পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-০৭+০৮+০৯

0
246

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-০৭+০৮+০৯

নিস্তব্ধ বিকেল, পরিবেশে। বিষন্নতা যেন আকাশে, বাতাসে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। পুকুরে পানি গুলো সামান্য দোল খেলে যাচ্ছে নিজের মন মতন। পাতিহাঁস গুলো ডেকে ডেকে সারা হলো। এ এক মন মাতানো পরিবেশ। পুকুরের লাল টাইলস করা বাঁধানো ঘাটের এক কোণায় বসে আছে প্রিয়দর্শিনী। তার সামনেই সুঠাম দেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়দর্শিনী কতক্ষণ চুপ থেকে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“প্রথমে তো আমি তোমাকে চিনতেই পারি নি,দৃষ্টান্ত দা। তুমি কিন্তু দারুণ দেখতে হয়েছো। কবে এলে দেশে?”

“তুই যেভাবে আমায় দেখে চমকে গিয়েছিলি। তোর ‘আপনি এখানে’ শুনে আমি তো প্রায় ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। দেশে এসেছি সপ্তাহ খানেক হলো। তুই কবে গ্রামে এলি? ঘরে না বসে পুকুর পাড়ে নিয়ে এলি কেনো?”

দৃষ্টান্তের প্রশ্নে দর্শিনীর হাসি কিছুটা কমে গেলো। তবে হাসির প্রদীপ নিভে যায় নি। কণ্ঠ কিছুটা খাদে নামিয়ে বললো,
“এইতো,আজই এলুম। তোমার সাথে আমার একটা কথা আছে, দৃষ্টান্ত দা। তুমি তো এখন এ গ্রামের সবচেয়ে ভালো ডাক্তার শুনলাম। তাই একটা দরকারেই এসেছি বলতে পারো।”

দর্শিনীর কথা বলার ধরণে ভ্রু কুঁচকালো দৃষ্টান্ত। পকেটে হাত গুঁজে ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কী দরকার, দর্শি? এভাবে বলছিস কেনো?”

দর্শিনী এবার ডানে বামে তাকালো। ধৃষ্ট দূরে দাঁড়িয়ে খেলছে। আশেপাশে জনমানসের চিহ্ন নেই। দর্শিনী প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো,
“আসলে দৃষ্টান্ত দা,আমার ভিতর আরেকটা প্রাণ বেড়ে উঠছে। এ সময় একটা ভালো ডাক্তারের সান্নিধ্যে থাকলে নাকি ভালো হয়। তাই এসেছিলাম তোমার কাছে। তুমি যদি আমার এ সময়ের চেক আপ টা করতে, অনেক উপকৃত হতাম।”

দৃষ্টান্ত চমকে উঠলো। চোখে মুখে উপচে পড়া খুশি ঝুলিয়ে বললো,
“বাহ্, অভিনন্দন আমাদের ছোট্ট দর্শি। ছোট্ট দর্শি মা হতে যাচ্ছে ভাবা যায়! তা এভাবে চো’রের মতন ফিসফিসিয়ে বলছিস কেনো রে?”

দর্শিনী থম মেরে গেলো দৃষ্টান্তের প্রশ্নে। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো অবহেলার দীর্ঘশ্বাস। চোখ গুলোতে ভীড় করলো যতনের নোনাজল। কণ্ঠ কেমন কেঁপে উঠলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ নিয়েই দর্শিনী বললো,
“এ কথা টা কেউ জানেনা, দৃষ্টান্ত দা। তুমিও কাউকে বলো না দয়া করে। গ্রামে এসেছি অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে। আমি চাই না আপাতত কেউ এ ঘটনাটি জানুক।”

দৃষ্টান্তের মনে সন্দেহের বীজ গাঢ়ো হলো। আনমনেই প্রশ্ন করলো,
“তোর স্বামী জানে তো?”
“নাহ্। সে এখন নতুন রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিচ্ছে। এটা জানার কোনো প্রয়োজন তার নেই। ধরতে পারো তাকে জানাবো না বলেই এতটা লুকোচুরি।”

দর্শিনী কথা থামিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো দৃষ্টান্তের দিকে। দৃষ্টান্ত বিপরীত পাশের বসার জায়গা টাতে আরাম করে বসলো। একটা ভ্রু উচুঁ করে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর হাসবেন্ডের কী আবার বিয়ে টিয়ে হয়েছে নাকি?”

দৃষ্টান্তের প্রশ্নে আৎকে উঠলো দর্শিনী। কীভাবে বুঝে গেলে দৃষ্টান্ত দা? দৃষ্টান্তের প্রশ্নে মাথা নিচু হয়ে আসলো তার। মিনমিন কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, নতুন বিয়ে করেছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করো না দৃষ্টান্ত দা। দয়া করো।”

“ঠিক আছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না। তোর প্রেগন্যান্সির কথা আর কেউ জানবে না। নির্দ্বিধায় বাড়ি ফিরতে পারিস। এ কয়েকমাস আমিই তোর চেক আপ করবো।”

দর্শিনী কৃতজ্ঞতার হাসি দিলো। ভাইয়ের ছেলের হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা হলো। সে চোখ বন্ধ করে দৃষ্টান্তকে বিশ্বাস করতে পারে। দৃষ্টান্ত আর যাই হোক,বেইমানী করবে না। সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে। সবসময় স্নেহের হাত রেখেছে মাথায়।

“পিসি,তোমার গোপন কথা বলা শেষ?”

ধৃষ্টের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে দর্শিনীর। মুচকি হেসে সে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ, শেষ আমার বাবা।”
“ডাক্তারের সাথে তোমার কী গোপন কথা, পিসি?”

দর্শিনী পড়লো মহা মুশকিলে। এ ছেলে প্রশ্নের পাহাড় নিয়ে বসেছে।

সরকার বাড়িতে হৈচৈ। এই মধ্য বিকেলে বাড়ির বউ ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত। পাড়ার কিছু ছেলেমেয়েও যোগ দিয়েছে তার সাথে। মোহনা কেবল খেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। তার শরীর ভীষণ ক্লান্ত। কত গুলো দিন পর আজ এত কাজ করলো। তার মনে নেই শেষ কবে সে রান্নাবান্না করেছিলো। দর্শিনী আসার পরে সংসারের ধূলি পরিমান কাজও সে করে নি। আজ অনেক গুলো দিন বা বলা যায় অনেক গুলো বছর পর কাজ করেছে। রান্নাঘর সামলিয়েছে।

হঠাৎ হৈচৈ শুনে মোহনার আরামে ভাঁটা পড়লো। বিরক্তিতে কুঁচকে এলো কপাল। এসময়ে হৈচৈ করছে কে? নতুন বউয়ের গলা পাওয়া যাচ্ছে না? মোহনা দ্রুত উঠে বসলো। নতুন বউটা তাকে শান্তি দিলো না। ছুট লাগালো সে ছাদে। নড়বড়ে কোমর নিয়ে এমন ছুটাছুটি তার বিরক্ত লাগছে। ছাদে উঠে মোহনার চোখ ছানাবড়া। নতুন বউয়ের হাতে ঘুড়ির সুতো।

মোহনা দ্রুত এগিয়ে গেলো মায়ার কাছে। আশেপাশের ছাদ গুলোতে মানুষের ভীড়। মোহনার লজ্জায় মাথা কাটা যায় অবস্থা। দ্রুত মায়ার সামনে গিয়ে খপ করে মায়ার হাত চেপে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বললো,
“বউ,কী করছো তুমি? তোমায় না সেদিন বলেছি নতুন বউরা এসব করে না। বউদের কাজ সংসার সামলানো।”

মায়ার ধ্যান তখন পুরো আকাশ জুড়ে। ঘুড়িটা না আবার কাটা যায়। শাশুড়ির কথা শোনার সময় তার নেই।

মোহনা বিরক্ত হলো। ছুটে গেলো ছেলের কাছে। বউকে একমাত্র ছেলেই সোজা করতে পারবে। সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে নিচে এসেই মোহনা হাঁক ছাড়লো,
“বাবু,বাবু দেখে যা তোর বউ কী করছে। বাবু।”

বিপ্রতীপ তখন সবে পাড়া বেরিয়ে ঘরে এসেছে। মাকে চিল্লাতে দেখে সে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বের হলো। ব্যাতিব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কী হয়েছে, মা? মায়া আবার কী করেছে?”

মোহনা যেন জব্বর সুযোগ পেলো বউয়ের নামে নালিশ করার। দ্রুত ছেলের কাছে এগিয়ে এলো। ন্যাকামি করে বললো,
“বাবু,তোর নতুন বউ ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছে। আমি কত নিষেধ করলাম শুনলোই না। পাড়া প্রতিবেশীরা মজা উড়াচ্ছে। তুই যা করার কর।”

বিপ্রতীপের মাথায় যেনো কেউ বিনে পয়সায় আগুন লাগিয়ে দিলো। মেয়েটার সাথে প্রেম করার সময় তো এত দস্যি মনে হয় নি। তবে, মেয়েটা এমন কেনো? এর একটা বিহিত করতেই হবে। বিপ্রতীপ ছুটলো ছাদে, বিহিত করার জন্য।

“এই সুতো ছাড় আরও, বল্টু। সুতো ছাড় তাড়া,,,”

বাকি কথা উচ্চারণ করতে পারলো না মায়া। সপাটে চড় পড়লো তার গালে। কিছুক্ষণের জন্য তার পৃথিবী যেন থমকে গেলো। চারপাশের হৈচৈ হঠাৎ করেই নিশ্চুপতা গ্রাস করলো। সবাই যেন মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা টা বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত। হলো টা কী?

মায়া তার বাম গালে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকালো। জাম রাঙা টিশার্ট শরীরে জড়ানো সুঠাম দেহী বিপ্রতীপ রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া হতবিহ্বল। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“আপনি আমায় চড় মেরেছেন!”

বিপ্রতীপের তখন রাগে শরীর কাঁপছে। রক্ত লাল চক্ষু জোড়া নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“হ্যাঁ, আমি মেরেছি। ছাড়া গরুকে দু এক ঘাঁ না দিলে বঁশে আনা যায় না। তাই দিয়েছি।”

মায়া কতক্ষণ টলমলে দৃষ্টি নিয়ে বিপ্রতীপে দিকে তাকিয়ে রইলো। মিনিট এক পেরুতেই পাশের ছাদ গুলোর দিকে তাকালো। সবাই কেমন হা করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ার দৃষ্টি গেলো ছাদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা শাশুড়ির দিকে। যার মুখে মুচকি হাসি।

মায়া নিজের চোখের কোণে আঙুল দিয়ে চিকচিক করা জলটুকু মুছে ফেলল। হাতের লাটাই টা ছুঁড়ে মারলো দূরে। বিকট শব্দ করে ভেঙে গেলো কাঠের লাটাই টা। বিপ্রতীপও সে শব্দে খানিকটা কেঁপে উঠলো। মায়া কাঠের লাটাইয়ের ভাঙা একটা টুকরো কুড়িয়ে নিলো। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ভাঙা টুকরোর কোণাটা দিয়ে শক্ত এক আঁচড় কাটলো বিপ্রতীপের ডান হাতে। বিপ্রতীপ সাথে সাথে বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে উঠলো। ফর্সা হাত খানায় লাল মোটা এক আঁচড় স্পষ্ট হয়ে ফুলে গেছে।

মোহনা হায় হায় করে ছুটে এসে ছেলের হাতটা আঁকড়ে ধরলো। মায়া বাঁকা হেসে মা ছেলের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“ছাড়া গরুও যে পাল্টা জবাব দিতে জানে সেটা দেখিয়ে দিলাম। আমি প্রিয়দর্শিনী না। আমি মায়া। শক্তের জম, নরমের ছায়া।”

গটগট পায়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো মায়া। পাশের ছাদে দাঁড়ানো ছেলেটা মুচকি হাসলো। মায়াকে যে সবাই চিনতে পারে না!

সারা গ্রাম ঘুরে সবে বাড়িতে পা রাখলো দর্শিনী আর ধৃষ্ট। মৃত্যুঞ্জয় তাদের উঠোনে বসে আছে। মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে সামান্য ভ্রু কুঁচকালো দর্শিনী। ছেলেটার কী আর কোনো কাজ নেই? সারাদিনই এ বাড়িতে পরে থাকে!

দর্শিনীকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখেই তার মা সরলা প্রশ্ন করলো,
“কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”

দর্শিনী স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
“এইতো,একটু গ্রামটা ঘুরে দেখে এলুম।”

“এই পিসি,তুমি মিথ্যে বলো কেনো? তুমি তো শুধু গ্রাম ঘুরো নি।”

ধৃষ্টের কথায় হৃৎপিণ্ড ছলাৎ করে উঠে দর্শিনীর। উপস্থিত সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকায় দর্শিনীর পানে। নিপা রান্নাঘরে ছিলো। ধৃষ্টের কথা শুনে ছুটে এসে গদোগদো কণ্ঠে ধৃষ্টকে প্রশ্ন করে,
“তাহলে তোমরা কোথায় গিয়েছিলে,বাবা?”

“আমরা তো ভালো ডাক্তারের বাড়ি গিয়েছিলাম। পিসি তো অনেকক্ষণ লাগিয়ে গোপন কথা বলেছে ডাক্তারের সাথে।”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ আট

বাড়ির উঠনো নিস্তব্ধ পরিবেশ। কিছুক্ষণ আগে ধৃষ্টের বলা কথা যেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বো’মার মতন ফেটেছে। নিপা ছিঃ ছিঃ করে উঠে বললো,
“দেখেছেন তো মা,পরের ছেলের দোষ দিয়েছেন সংসার ভাঙার জন্য। আসল দোষী কে দেখুন। গ্রামে আসতে না আসতে আপনার মেয়ের বেলেল্লাপনা শুরু। ছিহ্।”

“তুমি এসব কী বলছো,বৌদি? ধৃষ্টের কথা শুনেই এসব বলছো। আমাকে তো আগে সবটা পরিষ্কার করে বলতে দিবে তাই না?”

দর্শিনীর কথা থামতেই তার মা বিরাট এক চড় বসালো মেয়ের গালে। টলমলে দৃষ্টি নিয়ে বললো,
“নিজের সংসার তো খেয়েছিস। এখন আমার সংসারেও কী ফাটল ধরাতে চাচ্ছিস, মুখপুরী?”

মা, বৌদির আচরণে ঘৃণায় দর্শিনীর শরীর রি রি করে উঠলো। বিষাদে ভরে উঠলো হৃদয়। বৌদি নাহয় বলেছে, কারণ সে পরের মেয়ে। কিন্তু মা? মা তো নিজের মানুষ। মা কীভাবে পারলো এটা বলতে?

“আপনারা ছোট্ট একটা বাচ্চার কথায় এতকিছু বলছেন। অথচ যে মানুষটা বিশ্লেষণ করতে চাইছে, তার কথাটাও শোনার চেষ্টা করছেন? অদ্ভুত!”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় দর্শিনীর চোখের জল আহ্লাদ পেলো যেন। দর্শিনী তাচ্ছিল্য হেসে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বুঝলেন,মেয়ে হলো সংসারের সবচেয়ে বড় বোঝা। আর সে মেয়ে যদি হয় সংসার ভাঙা তাহলে তো কথাই নেই। নিজের মা-ই যেখানে জ্বালা জ্বালা ভাবে সেখানে অন্য কারো কথা বাদ-ই দেন।”

মেয়ের কথা সরলার অন্তর আত্মা কাঁপালো। নেতিয়ে গেলো তার উত্তপ্ত রাগ। প্রতাপ সাহা এগিয়ে আসলেন। মেয়ের মাথায় আদুরে স্পর্শ করলেন। মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,
“কষ্ট নিও না মনে, মা। এ বাড়ি তোমার। এখানে কারো সাধ্য নেই তোমাকে পর করার। তোমার যেখানে ইচ্ছে তুমি যাবে। তোমার কাউকে জবাবদিহিতাও করার দরকার নেই। আমি বিশ্বাস করি তোমায়। আর কেউ কী ভাবলো না ভাবলো সেটা তোমার দেখতে হবে না।”

প্রিয়দর্শিনী জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। চোখের কোণ ঘেষে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। কণ্ঠ ক্ষাণিকটা কেঁপে উঠলো। অপরাধী কণ্ঠে সে বলে উঠলো,
“বাবা,আমি দৃষ্টান্ত দা এর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তুমি তো জানো দাদার সাথে ছোট বেলা থেকেই আমার কত ভালো সম্পর্ক। আমার মনে কোনো পাপ নেই, বাবা।”

ধৃষ্টের বলা কথা টা এবার পরিষ্কার হলো সবার কাছে। নিপার এতক্ষণের ঝলমলে মুখখানা চুপসে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় অবাক কণ্ঠে বললো,
“দৃষ্টান্তের কাছে গিয়েছিলেন? এটা প্রথমেই বলে দিতেন। আপনার মা, বৌদি তাহলে আর খারাপ কিছু ভাবার সুযোগই পেতো না।”

“ভাগ্যিস তখন বলি নি,নাহয় নিজের লোকদের মনের খবর জানতে পারতাম?”

দর্শিনীর কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ভাব। নিধি এবার এগিয়ে এলো। নিজের ছেলের কান টেনে ধরে শাসনের স্বরে বললো,
“এই ছেলের কথায়, নিপা তুই নাচছিস? জানিস না ও অর্ধেক কথা বলে আর অর্ধেক পেটে রাখে? আর মা, আপনিও? নিজের মেয়ের উপর একটু ভরসা রাখুন। আমার যখন বিয়ে হলো তখন প্রিয়ো ছিলো বারো তেরো বছরের ছোট্ট পাখি। তাকে নিজের হাতে বড় করলাম। এখন আমাকে কেউ গলা কেটেও যদি প্রিয়োর নামে কিছু বলে তবুও আমি বিশ্বাস করবো না। কারণ আমার নিজের লালন পালনের উপর ভরসা আছে। আর আপনি তো ওর মা, আপনি কীভাবে বার বার নিপার কথা শুনে ওকে অবিশ্বাস করেন? বলি হারি যাই,পারেনও বটে। মেয়েটা আসছে আজকে। এ অব্দি দুইটা চড় খেয়েও ফেলেছে। শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে একটু ভালো ভাবে বাঁচার জন্য বাবার বাড়ি এসেছে। আর সেই বাবার বাড়ি কিনা ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে? মা না বুঝলে কে বুঝবে?”

নিপা এবার আমতা-আমতা করা শুরু করলো। আমতা-আমতা করেই বললো,
“ধৃষ্ট যেভাবে বলেছিলো,যে কেউই তো খারাপ ভাববে, বড়দি। তাই আমিও ভেবেছি।”

“থাক,তুই আর কথাই বলিস না, ছোটজা। তোরও তো বিয়ে হয়েছে সাত আট বছর হলো। এত বছর যাবত প্রিয়োকে দেখছিস। এখনো চিনতে পারলি না? খালি উসকানি দেওয়ার তালে থাকিস।”

নিধির কথায় চুপ হলো নিপা। সরলাও আর কিছু বললো না। নিধি এবার ধীর পায়ে দর্শিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“অনেক হয়েছে কান্নাকাটি। এবার ঘরে চল। তোর জন্য যে হাত পুড়িয়ে রান্না করলাম একটু খেয়ে দেখলি না। খালি টো টো করে ঘুরার তালে থাকিস। এখন মাছের মাথাটা যে তোর আশায় বসে আছে, জানিস? চল খেতে। খাবার খেয়ে ঘুম দিবি। তোর জন্য তোর এই বড়বৌদিই যথেষ্ট। আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে। আর কেউ কিছু বলুক একদম শুনিয়ে দিবো।”

দর্শিনী জড়িয়ে ধরলো তার বৌদিকে। বড় বৌদি যত্নের হাত বুলিয়ে দিলো সারা অঙ্গে। মৃত্যুঞ্জয় অপলক চেয়ে রইলো দর্শিনীর দিকে। এই নারীতে সে যেভাবে আটকে গিয়েছে আর ফেরত যাওয়ার উপায় নেই। এখন কেবল দেখতে হবে তার ভাগ্যে কী আছে।

_

“তোমার সাথে তো আমার প্রণয়ের বিয়ে। তবে এত অশান্তি কেনো করছো সংসারে?”

নিজের হাতে বরফ ডলতে ডলতে বিপ্রতীপ মায়াকে প্রশ্ন করলো। মায়া চুল আঁচড়ানোতে মনোনিবেশ করে মুচকি হেসে বললো,
“তোমার সাথেও তো আমার প্রণয়ের বিয়ে, স্বামী। তবে,কেনো বলো নি ঘরে সতীন আছে?”

মায়ার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো বিপ্রতীপ। তার হাত ফসকে বরফের টুকরো টা নিচে পড়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“আসলে, আমি ভয় পেয়েছিলাম। তুমি যদি এটা জেনে আমাকে ছেড়ে দেও।”

বিপ্রতীপের কথায় মায়া মুচকি হাসলো। বাঁকা হাসি ঝুলিয়েই বললো,
“আর আমি কষ্ট পেয়েছি। তুমি ঘরে স্ত্রী থাকা স্বত্তেও আমাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছো। তুমি তোমার সেই স্ত্রীর প্রতিও তো অবিচার করেছো।”

মায়ার কথায় টনক নড়লো বিপ্রতীপের। হঠাৎ করেই দর্শিনীর শূণ্যতা গ্রাস করলো তার অন্তরে। তার মস্তিষ্ক জানান দিলো অবিচারের কথা। সত্যিই তো,সে তো ঠকিয়েছে দর্শিনীকে। মায়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে সে তো অন্যায়ই করেছিলো।

মায়া বিপ্রতীপকে চুপ থাকতে দেখে বাঁকা হাসলো। বিপ্রতীপের সামনে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
“তুমি আর তোমার মা যে অন্যায় করেছো,তার ক্ষমা নেই স্বামী।”

“খাবার খাওয়ার সময় কেউ কান্না করে? কী রে বাবা! এমন কাজ কেউ করে? তোমার কান্না কিসের এত?”

নিধির কথায় দর্শিনী চোখের জলটা মুছে নিলো। ভাতের থালায় হাত দিতেই আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। প্রতাপ সাহা এবার মোড়া থেকে উঠে এলেন। মেয়ের পাশে বসে আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“কাঁদছো কেনো, মা? তোমার বৌদি তোমার জন্য কত শখ করে রান্না করেছে। খাবার কী পছন্দ হয় নি, মা?”

দর্শিনী বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললো,
“জানো বাবা,কতদিন পর আমি এভাবে খেতে বসলাম? এতদিন কেবল বেঁচে থাকার জন্য খেয়েছি। প্রতিদিন খেতে বসতাম আর মনে হতো বিষ ভক্ষণ করছি। কেউ আমায় আদর করে খাওয়ায় নি, বাবা। কতদিন এমন সাজিয়ে কেউ খাবার দেয় না আমায়। আমাকে ওরা তিলে তিলে মেরে ফেলেছে,বাবা। একবারে নিঃশেষ করে দিয়েছে। ওরা আমায় বাঁচতে দিচ্ছিলো না, বাবা। বাবা গো, কী ভীষণ যন্ত্রণা ভালোবাসায়। আগে জানলে এই ভুলে পা বাড়াতাম না। বেঁচে থেকে মরে যাওয়াটা কত যে কষ্টের,বাবা। জানো বাবা,একটা গানের লাইন বোধহয় আমার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,, শুধু সুখ চলে যায়’ – আমার জীবনে এ লাইনটা প্রতি অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। মা আমায় এখন চড় থাপ্পড় দিলেও আমার খারাপ লাগে না। এই মা আমায় কত নিষেধ করেছিলো, সে ঘরে পাঠাবে না। জোড় করেই নিজের কপাল পুড়িয়ে ছিলাম গো, বাবা। কী ভীষণ যন্ত্রণা! ভালোবাসার মানুষ গুলো এমন বিশ্বাসঘাতক কেনো হয়, বাবা? তারা জানেনা,তাদের বিশ্বাসঘাতকতা মেরে দেয় কাউকে। বাবা গো,মানুষ এত পাষাণ কেমন করে হয়!”

দর্শিনীর কণ্ঠে নিরব অভিযোগ শুনে কেঁদে উঠে বাবার প্রাণ। নিধি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ননদকে। মুছিয়ে দেয় অশ্রুকণা। ধমকে বলে উঠে,
“একটা চড় দিবো। খাবারের সময় এত কথা কেনো বলিস? চুপ করে খা। তুই বাঁচবি। ভালো ভাবেই বাঁচবি। আর ঐ নরকে তোরে পাঠাবো না আমরা।”

প্রিয়দর্শিনীর কান্না বন্ধ হয় না। কতদিন পর অভিযোগ করার সুযোগ পেলো সে! এতদিন তো মরার মতন বেঁচে ছিলো। এটাকে কী আর বেঁচে থাকা বলে?

তাদের কথপোকথনের মাঝে মাংসের বাটি টা নিয়ে ঘরে হাজির হয় নিপা। দর্শিনীর থালায় কয়েক টুকরো মাংস দিয়ে গদোগদো কণ্ঠে বলে,
“তুমি কেঁদো না। ভালো মতন খাও। ও ঘর জাতের ছিলো না তাই কষ্ট পেয়েছো। এবার আমরা দেখেশুনে তোমার বিয়ে দিবো।”

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ নয়

গ্রীষ্মের উত্তপ্ত রাত। বিষণ্নতার দীর্ঘশ্বাস পরিবেশে বিরাজিত। প্রিয়দর্শিনীর আজ অশ্রুভেজা রাত। কত গুলো বছর পর বিছানায় সে একা! দীর্ঘ দিনের পরিচিত প্রিয় মানুষটা পাশে নেই। অবশ্য এতদিন এক বিছানাতে থেকেও মানুষটার সাথে দূরত্ব ছিলো তার আকাশ পরিমাণ। আর আজ, বিছানাও আলাদা। মানুষটা হয়তো নতুনে মত্ত,আর সে পুরোনোতে নিবদ্ধ। শুভ্র রাঙা বালিশের কাভার খানা জায়গায় জায়গায় ভিজে আছে। দীর্ঘক্ষণের অশ্রু বিসর্জনের প্রমাণ হিসেবে জ্বল জ্বল করছে দাগ গুলো। দর্শিনীর হঠাৎ করেই ছোট বৌদির বলা কথাখানা মনে পড়লো। বাবার বাড়িতে এসেছে সে,দিন একও অতিবাহিত হয় নি। এখনই ছোট বৌদি বিয়ের কথা তুলে ফেলছে। বাকি দিন তো পরেই রইলো। বাবার বাড়িতে যে এতটা কঠিন হবে টিকে থাকা তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি দর্শিনী। এতদিন শ্বশুর বাড়ি মনে হয়েছিলো নরক কিন্তু এখন দেখছে বাবার বাড়ি তো এর চেয়েও ভয়ঙ্কর। বিয়ের পর মেয়েরা এতটাই পর হয়? স্বর্গের মতন বাবার বাড়ি নরকে রূপান্তরিত হয়ে যায়!

একটু আগের কথা ভেবে দর্শিনীর ঠেলে কান্না আসছে। ভাগ্যিস বড় ভাইয়া ছোট বৌদিকে ধমক দিয়েছিলো তাই বিয়ের কথা টা আর বাড়াতে পারে নি। কিন্তু কতদিন চুপ করে থাকবে বৌদি! একদিনেই ঘাঁড়ের বোঝা হয়ে গেছে সে।

দর্শিনীর মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ভাবনা। তাকে কিছু করতে হবে। এভাবে বাবা ভাইয়ের বোঝা হয়ে থাকবে না সে। নিজের পায়ে তাকে দাঁড়াতে হবে। গোড়া থেকে কেউ যেন তাকে উপড়ে ফেলতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

ভাবনার মাঝেই দর্শিনীর ফোনটা ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠলো। দর্শিনী হঠাৎ শব্দে চমকে উঠলো। পাশে তাকাতেই ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করলো একটা অপরিচিত নাম্বার। দর্শিনী ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফোনটা বেজে কেটে গেলো। পরক্ষণেই আবার বিরতিহীন ভাবে বেজে উঠলো। দর্শিনীর ভ্রু ক্ষাণিকটা কুঞ্চিত হলো। এবার ফোনটা সে রিসিভ করলো। খুব বিনীত স্বরে প্রশ্ন করলো,
“হ্যালো,কে?”

“সই,আমি। তোমার সাত জন্মের সই বলছি।”

অপরপাশের উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠের অধিকারীকে চিনতে এক সেকেন্ডও সময় অপচয় হয়নি দর্শিনীর। বরং সে ভিষণ অবাক, বিষ্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
“মায়া!”

“তুমি আমায় চিনলে কীভাবে, সই?”

আবারও মায়ার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ ভেসে এলো। দর্শিনী নিজের বিষ্ময় কাটাতে কিয়ৎপরিমাণ সময় ব্যয় করলো। অতঃপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। ঘড়ির কাটা দুটোর কাছাকাছি। এত রাতে মায়ার কল দেওয়ার কারণ বোধগম্য হলো না দর্শিনীর। সে মুখ চোখ কুঁচকে জবাব দিলো,
“তোমার কথার ধরণেই তোমাকে চিনেছি। আর তুমি ছাড়া আমার এত জন্মের সই কেউ হতে চায় নি। অভাগিনী তো তাই। তা এত রাতে কী মনে করে কল দিলে?”

“এত রাতে তোমাকে মনে করে কল দিলাম। সারাদিন তোমাকে ভীষণ মনে পড়েছে তো তাই।”

মায়ার এহেন কথার ধরণে দর্শিনী বারংবার অবাক হচ্ছে। কণ্ঠে অবাক ভাবটা ধরে রেখেই বললো,
“আমায় মনে পড়েছে? কিন্তু কেনো?”

“ঐ যে,তুমি আমার সই বলে। কেমন আছো তুমি?”

“আমার ভালো থাকার কারণ কেঁড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছো কেমন আছি! হাসালে।”

দর্শিনীর কণ্ঠের তাচ্ছিল্য ভাবটা মায়া ঠিকই উপলব্ধি করেছে। দর্শিনীর তাচ্ছিল্যের বিপরীতে সে একরাশ নির্ভেজাল হাসি উপহার দিয়ে বিষাদময় কণ্ঠে বললো,
“সত্যিই কী আমি তোমার ভালো থাকার কারণ কেঁড়েছি,সই? তুমি কী এ সংসারে এতদিন ম্যালা ভালো ছিলে! ভীষণ ভালো থাকার অভাবে তবে প্রতিনিয়ত কে ধুঁকে ধুঁকে ম’রে’ছে?”

মায়ার কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো যা নাড়িয়ে দিলো দর্শিনীর অন্তর। মায়ার বিশাল গভীর প্রশ্নে হারিয়ে ফেললো নিজেকে। সত্যিই তো, সে কি এতদিন ভীষণ খুশি ছিলো? মোটেও না। তবে কেনো মিছে অভিযোগ? নিজেকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্যই কী এত তোড়জোড়? নাকি প্রিয় মানুষটাকে প্রতারক ভাবতে না চাওয়ার জন্য এত বিশাল আয়োজন?

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে মায়া খিলখিল করে হেসে উঠলো। মায়ার হাসির শব্দে দর্শিনীর ধ্যান ভাঙলো। সে অবাক কণ্ঠে বললো,
“এই মেয়ে,হাসছো যে?”

“তোমাকে ভাবতে দেখে হাসলাম,সই। কী ভাবছো এত? তোমার মুক্তির কারণ এই মায়া। আর মায়ার প্রতিই তোমার এত অভিযোগ? থাকুক,এতে আমার কেনো আক্ষেপ নেই। দর্শিনীদের মুক্তির কারণ হতে আমার বড্ড ভালো লাগে। আজ তবে রাখি, সই? হুটহাট জ্বালাবো ভীষণ। মনে রেখো আমায়। ভালো থেকো, সই। এখন থেকে তোমার ভালো থাকার দায়িত্ব তোমার। নিজেকে ভালো রেখো, কেমন।”

অপরপাশ থেকে ফোনটা কেটে দেওয়া হলো। দর্শিনী অবাক নয়নে কেবল তাকিয়ে রইলো। তার বোধগম্য হলো না মেয়েটার আচরণ। মেয়েটা এমন কেনো? হুটহাট মনে ঝড় তুলে দেয় হেঁয়ালি মাখা কথা দিয়ে। মেয়েটার মাঝে বড্ড রহস্য।

_

গ্রামের সজীব সকাল। সূর্যের তেজ আজ তেমন উত্তপ্ত না। সামান্য ধোঁয়াশা ভাব পরিবেশে বিদ্যমান। দর্শিনী কেবল গ্রামের স্কুল থেকে বের হয়েছে। পেছন থেকে তাকে কেউ ডেকে উঠলো,
“প্রিয়দর্শিনী?”

দর্শিনী দাঁড়িয়ে গেলো ডাক শুনে। সচারাচর পুরো নাম ধরে তাকে কেউ ডাকে না। কণ্ঠের মালিকের খোঁজ করার জন্য পিছে ঘুরে তাকালো দর্শিনী। পিছের মানুষটাকে দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“জ্বি?”

মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে এলো। হাতের ভাজে এপ্রনটা নিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“আপনি এখানে যে? স্কুলে কোনো কাজে এসেছিলেন বুঝি?”

দর্শিনীর এহেন প্রশ্নে সামান্য বিরক্ত লাগলেও সে বিরক্ত ভাব প্রকাশ করলো না। বেশ ভদ্র,বিনীত স্বরে বললো,
“হ্যাঁ, কাজেই এসেছি। বাবা ভাইদের ঘাড়ে তো বসে খেতে পারি না তাই চাকরি জোগাড় করতে এলুম। তা আপনি এখানে?”

“ক্যাম্পিং করতেই তো গ্রামে আসি। সেটাই করছি।”

দর্শিনী এবার পূর্ণ দৃষ্টি দিলো। মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে এপ্রন দেখে ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত হলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আপনার পেশা? ডক্টর?”

মৃত্যুঞ্জয় দারুণ হেসে বললো,
“হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন মেডাম।”

দর্শিনীর হঠাৎ করেই দৃষ্টান্তের কথা মনে পড়লো। মনে মনে খচখচ করা শুরু করলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“আপনি দৃষ্টান্ত দাদাকে চিনেন?”

“হ্যাঁ, চিনবো না কেনো? ও আর আমি দু’জনই একসাথে ক্যাম্পিং করছি। চলুন আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।”

মৃত্যুঞ্জয়ের প্রস্তাবটা খুব একটা খারাপ লাগে নি দর্শিনীর। সেও মাথা দুলিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো। হাঁটতে হাঁটতেই বললো,
“আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, আপনি আমাকে কবে থেকে চিনেন?”

মৃত্যুঞ্জয়ের পা টা থেমে গেলো দর্শিনীর এমন প্রশ্নে। হৃদয় মাঝে ছলাৎ করে উঠলো আকষ্মিক ভয়। হঠাৎ মেয়েটা এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো কেনো? নিজেকে ধাতস্থ করলো সে মিনিট খানেক নিয়ে। আমতা-আমতা করে বললো,
“কেনো?”

“দরকার আছে। বলুন,আমায় কবে থেকে চিনেন আপনি?”

“গতকাল থেকে।”

“তাহলে আমার বাবার কাছে কীভাবে খবর পাঠালেন?”

দর্শিনীর প্রশ্নে অবাক হলো না মৃত্যুঞ্জয়। বরং হো হো করে উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। বেশ মিষ্টি করে বললো,
“বাহ্,আপনি তো দারুণ চালাক। অবশ্য এমনটাই আশা করা যায় আপনার কাছে। আপনাকে আমি গতকালই প্রথম দেখেছি কিন্তু গত চার বছর যাবত চিনি।”

থেমে গেলো দর্শিনীর পা। তার চক্ষু যেন বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অবাক কণ্ঠে সে শুধালো,
“চার বছর যাবত চিনেন মানে?”

“চার বছর আগে আপনার নাম শুনেছি। আপনাকে না দেখেই চেনা যাকে বলে।”

মৃত্যুঞ্জয়ের সহজ সরল জবানবন্দিতে অবাক ভাবটা বাড়লো বয় কমলো না দর্শিনীর। আর দারুণ লাগলো মৃত্যুঞ্জয়ের অকপটে সত্যি বলার ধরণটা। দর্শিনী বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“তাহলে ট্রেনে আমাকে দেখে চিনলেন কীভাবে?”

“নাম শুনেই আন্দাজ করেছিলাম। আপনি যখন ঘুমিয়ে গেলেন তখন আপনার বাবাকে ফোন দিয়ে আপনার বিবরণ দিয়ে জিজ্ঞেস করে সিউর হয়ে ছিলাম।”

মৃত্যুঞ্জয়ের কণ্ঠে স্বাভাবিক ভাব। দর্শিনী অবাকের উপর অবাক হলো। আর ভালো লাগা কাজ করলো মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যাক্তিত্বের উপর। পথে তাদের টুকটাক আরও কথা হলো। কথার এক পর্যায়ে মৃত্যুঞ্জয় বলে উঠলো,
“যাকে ছেড়ে এসেছেন তার জন্য পিছুটান কেনো রেখেছেন মেডাম?”

দর্শিনী ততক্ষণে নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নে সে হেঁয়ালি হেসে জবাব দিলো,
“পিছুটান তো আমি রাখি নি। তাকে একবারেই আমি মুক্ত করে দিয়ে এসেছি। মনের মুক্তি তো আগেই দিয়েছিলাম। খাতা কলমেও মুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছি।”

#চলবে