পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
205

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-৩১+৩২+৩৩

মাথার উপর শব্দহীন ঘুরছে ফ্যান। পরিবেশটা একদম নীরব। এতক্ষণের কৌতূহল, আনন্দ সব চাপা পরে গিয়েছে আকষ্মিক ভীতির কাছে। দর্শিনী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এখানে হলোটা কি! তাকে দেখে ভদ্রলোকের এমন আচরণের কারণটাই বা কি! লোকটা চিৎকার দিয়ে বাক্য দু’খানা উচ্চারণ করেই গটগট পায়ে বের হয়ে গিয়েছে। দর্শিনী কেবল বোকার মতন তাকিয়ে ছিলো। তার জানামতে সে এ লোকটাকে চেনে না, তাহলে তাকে দেখে এমন রিয়েক্ট করার কারণ কী?

লোকটা বাক্য দু’খানা ব্যয় করে বেরিয়ে যেতেই সবাই যেন স্বস্তির শ্বাস ফেললো। মৃত্যুঞ্জয়ের কাকী ধীর গতিতে বললো,
“গুড লাক আমাদের। মৃত্যুঞ্জয় এমন উচ্চ কণ্ঠ শুনলে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যেতো।”

দর্শিনীর পাশের ভদ্র মহিলাও মাথা নাড়ালো। দর্শিনী তখনও সবাইকে দেখে যাচ্ছে। তার মাথায় কিছুই ঢুকলো না।

মৃত্যুঞ্জয়ের মায়ের দিকে তাকিয়ে দর্শিনী শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
“উনি কে? আর আমাকে দেখেই বা এমন করলো কেনো? আমি তো উনাকে চিনিই না।”

মৃত্যুঞ্জয়ের মা দৈবশ্রী রায়,মিষ্টি হাসলেন। দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“উনি মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা। আমরা গ্রামে থাকি না বলে হয়তো চিনো না।”

ভদ্রমহিলার কথায় দর্শিনী ধীর কণ্ঠে বললো,
“ওহ্ আচ্ছা।”

দৈবশ্রী আর মৃত্যুঞ্জয়ের কাকী হেলেনা কি যেন চোখাচোখি করলো। অতঃপর হেলেনা মিষ্টি হেসে আমতা-আমতা করে বললো,
“দাদা ভাইয়ের কথায় কিছু মনে করো না ডার্লিং। ইউ আর ভেরি ভেরি বিউটিফুল লেডি। দাদাভাইয়ের উচ্চ বাক্যের কথা বড় সানকে বলো না কেমন?”

দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। সে তো এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিতে পারছে না, তার উপর দু’জন মহিলার মুখেই কেমন যেন একটা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। দর্শিনীর কুঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আরে আমি এটা উনাকে বলতেও বা যাবো কেনো! সামান্য ব্যাপার।”

“ডার্লিং ইউ নো,বড়বাবা আর দাব্রো দু’জন দু’জনের এনিমি। কেউ কারো সাথে কথা বলে না।”

ছোট্ট ধ্রুবের কথায় দর্শিনীর সন্দেহের তীর আরও ধারালো হয়। ভ্রু যুগল কুঁচকে যায় আরো খানিকটা। নিজের বাবার সাথে কথা বলে না মৃত্যুঞ্জয়! কিন্তু কেনো! যতটুকু মৃত্যুঞ্জয়কে দর্শিনী চেনে,ছেলেটা যথেষ্ট ভদ্র, সভ্য। অথচ সে নিজের বাবার সাথে কথা বলে না?

হেলেনা নিজের ছেলেকে ধমক লাগিয়ে দিলো নিজের ঘরে পাঠিয়ে দিলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে কথা ঘুরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বললো,
“আরে বিউটিবার্ড,তুমি কিচ্ছুটি মনে করো না ধ্রুবের কথায়। ও উল্টাপাল্টা বলে।”

দর্শিনী অবাক হলো। কথা ঘুরানোর ভঙ্গিমা দেখে তার অবাক ভাবটা আরও বাড়লো। কিন্তু সে প্রকাশ করলো না। তন্মধ্যেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো মৃত্যুঞ্জয়। সুঠাম দেহে কালো টি-শার্ট টা বেশ আঁটসাঁট হয়ে সেঁটে আছে। মুখভর্তি চাপদাড়ি। ফর্সা ধবধবে গলার বামদিকে কালো কুচকুচে তিল। মুখের মাঝে গাম্ভীর্যের ছোঁয়া। চোখ মুখে ফুটে উঠেছে ঘুম ঘুম ভাব। বোঝাই যাচ্ছে মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে।

দর্শিনী হালকা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। সচারাচর মৃত্যুঞ্জয়ের এমন এলোমেলো কিন্তু গুছানো ভাব দেখা যায় না। বেশ সুদর্শন বলা যায় লোকটাকে নির্দ্বিধায়।

মৃত্যুঞ্জয় শেষ সিঁড়িটায় পা রেখে বরাবর তাকাতেই ঘুম ঘুম চোখের ঘুম উবে গেলো। রাজ্যের বিষ্ময় নিয়ে সে মূর্তি হয়ে গেলো যেন। প্রিয়দর্শিনী! প্রিয়দর্শিনী এখানে! কীভাবে? আর কেন?

মৃত্যুঞ্জয়ের হতভম্ব অবস্থা দেখে তার কাকী হেসে উঠে। মেয়েটা বিদেশি হলেও বাঙালিদের মতন আন্তরিক। খুব সুন্দর বাংলাও পারেন। শরীরে শাড়ি জড়ানো,বাদামি রাঙা চুল গুচ্ছ,ধবধবে সাদা মুখ খানায় শোভা পাচ্ছে লাল টকটকে টিপ, সিঁথির মাঝে মোটা করে সিঁদুর। নির্দ্বিধায় বলা যায় সে ভীষণ সভ্য নারী। এদেশে এলে যে ভিনদেশী চালচলন দৃষ্টিকটু লাগবে এটা যেন তার ঢের জানা তাই এই দেশের মতনই তার সাজগোজ।

মৃত্যুঞ্জয় নিজের অবাক ভাবটা গিলে নিলো। দর্শিনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,
“বাহ্, আজ যে চাঁদের হাঁট বসেছে আমার বাড়িতে। তা চন্দ্রাবতী, আমাদের বাড়িটা আপনার পদধূলি দিয়ে ধন্য করার কারণ জানাবেন কী এই অধমকে? আমার টানে যে আসে নি সে আমি বড্ড জানি।”

শেষের কথাটা বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো মৃত্যুঞ্জয়। ওর সাথে তাল মিলিয়ে মা,কাকীও হেসে দিলো। দর্শিনী বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। আজ সে একের পর এক অবাক হয়েই যাচ্ছে। আজ যেন তার অবাক হওয়ার দিন।

দর্শিনীকে ঠাঁই বসে থাকতে দেখে মৃত্যুঞ্জয় হাসি থামালো। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“আরে মজা করেছি ম্যাডাম। আপনি হঠাৎ এসেছেন দেখে অবাক হলাম। আপনি আমাকে একটা কল দিলেই তো চলে যেতাম। এতটা পথ কষ্ট করে এ শরীরে এসেছেন। কোনো সমস্যা!”

“বাহ্, হিরো,এমন মিষ্টি মেয়েটাকে আমাদের সাথে তো পরিচয় করালে না আবার মেয়েটা নিজে এসেছে তাতেও দেখছি প্রশ্নের পাহাড় গড়ে তুলেছো। ভেরি ব্যাড হিরো।”

মৃত্যুঞ্জয় মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেললো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কথা ঘুরিয়ে বললো,
“আরে ফুলবৌ,তুমিও না অনেক পিঞ্চ মারতে জানো।”

হেলেনা মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় হো হো করে হেসে উঠলো। দর্শিনী অবাক হয়ে দেখলো তাদের কথপোকথন। কী সুন্দর বন্ডিং! এই পরিবারটাকে তার দারুণ লেগেছে।

তাদের মাঝে টুকটাক আরও কথা হলো। অবশেষে দর্শিনী বিদায় নিলো। মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে সে আপাতত দৃষ্টান্তের কাছে যাবে। কিছু একটা যে করতেই হবে।

দর্শিনীকে দরজা অব্দি এগিয়ে দিলো হেলেনা আর দৈবশ্রী। ভীষণ যত্নও করলো। দর্শিনী মুগ্ধ হলো। পরিবারটা দারুণ।

মৃত্যুঞ্জয় দরজা অব্দি এসে কিছু একটা ভেবে থেমে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় থামতেই থেমে গেলো আরও তিন জোড়া পা। মৃত্যুঞ্জয় হুট করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“দর্শিনীকে কেউ কিছু বলে নি তো, মা?”

মৃত্যুঞ্জয়ের এমন প্রশ্নে হতভম্ব সবাই। দর্শিনী হতভম্ব কণ্ঠেই বললো,
“কে কী বলবে আমাকে? অদ্ভুত প্রশ্ন!”

মৃত্যুঞ্জয় উত্তর দিলো না। বরং তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,
“ভদ্রলোক কোথায়?”

দৈবশ্রী আর হেলেনার বোধগম্য হলো সবটা। মৃত্যুঞ্জয় ঠিক কাকে বুঝাতে চেয়েছে সেটা আর বুঝতে বাকি রইলো না কারো। দৈবশ্রী কোনোরকমে আমতা-আমতা করে বললো,
“না,কেউ কিছু বলে নি। আর তোর বাবা গ্রামের পূর্ব দিকের দিঘিটা দেখতে গিয়েছে। কিনবে বোধহয়।”

“দেখো মা,ভুল করেও কোনোরকম কিছু যেন না ঘটে।”

“কিছু হবেনা। তুই চিন্তা করিস না।”

দর্শিনী পুরোটা সময় চুপ করে ছিলো। মৃত্যুঞ্জয়ের কণ্ঠটা তার কাছে এখন অন্যরকম লাগলো। নিজের বাবাকে এই ছেলেটা ভদ্রলোক কেনো বললো! মৃত্যুঞ্জয় তো এমন মানুষ না তাহলে?

মৃত্যুঞ্জয় ছোট্ট শ্বাস ফেলে বের হতে নিলেই দৈবশ্রী অসহায় কণ্ঠে বললো,
“তিনটা বছর যাবত এই কাঠিন্যতা বজায় রেখেছিস। একটু নরম হওয়া যায় না, বাবা?”

মৃত্যুঞ্জয় গটগট পায়ে বের হয়ে গেলো উত্তর বিহীন। হতাশার শ্বাস ফেললো দৈবশ্রী আর হেলেনা। দর্শিনী কেবল কুড়িয়ে নিয়ে গেলো কতগুলো প্রশ্ন। তিন বছর যাবত মৃত্যুঞ্জয় কিসের কাঠিন্যতা বজায় রেখেছে? আর নিজের বাবার প্রতি তার এত উগ্র আচরণই বা কেনো? এ যেন এক গোলকধাঁধা।

_

দু’তালা বাড়িটা নির্জন। কেমন ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা বিরাজমান। মায়া ও হৈমন্ত তন্নতন্ন করে খুঁজলো চিলেকোঠার ঘরখানা। নাহ্,এই ডায়েরীটা ছাড়া আর কোনো রকমের কিছু পায় নি তারা। দু’জন আপাতত ক্লান্ত হয়ে বসে আছে বিছানাতে। ভয়,উত্তেজনায় শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার।

নিস্তব্ধতা ঠেলে হৈমন্তের ফোন খানা বেজে উঠলো। মায়া খানিকটা কেঁপে উঠলো। মায়ার অস্বাভাবিক কেঁপে উঠা দেখে ভ্রু কুঁচকালো হৈমন্ত। মায়ার বাহুতে হাত রেখে শুধালো,
“তুই কী ভয়ঙ্কর কিছু ভাবছিস মায়াবতী? অতিরিক্ত ভয় পাচ্ছিস? কিছু হবে না তোর। আমি আছি না? বিশ্বাস রাখ আমার উপরে।”

“আমার মনে হচ্ছে আমরা বড় কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছি হৈমন্ত ভাই। খুব খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।”

“ধূর পাগলি,কিছু হবে না। আমি আছি তো তোর সাথে।”

মায়া তবুও ঘামছে। অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটতে পারে সে ভয়ে তার অন্তর আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ বাড়ির গেইট দিয়ে গাড়ির হর্ণ ভেসে এলো। চমকে উঠলো দু’জনেই। দু’জনের মাঝেই চোখাচোখি হলো। মায়া দ্রুত চিলেকোঠার ঘর থেকে বের হয়ে উঁকি দিলো ছাঁদের কার্নিশ ঘেষে নিচের দিকে। গেইট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করছে। গাড়ি থেকে বিহঙ্গিনী বেরিয়ে এলো। অতঃপর মোহনাকে ধরে বের করলো। মায়া অবাক হয়ে গেলো। এই অসুস্থ মহিলা হসপিটাল থেকে চলে আসলো কেনো? তবে কী মহিলার মাথায় অন্য কিছু আছে? মৃত্যুক্ষুধা কী তবে তাকে বাড়ি অব্দি টেনে আনলো?

হৈমন্তও ততক্ষণে চিলেকোঠার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অসুস্থ মোহনাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেখে সেও চমকে গেলো। মায়ার দিকে তাকিয়ে চঞ্চল কণ্ঠে বললো,
“এ মহিলা না অসুস্থ? তাহলে চলে এলো যে হসপিটাল থেকে? কিছু কী টের পেলো?”

“আমি জানিনা হৈমন্ত ভাই। তবে যা-ই হোক,এখন এ বাড়িতে আরও গেঁড়ে বসতে হবে। অনেক রহস্য বাকি আছে। তুমি এখন তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে তোমাদের বিল্ডিং-এ যাও।”

হৈমন্ত মাথা নাড়িয়ে “সাবধানে থাকিস” বলে এক লাফে চলে গেলো নিজের ছাঁদে। মায়া একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে বললো, “বাঁচা গেলো।”

কিন্তু মায়া জানেনা,বাড়ির নিচ থেকে একজন রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে এ দৃশ্য খানা দেখে।

_

“তুমি কী কিছুই করবে না, দৃষ্টান্ত দা?”

পুকুর পাড়ের নির্জন জায়গাটাতে বসে আছে দর্শিনী। তার সামনের পাঁকা করা বসার জায়গাতেই মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্ত বসা। দর্শিনীর প্রশ্নে নড়েচড়ে বসলো দৃষ্টান্ত। দৃষ্টি তার পুকুরের শ্যাওলা জলে।

মৃত্যুঞ্জয় গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তোকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছে।”

“আমার হাত থেকে সবটা বের হয়ে গেছে মৃত্যুঞ্জয়। আপাতত ভাগ্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই যে।”

ক্ষ্যাপে উঠলো দর্শিনী। বেশ উচ্চস্বরেই বললো,
“এসব বলে কাপুরুষেরা। আর যাই হোক, প্রেমিকদের মুখে এসব মানায় না। যদি প্রেমিকাকে আগলে রাখার সামর্থ্যই না থাকে তবে প্রেম করেছিলে কেনো!”

“নিজের বেঁচে থাকার কারণকে কে চায় হারাতে বল? আমিও চাই নি। যখন একবার হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলাম তখন এই মেয়েটা আমার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে শক্ত করে আগলে রেখেছিলো। কত হেলা,অপমান সহ্য করেও টিকে ছিলো। অতঃপর তাকে ফিরাতে ফিরাতে ক্লান্ত হয়ে আমি জড়িয়ে গিয়েছিলাম তার মায়ায়। কিন্তু কে জানতো,ভাগ্য বরাবরই আমার বেলাতে নিষ্ঠুর হবে?”

দৃষ্টান্তের কথায় দর্শিনীর সাথে সাথে মৃত্যুঞ্জয়ও অবাক হয়। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
“একবার হারিয়েছো মানে! তৃণা তবে তোমার প্রথম ভালোবাসা না?”

দৃষ্টান্তের অকপটে স্বীকারোক্তি,
“না,দ্বিতীয় আর শেষ ভালোবাসা।”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ বত্রিশ

চোখের পলকে কেটে গেলো দিন দুই। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি, পরিবেশেরও পরিবর্তন হচ্ছে। কেবল পরিবর্তন হয় নি তৃণার বিধ্বস্ততা, দৃষ্টান্তের অসহায়ত্ব। সেদিন পুকুর পাড়ে অনেক জোড়াজুড়ির পরও মৃত্যুঞ্জয় কিংবা দর্শিনী জানতে পারে নি দৃষ্টান্তের প্রথম ভালোবাসা কে। কিন্তু দৃষ্টান্তের শেষ ভালোবাসা আঁকড়ে রাখার আকুলতা দেখেছে। দর্শিনীর ভীষণ খারাপ লাগছে এদের ভবিষ্যতের বিচ্ছেদের কথা ভেবে।

নানান রকমের ভাবনা ভেবেই দর্শিনী হাঁটছে মাটির সরু পথটা দিয়ে। পাশে প্রতাপ সাহাও আছেন। উদ্দেশ্য হরমোহনের বাড়ি যাবে। বাবা-মেয়ে মিলে ভেবেছে ঠান্ডা মাথায় আরেকবার চেষ্টা করবে ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য। মেঘলা আকাশ, বৈরী বাতাস পরিবেশটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। বাবা মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে। দু’জনের মাঝেই নিস্তব্ধতা। আজ কত গুলো বছর পর বাবার হাত ধরে মেয়ে হাঁটছে! ছোট বয়সে, ছোট, ছোট হাত গুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরতো বাবার হাত। সেখানে কোনো দ্বিধা থাকে না। কারণ ঐ বয়সে তার একমাত্র আশ্রয় তো এই জন্মদাত্রী, জন্মদাতা। কিন্তু সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে ঢিলে হয়ে যায় আঁকড়ে ধরা হাতটা, তৈরী হয় কত দ্বিধা! সে দেয়াল টপকে আর বাবা-মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরা হয় না, যার জন্য জীবনে বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে হয়।

“মা,তোমার কী মনে হয়? হরমোহন এত সহজে সন্ধি করবে? কত ভাবেই তো তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম এ জমি আমি ছাড়বো না, সে তো মানলো না। তোমার কী মনে হয়,আবার বললে ও মানবে?”

প্রতাপ সাহার কথায় দর্শিনীদের নিস্তব্ধতার বেড়া ভাঙলো। দর্শিনী কতক্ষণ ঠোঁট উল্টে রেখে বললো,
“জানিনা বাবা,তবে আমি শুনেছি ভালোবাসা দিয়ে নাকি সব করা সম্ভব। আমরা তো রেষারেষি, হানাহানি দিয়ে এতদিন চেষ্টা করেছিলাম, পারলাম না। একবার ভালোবেসে চেষ্টা করে দেখি? আমি তো জানি, এটা দাদুর হাতের শেষ স্মৃতি যা তুমি হারাতে দিতে চাও না। আমরা নাহয় আরেকবার আঁকড়ে ধরবো।”

প্রতাপ সাহা হাসলেন। আবার কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেনও। অতঃপর মেয়ের মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে শীতল কণ্ঠে বললেন,
“ভালোবাসা দিয়ে সব জয় করা যায় কথাটা কিন্তু আজকাল ভুল,মা। যদি তেমনই হতো,তাহলে তোমার এত ভালোবাসার পরও তোমার প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির মানুষ তোমাকে এত অবহেলা দিতে পারতো না। আর এখন বড়বৌমা,যে এককালে তোমারে কত ভালোবাসতো, সে এমন হুট করে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না।”

বাবা যেন মোক্ষম সময়ে মোক্ষম কথাটা বললো। দর্শিনীর পায়ের গতি আরও কিছুটা ধীর হয়ে গেলো। বাবা তো ভুল কিছু বলে নি। সত্যিই তো,ভালোবাসা দিয়ে আদৌও সব সম্ভব! হয়তো হ্যাঁ, আবার হয়তো না।

দর্শিনী ছোট শ্বাস ফেললো। জীবনে যদি সবটার নেগেটিভ দিক বের করি তাহলে হতাশা ছাড়া কিছুই মিলবে না। তাই কিঞ্চিৎ নেগেটিভ জিনিস এড়িয়ে চলা ভালো, জীবনে খুশি থাকা যায়। দর্শিনী হাসলো। বাবার কথার উত্তরে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
“বাবা,কে বলেছে ভালোবাসা দিয়ে জয় করা যায় না? তুমি নিপা বৌদিকে দেখেছ? কীভাবে বদলে গেলো? এত বছর যে মানুষটা বাঁকা কথা ছাড়া সোজা কথার উত্তর দিতো না কাউকে,সে মানুষটা আজকাল কত নরম হয়েছে দেখেছো? আর বড়বৌদির কথা বলছো! যে মানুষটার আঁচলের তলে আমি মায়ের সুঘ্রাণ পেতাম সে মানুষটার সামান্য রুক্ষতা আমার বদল মনে হয় নি। তার শ্বশুর বাড়ি,স্বামী,বাবার বাড়ি সব মিলিয়ে সে ভেঙে পড়েছে। আমরা না বুঝলে কে বুঝবে, বাবা? আমরা তো জানি মানুষটা কী ছিলো। সব ঠিক হয়ে যাবে, বাবা। কিছু ভেবো না।”

প্রতাপ সাহা হাসলেন। মেয়েটা আজও বদলায় নি! এই মেয়েটা একদম ভিন্ন ধাঁচের। কখনো উত্তপ্ত আগ্নি,কখনো বা শীতল বারি।

“আরে দর্শিনী যে! কেমন আছো, মেডাম?”

নিজের সামনে সামান্য পরিচিত লোকটাকে দেখে থামলো প্রতাপ আর দর্শিনী। দর্শিনী হাত জোর করে বললো,
“নমস্কার হীমাদ্রি দা। ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ ভালো আছি। কাকামশাই,ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ বাবা,ভালো আছি। তোমার কী খবর?”

“ভালো কাকা।”

হিমাদ্রী ছেলেটার বিনীত আচরণ বড় ভালো লাগে প্রতাপ সাহার। গ্রামের সবচেয়ে ভদ্র, সভ্য ছেলে বলা যায় তাকে। কোনো ঝুট ঝামেলায় তাকে পাওয়া যায় না কখনো। হিমাদ্রীর ভাইয়ের সাথেই তৃণার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

হিমাদ্রী এবার দর্শিনীর দিকে দৃষ্টি দিলো। বোকা সোকা একটা হাসি দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে বললো,
“দর্শিনী,তোমাকে যে একবার স্কুল যেতে বলেছে বড় স্যার। আমি তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। তোমার তো চাকরিটা হয়েছে। কাল থেকেই পারলে জয়েন হতে পারো।”

আকষ্মিক চাকরি হওয়ার খবরটা পেয়ে দর্শিনী অবাক হয়ে যায়। সাথে প্রচন্ড রকমের খুশিও হয়। বাবা যে স্কুলের শিক্ষক ছিলো সন্তানও সে স্কুলের শিক্ষক হলে সেটা বাবার জন্য কতটা গর্বের! নিজের মাথাটা আরেকটু উঁচু করে বাঁচার একটা অবলম্বনও পেলো দর্শিনী। কিন্তু সেখানে বাঁধ সাধলো প্রতাপ সাহা। অবাক কণ্ঠে বললো,
“এখন চাকরি কীভাবে করবে? তোমার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন, সেখানে কিনা তুমি চাকরি করার কথা ভাবছো? না মা,এটা আমি পছন্দ করছি না।”

“কাকা মশাই, আপনি চিন্তা করছেন কেনো? মা হওয়াটা আশীর্বাদ স্বরূপ। সেটার উছিলায় কিছু করতে না দিয়ে অভিশাপ করে তুলবেন না গর্ভকালীন সময়টা। আর ও এখন বাসার বাহিরে থেকে নিজের মন রিফ্রেশ রাখবে সেটা আরও ভালো ব্যাপার। তাই না?”

হিমাদ্রীর কথায় প্রতাপ সাহা কিছু বললেন না। দর্শিনী বুজেছে,চাকরিটা করতে হয়তো বাবার সাথে মন কষাকষি করা লাগবে। কিন্তু বাবা ঠিক বুঝবে আশা করা যায়। কিন্তু হিমাদ্রীর সামনে মন কষাকষি টা বিদঘুটে দেখা যাবে বলে সে ছোট্ট কন্ঠে হিমাদ্রীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আমি কাল গিয়ে কথা বলবো আর পারলে কাল থেকেই শুরু করবো। ধন্যবাদ। নমস্কার।”

হিমাদ্রীও “নমস্কার” বলে হেলতে দুলতে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো৷ দর্শিনীরাও নির্দিষ্ট গন্তব্যে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু প্রতাপ সাহা মেয়ের সাথে আর কোনো কথা বললেন না। কিন্তু মেয়ের ধরে রাখা হাতটাও ছাঁড়লেন না। বরং আরেকটু শক্ত করে ধরে রাখলো সে হাত খানা। দর্শিনী হাসলো, বাবা হয়তো একেই বলে!

প্রতাপ আর দর্শিনী হরমোহনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। হরমোহনের বাড়ির ভিতরে কেউ একজন এসেছে বোঝা যাচ্ছে। তারা ভিতরে না গিয়ে বাহির থেকেই উঁকি দিয়ে চমকে উঠলো। দর্শিনী হা হয়ে তাকিয়ে রইলো বাড়ির ভিতরে থাকা মানুষটাকে দেখে। প্রতাপ সাহাও বেশ অবাক হলো। হরমোহন এবং সে মানুষটা প্রতাপ সাহার জমি নিয়েই আলোচনা করছে। কোনো মতে সে জমি ছাড়া যাবে না বলে হরমোহনকে হুমকি দিলো সে মানুষ।

দর্শিনী বাবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। বাবারও প্রায় একই দশা। হঠাৎ করে দর্শিনীর মুখ চোখ কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেলো। কঠিন কণ্ঠে বললো,
“এ জমি আমরা আর ছাড়ার কথা ভাববো না, বাবা। ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে মানুষ কতটা খারাপ, দেখলে? জান যায় যাবে,জমি কিন্তু ছাড়বো না।”

প্রতাপ সাহা কিছু বললো না কেবল মাথা নুইয়ে নিলো। বন্ধু যখন শত্রু হয়ে যায় তার কাছে ভালো কিছু আশাকরা নিত্যান্তই বোকামি।

_

মোহনা বাড়ি ফিরেছে আজ দু’দিন হলো। নিজের ঘর থেকে সে খুব কম বের হয়। নিত্যান্তই প্রয়োজন ছাড়া বেরই হয় না বলা যায়। সারাদিন ঘরে থাকে। কি যে করে একমাত্র সে-ই জানে।

আজ বিপ্রতীপকে জেল থেকে ছাড়ানো হবে বলে নিলয় কুমার থানায় গিয়েছে। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে মোহনা এই দু’দিন বিপ্রতীপকে ছাড়ানোে কথা বলে নি। বরং তার ভাব ভঙ্গিমা এমন যে বিপ্রতীপ জেলে থাকলেই ভালো। মোহনা নিজের স্বামীর সাথেও কথা বলা ছেড়েছে মাস খানেক আগে। প্রয়োজনে কেবল হু,হা জবাব দিতো। এই দু’দিন সে এটাও করে নি। সে বাড়িতে এমন ভাবে অবস্থান করেছে যেন তার কোনো অস্তিত্ব নেই।

মায়া নিজেকে বেশ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু যতবার মোহনার সামনে পড়ছে ততবারই ভয়ে তার শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। তার মনে হচ্ছে এই বুঝি মোহনা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে মে*রে ফেলবে তাকে। মায়ার ভয় হয়,এ মহিলা যা ভয়ঙ্কর খুব নৃ*শংস ভাবে না আবার খু*ন হতে হয় মায়াকে।

মায়া রান্নায় মগ্ন। হঠাৎ করে বিহঙ্গিনী আর মোহনার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তারা কোনো বিষয় নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি করছে বোধহয়। মায়ার আগ্রহ জাগলো। কি নিয়ে এত কথা কাটাকাটি হচ্ছে তা বুঝার জন্য সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে মোহনার ঘরে উঁকি দিলো। পর্দার আড়াল থেকে দেখা গেলো বিহঙ্গিনী মোহনার সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলছে,
“ভাইয়া,মারা যায় নি। তাই না মা? তুমি আমাদের মিথ্যা বলেছো। তুমি পাষাণ, মা। বড্ড পাষাণ। ভাইয়া কোথায় সেটা বলো।”

মোহনার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। ভীষণ বিচলিত দেখাচ্ছে তাকে। সে কোনো রকম নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এসব উদ্ভট কথা কেনো বলছো একটা মৃত ছেলের নামে? যে মা*রা গেছে সে তো শেষই। তাকে নিয়ে এসব বলার মানে নেই।”

মায়া অবাকের পাশাপাশি বিষ্মিতও হলো। কার কথা বলছে মোহনা আর বিহঙ্গিনী? যাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ছোট্ট মায়া এত কিছু ঘটিয়েছে, তার কথা? সে মানুষটা মা*রা গেছে! এ জন্যই বিয়ের এতদিন পরেও মায়া সে মানুষটার ছায়াও এ বাড়িতে দেখে নি!

মায়ার কথার মাঝে বিহঙ্গিনীর রাগান্বিত কথা ভেসে এলো,
“তুমি কী করেছো মা ভাইয়ার সাথে? ভাইয়া মারা যায় নি আমি জানি। তুমি ভাইয়াকে পা*গল বানিয়ে রাস্তায় ছেঁড়ে দিয়েছো তাই না? ভাইয়া না তোমার ছেলে ছিলো, মা? কীভাবে পারলে তাহলে এমন করতে? ভাইয়া তোমার ব্যাপারে কিছু জেনে গিয়েছিল তাই না, মা? আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু এখনো আমার মনে আছে, মাভক্ত ছেলেটা হুট করে কেমন বদলে গেলো। কাউকে সহ্য করতে পারতো না। তোমাকে,বাবাকে। কি করেছিলে মা বলো?”

মায়ার হাত পা অসার হয়ে আসে। এ মহিলা নিজের ছেলেকেও ছাঁড় দেয় নি! এ কেমন মানুষ! মায়া কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে গিয়ে বসলো। এ বাড়িতে তার থাকার দুঃসাহস আর হচ্ছে না।

_

“তুমি তো বোন, বড়বৌদি। তুমি তো একটু তৃণার পাশে দাঁড়াতে পারো। এমন করছো কেনো তুমি? হঠাৎ বদলে গেলে কেনো?”

দর্শিনীর প্রশ্নে নিধির কোনো হেলদোল নেই। সে নিজের মতন কাজ করছে। দর্শিনী অধৈর্য্য হলো। অধৈর্য্য কণ্ঠে বললো,
“এমন কেনো করছো, বৌদি?”

“যদি বলি তোমার জন্য!”

দর্শিনী অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমার জন্য! আমার জন্য করলে আমার সাথে করো। তবুও তৃণার পাশে দাড়াও প্লিজ।”

“পাশে দাঁড়াবো একটা শর্তে। সব আগের মতন করে দিবো। যদি তুমি রাজি হও।”

দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। বড়বৌদির কথার ধরণ কেমন বদলে গিয়েছে আগে থেকে। এখন কেবল কর্কশ স্বর ভেসে আসে। দর্শিনী মাথা দুলালো,নিবিড় স্বরে বললো,
“কী শর্ত?”

“আমার বড়দাকে তোমার বিয়ে করতে হবে। বলো,রাজি?”

দর্শিনী কেঁপে উঠলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“তোমার বড়দা সারাদিন মদের আড্ডায় পড়ে থাকে না? ছিঃ বৌদি, তুমি এতটা নিচ?”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ তেত্রিশ

বাড়িতে পিনপতন নীরবতা। ঝড় হওয়ার পর যে বিধ্বস্ততা থাকে ঠিক সে বিধ্বস্ততা বিরাজমান। আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনি করছে দর্শিনীর হাহাকার। তার কান্নায় জমিও বোধহয় খানিক ধ্বংস লীলা চালাতে চাচ্ছে। পুকুর পাড়ের শেষ সিঁড়িটাতে বসে দর্শিনী কাঁদছে। কাকে বিশ্বাস করবে সে! আজকাল তো মনে হচ্ছে সব মানুষই আপন নামের একটা মুখোশ জড়িয়ে রেখেছে মুখে। তাই তো,বারবার রচিত হচ্ছে ঠকে যাওয়ার গল্প। নিয়তি বার বার ধিক্কার জানাচ্ছে জীবনকে। এই হাহাকার করা বিশাল শূণ্যতা নিয়ে বাঁচা যায় আদৌও?

দর্শিনীর মনে পড়লো কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। বৌদি যখন বৌদির ভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলো,দর্শিনী তখন ক্ষ্যাপে উঠেছিলো। নিজের ভিতর রাগ চেপে না রেখে সে চিৎকার দিয়েই নিজের ভাইয়ের বৌকে কথা শোনাচ্ছিল। এক কান, দুই কান করে পুরো বাড়িতে কথা ছড়িয়ে গেলো। দর্শিনীর বড়দা বোনের চিৎকারের কারন জেনে আহম্মক বনে যায়। তার অর্ধাঙ্গিনী কিনা শেষমেশ এতটা কুরুচিপূর্ণ হলো! এমন নিকৃষ্ট কথা উচ্চারণ করলো কীভাবে! রেগে গিয়ে প্রদীপ নিজের স্ত্রীর গালে সশব্দে চড় বসায়। ঘটনা আরও বিশ্রী হওয়ার আগে প্রতাপ সাহা ছেলেকে ধমকে থামিয়ে দেয়। নিধি তখন কেবল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ছিলো স্বামীর পানে। তার এত বছরের বৈবাহিক জীবনে প্রদীপ হাত তুলবে দূরের কথা জোর গলায় একটা ধমক অব্দি দেই নি অথচ আজ!

নিধি এরপর আর কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। প্রদীপ কথা শুনালো, নিপা আর সুমনও কথা শুনালো। নিধি কেবল চুপ করে সবটা হজম করলো। অতঃপর ধীর পায়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। নিধির এই নিস্তব্ধতা যেন হঠাৎ করেই দর্শিনীর অপরাধবোধের কারণ হলো। বৌদি হয়তো জীবনটা গুছিয়ে দেওয়ার জন্য এমন প্রস্তাব দিয়েছিলো অথচ সে কেমন করে বৌদিকে সবার সামনে ছোট করলো! কিন্তু বৌদি একজন মাতাল ছেলের বউ হওয়ার কথা কীভাবে ভাবতে পারলো!

নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা জন্মালো দর্শিনীর। কতটা ফেলনা হয়ে গেছে সে! মায়ের মতন বড়বৌদিরও চোখের বিষ হয়ে গেলো। এতটা অভিশপ্ত জীবন থেকে মু্ক্তি মিলবে আদৌও!

দর্শিনীর হাতের ফোন খানা তার ভাবনার মাঝেই বেজে উঠলো। দর্শিনী খানিকটা চমকে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে মায়ার নামখানা। দর্শিনী অবাক হলো। এই সময় মায়ার ফোন দেখে সে কিঞ্চিৎ বিচলিতও হলো। মোহনার আবার ভালো-মন্দ কিছু হয়ে গেলো না তো! সেদিন তো মানুষটাকে ভীষণ অসুস্থ দেখেছে,এরপর আর খবরও নেওয়া হলো না মানুষটার। যতই হোক,একটা সময় ঐ মানুষটাকে তো সে মা ডাকতো। মা ডাকা মহিলাটার খারাপ সময়ে পাশে না থাকাটা তাকে গোপন লজ্জা দিলো। আজকাল কী সে বেশি স্বার্থপর হয়ে গেলো?

দর্শিনীর ভাবনার মাঝেই ফোনটা কেটে গিয়ে আবার নতুন উদ্যমে বেজে উঠলো। দর্শিনী আর অপেক্ষা না করে সাথে সাথে রিসিভ করলো। রিসিভ করতেই মায়ার বড্ড অস্বাভাবিক শীতল কণ্ঠ ভেসে এলো,
“সই,ভালো আছো?”

দর্শিনী অবাক হলো। মায়ার সাথে তার যতটুক কথা হয়েছে এ অব্দি, মায়ার কথার ধরণ খুব চঞ্চল। কিন্তু আজ, হঠাৎ এতটা নির্জীব কেনো মেয়েটা? তবে কী কোনো খারাপ খবর আছে?

দর্শিনী বিচলিত কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ ভালো আছি। মায়া, তুমি কেমন আছো?”

“ভালো আছি, সই। আচ্ছা সই,আমায় একটা কথা বলবে?”

দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। মায়া যেমন মেয়ে,কখনো পারমিশন চেয়ে কথা বলে নি। যখন যেটা বলতে ইচ্ছে করেছে তখন সেটাই বলেছে। আজ হঠাৎ অনুমতির প্রয়োজন পড়লো?

দর্শিনী ভাবনা গুলো নিজের মাঝেই রেখে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“হ্যাঁ বলো,কী বলতে চাও।”

“শাশুড়ি কেমন মানুষ ছিলো, সই? খুব অত্যাচার করেছে কী তোমার উপর?”

মায়া যেন আজ দর্শিনীকে অবাকের চরম পর্যায়ে নিয়ে যাবে। দর্শিনী বিষ্মিত হয়ে বললো,
“এসব প্রশ্ন কেনো করছো?”

“কারণ আছে, সই। প্লিজ বলো না। শাশুড়ী তোমাাকে শারীরিক অত্যাচার করেছে কখনো?”

“না,আমার শরীরে সে কখনো হাত দেয় নি। কেবল বিয়ের দিন চড় মেরেছিলো এত বছরের মধ্যে। এ ছাড়া মানসিক অত্যাচার সে প্রচুর করেছে। উঠতে বসতে খোঁটা দিতো। বাচ্চা হচ্ছে না বলে বন্ধ্যা ডাকতো, আরও অনেক কিছু।”

“অথচ সে আমার হাতে গরম তেল ঢেলে দিয়েছিলো। কথায় পারছে না দেখেই বুঝি হাতের ব্যবহার করেছে!”

নিজের সাবলীল উত্তরের বিপরীতে মায়ার এহেন কথায় চমকে উঠে দর্শিনী। শাশুড়িমা এতটা খারাপ মানুষ! এতটুকু একটা মেয়ের সাথে এমন নোংরা আচরণ সত্যিই মানায়? এত শখ করে না ছেলের দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি হলেন, তাহলে এসব কেনো করছেন!

নিজের মনে হাজের প্রশ্নের বেড়াজালে দম বন্ধ হয়ে আসে দর্শিনীর। মানুষ পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে মানুষের রুচি,জেদ,রাগ সবই বদলাতে পারে। হয়তো মোহনারও রুচি বদলিয়েছে। হয়তো নিজের ছেলের জন্য সে আরও ভালো কাউকে পেয়েছে।

মনে মনে হাসলো দর্শিনী। মায়ারও তবে কী দিন ফুরালো? না,এতটুকু মেয়ের সাথে এতবড় অন্যায় সে হতে দেবে না। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। দর্শিনী নিজের কণ্ঠটা কিঞ্চিৎ খাঁদে নামালো, প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো,
“তোমাকেও হয়তো তাড়াতে চাচ্ছে, মায়া। তুমি হাল ছেঁড়ো না। যে ভুল আমি করেছি নরম থেকে, সে ভুল তুমি করো না।”

“ভুল আমি করে ফেলেছি,সই। তবে আর না। আমার মনে হচ্ছে এ বাড়িতে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে সই। আচ্ছা,তুমি কী জানো শাশুড়ির আরও একটা ছেলে আছে?”

মায়ার কথা দর্শিনীর মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতেই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো শরীরে। শিরশির করে কেঁপে উঠলো সারা শরীর। সে বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“কী বলছো মায়া? এটা কী করে সম্ভব? আমি তিন বছর ছিলাম ও বাড়িতে, এমন কখনোই শুনি নি।”

“আমি সত্যি বলছি। খুব বিশ্রী কিছুর মাঝে আমি ফেঁসে গেছি সই। আমি বোধহয় নিজেকে বাঁচাতে পারবো না। এ বাড়ির যেই বিভীষিকাময় রহস্য, তার অতলে তলিয়ে যাচ্ছি আমি। আর হয়তো উপরে উঠতে পারবো না।”

মায়ার কণ্ঠে অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। দর্শিনী কিছু বলার আগেই মায়া ফোনটা কেটে দিলো। দর্শিনী কেবল অবাক হয়ে নিস্তব্ধ পুকুর পাড়টাতে বসে রইলো। তার মাথায় কিছু আসছে না। কি করবে সে! হঠাৎ দর্শিনীর সেদিনের কথা মনে পড়লো যেদিন বিহঙ্গিনী রাস্তার মাঝে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলো। দর্শিনী কিছু একটা ভেবে হাসলো। সে বোধহয় রহস্যের সামান্য সমাধান করতে পারবে।

_

বিপ্রতীপ জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। সে এখন বাড়িতেই আছে। তার এত সাধের চাকরি খানা চলে গিয়েছে। দু দু’বার জেল খাটা আসামিকে তো আর কেউ জেনেশুনে চাকরিতে রাখবে না। তাই আপাতত বাড়ির সব সদস্য বাড়িতেই। তবে সবাই আলাদা আলাদা রুমে। মোহনা এক রুমে,নিলয় কুমার আরেক রুমে,বিপ্রতীপ আর মায়াও আলাদা রুমে। কারো সাথে যেন কারো সম্পর্ক নেই। যেন কত গুলো প্রাণহীন মানুষ একটা বাড়িতে একসাথে বসবাস করছে।

মায়া এখন যতটুকু পারছে মোহনার সাথে সাবলীল ভাবে কথা বলছে। এ মহিলাকে রাগানো আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা যেন একই ব্যাপার।

প্রকৃতিতে এখন ঠিক ভর সন্ধ্যা। বাতাসে ভেসে আসছে যে সাবধান বাণী। খুব খারাপ কিছু হওয়ার সতর্ক বার্তা যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে বাতাসের তালে তালে। মায়া চিলেকোঠার ধূলোমাখা ঘরটাতে টিপটিপ পায়ে হাজির হয়েছে। তার মনে হচ্ছে আরও কিছু হয়তো এই ঘরটাতে লুকিয়ে আছে যা তারা দেখছে না। সেটা খুঁজে বের করতে হবে।

চিলেকোঠার ঘরটাতে পুরোনো আলমারি, খাট রয়েছে। একটা বুক সেলফ ও আছে। মায়া তন্নতন্ন করে আবার খোঁজ লাগালো। তাকে খুঁজে বের করতেই হবে এ বাড়িতে লুকানো রহস্য। মায়া বেশ খানিকটা সময় খোঁজাখুঁজি করে ক্লান্ত হলো। না,আর তো তেমন কিছুর দেখা মিলছে না।

মায়া ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো সামনের খাটতাতে। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে আশাপাশ তাকাতেই খোলা আলমারির এক কোণায় কিছু একটা দেখতে পায় মায়া। তৎক্ষনাৎ সে উঠে আলমারির দিকটাতে এসে সেই জিনিসটা বের করে। একটা মেয়েলি ড্রেস! না না,সাধারণ ড্রেস না এটা, কোনো স্কুল ড্রেস হবে। মায়া নেড়েচেড়ে দেখতে নিবে এর মাঝেই মোহনার বাজখাঁই গলা ভেসে এলো। ভয়ে মায়ার হাতটা থেকে জামাটা নিচে পড়ে গেলো। মায়া কোনোমতে জামাটা উঠিয়ে আলমারিতে রেখে ছুট লাগিয়েছে নিচে।

মোহনা কিছুটা সুস্থ এখন। বা’হাতটা নাড়াতে পারে না কিন্তু এমনেতে সে স্বাভাবিক সব করতে পারে এখন।

মায়া হুড়মুড় করে ড্রয়িং রুমে হাজির হয়। ঘামে লেপ্টে থাকা মুখটা মুছতে মুছতে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ শাশুড়ি, কিছু বলবেন!”

মোহনা হাসি হাসি মুখ করে তার হাতে থাকা বাটিটা এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“কষা মাংস রাঁধছি,দেখো তো লবন হলো কিনা। আমি তো মাংস খাই না। আমার বাবুর ভীষণ পছন্দের তো তাই রাঁধলাম। নেও ধরো।”

মায়া কিঞ্চিৎ অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। ধীর হাতে বাটিটা নিয়ে এক টুকরো মাংস মুখে নিয়ে চিবোতে লাগলো। হঠাৎ মোহনা ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
“এ বাড়ির প্রতিটা ইটের খবর আমি জানি, বৌমা। আর চিলেকোঠার খবর রাখবো না ভাবলে কী করে? ধূলোমাখা টেবিলে ধূলোর স্তূপ হালকা। তা সেখানে তোমার কী কাজ শুনি?”

মায়ার গলায় খাবার আটকে গেলো। নাকেমুখে কাশি উঠে গেলো। মায়ার অনবরত কাশির শব্দে সবাই ই বেরিয়ে এলো। মোহনা তার সাথে থাকা জলের গ্লাস টা এগিয়ে দিলো মায়ার দিকে। মায়া কোনো রকম জলটা মুখে দিয়ে গট গট করে পান করে নিজেকে ধাতস্থ করলো। বিপ্রতীপ, বিহঙ্গিনী,নিলয় কুমার – সবারই কৌতূহল দৃষ্টি মায়ার দিকে। কাশতে কাশতে মেয়েটার মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ মায়া কৌতূহল দৃষ্টি গুলোকে আরও কৌতূহল করতে গগণ বিদারক চিৎকার দিয়ে উঠলো। নিজের পেট চেপে বসে পরলো মাটিতে। চোখের নোনাজল ফেলে বললো,
“কী অসহ্য পেট ব্যাথা গো,আমি ম*রে গেলাম। আমাকে বাঁচাও প্লিজ।”

মায়ার চিৎকারে ভড়কে গেলো সবাই। সর্বপ্রথম বিহঙ্গিনী এসেই ওকে জড়িয়ে ধরলো। মায়া কোনোমতে ঝাপসা চোখে আশপাশে তাকালো। মোহনা কী তবে বাজিমাত করে দিলো!

#চলবে