সম্মোহনী সেই মেয়েটি পর্ব-০১

0
1010

#সম্মোহনী_সেই_মেয়েটি
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃরাদিয়াহ_রাফা_রুহি

ভার্সিটির সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।সরুন আমার পিছন থেকে।আমি গাড়ি থেকে নামার পর থেকেই দেখছি আপনি আমার পিছনে পিছনে আসছেন।সমস্যা টা কি আপনার বলুন তো।এভাবে চিপকে চিপকে কেন হাঁটছেন।আশ্চর্য তো কথা কানে যাচ্ছে না আপনার।

ছেলেটা ফিসিরফিসির করে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠে,

সাইডে চলো একটু, বলছি।আমি তোমার পিছনে পিছনে না এলে তোমার ই সর্বনাশ হবে।

ছেলেটার এমন নেশালো কন্ঠ কেন।এমন লাস্যময় কন্ঠে যেনো মাদকাসক্তের মতো নেশা আছে।কিন্তু ছেলেটা একদম অনিলার পিঠ চেপে হাঁটায় সে ভয়ে গুটিয়ে নিতে চাইলো নিজেকে।কিন্তু অনিলা যেদিকেই ঘুরছে ছেলেটাও সেদিকেই ঘুরছে।সবার সামনে কতটা লজ্জায় পর‍তে হচ্ছে তাকে এই ছেলে টার জন্য।আবার বলছে সাইডে চলো।সে ক্রুদ্ধ কন্ঠে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,

দেখুন আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু হবে না। আমি ভদ্র ঘরের মেয়ে।ভালোই ভালোই বলছি আমার পিছু পিছু আসা বন্ধ করুন নইলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম।

ছেলেটা অনুদ্ধত কন্ঠে বললো ,

তুমি ভদ্র ঘরের মেয়ে “সেই জন্যই তো বললাম একটু সাইডে চলোকথা আছে ইম্পোর্টেন্ট”।

আমি যাবো না আপনার সাথে।আপনি আমার পিছু নেওয়া বন্ধ করুন।আমার ক্লাস আছে ক্লাসে যেতে হবে আমাকে।অনিলা গলায় তেজ বারিয়ে বললো।

অনিলা কোনো কথা শুনছে দেখে ছেলেটা ওর দুই বাহু পেছন দিক থেকে ধরে একটা ফাঁকা ক্লাস রুমের দিকে হাঁটা দিলো।

অনিলাকে ওই ভাবে ধরে নিয়ে যেতে দেখে ভার্সিটির সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।রীতি মতো গুঞ্জন সৃষ্টি হলো সবার মাঝে।অনেকে অনেক কিছু বলা বলি করছে।কেউ কেউ ধারণা করছে ছেলেটার সঙ্গে অনিলার কোনো সম্পর্ক আছে।তাই এভাবে এতো ঘনিষ্ঠ হয়ে হাঁটছে।কেউ কিছুই বলার বা এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেলো না।এরকম ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটেই থাকে তাদের ভার্সিটিতে।

অনিলা সবার এই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারলো না।সবাই তাকে কিভাবে দেখছে।

রুমে আনার পর ছেলেটাকে নিজের পরনের জ্যাকেট টা খুলতে দেখে অনিলা প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়।

দেখুন আপনি কিন্তু এটা ঠিক করছেন না।আমি কিন্তু চেঁচিয়ে লোক জড়ো করবো।গণ ধোলাই খাওয়াবো কিন্তু।

ছেলেটা অনিলার কোনো কথায় কর্নপাত না করে এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে।অনিলা পিছিয়ে যাচ্ছে আর ছেলেটা এগিয়ে আসছে।এক সময় অনিলা দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে গেলো।চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিলো ভয়ে।এদিকে ছেলেটা নিজের জ্যাকেটের পুরো চেইন টা খুলে ফেললো।চেইন খোলার মৃদু শব্দ কর্ণকুহর হতেই অনিলা চোখ মেলে চাইলো।হঠাৎ এমন অবস্থায় পুরো ভয় পেয়ে ছেলেটার গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো সে।অনিলা ফুশে উঠে রুদ্ধ গলায় বললো,

আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি খুব ভদ্রলোক।কিন্তু আপনি তো দেখছি ভদ্রলোকের মুখোশ পরে আছেন।

অনিলার কথা শেষ হতেই ছেলেটা কটমট করে তাকায় তার দিকে।বিনা দোষে তাকে কিনা চড় মেরে দিলো মেয়েটা।রাগে তার গাল লাল হয়ে গেছে।আসলে গাল টা চড় খেয়ে নাকি রাগে লাল হয়ে গেছে বোঝা যাচ্ছে না।তার চোখ রীতিমতো টগবগ করছে রাগে।ক্ষোভে তার এমন মনে হচ্ছে কাচায় চিবিয়ে খাবে মেয়েটাকে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছে সে।ছেলেটা বুঝে উঠতে পারছে না এই মেয়েটার এরকম ব্যবহারের কারণ।সে তো এই মেয়েকে সাহায্য করতেই চাইছিলো।সে নিজের জ্যাকেট টা খুলে পেছন দিক থেকে ঢেকে দিলো মেয়েটাকে।

অনিলা অবাক হয়ে তাকালো ছেলেটার দিকে।ছেলেটা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

প্লিজ ক্লোজ ইউর ড্রেস ক্লথিং।পিঠের অর্ধাংশ উদাম হয়ে আছে।কথা শেষ করেই ছেলেটা গটগট করে বেরিয়ে এলো ক্লাস রুম থেকে।

অনিলা হতবুদ্ধি হতবাক হয়ে গেছে একেবারে।সে তার পিঠে হাত দিয়ে দেখলো সত্যিই তার জামার পুরো চেইন টাই খোলা।এটাতো মনে হচ্ছে নষ্ট হয়ে গেছে।চুল টাও বেধে এসেছে আজ সে।বেশ অনুতপ্ত হলো সে ছেলেটা কে চড় মাড়াতে।ইশ না জেনে চড় মেরে দেওয়া টা ঠিক হয়নি তার।তার মানে ওর ড্রেসের চেইন টা খোলা থাকার কারণেই ছেলেটা তার পিঠ ঘেঁষে পিছু পিছু আসছিলো।অনিলার মনে হলো ছেলেটা কে তার স্যরি বলা উচিত।জ্যাকেট গায়ে জড়িয়েই অনিলা তারাতাড়ি বেরিয়ে এলো।কিন্তু ততক্ষণে ছেলেটা কিছুটা দূরে চলে গেছে।

এদিকে অনিলার বান্ধবী নিশা দৌড়ে এগিয়ে এলো অনিলার দিকে।সে যখন শুনতে পেলো অনিলাকে কেউ ফাঁকা একটা ক্লাস রুমে নিয়ে গেছে।তখন সে ছুটে বেরিয়ে আসে ক্লাস থেকে।নিশা দ্রুত এগিয়ে এসে ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল,

অনিলা তুই ঠিক আছিস।কিছু হয়নি তো তোর।ছেলেটা তোর কোনো ক্ষতি করে নি তো।

অনিলার কানে যেনো নিশার কথা গুলো পৌঁছচ্ছেই না।সে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ছেলেটার প্রস্থান করার পানে।

নিশা দেখলো অনিলার গায়ে একটা জ্যাকেট জড়ানো।জ্যাকেট টা দেখে অনেক টা ভড়কে গেলো নিশা।সে দেখলো অনিলা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

নিশাও দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো সেদিকে।একি এটা যে তার ভাই।পেছন দিক থেকে দেখলেও সে খুব ভালো করেই চিনতে পেরেছে তার ভাইকে।একটু আগেই তো তাকে তার ভাই ভার্সিটিতে ছাড়তে এসেছিলো।তার মানে কি তার ভাই ই অনিলাকে।না না এটা হতেই পারে না।নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিলো।সে অনিলাকে অপ্রসন্ন ভাবে জিজ্ঞেস করলো,

কিরে অনিলা তোকে এই জ্যাকেট টা কে দিলো।

অনিলা আনমনে জবাব দিলো,ওই ছেলেটা।যে আমাকে একটু আগেই ক্লাস রুমে নিয়ে গেছিলো।

নিশা উত্তেজিত গলায় বললো, তুই কি বলছিস টা কি এটা তো আমার ভাই আইমান জুনইদ।আমার ভাই তোকে ফাঁকা ক্লাস রুমে কেন নিয়ে যাবে।

নিশার কথা শুনে যেনো অনিলার যেনো সম্বিত ফিরলো,

কিহ এটা জুনইদ ভাই।আগে তো দেখিনি উনাকে।

হ্যাঁ জুনইদ ভাই।আর দেখবি কিভাবে তুই কি গেছিস কোনো দিন আমাদের বাড়ি।তুই আগে বল ভাইয়া তোকে ফাঁকা ক্লাস রুমে কেন নিয়ে গেছিলো।

অনিলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো নিশার দিকে।আর সব কিছু বললো।সব শুনে নিশা তো মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলো।অনিলা নিশার পাশে বসে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,

স্যরি রে দোস্ত।উনি আমাকে যেভাবে আমাকে নিয়ে এসেছিলো আমি ঘাবড়ে গিয়ে চড় টা মেরে দিয়েছি।আর আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও কি একি কাজ করতো না বল।

নিশা ভীতু স্বরে বললো,

এখন কি যে হবে আল্লাহ জানে।তুই আমার ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে অবগত নস।হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে ফেলবে বাড়ি গিয়ে।

দোস্ত আমি যদি স্যরি বলি জুনইদ ভাই কে।ইয়ে না মানে জুনইদ ভাইয়ের নাম্বার টা একটু দে না।অনিলা ফট করে বলে ফেললো।

তুই নাম্বার নিয়ে কি করবি।

আরে দে না নাম্বার টা।স্যরি বলবো উনাকে।

নিশা ও আর কোনো কথা না বলে নাম্বার টা দিয়ে দিলো।

আআর স্যরি,ওর সামনে কোনো স্যরি তে কাজ হবে না।চল বাসায় চল আজ আর ক্লাস করা হবে না।এসব আর ভাবতে হবে না।যা হওয়ার হয়ে গেছে।ওরা দুজন ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে চলে এলো।

সব্বাই নিশা আর অনিলার দিকে তাকিয়ে থেকে এটা সেটা বিরবির করে বলে যে যার মতো চলে গেলো ক্লাসের দিকে।

চলতি সময়ের মধ্যেই যেন সূর্যকরোজ্জ্বল গগনের মন ক্ষুণ্ণ হলো।শেফালি ফুলের নরম গায়ে অনিল আঁচড় কাটতেই দোলায়মান হলো তারা।বৃষ্টি পরতেই ঝপঝপ শব্দ করে শালিকের দল উড়ে গেল দিগন্তে।আকাশ জুড়ে তখন কৃষ্ণমেঘের রাজত্ব।দিবালোক হয়েও যেন নিশুতি রাতের প্রহর চলছে। কিঞ্চিৎ সময় যেতে না যেতেই গা ঝাঁকুনি দিয়ে এক পলশা বৃষ্টি নামলো তপ্ত ধরার মধ্যখানে৷ আলতোভাবে ছুঁয়ে সিক্ত করে তুললো শুভ্রতায় মোড়ানো কোমল ফুলের গা। অকৃত্রিম ঘ্রাণে মাতোয়ারা হলো আশপাশ।বারান্দায় বসে বসে অনিলা ভার্সিটিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভাবছে।খনে খনে বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু পানি ছিটেও আসছে তার শরীরে।সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার।সে তার ভাবনায় মত্ত।প্রতিটি মুহুর্তে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে সে।এর জন্য জুনইদের কাছে ক্ষমা না চাওয়া অব্দি ওর শান্তি হবে না।কিন্তু কিভাবে ক্ষমা চাইবে এসব ভাবতেই পারছে না।সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে জুনইদ এর নাম্বার ডায়াল করলো সে।

এদিকে জুনইদ বাড়ি এসেই কারোর সাথে কোনো কথা না বলে।সোজা নিজের রুমে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পরে।

জুনইদের মা জুনইদ কে ডাকতে গেলে খুব বাজে বিহেভিয়ার করে ফেলে সে।হাতের কাছে ফুল দানি টা ছুড়ে মারে।সব জিনিস ফেলতে শুরু করে রাগে।বার বার ওই থাপ্পড়ের কথা মনে পরছে।গাল দুটো লাল হয়ে টগবগ করছে।যে ছেলে কিনা সবার ক্রাশ তার গালে কিনা একটা মেয়ে এভাবে থাপ্পড় মারলো।এই প্রথম কোনো মেয়ে তাকে থাপ্পড় মেরেছে।আইমান জুনইদের গালে থাপ্পড় মারা।এর দাম তো মেয়েটাকে দিতেই হবে।ভার্সিটি থেকে নিশাকে নামিয়ে দিয়ে বের হচ্ছিলো তখনই মেয়েটা গাড়ি থেকে নামছিলো আর না চাইতেও চোখ পরে যায় মেয়েটার উদাম পিঠে।

ঠিক সেই সময় ই তার ফোন টা বেজে উঠলো।
জুনইদ ফোন টা রিসিভ করলো,

হ্যালো কে বলছেন?

হ্যা-হ্যালো আমি অনিলা বলছি।আ-আপনি আজকে যাকে সাহায্য করেছেন সেই মেয়েটি আমি।

অনিলার কথা শুনে যেনো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো জুনইদের রাগ টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে।কিন্তু জুনইদ শান্ত রইলো।আশ্চর্য ও হলো কিছু টা।

আ-আসলে আমি নিশার ফ্রেন্ড।ওই ই আপনার নাম্বার টা দিয়েছে।

কেন তুমি কি আমার প্রেমে পড়েছো নাকি যে আমার নাম্বার ম্যানেজ করে আমাকে কল করেছো।

কথা শেষ করেই কল টা কেটে দিলো জুনইদ।বাকা হেসে বললো,

ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার।এই মেয়ে তো আর এমনি এমনি ফোন দেবে না ওঁকে।নিশ্চয়ই স্যরি বলতেই ফোন দিয়েছে।কিন্তু সে তো এতো সহজেই স্যরি এক্সেপ্ট করবে না।সে ফট করে ফোন টা কেটে দিয়ে অনিলার নাম্বার টা ব্লক লিষ্টে ফেলো দিলো।

এদিকে অনিলার মন ক্ষুন্ন হলো জুনইদের এভাবে ফোন কেটে দেওয়াই।সে তো কিছুই শুনলো না।কাল তো ভার্সিটিতেও যেতে পারবে না ফ্রাই ডে কাল।কি করে যাবে সে নিশার বাড়িতে।আইডিয়া সে যদি জ্যাকেট টা ফিরিয়ে দেওয়ার নাম করে নিশার বাড়িতে যায় তাই তো হয়ে যাবে।তাহলে কাল ই গিয়ে ক্ষমা চাইতে পারে জুনইদের কাছে।

হঠাৎ পাশে থাকা টিয়াপাখি মিহি কন্ঠে আওয়াজ তুললো, প্রথম লক্ষন।প্রেম সম্মোহন!

অনিলার কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র হৃষ্টচিত্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।খাচায় থাকা ডানা ঝাপটানো টিয়ার সামনে এগিয়ে বললো,

কি সব উদ্ভট কথা বলছিস স্ট্রুয়ার্ট।তুই সব সময় বাজে বকিস কেন বলতো।

স্ট্রুয়ার্ট কোনো ভাবান্তর না দেখিয়ে আবার বলে, প্রথম লক্ষন,প্রেম সম্মোহন।

অনিলা চোখ ছোট ছোট করে বললো।

তুই ও না।কি একটু কথা বলতে শিখেছিস এতেই এতো হ্যাঁ।

#চলবে

আসসালামু আলাইকুম। নামাজ কায়েম করুন।