পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
212

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

প্রকৃতি অন্ধকার করা সন্ধ্যা বেলাতে আর যা-ই হোক বন বাদাড়ে থাকা মঙ্গলজনক না সেটা দর্শিনী বেশ ভালোই জানে। ভারী পেট নিয়ে তাই সে উঠে দাঁড়ালো। গাড়ো গোলাপি রঙের শাড়িটার আঁচল টেনে পিঠে জড়িয়ে নিলো। আঁচলের কোণায় একটা দেশলাইয়ের বাক্স বাঁধা দেখে সে কিঞ্চিৎ হাসলো। আজকাল মা সবসময় তার আঁচলে এসব গুঁজে দেয় বা বেঁধে দেয়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় খারাপ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যই নাকি এ ব্যবস্থা। দর্শিনী নিষেধ করে না। থাকুক,কিছু কুসংস্কার মানতেও ভালো লাগে। এর মাধ্যমে কাছের মানুষ গুলোর উৎকণ্ঠা মাখানো ভালোবাসা তো অন্তত দেখা যায়।

ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ঘাটের উপরে উঠে এলো সে। চারদিকে গা ছম ছম করা শীতলতা। সন্ধ্যার পর শীতল হয়ে যায় সবটা। পুকুর পাড়ের পূর্ব দিক থেকে কিছু জংলী ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। খারাপ লাগছে না গন্ধটা। পায়ের নিচে নরম নরম ঘাস গুলো জুতার উপর দিয়েও শিরশির অনুভূতি দিচ্ছে।

সারাদিন পেটে তার কিছুটি পড়ে নি। সেই যে মুখ ভার করে সকালের দিকে ঘর থেকে বেরিয়েছে এ অব্দি ঘরে যায় নি সে। ফোনে সবারই মিসড কল ভেসে উঠেছে। এগুলো ঠিক মিসড্ কল বলা চলে না। সবার উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশও বলা যায়। সবার উপরে তাই বাবার নামটা ভেসে আছে। গুণে গুণে তেইশটা কল দেখাচ্ছে বাবার নামটার পাশে। বাবার নামটার নিচেই মৃত্যুঞ্জয় এর নামটা ভেসে উঠেছে। সে একুশটা কল দিয়েছে। বাবার পর সব জায়গাতেই যেন হুট করে এ মানুষটা জুড়ে যাচ্ছে। দর্শিনীকে আগলে রাখছে। কিন্তু এত এত আয়োজন! সব তো মিছে অনুভূতি। এরপর বড়দা,ছোটদা,ছোটবৌদি সবারই কল আছে। নানান রকমের জল্পনা কল্পনা করতে করতে বাড়ির পথে এগিয়ে গেলো সে। মিনিট সতেরো পেরুতেই বাড়ির উঠানে এসে পৌঁছুলো। এই শরীর নিয়ে পিপীলিকার মতন হাঁটতে হয় বলে এতক্ষণ লেগেছে, নাহয় ছয় সাত মিনিটের পথ।

বাড়ির মাঝ উঠান বরাবর সৌরবিদ্যুৎ এর লাইট জ্বলছে। আর বাড়ির মেইন দরজার কোণায় হারিকেন রাখা। লাইট থাকা স্বত্বেও হারিকেন রাখাটা বাকি সবার কাছে আশ্চর্যজনক হলেও গ্রামবাসীদের কাছে যে বাঁধা ধরা নিয়ম এটা। তারা মনে করে, বাড়ির মেইন গেইটের সামনে একটু আগুন থাকলে বাড়িতে ভূত প্রেত কম প্রবেশ করে। অশুভ ছায়াও আসে না।

হারিকেনটাকে পাশ কাটিয়ে দর্শিনী বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। উঠোনের দিকে ভালো করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই সে অবাক হলো আকাশসম। বাড়ির উঠোনে কত মানুষ! বাবা-মা,বড়দা,ছোটদা,বড়বৌদি,ছোটবৌদি,ধৃষ্ট,দৃষ্টান্ত,মৃত্যুঞ্জয়, ছোট কাকী, জেঠু, জেঠিমা, মেঝো কাকী। বাবা, জেঠু ওরা কাঠের চেয়ারে বসা। কাকীরা বেতের মোড়াতে বসে আছে। মা আর নিপা বৌদি উঠনের কোণায় জারুল গাছটার নিচে বসা। বাড়ির প্রতিটি ঘরেই আলো জ্বলছে। দৃষ্টান্ত দাঁড়িয়ে আছে ধৃষ্টের গলা ধরে। মাঝে মাঝে ধৃষ্টের করা প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছে। আর মৃত্যুঞ্জয় পায়চারী করছে। পড়নের সাদা শার্টটা পিঠের জায়গা দিয়ে ঘামে ভিজে পিঠেই লেপ্টে আছে। চুল গুলো কপালের উপর এলোমেলো করে পড়া। হাতে কালো একটা ঘড়ি। সাথে কালো প্যান্ট। একদম জেন্টালম্যান লুক। কিন্তু চেহারার মাঝে দুশ্চিন্তার ছাপ। বার বার ফোনে কাকে যেন কল দিচ্ছে। দর্শিনী কিছু একটা ভেবে নিজের ফোনের দিকে তাকালো। হ্যাঁ, সে ভুল ভাবে নি। মৃত্যুঞ্জয় তাকেই কল দিচ্ছে। কলটা নিশব্দে হাতের মুঠে অনবরত বাজতে বাজতে কেটে গেলো। এবার নোটিফিকেশনে বাবার নামের আগে আরেকটা নাম যুক্ত হলো, মৃত্যুঞ্জয়। দর্শিনী হাসলো,বাবার চেয়েও উদ্বেগ হওয়ার মানুষ তবে এলো!

দর্শিনীকে দেখে যেন উপস্থিত বেশ কয়েকজনের আত্মায় পানি এলো। প্রতাপ সাহা চেয়ার থেকে উঠে মেয়ের দিকে এগিয়ে এলো। মৃত্যুঞ্জয়ও দ্রুত এগিয়ে এলো।

“তোমায় আমি যথেষ্ট বিবেকবান ভেবেছিলাম, মা। কিন্তু তুমি কী করলে এটা? কোথায় ছিলে সারাটা দিন? এসবের অর্থ কী, মা?”

প্রতাপ সাহার প্রশ্নের বিপরীতে দর্শিনী কেবল মাথা নত করে ফেললো। এ বাড়িতে থাকতে আজকাল তার লজ্জা করে। রোজ রোজ তার জন্য ঝগড়া, অশান্তি হয়। এটা কোনো মেয়ের কাছে বা কোনো মানুষের কাছেই সম্মানজনক না।

“প্রতাপ,তুই সবসময় তোর মেয়েকে আশকারা দিয়ে এসেছিস,যার জন্য আজ তোর মেয়ে এমন অবাধ্য, উশৃংখল হয়েছে। এখন অন্তত তোর শাসন করা প্রয়োজন ছিলো, অথচ তুই মাখনের মতন আচরণ করছিস! অদ্ভুত!”

আজ নিজের জেঠুর কথাও দর্শিনীর কাছে ঠিক মনে হচ্ছে। সত্যিই, বাবা তাকে শাসন করে নি এ জীবনে। তাই হয়তো এমন হয়ে গেছে জীবনটা। এত এলোমেলো!

“বড়দা,কিছু মনে করবেন না, শাসন তো আপনারও করা উচিৎ ছিলো আপনার বড় মেয়ে মিতুলকে। স্বামী, সংসার, দু বছরের ছেলেকে রেখে অন্য কারো হাত ধরে পালানোর কথা তাহলে আর তার মাথায় আসতো না। মিথুন অবশ্য ভালো ছেলে তাই তাকে নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু আপনার মিতুল তো অবাধ্য সন্তান হয়েছেই।”

ছোট ভাইয়ের বউয়ের কথায় দাঁত কিড়মিড় করে উঠে প্রতাপ সাহার বড় ভাই আনন্দলাল সাহা। আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসানোর স্বরে বলে,
“ছোট বউ,বেশি বড় বড় কথা বলো না। বিধবা মেয়েমানুষের এত তেজ আসে কোথা থেকে! যত্তসব। আমার ভাইটার আত্মাও শান্তি পাবে না তোমার বেলাল্লাপনার জন্য।”

“কথা তো বলা শুরুই করি নি। শুরু করলে মুখ লুকানোর জায়গা পাবেন না, দাদা। আমার স্বামী আমার জন্য না হলেও আপনাদের আচরণ দেখে যে শান্তি পাবে না সেটা নিশ্চিত। আপনাদেরই তো রক্তের ভাই ছিলো। মানুষটা মারা যেতেই তার সম্পত্তির জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। আমাকে আর আমার ছোট বাচ্চাটাকে টিকতে দেন নি। আরও কিছু বলবো নাকি এ টুকুই হবে?”

আনন্দমোহন নিজের স্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লেন, “গিন্নি, এখান থেকে চলো। দিন দিন মেয়ে ছেলে বেশরম হচ্ছে। এদের সাথে কথা বলাও যেন দায় হয়ে গেছে। সেধে সেধে ঝাঁটার বাড়ি খেতে আসছি। আমার তো খারাপ লাগে এ বাড়ির বৌদের জন্য। বেচারি রা ননদের জ্বালায় ভালো করে হয়তো সংসার করতে পারছে না।”

“আসেন কেনো জেঠা মশাই সেধে সেধে? আপনাদের কেউ আসতে বলে?”

দর্শিনীর শীতল প্রশ্নে তাজ্জব বনে গেলো সব। মেঝো কাকী ছি ছি করে বলে উঠলো,
“ডিভোর্সি মেয়েছেলের এত মুখ চালানো শোভা পায়? ছি।”

দর্শিনীকে বিক্ষিপ্ত করার জন্য এ কথা নামক ছুড়িই যেন যথেষ্ট ছিলো। হঠাৎ করেই সে চুপ হয়ে গেলো। আশপাশ হাতরেও যেন কথা পেলো না বলার মতন। মৃত্যুঞ্জয় শক্ত কণ্ঠে জবাব দেওয়ার আগেই ছোট ধৃষ্টের মোলায়েম কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ডিভোর্সি কী গো? আমার বন্ধুরা আমার সাথে মিশে না। আমার পিসিমনি নাকি খারাপ। সংসার ছাড়া মেয়ে। এসব বলে ওরা আমাকে অনেক ক্ষ্যাপায় জানো। আমার খুব লজ্জা লাগে ওদের কথা শুনে। ওরা যে আমার সাথে খেলে না তাই কষ্টও লাগে। পিসিমনি,তুমি চলে যাও না পিসেমশায়ের কাছে। তোমার জন্য আমার বন্ধুরা আমাকে লজ্জা দেয়।”

বিশাল আকারের বজ্রপাত যেন হলো উঠানে। আট বছরের একটা বাচ্চার মুখে এসব কথা কতটা অবিশ্বাস্যকর সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই ই বাচ্চাটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটা না বুঝে যে কী বলে ফেলছে তা ধারণার বাহিরে।

সবাই যখন ধৃষ্টকে দেখতে ব্যস্ত তখন মৃত্যুঞ্জয় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো দর্শিনীর দিকে। সে জানে,এই মেয়েটা এত বড় একটা কথা হজম করতে পারবে না কখনো। মৃত্যুঞ্জয়ের গলা শুকিয়ে যায়।

দর্শিনী কতক্ষণ তাজ্জব বনে ধৃষ্টের দিকে তাকিয়ে থাকে। সমাজে, বাড়ির মানুষ তাকে ছাড় দিবে না ঠিক আছে কিন্তু এতটুকু একটা বাচ্চাও তার দুর্বলতা দেখিয়ে দিলো? সে কতটা নিচ সেটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো?

নিধি ছুটে এসে ছেলের গালে চড় থাপ্পড় মারা শুরু করে। ঘটনার আকষ্মিকতায় সবাই হতভম্ব। দৃষ্টান্ত ধৃষ্টের পাশে ছিলো বলে তাড়াতাড়ি সে নিধির হাত ধরে ফেলে। ধৃষ্টকে তার পিঠের পিছনে লুকিয়ে ফেলে। নিধির রাগে শরীর যেন থরথর করে কাঁপছে। ছেলের কান টেনে রাগী কন্ঠে বলে,
“বাহির থেকে এসব শিখে আসিস। তোকে বলেছি না এসব কাউকে বলতে না? তাহলে বললি কেনো জা*নো*য়া*র। আমি তো এদের চোখের বিষ হয়েছি এখন কী তুই ও হবি?”

নিধির শাসন করে বলা কথা গুলো যেন ধৃষ্টের পক্ষেই রইলো। আকারে ইঙ্গিতে যেন বুঝালো ধৃষ্ট কাজটা ঠিক করেছে।

ধৃষ্ট মায়ের মার খেয়ে কেঁদে কেটে অস্থির। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দর্শিনীকে অভিযোগের স্বরে বললো,
“পিসিমণি,জানো মা ঘরে বলেছে তুমি নাকি অভিশাপ।মরে গেলে সবার মঙ্গল।”

ধৃষ্টের বলা প্রতিটা কথা যেন একেকটা বোমার মতন ব্লাস্ট করছে। দর্শিনী তাজ্জব বনে নিজের পরিবারের সদস্য গুলোর দিকে চোখ বুলালো। নিধি ততক্ষণে মুখে আঁচল চেপে ছেলেকে নিয়ে ঘরে ছুটে গিয়েছে। দর্শিনীর জেঠু সুযোগ পেয়ে আরও কয়েকটা বাক্য ব্যয় করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছে। তার পিছে জেঠিমা আর মোঝো কাকীও চলে গিয়েছে। পুরো বাড়িতে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে গুটি কয়েকজন। দর্শিনী,নিপা,ছোটদা,বড়দা,প্রতাপ,মৃত্যুঞ্জয়,দৃষ্টান্ত,ছোট কাকী আর মা।

দর্শিনী ধীর গতিতে ঘরের দিকে অগ্রসর হতে নিলেই প্রতাপ সাহা মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিশ্চুপে জড়িয়ে নেয় মেয়েকে বুকের মাঝে যেন সমাজের সমস্ত কথার তীর থেকে সে মেয়েকে এভাবেই বাঁচিয়ে ফেলবে।

বাবার বুকে নিষ্প্রাণ লেপ্টে থেকে দর্শিনীর নির্লিপ্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আমি অভিশাপ না, তাই না বাবা? আমি তো আশীর্বাদ তাই না? তুমি না বলো,মেয়ে হলো বাবা-মায়ের আশীর্বাদ। আমিও তো তাহলে তোমার আশীর্বাদ তাই না?”

প্রতাপ সাহা আজ কাঁদলেন। দু’চোখের নিরব অশ্রু বিসর্জন দিয়ে প্রকাশ করলেন নিজের হাহাকার, অসহায়ত্ব। বাবা হিসেবে আজ সে ব্যর্থ। তার ব্যর্থতা যেন আকাশ বাতাসকে কাঁপিয়ে তুলেছে। হুমায়ুন আহমেদ হয়তো এ জন্যই বলেছে,”পৃথিবীতে হয়তো অনেক খারাপ পুরুষ আছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই।”

_

তীব্র ফিনাইলের গন্ধে মাথায় ভোঁতা অনুভূতিরা চুপসে আছে। মায়াকে ইমার্জেন্সি বিভাগে নেওয়া হয়েছে। মেয়েটার মুখ কেমন ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে।

ওয়েটিং রুমে পায়চারী করছে বিহঙ্গিনী, বিপ্রতীপ, হৈমন্ত,মোহনা,নিলয় কুমার। মায়া যখন অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারালো তখন সবকিছু ভুলে বাড়ির মানুষ গুলো তাকে নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো। মায়াকে পাঁজাকোলে করে বাড়ির বাইরে আসতেই হৈমন্তের চোখে পড়ে। হৈমন্ত নিজের গাড়িতে উঠিয়ে তাদের হসপিটালে নিয়ে আসে। ভয়ে তার কলিজা শুকাচ্ছে। মেয়েটা কয়েকদিন প্রচুর ভয় পেতো নিজের জীবন নিয়ে, হৈমন্ত বার বার সাহস দিয়ে এসেছে অথচ আজ মেয়েটার এ অবস্থা! এটা কী ঐ মহিলারই কারসাজি? মহিলাকে তত উৎকণ্ঠিত দেখা যাচ্ছে না আবার খুশিই লাগছে না। আপাতত মোহনাকে বুঝা পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিপ্রতীপ উপায় পেলো না। নিজেকে কেমন ছন্নছাড়া লাগছে। সকারে চাকরি চলে গেলো, এখন মায়ার এ অবস্থা। তার এখন কাউকে প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতেই রাত বারোটার উপর কাটা পৌঁছুতেই ফোন লাগালো সে। অপরপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই দুনিয়ায় অসহায়ত্ব নিজের কণ্ঠে ঢেলে দিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো,
“শুভ জন্মদিন প্রিয়দর্শিনী। আই নিড ইউ।”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ পয়ত্রিশ

দখিনা বাতাসে যখন লেবুর ঘ্রাণ ভেসে এসেছিল তখন রাতটাকে আরেক ধাপ নিঃসঙ্গ মনে হয়েছিলো। ঘরের টিনের উপর ডাহুক ডাকছে কী ভীষণ করুন সুরে। কী ভীষণ অসহায়ত্ব সেই সুরখানায়! আজ মুক্ত ডাহুক হতে পারে নি বলে দর্শিনী নিজের নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্বটা প্রকাশ করতে পারে নি। বাবার চোখের জল দেখেও পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে ছিলো। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া টা ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ছেলে হলে নিশ্চয় এত কিছু সহ্য করতে হতো না। মেয়ে বলেই হয়তো বাবার চোখের জল হয়েছে, ছেলে হলে বাবার ঘাড়ের দায়িত্ব ভাগ করার মানুষ হতো। মেয়ে জীবন এতটা বৃথা কেনো! আজ মেয়ে বলেই কী ডাহুকের চেয়েও বেশি পরাধীন দর্শিনী! একটা সামান্য জীব হয়ে ডাহুকও নিজের হাহাকার উজাড় করে দিতে পারছে তবে দর্শিনী কেনো নয়! কারণ সে কেবল মানুষ না, মেয়ে মানুষ, পরাজয়ের ফানুস।

নিজের বিষাদ যখন প্রকৃতিতে ঢেলে দিতে মত্ত দর্শিনী তখনই ফোনটা শব্দ করে কেঁপে উঠে। ফোনের দিকে তাকিয়ে নাম্বারটা পরিচিত নাকি অপরিচিত ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে যায়। দ্বিতীয়বার রিং বাজতেই ফোনটা ধরে সে। ক্ষীণ স্বরে “হ্যালো” বলতেই বিপ্রতীপের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“শুভ জন্মদিন প্রিয়দর্শিনী। আই নিড ইউ।”

আকষ্মিক এমন কথায় চমকে গেলো দর্শিনী। কয়েক মুহূর্ত কেবল সে ভাবলো,এই কথা খানা বলা ব্যাক্তিটা তার ভ্রম না সত্য! কিঞ্চিৎ ভাবনাচিন্তার পর যখন সে ধাতস্থ হলো এটা বিপ্রতীপ সে তড়িৎ গতিতে কেঁপে উঠলো।

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে বিপ্রতীপ দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো। নিবিড় কণ্ঠে আবার বললো,
“কথা বলবে না আমার সাথে, দর্শিনী?”

দর্শিনীর হাত-পা অসার হয়ে গেলো। প্রায় কত গুলো দিন পর বিপ্রতীপ এত ভালো করে কথা বলছে? দিন বললে ভুল হবে,অনেক গুলো মাস পর বিপ্রতীপ এত নরম স্বরে কথা বলছে। প্রায় দশ এগারো মাস। দর্শিনী স্মৃতির কোণায় কোণায় হাতরেও পেলো না বিপ্রতীপ কবে বদলেছে সেই তারিখ। বিপ্রতীপ একদিনে বদলায় নি, প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে। দর্শিনীকে অসহ্যকর একটা জীবন দিয়ে বিপ্রতীপ বদলেছে। তবে আজ, এতদিন পর এত শীতলতা কেনো!

“দর্শিনী, তুমি কী আছো লাইনে? কথা বলছো না কেনো? কথা বলবে না?”

দর্শিনীর ধ্যান ভাঙলো। মুখ চোখ কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেলো। হৃদয় মাঝে কালো রাঙা মেঘ সরে গিয়ে উত্তপ্ত লেলিহান শিখার উদয় হলো। সেই লেলিহান শিখায় উৎপন্ন হওয়া ক্রোধ ছুঁড়ে মেরে বললো,
“কথা বলার কথা তো ছিলো না। আমাদের কথা তো সেই কবেই ফুরিয়েছে। তবে আজ নতুন করে এত জাঁকজমক ভাবে সেটা জিজ্ঞেস করছো যে?”

বিপ্রতীপ থমকালো,বিরস কণ্ঠে বললো,
“আমি ক্লান্ত দর্শিনী। ভীষণ ভাবে ক্লান্ত গো। আর একটা বার আমার ক্লান্তি দূর করার মানুষ হবে? কথা দিলাম, আর কখনো কষ্ট দিবো না।”

বিপ্রতীপের এমন কথায় হতভম্ব দর্শিনী। এত গুলো বছর পর আজ বিপ্রতীপের মনে পড়লো দর্শিনীর কথা? অথচ এই দর্শিনীও তো কতবার আগলে নিতে চেয়েছে সেই হৃদয়হীন পুরুষকে, তখন কই ছিলো সে মানুষ? অতীত ভেবে তাচ্ছিল্য হাসলো দর্শিনী। তাচ্ছিল্য কণ্ঠেই বললো,
“বাহ্,মায়ার মজা শেষ তবে? তোমার নূন্যতম লজ্জা কবে হবে আমি জানিনা, মরার আগে আর একটা বার মানুষ হওয়ারও তো চেষ্টা করলে পারো। আর কত নিচে নামবে? কিছু তো শরম করো।”

দর্শিনীর তাচ্ছিল্য কথায় আজ বিপ্রতীপের রাগ হচ্ছে না, বরং তার মনে হচ্ছে সে এটারই যোগ্য। তবুও আরেকটা বার নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার মানুষটাকে পেতে হলে সে কিছু কথা তো সহ্য করতেই পারবে।

দর্শিনী হঠাৎ করে রেগে গেলো। উচ্চস্বরে বললো,
“আর কখনো যদি তুমি আমায় কল দেও তবে মনে রেখো,তোমার জন্য ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করছে। তোমাদের টাকা আছে তাই আইন আটকে রাখতে পারছে না তোমাদের তবে আমারও কিন্তু ধ্বংসলীলা চালানোর সামর্থ্য কম নেই। তুমি মায়ার কাছে কলটা দেও, ওর সাথে কথা আছে।”

বিপ্রতীপে মুখ চোখ শক্ত হলো। দর্শিনীর এমন কড়া কথা যে তার ভালো লাগলো না সেটারই বহিঃপ্রকাশ ঘটালো তার অঙ্গভঙ্গি। সে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“মায়া অসুস্থ দর্শিনী। হঠাৎ করেই পেট ব্যাথায় নিশ্চল হয়ে গেছে সে। তাই হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে।”

দর্শিনী বিপ্রতীপের বিরক্তি স্বরে বলা কথা গুলো শুনে তাজ্জব হয়ে গেলো। যে মানুষটা পছন্দ করে বিয়ে করা স্ত্রী হসপিটালে ভর্তি সে কীভাবে এসব নোংরামি করতে পারে? এরা আদৌও মানুষ।

ঘৃণায় দর্শিনীর শরীর রি রি করে উঠলো। এক দলা থু থু ফেলে বললো,
“তোমার মতন নোংরা পুরুষ পৃথিবীতে আর দুটো নেই। ছোট্ট মেয়েটার এই অসুস্থতায় তুমি আমাকে তেল মারতে এসেছো? ভেবেছো গলে যাবো? কি নোংরা গো তুমি! লজ্জা করে না তোমার তাই না? নষ্ট পুরুষ।”

বিপ্রতীপ এবার রেগে গেলো। রাগী স্বরে বললো,
“আমি নোংরা হলে তুমি কী ভালো? ভেবেছো আমি কিছু বুঝি না তাই না? কোর্টে যে সেদিন তোমার আশিক তোমার খেয়াল রাখলো, কত নাটক দেখালো আমরা বুঝি না এসবের মানে? তুমি কোথাকার ভদ্র গো?”

বিপ্রতীপের এহেন কণ্ঠের পরিবর্তনে হা হয়ে গেলো দর্শিনী। তবে এটা জানা কথাই, বিপ্রতীপের স্বার্থে আঘাত লাগলে সে মুখোশ খুলতে দু সেকেন্ডও দেরি করে না। কিন্তু মায়ার জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে,মেয়েটা হঠাৎ করে অসুস্থ হলো কীভাবে? নাকি এসব ঐ বাড়ির মানুষের কারসাজি?

দর্শিনী ভেবে কূলকিনারা পেলো না কী করবে সে, অতঃপর ধীর কণ্ঠে বললো,
“আমি আসছি বিপ্রতীপ, খুব শীগ্রই আসছি। তৈরী থেকো।”

দর্শিনীর শেষ কথায় বিপ্রতীপের মুখে হাসি বিস্তৃতি লাভ করলো। ফোনটা ধীর হাতে কেটে দিলো। তন্মধ্যেই ইমার্জেন্সি রুম থেকে বের হয়ে এলো ডাক্তার। বিহু এগিয়ে গেলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মায়ার কী হয়েছে, ডাক্তার? হঠাৎ মাংস খাবার পরই এমন ব্যাথা শুরু হলো কেনো? কী সমস্যা!

হৈমন্ত চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভেবে রেখেছে, যদি মোহনার কারসাজি হয় এটা তাহলে সে মোহনাকে ছাঁড়বে না। দরকার হয় জীবনের প্রথম ও শেষ খু*নটা মোহনাকেই করবে।

কিন্তু হৈমন্তের ভাবনায় পানি ঢেলে ডাক্তার উচ্চারণ করলো অন্য বাক্য,
“মায়ার দুটো কিডনির অবস্থা বেশ খারাপ। একটা কিডনি পুরো ৯৫% নষ্ট হয়ে গিয়েছে, আর তার সাথের টা এটার সংস্পর্শে থেকে ৫৫% ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। খুব শীগ্রই আপনারা ডোনার খুঁজে বের করুন। নাহয় মেয়েটাকে বাঁচানো যাবে না। আর,খাবারের জন্য কিছুই হয় নি।”

হৈমন্ত যেন থ বনে গেলো। মায়ার শরীরে এত বড় রোগ অথচ তারা টের পেলো না! রোগটা তো আর একদিনে হয় নি,বছরের পর বছর যাবত হয়েছে তবে তারা টের পেলো না কেনো? নাহ্,এত তাড়াতাড়ি এই সাহসী মানবীকে জীবনের কাছে হারতে দেওয়া যাবে না।

_

আজকে যে দর্শিনীর জন্মদিন, সেটা সে ভুলেই গিয়েছিল। বিপ্রতীপ মনে না করালে হয়তো মনে পড়তো না। কি অদ্ভুত! অথচ আগে তার জন্মদিনে রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে বাড়িতে একটা খুশির আমেজে ভরে যেতো। দর্শিনী নিজেই খুব উদগ্রীব থাকতো নিজের জন্মদিন নিয়ে। জন্মদিন আসার দশদিন আগে থেকে সবারে বলে বেড়াতো। ভীষণ ছটফটে ছিলো কিনা। অথচ সে মেয়েটার কি বিরাট পরিবর্তন। সময় সব পারে। এইযে, ছটফটে দুরন্ত স্বভাবের দর্শিনীকে কেমন নির্জীব করে দিয়েছে!

_

সকাল হতেই দর্শিনী পরিপাটি হয়ে গেছে। আজ সে একটা জায়গায় যাবে, সেখান থেকে পারলে আজই শহরে যাবে। ঐ বাড়ির রহস্য মিটাতে হবে তাকে। এখন, এই মুহূর্ত থেকে রহস্য উদঘাটন শুরু না করলে বিরাট কিছু হতে পারে। তার মনটা যে ভীষণ কু গাইছে।

জলপাই রঙের শাড়িটা বেশ মানিয়েছে দর্শিনীর গোলগাল শরীরে। চোখে গাঢ়ো কাঁজল,ঠোঁটে গোলাপি রঞ্জক। কি মোহনীয় তার রূপ! কবি দেখে মুগ্ধ হয়ে দু লাইন ছড়া বেঁধে হয়তো বলতেন,

“নারীর প্রতি মোহের দৃষ্টি ফেলো নাকো নষ্ট পুরুষ,
মুগ্ধতায় নারীকে খোঁজো, সে যে এক স্নিগ্ধ ফানুস।”

দর্শিনী উঠোনো পা দিতেই প্রতাপ সাহা মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে কি যেন একটা বের করে পড়িয়ে দিলেন মেয়ের গলায়। দর্শিনী অবাক হয়ে চাইলো। ওমা,স্বর্ণের চেইন!

প্রতাপ সাহা মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,
“জন্মদিনের শুভেচ্ছা, মা।”

দর্শিনী কিঞ্চিৎ হাসলো, জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। ধীরে ধীরে বড়দা ছোটদাও এগিয়ে এলো। বড়দা কোনোরকম খুড়িয়ে হাঁটতে পারে। ছোটদা এগিয়ে এসে দর্শিনীকে স্বর্ণের এক জোড়া কানের দুল দিলো। দর্শিনী উঁচু পেট নিয়ে প্রণাম করতে গেলে দু’হাত দিয়ে আটকে দেয় ছোটদা। বোনের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে ছোট বেলার মতন আদরের ঝুড়ি খুলে দেয়।

প্রদীপ মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। একটা সাদা শপিং দর্শিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“শুভ জন্মদিন, পুতুল। তোর বড়দা এখন অক্ষম। অত দামী দামী উপহার দিতে পারছে না। এই সামান্য উপহার টুকু নে।”

দর্শিনী ভাইয়ের মুখ চেপে ধরলো। শাসনের স্বরে বললো,
“তোমরাই তো আমার উপহার দাদা। অমন অলুক্ষণে কথা বলবে না বললাম। কী এনেছো গো? কাঁচের চুড়ি?”

প্রদীপ টলমলে দৃষ্টিতে হ্যাঁ জানালো। দর্শিনী খুশিতে আহ্লাদী হয়ে গেলো। তারপর কিছু একটা ভেবে রান্নাঘরে তাকালো। আগে বাবার বাড়ি থাকতে বড়বৌদি জন্মদিনের দিন সকাল বেলা পায়েস রান্না করে দিতো। আজ বোধহয় দিবে না। ছোট্ট শ্বাস ফেললো সে। মা বোধহয় ঘরে আছে। প্রণাম করে আশীর্বাদ চাইতে হবে। প্রতিবার দর্শিনী একাজ টাই করেছে। অতঃপর সে ছুটলো মায়ের রুমের দিকে। মাকে প্রণাম দিবে,বড় বৌদি আর ছোট বৌদিকেও দিবে।

কিন্তু নিপার ঘরের সামনে যেতেই থমকে গেলো দর্শিনী। না চাইতেও সজাগ হয়ে উঠলো কান। নিপা ফোনে কাকে যেন বলছে,
“তুমি বলেছো বলেই আমি প্রিয়কে মেনে নিয়ে ভালো আচরণ করেছি।”

দর্শিনী অবাক হয়ে গেলো। তাহলে ছোট বৌদি এতটা ভালো আচরণ অন্যের কথা শুনে করেছে! কিন্তু কেনো?

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ ছত্রিশ

মাথার উপর ফ্যানের নিরলস ভনভন শব্দ, বাহিরে ডাকা কাকের কণ্ঠ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে বাসনপত্র নাড়াচাড়া করার শব্দ। দর্শিনী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ক্রন্দনরত নিপার সামনে বসে আসছে। তার কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘামের রাশি। ছোট বৌদিকে সে এখনও অব্দি রুক্ষ স্বরে কিছু বলে নি, তার আগেই মানুষটা কাঁদছে। এটা কী কেবল দর্শিনীর মন ভোলানোর জন্য!

“বৌদি,কান্নাটা বন্ধ করে আমাকে একটু খুলে বলবে প্লিজ,তুমি কার কথায় আমার সাথে এতটা ভালো অভিনয় করলে? আর আমার সাথে অভিনয় করার প্রয়োজনই বা কী ছিলো? আমি তো সর্বস্বহারা, তোমাকে তো অভিনয়ের পরিবর্তে কিছু দিতে পারবো না। তাহলে কিসের জন্য করলে এটা?”

দর্শিনীর কথার পরিবর্তে নিপা আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে। কান্না টা ঠিক আসল না নকল বোঝা মুশকিল। কান্নার জন্য কেঁপে কেঁপে উঠেছে তার শরীর। কথা বলতে পারছে না সে। কণ্ঠ তার কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠেছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে এতক্ষণ কথা বলা ব্যাক্তিটার নাম্বারটা বের করে ফোনের স্ক্রিনটা দর্শিনীর সামনে ধরলো। দর্শিনী বার কয়েক পাপড়ি ঝাপ্টালো, সে ভুল দেখছে না তো! ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে “দৃষ্টান্ত” নাম টা।

দর্শিনী অবাকের সপ্তম আকাশে চলে গেলো। দৃষ্টান্ত ছোট বৌদিকে বলেছে তার সাথে ভালো আচরণ করতে! কিন্তু কেনো? দর্শিনীকে সুখী করার জন্য! নাকি অন্য কিছু? বৌদিও বা শুনলো কেনো ওর কথা! কিসের বাধ্যবাধকতা দৃষ্টান্তের সাথে বৌদির!

হাজের খানেক প্রশ্ন উত্তর বিহীন দর্শিনীকে বিচলিত করে তুললো। সে দৃষ্টান্তকে ভুল বুঝতে পারছে না অথচ দোষীর কাঠগড়ায় আজ দৃষ্টান্ত। ছোট বেলা থেকেই ভাইদের পর যে ছেলেটাকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতো আজ সে মানুষটাকেই অবিশ্বাস করতে হবে! ভাগ্য তাকেই কেনো বার বার এমন পরীক্ষার মুখে ফেলে? তার সাথে এত নির্দয়তা কিসের!

দর্শিনী ক্লান্ত হলো ভাবতে ভাবতে। হাতড়ে পেলো না উত্তর। তবে আর নয়,যে যেমন ভাবে পারছে তাকে নাচিয়ে যাচ্ছে। আর কত?

দর্শিনী ক্রোধে ফেটে পড়লো। চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো তার। নিপার দিকে আঙ্গুল তাক করে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“হয় আমাকে সবটা সত্যি বলো,নাহয় তুমি এ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য। কী চাচ্ছো তুমি?”

নিপা দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরলো। এ মুহূর্তে নিপার যেন কাউকে জড়িয়ে ধরার খুব প্রয়োজন ছিলো। আর সে জানে, জড়িয়ে ধরার জন্য দর্শিনীর চেয়ে উত্তম কেউ হবে না। কারণ এই মেয়েটা পিঠ পিছে ছুড়ি মারতে জানেনা।

নিপাকে অনবরত অসহায়ের মতন কাঁদতে দেখে নরম হলো দর্শিনী। শীতল কণ্ঠে বললো,
“বৌদি,আমার দোষ কী ছিলো গো? তোমাদের ঘাড়ে এসে বসাটাই আমার দোষ? তাই বুঝি একেকজন এমন রঙ বদলাচ্ছো? এসব করো না গো,ভীষণ কষ্ট হয় আমার। তোমাদের তো আমি বড্ড ভালোবাসি, তোমাদের আচরণ আমাকে যে শেষ করে দিচ্ছে। আমি চলে যাবো এ বাড়ি থেকে, তবুও রঙ বদলের খেলায় মেতো না তোমরা।”

নিপা শব্দ করে কাঁদলো। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো দর্শিনীকে। অস্ফুটস্বরে বললো,
“আমি রঙ বদল করি না গো প্রিয়। আমি তোমার সাথে একটু ভালো আচরণ করার চেষ্টা করেছি কেবল। ভালো হয়ে দেখি জীবন কতটা সুন্দর। আর দৃষ্টান্ত আমাকে অভিনয় করতে বলে নি। বলেছে তোমার সাথে ভালো আচরণ করতে। এখানে কোনো অভিনয় ছিলো না গো।”

“তাহলে তুমি নিজের ইচ্ছায় ভালো আচরণ করো নি? সবটা দৃষ্টান্ত দা এর কথায় করেছো! কিন্তু কেনো? তুমি তার কথাও বা কেনো শুনেছো!”

“কারণ বিয়ের এত গুলো বছর পরও আমি তাকে ভালোবাসি। খুব বেশিই ভালোবাসি।”

দর্শিনীর যেন মনে হলো সে ভুল শুনেছে। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে সে নিপার দিকে। এটা আদৌও সম্ভব! দৃষ্টান্ত দা কে ছোট বৌদি ভালোবাসে! তবে কি দৃষ্টান্তদা এর প্রথম প্রেমিকা ছোট বৌদি ছিলো? এ জন্যই কী ছোটদা এর বিয়ে হওয়ার পর দৃষ্টান্ত দা এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিয়ে ছিলো? অথচ দর্শিনী দৃষ্টান্তকে আগা হতে গোড়া অব্দি চিনতো। তবে কী চেনার মাঝে ভুল ছিলো!

দর্শিনী হতভম্ব মুখ খানা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তবে তুমিই কী ছিলে দৃষ্টান্তাদা এর প্রথম ভালোবাসা?”

নিপা মুখ চেপে ধরলো, কান্না ছিটকে যেন না বের হয় সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। দর্শিনী না থামতে বললো, না স্বান্তনা দিলো। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে এক ব্যর্থ প্রেমিকার আর্তনাদ দেখলো। মানুষটা তাহলে এ জন্যই সবসময় এত পাষান হয়ে থাকতো? বিয়ের ছয় সাত বছর পরও এ জন্য ই কী স্বাভাবিক হয় নি শ্বশুর বাড়ির মানুষ গুলোর সাথে!

দর্শিনীর সব প্রশ্নের উত্তর আছে নিপার কাছে সেটা সে ভালো করেই জানে। তাই নিপাকে আপাতত একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন, নিপা আজ সব বলবে এটা দর্শিনী জানে। অনেকবছর যাবত বলতে না পারার যন্ত্রণা আজ নিপা উজাড় করবে। দর্শিনীও প্রস্তুত হলো সবটা শোনার জন্য।

নিপার কান্নার গতি থেমেছে তবুও কিঞ্চিৎ কেঁপে কেঁপে উঠছে কণ্ঠধ্বনি। সেই কম্পিত কণ্ঠধ্বনি নিয়ে উচ্চারণ করলো তার যন্ত্রণাদায়ক অতীত,
“আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগের কথা। এই এলাকায় তখন আমার মামার বাড়ি ছিলো,আমার বেশ যাতায়াত ছিলো তাই এ গ্রামে। দৃষ্টান্ত আর আমি তখন কাছাকাছি বয়সেরই ছিলাম। আমার বয়স উনিশ কিংবা কুড়ি আর দৃষ্টান্ত বাইশ তেইশের সুপুরুষ। আমি খুব কমই গ্রাম ঘুরতে বের হতাম, একদিন অপরাহ্নে গ্রামের দক্ষিণ দিকের সূর্যমুখী বাগানের কাছে দৃষ্টান্তের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। দু’জনেরই টগবগিয়ে অনুভূতি হানা দিলো, অতঃপর শুদ্ধ প্রনয়। দু বছর বেশ ভালোই ছিলাম কিন্তু দু বছর পর আমার ভাগ্যে নেমে এলো কাল। দৃষ্টান্ত তখন ক্যারিয়ার নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত, বাবা ব্যস্ত আমার পাত্রের খোঁজে।

দৃষ্টান্ত বাবার কাছে কোন মুখে আমার হাত চাইবে? তখন সে বেকার। একদিকে ক্যারিয়ার, আরেকদিকে প্রিয়তমা। সে যখন দ্বিধার সাগরে ডুবন্ত প্রায় তখন তার ভিসা এলো। তার ঝলমলে ক্যারিয়ার গঠনের সবচেয়ে উত্তম সুযোগ। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। বেশ কড়া গলায় বললাম তাকে আমায় যেন ছেড়ে দেয়। সে মানলো না আমার কথা, শুরু করলো পাগলামি। আমার বাবার কান অব্দি গেলো সে পাগলামি। প্রচন্ড মার খেলো দৃষ্টান্ত। আমাদের গ্রামে গিয়েছিল আমাকে বুঝানোর জন্য, তখনই ভাড়াটে লোক দিয়ে অনেক মারলো তাকে। র*ক্তা*ক্ত দৃষ্টান্ত পরে রইলো পথের ধারে। শুধু মাত্র আমি তার পাশে এসে দাঁড়াবো সেই আশায়। কিন্তু আমি তখন শক্ত পদার্থ হয়ে গিয়েছিলাম। র*ক্তা*ক্ত দৃষ্টান্তকে দেখে হৃদয় আমার আরও পাষাণ হলো। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যা-ই হোক দৃষ্টান্ত আজ বেকার বলে আমার বাবা যে আচরণ করেছে একদিন তার জন্য লজ্জিত হবে। দৃষ্টান্তের ক্যারিয়ার দেখে সে আফসোসের দহনে পুড়বে। আমার অনীহায় মূর্ছা গেলো দৃষ্টান্ত ৷ প্রায় কত গুলো দিন নিরুদ্দেশ ছিলো। ততদিনে আমিও বসে গেছি বিয়ের পিঁড়িতে। মনের মাঝে রাজ্যের ক্ষোভ নিয়ে পা দিলাম তোমাদের বাড়ি। তুমি খেয়াল করে দেখো,আমি তোমাদের সবার সাথে কেমন আচরণ করতাম। আমি অতটাও অমানুষ ছিলাম না গো। পরিস্থিতি আমাকে এমন বানিয়েছে। আমার এমন স্বার্থপরতা সহ্য করতে না পেরে দৃষ্টান্ত পাড়ি জমালো ভিনদেশ। আর আমি,আজও আরেকবার ভালোবাসার চেষ্টা করে যাচ্ছি তোমার ভাইকে। আজ আমি বুঝি,তোমাদের তো কোনো দোষ ছিলো না তবে এত অনীহা তোমাদের আমি কেনো দিলাম! তোমাকে বেশি কষ্ট দিয়েছি নিজের মনগড়া ক্ষোভের কারণে। তখন মনে হতো তুমি হয়তো সবটা জানতে আমাদের প্রনয়ের কথা তবুও তুমি কোনো পদক্ষেপ নেও নি। অথচ এত গুলো বছর পর দৃষ্টান্ত আমার ভুল ভাঙলো সেদিন। তুমি না করা কাজের শাস্তি পেয়েছো এতদিন। আর আমিও কত বোকা, তখনের ষোলো বছরের কিশোরী কতটুকুই বা আমাকে সাহায্য করতে পারতো? ভালোবাসার কাছে মাঝে মাঝে সব যুক্তিতর্ক হেরে যায়। আজ বিয়ের সাতটা বছর যাবত চেষ্টা করছি তোমার ভাইকে ভালোবাসার কিন্তু তা আর পরলাম কই? আজও তো নির্দ্বিধায় বললাম আমি দৃষ্টান্তকে ভালোবাসি। ভালোবাসা কী আর বার-বার হয় গো? এমন করে কত ভালোবাসার গল্প চাপা পড়ে বাস্তবতার নিচে। কেউ জানেনা, কেউ রাখে না সে খোঁজ। তবে হ্যাঁ, তোমার ভাইকে আমি স্বামীর অধিকার দিয়েছি। এতবছর তার সাথে থেকে বেশ শক্তপোক্ত একটা মায়া জন্মেছে তার প্রতি। যার জন্য চাইলেও আমি তাকে ছাড়তে পারবো না। ভালোবাসা অন্তরে পুষে বাঁচা যায় তবে মায়া কাটানো সম্ভব না। তবে আজীবনের জন্য ভালোবাসাটা থেকে যায় খুব গোপনে।”

দর্শিনী এতক্ষণ কেবল হা হয়ে শুনলো সব ঘটনা। হ্যাঁ, অনেকবছর আগে দৃষ্টান্তদা একবার নিখোঁজ হয়ে ছিলো। এরপর হুট করে বিদেশ চলে গেলো। দর্শিনীদের বাড়ি আসাও কমিয়ে দিলো। অথচ এত গুলো বছর সে কিছুটি টের পেলো না! কী অদ্ভুত!

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে নিপা এগিয়ে এসে দর্শিনীর দু’হাত চেপে ধরলো। ততক্ষণে তার কান্নাও থেমে গেছে। দর্শিনী প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো নিপার দিকে। নিপা তা দেখে মুচকি হাসলো। দু-হাত দিয়ে চোখের পাপড়িতে, গালে লেপ্টে থাকা জলের কণা গুলো মুছে অনুরোধের স্বরে বললো,
“দৃষ্টান্ত আরেক বার যেহেতু অতীত ভুলে ভালোবাসতে পেরেছে, তবে তার ভালোবাসাটা রক্ষা করো প্রিয়। ছেলেটা আবারও একই ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না যে! একটা মানুষ আর কতবার প্রেমের দহনে পুড়বে বলো? মিলিয়ে দিও তাদের।”

দর্শিনী উত্তর দেওয়ার আগেই নিপা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। দর্শিনী তপ্ত এক শ্বাস ফেললো। ব্যাথিত স্বরে নিজেই নিজেকে বললো,
“প্রেম অনলে পরলে প্রিয়,পুড়ে হবে ছাই,,
তবুও এ প্রেমের মাঝেই স্বর্গ খুঁজে পাই।”

উঠোনে পা রাখতে আরেকদফা চমকালো দর্শিনী। বড়বৌদি পিতলের বাটিখানায় পায়েস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি নেই আবার কাঠিন্যতাও নেই। কিন্তু বড়বৌদির এ আচরণে দর্শিনী রীতিমতো হতবাক।

#চলবে