আর তার কাছে আরো ভালো হবো। আস্তে আস্তে আপনি রাগ দেখায় সবার থেকে দূর হয়ে যাবেন। আর পুরো সংসার আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। থাকেন তাহলে, আমি খেয়ে আসি।
আমি এসে দেখি টেবিলে বুয়া খাবার দিছে শুধু ৩ জনের। আমি আরেকটা প্লেট এনে শাশুড়ীর খাবারটা বাড়তে বাড়তেই দেখি ছেলের সাথে সেও চলে আসছে। আমি জানতাম সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। আর কখন কতটুকু আঙ্গুল বাকা করতে হবে তা আমি বুঝে গেছি। সবাই চুপচাপ খেয়ে রাতের শোয়ার জন্য যার যার রুমে চলে আসলাম।
আমি ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরেই একপাশে শুয়ে পড়লাম। নীল লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর সে হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ব্লাউজের বোতাম খোলা শুরু করলে, আমি উঠে বসে বললাম,
– আমাকে তুমি একদম টাচ্ করবে না৷ সে অধিকার তুমি হারিয়েছো। বিলিভ মি এখন তুমি আমায় টাচ্ করলে আমার জাস্ট ঘেন্না লাগে। ভালভাবে যদি শুতে পারো তাহলে বেডে শুবা নইলে ফ্লোরে ঘুমাও যাও।
নীড় কিছুক্ষণ খুব মর্মাহত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি শুধু ফ্লোরে যেয়ে শুয়ে পড়লো। আমার তখন আবার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। মনে মনে বলতে থাকলাম, ওর তো ঠান্ডা লেগে যাবে আর ঠান্ডা লাগলেই অ্যাজমা হবে৷ আমি কি একটু বেশিই বলে ফেললাম! এখন কি আমি রিকুয়েস্ট করবো বিছানায় শোয়ার জন্য? না থাক আজ হয়তো কিছু হবে না কাল আর উল্টা পাল্টা কথা বলবো না। ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম।

কিন্তু মাঝরাতে অদ্ভুত একটা সা সা শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। হঠাৎ উঠে দেখি নীড় ফ্লোরে উঠে বসে আছে আর বার বার ইনহেলার নিচ্ছে। ওর বুকটা প্রচন্ড জোরে ওঠানামা করছে। আমি সহ্য করতে পারলাম না৷ আমিও ফ্লোরে ওর পাশে বসে, অনেক রিকুয়েস্ট করলাম বিছানায় যাওয়ার জন্য কিন্তু জেদি মানুষটাকে কোনোভাবেই উঠাতে পারলাম না৷ শেষমেষ আমিও ফ্লোরে ঘুমানোর হুমকি দিলে তারপর উঠে বেডের এককোনায় আমার থেকে যোজন যোজন দূরে শুয়ে পড়লো।
স্যরি বলব বলব করেও বললাম না ভাবলাম, সকালে যখন ঘুমের ঘোরে আমাকে কাছে টেনে নিবে তখন বলবো। ভাবতে ভাবতে যখন দেখলাম ওর নিঃশ্বাসের কষ্ট একটু কমছে তখন আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু সকালে উঠে দেখি সে কাল রাতে যেভাবে শুয়েছিলো, এখনও সেভাবে শুয়ে আছে। একটুও নড়ন চড়ন নাই আর আমাকে কাছেই তো টানেনি। ভাবলাম ওর পছন্দের নাস্তা বানাই তাহলে খুশি হয়ে যাবে।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখি কেউ ওঠেনি বুয়া ছাড়া। আমি বুয়াকে কিছু সবজি কেটে দিতে বললাম। তারপর ওর পছন্দের সবজি খিচুড়ি, ডিম ভাজি আর বেগুন ভাজি করলাম। সবাই নাস্তা করতে আসলে আমি সবাইকে নাস্তা দিলাম। শাশুড়ী ফিরেও চাইলো না এমনকি নীড়ও আমার দিকে তাকালো না। তারা দুজন চুপচাপ নাস্তা করতে থাকলো। নীড়ের ব্যবহারে আমার খুব কষ্ট হতে থাকলো৷ একমাত্র আব্বুই নাস্তার প্রশংসা করে খুব তৃপ্তি নিয়ে খেতে থাকলো।আমি নীড়কে আর একটু খিচুড়ি দিতে গেলে সে উঠে গেলো৷ শ্বশুরের পীড়াপীড়িতে আমিও খেয়ে নিয়ে তাকে চা বানিয়ে দিয়ে রুমে এসে দেখি নীড় শুয়ে আছে চোখের উপর হাত দিয়ে। আমি ওর খুব কাছ ঘেসে বসে আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলায় দিতে থাকলে ও বললো,
– আমাকে টাচ্ করতে ঘেন্না হচ্ছে না! নাকি শুধু আমি টাচ্ করলেই ঘেন্না হয়?
– I am sorry.
– কি জন্য?
– কাল রাতের জন্য।
– অ্যাজমা না হলে তোমার খারাপ লাগতো না। সো বাদ দাও। তুমি চেঞ্জ করে নাও আমরা ডক্টরের কাছে যাবো।

চলবে?