পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব-১০+১১+১২

0
220

#পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
#পর্ব-১০+১১+১২

“ডিভোর্স দিয়েছেন!”

মৃত্যুঞ্জয়ের কণ্ঠে ভীষণ বিস্ময়। দর্শিনী সামান্য হাসলো। সামনের চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে নরম কণ্ঠে বললো,
“না, দেই নি। তবে ব্যবস্থা করে এসেছি।”

“ব্যবস্থা করে এসেছেন মানে?”

“আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন দিয়ে এসেছি। উকিল সাহেব আজকালের ভিতরে হয়তো কাগজ ওর কাছে পাঠাবে। যে আমার না তাকে অকারণে বেঁধে রেখে তো লাভ নেই তাই মুক্তি দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে এসেছি।”

মৃত্যুঞ্জয় ভারী অবাক হলো দর্শিনীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে। এমন একটা মেয়েকে যে হাতছাড়া করেছে সে যে কতটা বোকা, ভাবনার বাহিরে। নিশ্চুপ ভাবে অতিক্রান্ত হওয়া সময়ে ভাইব্রেট করে বেজে উঠলো দর্শিনীর ফোন খানা। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যেতেই দর্শিনী ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“আজ আমি আসি তবে? আবার দেখা হবে। বাবা কল দিচ্ছে।”

দর্শিনীর কথায় মাথা নাড়িয়ে বিদায় জানালো মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ কী মনে করে ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আপনার না সেদিন ফোন ছিলো না? তবে,আজ ফোন আসলো কীভাবে?”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথার ধরণে হেসে ফেললো দর্শিনী। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“এটা বড় বৌদির মোবাইল। বৌদি আমার হাতের মোবাইল আনি নি বলে এটা দিয়েছে। জানেনই তো,বড় বৌদি আমায় কত ভালোবাসে।”

মৃত্যুঞ্জয়ের অবাক ভাব কাটলো। দর্শিনীকে বাড়ির দরজা অব্দি এগিয়ে দিয়ে চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। দর্শিনী বাড়িতে পা রাখতে যাবে সে মুহূর্তে তার মনে আকষ্মিক প্রশ্ন জেগে উঠলো। বড় বৌদির ফোনে গতকাল রাতে মায়া কল করেছিলো। কিন্তু মায়া নাম্বারটা পেলো কীভাবে! মৃত্যুঞ্জয় না বললে তো এই কথাটা মাথাতেই আসতো না। দর্শিনী দ্রুত বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। উদ্দেশ্য, বড় বৌদিকে প্রশ্ন করে দ্বিধা পরিষ্কার করবে। মনের মাঝে জেগে উঠলো অপ্রত্যাশিত ভয়। উদ্ভট ভাবনার উদয় হলো হৃদয় মাঝে। বৌদি কী তবে তাকে না জানিয়ে অন্য কিছু করেছে!

দর্শিনী যে উত্তেজনা নিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করেছিলো, সে উত্তেজনা মিইয়ে গেলো এক নিমিষেই। সদ্য কিশোরী থেকে যৌবনে পা দেওয়া এক নারী ছুটে এলো দর্শিনীর কাছে। জড়িয়ে ধরলো আবেশে। উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কেমন আছো, প্রিয় দি? কতদিন পর তোমার দেখা! মনে আছে তো আমায়?”

“তোরে ভুলে যাবো,আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে বল তো? তা কেমন আছে আমার তৃণশয্যা?”

“তোমায় ছাড়া ভীষণ খারাপ ছিলাম। কিন্তু এখন পুরো দারুণ আছি। তাড়াতাড়ি আসো,বসো। জল খাবে? কোথায় গিয়েছিলে?”

মেয়েটার কণ্ঠে উচ্ছ্বাসিত ভাবখানা একটুও কমে নি। বরং তা বেড়েছে। কতদিন পর তার প্রিয় দিদিকে কাছে পেলো। নিধির বিয়ের পর থেকেই তো দুজনের গলায় গলায় ভাব ছিলো। দর্শিনীকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না তৃণশয্যা। নিধির বোন হলেও নিজের বোনের চেয়েও বেশি জানে দর্শিনী। এতদিন মেয়েটা মামার বাড়ি ছিলো কিন্তু দর্শিনী বাড়ি ফিরেছে শুনেই চলে এসেছে এ বাড়ি।

দু জনের কথার মাঝেই এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়ে হাজির হলো নিধি। দর্শিনীর দিকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে দর্শিনীর মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম টুকু আঁচল দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললো,
“কোথায় ছিলি রে? সকাল হতেই নিরুদ্দেশ। সকালের নাস্তা কে করবে শুনি?”

দর্শিনী শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এই সুন্দর রমনী’র পানে। এত যত্ন করা মানুষটাকে নিয়ে সে একটু আগে কত উল্টোপাল্টা না ভেবেছিলো। আর এ মানুষ টা কত সাবলীল ভাবে যত্ন করছে তাকে! দর্শিনী মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো বড় বৌদিকে। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“এইতো কাছেপিঠেই ছিলুম। তুমি এত ভালো কেনো, বৌদি?”

দর্শিনীর প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে উঠলো নিধি আর তৃণা। দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে নিধি বললো,
“তুই ভালো বলেই আমি ভালো। এবার চুপচাপ শরবতটা খেয়ে নাস্তা খেতে আয়। তৃণাও তোর জন্য বসে আছে কখন থেকে। চল তাড়াতাড়ি।”

_

“শাশুড়ী, সকালের নাস্তা এখনো হয় নি? কতক্ষণ লাগবে আর?”

মায়ার কণ্ঠে বিরক্তের ভাব স্পষ্ট। খাবার টেবিলে বসে আছে বিহঙ্গিনী, শ্বশুর, বিপ্রতীপ। মায়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্রতীপ কপাল কুঁচকে বলে উঠলো,
“মাকে এভাবে কাজের কথা বলছো,নিজে গিয়ে করতে পারছো না? দর্শিনী আর যাই করুক কখনোই এভাবে মাকে কাজের আদেশ করতো না।”

মায়া তখন কেবল আপেলের এক কোণায় কামড় বসিয়েছে। বিপ্রতীপের কথা শুনে তার মুখ থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে ফেলে আপনা-আপনি। সরু চোখে বিপ্রতীপের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
“আমি প্রথমেই বলেছি-আমি মায়া, প্রিয়দর্শিনী না। আর এতই যখন সে মানবী ভালো ছিলো তবে আবার ঘরে আরেকজনকে আনলেন কেনো? আসলে আপনাদের জন্য একটা প্রচলিত কথা মানানসই, ‘অতি প্রেমে মধুও বিষ,স্বল্প প্রেমে তক্তাও বালিশ’। সই আপনাদের প্রতি অতি প্রেম দেখিয়েছিলো তাই তার এ দশা। আমার কাছে আবার ওসব পাবেন না৷ আমি স্বল্প প্রেম দেওয়া মানুষ। মানিয়ে নিতে পারলে ভালো, নাহয় গলার কাটা হয়ে আটকে থাকবো। অতি প্রেম আমার কাছে ভুলেও আশা করবেন না।”

বিপ্রতীপ নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে চুপ করে গেলো। বিহঙ্গিনী এবং তার বাবা কেবল নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে রান্নাঘরের দরজা থেকে মোহনা বলে উঠলেন,
“অতি প্রেম তোমায় দিতে হবে না। আসলে-‘বেশি খাতিরে, পাতিল ভাঙে’ তাই ঐ মেয়ের সংসার ভেঙেছে। তুমি বরং একটা নাতি দিও। বংশের প্রদীপ জ্বালানোর মানুষ আনার জন্যই তোমাকে আনা হয়েছে। বড় বড় কথা বলার জন্য না।”

মায়া শাশুড়ীর পানে তাকিয়ে একটা গা জ্বালানো হাসি দিলো। শাশুড়ীকে খোঁচা দিয়ে বললো,
“আমার বয়স সবে ষোলো কিংবা সতেরো হবে,আমার বাকি জীবন তো পরেই আছে। এত তাড়াতাড়ি নাতির আশা করছেন কেনো, শাশুড়ী? আর আমি মানুষ কোনো মেশিন নই যে আপনারা চাইলেন আর আমি বংশের প্রদীপ দিয়ে দিলাম। এখনো আমায় চিনলেন না!”

মোহনার রাগ উঠলো। কিন্তু সে প্রকাশ করলো না। এই মেয়েকে ঘাটালে ভালো কিছু যে হবে না তা সে এতদিনে বুজে গেছে। কম বয়সী বউ এনেছে স্বাধ করে। এবার তার মজা টের পাচ্ছে। এই মেয়ে এত লাগামহীন।

মোহনার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে মায়া মুচকি হাসলো। এদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যই তো এত তোড়জোড়। এদের শিক্ষা না দিয়ে এ বাড়ি ছাড়ছে না সে।

_

বিকেল নেমেছে ধরণীর বুকে। সাথে নেমেছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। দর্শিনী আর তৃণা গ্রাম ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ বৃষ্টি দেখে তারা পুকুর পাড়ের বিশাল ছাউনির নিচে গিয়ে আশ্রয় নিলো।

তৃণা বৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বিরস কণ্ঠে বললো,
“প্রিয়দি, তোমাকে ওরা বড্ড কষ্ট দিয়েছে তাই না?”

দর্শিনীর দৃষ্টি তখন পুকুরের ঘোলা জলে নিবদ্ধ। তৃণার প্রশ্নে সামন্য চমকে উঠে সে। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“বড্ড কষ্ট কিনা জানিনা তবে বাবা আর বিহঙ্গিনী যে ভালোবাসা টা দিয়েছে সেটা অনেক ছিলো।”

“আর বিপ্রতীপ দাদা তোমায় কী দিয়েছে,দি?”

দর্শিনীর কণ্ঠ কিয়ৎক্ষনের জন্য থেমে যায়। এক আকাশ বিষণ্ণতা নিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“বিপ্রতীপ আমাকে সারা জীবনের বিষাদ দিয়েছে। বেঁচে থেকেও মৃত্যুর স্বাদ দিয়েছে। বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা দিয়েছে। বিপ্রতীপ যা দিয়েছে তা বলেও শেষ করা যাবে না। প্রথম প্রথম সে অনেক ভালোবাসাও দিয়েছিলো কিন্তু শেষবেলার অবহেলার কাছে ঢেকে গেছে সে ভালোবাসা। বিপ্রতীপ কখনোই আমাকে ভালোবাসে নি। সে আমায় ভালোবাসলে কখনো আরেক নারীতে মত্ত হতে পারতো না। আমি বিপ্রতীপের রঙচঙে মুগ্ধতা ছিলাম কেবল। মুগ্ধতা কেটে যাওয়ার সাথে সাথে আমাকে সে ছুঁড়ে ফেলেছে। প্রেমিক পুরুষরা দিনশেষে এমন বদলে যায় কেনো, বলতে পারিস? কী ভীষণ যন্ত্রণা ভালোবাসায়। আমি বলবো কখনো প্রেমে পরিস না। প্রেমিক পুরুষদের বদল মানতে পারবি না যে।”

তৃণা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দর্শিনীর পানে। দর্শিনী বদলে গেছে। এমন বিষাদময় দর্শিনী কখনো ছিলো না। ভালোবাসা কী পারে না? একটা উচ্ছ্বাসিত নারীকে কি অবলীলায় বিষাদে ঢেকে দিতে পারে!

তাদের কথার মাঝেই হুড়মুড় করে পুকুরপাড়ে হাজির হলো দুই মানব। তৃণা তাদের দেখে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“আরে মৃত্যুঞ্জয়’দা আর দৃষ্টান্ত’দা? কবে এলেন আপনারা গ্রামে?”

মৃত্যুঞ্জয় শরীরের থেকে বৃষ্টির জল গুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“এইতো, আমি এলাম গত পরশু আর দৃষ্টান্ত এসেছে সপ্তাহ খানেক হলো।”

দৃষ্টান্ত দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
“এই বৃষ্টির মাঝে তুই বাহিরে কী করছিস? তাও এই সন্ধ্যায়? নিজের খেয়াল রাখছিস তো?”

দর্শিনী আমতা-আমতা করে বললো,
“আসলে তৃণা এসেছে তো তাই গ্রাম ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির জন্য আর বাড়ি ফিরতে পারি নি।”

মৃত্যুঞ্জয় সরু দৃষ্টিতে তাদের দেখলো। কেনো যেনো তার দৃষ্টান্তের এমন শাসন পছন্দ হয় নি। বিরক্তি ভাবে ভরে গেলো শরীরে প্রতিটি শিরা উপশিরা।

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ এগারো

সময় নিজের মতন অতিবাহিত হচ্ছে। দর্শিনী গ্রামে এসেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক হতে চললো। ছোট বৌদির খারাপ কথা, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, নতুন করে বাঁচার উন্মাদনা নিয়ে কাটছে দিন গুলো।

এখন শীতল রাত নেমেছে প্রকৃতিতে। দর্শিনী জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল রূপোর থালার মতন চাঁদ উঠেছে আকাশে। দর্শিনী সে দিকেই দৃষ্টি স্থাপন করে আছে। তার খাটে ঘুমিয়ে আছে তৃণা। দু’জনে এক সাথেই ঘুমায়। দর্শিনী চাঁদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিশাল আকাশে চাঁদ টা যেমন একা, তেমনই একা মাটির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শিনী। এই একাকীত্ব কারো সামনে প্রকাশ করা যায় না। আর না যায় ভিতরে লুকিয়ে রাখা। আশেপাশে হাজার খানেক মানুষ থাকলেও প্রিয় মানুষের শূণ্যতা বড্ড পোড়ায়। প্রিয় মানুষ ব্যাতীত খুব জোর বেঁচে থাকা যায় কিন্তু ভালো থাকা যায় না। আর দর্শিনী প্রতিনিয়ত ভালো না থাকার অভাবে দুমড়ে মুচড়ে মরছে। আচ্ছা, সে যেমন কষ্ট পাচ্ছে তার একাংশ কষ্টও কী বিপ্রতীপ পায় না? এত বছর এক সাথে ছিলো, একটু কী মায়াও জন্মায় নি? হাহ্,পুরুষ জাতি এত কঠোর কেমন করে হয়!

ভাবনার মাঝেই উঠোনের দক্ষিণ পাশে কারো ছায়া দেখতে পায় দর্শিনী৷ লেবু গাছটার নিচে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা চমকে উঠে সে। এত রাতে তাদের উঠোনে কে দাঁড়িয়ে আছে! ফিসফিস কথার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে! দর্শিনী সামান্য ভয় পেলেও সাহস রাখে বুকে। বিছানা কতক্ষণ হাতড়ালো মোবাইলটা খোঁজার জন্য। অতঃপর মনে পড়লো ধৃষ্ট বিকেলে মোবাইলটা দিয়ে গেইম খেলেছে। হয়তো তাদের ঘরে নিয়ে গেছে। দর্শিনী হতাশার শ্বাস ফেললো। কৌতুহল দমানোর জন্য ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।

ঘর থেকে বেরুতেই দর্শিনীর ঘরের দরজা টা একটু শব্দ করে বারি খায়। অন্ধকারে সে শব্দে চমকে উঠে দর্শিনী। ধীর গতিতে দরজাটা আটকিয়ে উঠোনে নামে সে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে পুরো উঠোন জুড়ে কেউ নেই! দর্শিনী লেবু গাছটার নিচে এগিয়ে গেলো,সে জায়গাটা ফাঁকা। কেবল কয়েকটা জোনাকি পোঁকা উড়ে বেড়াচ্ছে। দর্শিনী ডানে বামে খোঁজ করেও কাউকে না পেয়ে নিরাশ হলো। হঠাৎ তার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো অন্য ভাবনা। গ্রামের মানুষেরা বলে রাত হলে লেবু গাছের নিচে নাকি ভূত, প্রেত থাকে। তবে কী সে এমন কিছুই দেখলো! দর্শিনীর হঠাৎ করে ভয় লাগতে শুরু করলো। সে অনুভব করলো, এ অবস্থায় হুটহাট তার বেরিয়ে পড়া উচিৎ হয় নি। বাচ্চাটার না আবার ক্ষতি হয়ে যায়।

দর্শিনী দ্রুত ঘরের দিকে এগিয়ে যাবে,এমন সময় তার বাহুতে কেউ হাত রাখে। দর্শিনী চমকে উঠে। ভীত হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠে। ঘামে ভিজে যায় শরীর। ভীত নয়নে সে পিছে তাকাতেই শরীরের পুরো উত্তেজনা টা শিথিল হয়ে যায়। এতক্ষণের উত্তেজনার জায়গায় ভর করলো বিষ্ময়। দর্শিনী অবাক কণ্ঠে বললো,
“বাবা,তুমি এখানে!”

প্রতাপ সাহা ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিবিড় কণ্ঠে শুধালো,
“তুমি এত রাতে এখানে কী করছো,মা?”

দর্শিনী শাড়ির আঁচল টা দিয়ে মুখ ও গলার ঘামটা মুছলো। নিজেকে একটু সময় দিয়ে ধাতস্থ করলো। উত্তেজনা, ভয় কেটে যেতেই সে বললো,
“এইতো,ঘুম আসছিলো না দেখে উঠোনে হাটছিলাম। তুমি উঠেছো কেনো, বাবা?”

“আমি তো দরজার শব্দ পেয়ে উঠলাম। গ্রামে চোর-ডাকাতের প্রকোপ বেড়েছে। তাই ঘুমালেও ঘুম হয় না। সামান্য শব্দ পেলেই সজাগ হয়ে যাই। তোমার এত রাতে উঠানে নামা উচিৎ হয় নি, মা। রাতের বেলা কত রকমেরই বিপদ হতে পারে। এখন খারাপ ছেলেপেলেরা রাত বিরাতে নেশা করে ঘুরে বেড়ায়। এজন্য উঠোনেও তুমি নিরাপদ না। কী বলেছি বুজেছো, মা?”

“হ্যাঁ বাবা,বুজেছি।”

কথা শেষ করে মুচকি হাসি দিলো দর্শিনী। একটু আগে সে এখানে তবে কাকে দেখেছে? নাকি চোর-ডাকাত দল এসেছিলো! মনের মাঝে একটা দ্বিধা রয়েই গেলো দর্শিনীর।

“তুমি কী এখন ঘুমাবে? নাহয় চলো বাবা-মেয়ে আজ একটু কথা বলি।”

দর্শিনীরও ঘুম আসছিলো না। যাক,অবশেষে তার একাকীত্ব দূর করার একজন মানুষ পেলো। দর্শিনী হাসিমুখে সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ঘুম আসছে না। চলো গল্পই করি।”

প্রতাপ সাহা মেয়েকে নিয়ে উঠনোরের কিনারায় মাচাটার উপর গিয়ে বসলেন। মেয়ের মাথায় যত্নের হাত বুলিয়ে বললেন,
“জানো,তুমি যখন জন্মালে তখন আমার কী যে খুশি লেগেছিলো। আমি তোমার মাঝে আমার মাকে খুঁজে নিয়ে ছিলাম। তুমি যা-ই আবদার করতে তা-ই পূরণ করার চেষ্টা করতাম। আমার মনে হতো আমার মা আবদার করছে। তোমার মা হাজার বারণ করলেও আমি শুনতাম না। তোমার প্রতি আমার এত ভালোবাসায় হয়তো তোমার জীবনে সুখ কেড়ে নেওয়ার কারণ।”

বাবা’র শেষ কথাটার অর্থ বোধগম্য হলো না দর্শিনীর। অবাক কণ্ঠে বললো,
“কী বলছো বাবা! তুমি আমার সুখ কেড়ে নেওয়ার কারণ কীভাবে!”

প্রতাপ সাহা মুখ নিচু করে ফেললেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ব্যর্থতা প্রকাশ করলেন। বিষন্ন কণ্ঠে বললেন,
“বিপ্রতীপের সাথে তোমার বিয়েতে তোমার মা অনেক অমত প্রকাশ করে ছিলো। কিন্তু আমি এতটাই মেয়ের আবদার পূরণ করতে সচেষ্ট ছিলাম যে এই অমত আমি শুনিই নি। সেদিন যদি একটা বার তোমার মায়ের কথার গুরুত্ব দিতাম, তবে আজ তোমাকে নির্ঘুম একাকীত্ব পূর্ণ রাত্রি যাপন করতে হতো না।”

“আমার দুঃখের পুরোটা দায়ভার আমার, বাবা। এটার ভার আমি কাউকে দিবো না। ভুল মানুষকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। যার খেসারত আজ আমি আমার সুখ বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছি। তুমি তো কেবল আদর্শ বাবা হতে চেয়েছো। মেয়ের কোনো অভিযোগ রাখতে চাও নি৷ তাহলে তোমার ভুলটা কী? মেয়েকে রাজ্যের সুখ দিতে চেয়েছো,এখানে তোমার দোষটা কী!”

দর্শিনীর কাঠ কাঠ জবাবে হাসলেন প্রতাপ সাহা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফসোসের সহিত বললেন,
“বরাবরই স্কুলের অংক শিক্ষক হিসেবে আমার সুনাম ছিলো। সবাই বলতো প্রতাপ সাহার মতন অংকের সমাধান কেউ করতে পারবে না। কিন্তু জীবন অংকের এমন ভুল সমাধান করবো, কে জানতে? অংক কষতে কষতে শেষ অব্দি এসে দেখি পুরো অংকটাই ভুল কষেছি। এই ভুল কী আদৌও শোধরাবার?”

বাবার এমন অসহায়ত্ব দর্শিনীর সহ্য হলো না। সে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। প্রতাপ সাহার চোখে অশ্রুকণা। কণ্ঠস্বর কাঁপছে। মেয়েটার জীবন এভাবে ধ্বংস হচ্ছে, তা কোন বাবা-ই সহ্য করতে পারবে?

দর্শিনী বাবার অসহায়ত্ব বুঝলো। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে তৃপ্তিদায়ক স্বরে বললো,
“তুমি একজন অসাধারণ শিক্ষক সাথে একজন আদর্শ বাবা। বাবাদের কোনো ভুল নেই। বাবারা সবসময় সঠিক। তোমার অংক কখনোই ভুল হয় নি আর হবেও না। আমার ভাগ্য টা খারাপ সেটার দায়ভার তোমার না। তবে এই খারাপ হওয়ার পিছনেও হয়তো ভালো কিছু আছে। তুমিই তো বলতে, প্রতিটা কাজের ভালো খারাপ দুটো দিক আছে। আমরা খারাপ দিকটা দেখছি অথচ ভালো দিকটা হয়তো চোখেই লাগছে না। তুমি মন খারাপ করো না, বাবা। মুদ্রার এপিঠ দেখে মন খারাপ করছো,এখনো তো ওপিঠ দেখা বাকি আছে তাই না?”

প্রতাপ সাহা হাসলেন। মেয়েটা তার কত বুঝদার হয়ে গেলো! হাসিমুখ বজায় রেখেই সে বললো,
“ওপিঠও খুব শীগ্রই দেখবো, মা। জীবন যদি তোমাকে আরেকটা সুযোগ দেয় তবে অতীত ধরে রেখে সে সুযোগ হাতছাড়া করো না। তোমাকেও কেউ একজন অনেক ভালোবাসবে। তাকে ফিরিয়ে দিও না তুমি। আরেকবার জীবনকে সুযোগ দিও। জীবন একটাই,বাঁচার মতন বাঁচতে হবে। বিষাদ নিয়ে কী ভালো থাকা যায়? মৃত্যুর আগে আমি আরেকবার তোমার অংক মিলিয়ে দিয়ে যেতে চাই। আরেকবার আমি তোমাকে হাসতে দেখতে চাই। তুমি আমায় সে সুযোগ দিও, মা।”

দর্শিনী আর কোনো কথা বললো না। কেবল ছোট্ট শ্বাস ফেললো। আদৌও সে আবার বন্ধনে জড়াতে পারবে! বন্ধনে যে তার বড্ড ভয়।

_

গ্রামের সকাল বরাবরই মিষ্টি হয়। দর্শিনী দাঁড়িয়ে আছে বড় মাঠের এক কোণায়। দীর্ঘ এতক্ষণ পরিশ্রম করে সে ক্লান্ত। আজকাল অল্পতেই ক্লান্তি লাগে তার। দর্শিনী জাম গাছটার ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। তৃণা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী বিধায় গ্রামে মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্তের ক্যাম্পিং-এ সেও সাহায্য করছে। দর্শিনীও তাদের সাথে টুকটাক কাজ করছে কারণ দর্শিনীও মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ছিলো। কিন্তু ডাক্তার হওয়ার আগেই প্রণয়ে জড়িয়ে তার সুন্দর ভবিষ্যৎ সে নষ্ট করেছে। মাঝে মাঝে নিজেই ভেবে অবাক হয় যে নিজের পায়ে নিজে কীভাবে কুড়াল মেরেছে সে!

গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ তৃণার দিকে দৃষ্টি যায় তার। তৃণা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়দের দিকে! দর্শিনী অবাক হয়। এমন দৃষ্টির মানে তার কাছে অজানা নয়। তবে কী মেয়েটা মৃত্যুঞ্জয়কে পছন্দ করে?

#চলবে

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ বারো

ধূসর রাঙা বিকেল পরিবেশে। গগনে থেমে থেমে মেঘ গর্জন করে উঠছে। কিঞ্চিৎ বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। ধুলোবালি উড়ছে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে।

দর্শিনী শুয়ে আছে তার বিছানায়। দিন পেরুচ্ছে স্রোতের বেগে। আজ সাতাশটা দিন হতে চললো সে পিছুটান ফেলে চলে এসেছে তার বাবার ভিটায়। আজকাল তাকে শূণ্যতা তত বেশি পুড়াতে পারে না। কিন্তু বিষাদ রোজ নিয়ম করে বক্ষস্থলে নীল ব্যাথা লেপ্টে দিয়ে যায়। বিষন্নতা রোজ হিসেব করে সকাল বিকেল কড়া নাড়ে তার হৃদয় কোণে। সে পাত্তা দেয় না। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায় নানান অজুহাতে। কিন্তু মন কী সেসব বুঝে! সে তো ভালোবেসে ছিল। বড্ড ভুল কিছু কী করেছিলো? মানুষ কেনো চলে যায়? কেউ একজন থেকে যেতে পারে না? কেউ একজন থেকে যাক। কেউ থাকুক,যে ব্যাথা বুঝবে,আবেগ বুঝবে। বিপ্রতীপকে সে ভালোবেসে ছিলো। কিন্তু দিনশেষে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে মানুষ। কী ভীষণ যন্ত্রণায় তাকে ডুবিয়ে দিয়ে মানুষটা সুখের বাসর পেতেছে। মানুষ গুলো কেমন বদলে যায় তাই না? মানুষ গুলো কেনো চিরদিন এক থাকে না? কেনো ভীষণ ভালোবাসা বদলে যায় অবহেলার কার্তুজে! মানুষ গুলো কেনো কথা দিয়ে কথা রাখে না? মানুষ গুলো কেনো দিনশেষে থেকে যায় না?

ভাবনার মাঝেই দর্শিনীর ফোনটা বেজে উঠে তুমুল শব্দে। তার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই জ্বলজ্বল করে উঠে একটা অপরিচিত নাম্বার। বোঝা-ই যাচ্ছে,ফোনের সংরক্ষণ তালিকায় নাম্বার খানা নেই। দর্শিনী তবুও নাম্বার খানা চিনলো। ফোনটা রিসিভ করে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
“মায়া?”

ফোনের বিপরীতে থাকা নারীটি অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“চিনলে কীভাবে আমাকে,সই?”

দর্শিনী একটু হাসলো। নিবিড়ভাবে বললো,
“তোমায় চিনবো না? কি বলছো! আমার জীবনের চরম সর্বনাশ বলো আর উপকার বলো,সেটা তো তুমিই করেছিলে তাই না? আর তোমায় চিনবো না আমি!”

মায়া খিলখিল করে হেসে উঠলো। দর্শিনীর কথাটা প্রশ্রয় দিয়ে বললো,
“কোনো একদিন বুঝবে, এটা চরম উপকার ছিলো। চরিত্রহীন পুরুষের সাথে ত্যাগ স্বীকার করে পরে থাকা,ভীষণ ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই না।”

“তাই বুঝি? তা আমি নাহয় না জেনে চরিত্রহীন পুরুষের কাছে গিয়েছিলাম,তুমি জেনেশুনে এলে যে! নিজের এত বড় ক্ষতিটা করে আমার উপকার না করলেই পারতে।”

দর্শিনীর কণ্ঠে বিদ্রুপ স্পষ্ট। মায়া হাসলো,মিষ্টি করে বললো,
“দর্শিনীরা ভীষণ নরম। তারা প্রতিবাদ করতে জানে না। তারা সহ্য করেই কাটিয়ে দিতে চায় জীবন। কিন্তু মায়া তেমন না। বিপ্রতীপদের সোজা করার জন্য মায়ারা আসে। তুমি হয়তো আমায় খারাপ ভাবছো। জেনেশুনে বিপ্রতীপকে বিয়ে করেছি বলে,তুমি আমাকে সই ডেকেও শত্রু ভাবো। কিন্তু এটা সত্যিই আমি প্রাপ্য না। তোমার স্বামীর তোমাকে রেখেও আমার দিকে নজর গিয়েছিলো। যদি আমি প্রত্যাখ্যান করতাম, তবে আরেকদিকে যেতো। তোমার সংসার একদিন ঠিকই ভাঙতো। দু’দিন আগে আর পরে। কিন্তু এই বেইমান গুলো উচিৎ শিক্ষা পেতো না। দর্শিনীদের ভেঙে দিয়েও এরা নির্দ্বিধায় সুখে থাকতো।”

দর্শিনী অবাক হলো। এতটুকু একটা মেয়ে,কিন্তু তার কথায় কি তেজ! কি প্রতিবাদ! সত্যিই তো দর্শিনীরা বোকা,নরম। তারা প্রতিবাদ করতে জানেনা। মায়ার কথা আর যুক্তি তো ফেলনা না। সত্যিই বিপ্রতীপের মন বাহিরে চলে গিয়েছিলো। মায়া না হলেও কেউ না কেউ তার সতীন হতো। মেয়েটার তো দোষ নেই।

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে মায়া তপ্ত শ্বাস ফেললো। কী মনে করে যেন বললো,
“জানো,তোমার জন্য আমার আক্ষেপ হয় ভীষণ। মন খারাপের উড়োচিঠি আসে হৃদয় মাঝে। ভালোবেসে কি ভুলটাই না করেছিলে!”

“আমারও নিজের উপর ভীষণ মায়া হয় গো। কী আর করার? ভুল গুলো মোর ফুল হয়ে যাক। তুমি নাহয় আগলো রেখো ঐ পরিবারকে।”

মায়া আবার হাসলো। মেয়েটা কারণে অকারণে হাসে। হাসি থামিয়ে তার রিনরিনে কণ্ঠে ঝংকার তুলে বললো,
“এত ভালোবেসার পরও এই ইট পাথরের বাড়ি তোমায় আপন করলো না। আর আমায় বলছো আগলে রাখতে? এরা কারো আপন হতে পারে না।”

দর্শিনী মায়ার কথার অর্থ খুঁজে পায় না। মেয়েটার মনে, কথার ধরণে কেমন একটা আক্রোশ খুঁজে পায়। এত আক্রোশ নিয়ে ও আদৌও বিপ্রতীপকে ভালোবেসে ছিল তো!

দর্শিনী নিজের মনে দ্বিধা মনে রাখলো, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো,
“ওরা যা করার আমার সাথে করেছে। তোমায় ওরা কিছু করবে না। তুমি ওদের একটু ভালোবাসা দিও।”

“ওদের হয়ে তুমি এত কথা বলছো, সই? অথচ সেদিন তোমার পক্ষ থেকে উকিল সাহেবের ডিভোর্স পেপার দেখে কি খুশি শাশুড়ির! বিপ্রতীপ অবশ্য একটু খারাপ লাগা প্রকাশ করছে কিন্তু পরক্ষণেই সাইন করে দিয়েছে পেপারটাতে। হ্যাঁ, ননদ আর শ্বশুরমশাই ভালো কিন্তু ওরা ভালো না। তোমায় একটু ভালোবাসলে কী বড্ড বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?”

মায়ার প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পায় না দর্শিনী। আনমনেই কেটে দেয় ফোনটা। সত্যিই তো,তাকে ভালোবাসলে বড্ড ক্ষতি কী হয়ে যেতো? সে তো একটু ভালোবাসার জন্য ও বাড়ির মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিলো। কিন্তু শেষমেশ অবহেলা নিয়ে ফিরে আসতে হলো কেন তাকে!

দর্শিনীর চোখের কার্নিশ ঘেষে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো। তার ভাবনার মাঝেই গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে রুমে প্রবেশ করলো তৃণা। দর্শিনী দ্রুত চোখের কোণা মুছে চুপ করে শুয়ে রইলো। ভাব এমন যেন,সে ঘুমিয়ে আছে।

তৃণা কতক্ষণ গুনগুনিয়ে গান গাইলো। চুল গুলো যত্নে বাঁধলো। সব নিরবে পর্যবেক্ষণ করলো দর্শিনী। মেয়েটার মধ্যে অগাধ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় আজকাল। আগে ও চঞ্চল থাকলেও এত সাজগোজ করতো না কিন্তু এখন সাজগোজ করে, গুনগুনিয়ে গান গায়- আরও নানান রকমের পরিবর্তন। জীবনে যখন প্রেমময় বসন্ত আসে তখনই বিশেষ পরিবর্তন ঘটে মানব দেহে। আর তৃণার শরীরের পরিবর্তন সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

তৃণা চুল আঁচড়ানোর মাঝেই ধৃষ্ট ঘরে ছুটে এলো। হাঁপাতে থাকা শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে মুখের ঘামটা মুছে দর্শিনীকে ধাক্কানো আরম্ভ করলো। ধাক্কানোর সাথে হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো,
“পিসি,তাড়াতাড়ি উঠো। ওরা দাদুকে মারছে।”

ধৃষ্টের কথায় লাফিয়ে উঠলো দর্শিনী। তৃণাও ততক্ষণে আরশির সামনে থেকে সরে ধৃষ্টের কাছে এলো।

দর্শিনী ধৃষ্টের ঘর্মাক্ত মুখ খানা আঁচল দিয়ে মুছে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে বাবার? কোথায় বাবা? কে মারছে বাবাকে?”
“পিসি,দাদু মাঠে। তাড়াতাড়ি চলো। দাদুকে কারা যেন মারছে।”

দর্শিনী দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। তৃণার দিকে এক পলক তাকাতেই চোখে চোখে কথা হলো তাদের। সাথে সাথেই ছুট লাগালো দু’জন।

_

ঢাকা শহরেও অনবরত দু’দিন যাবত বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সকাল থেকে আবার বর্ষন বন্ধ হয়েছে। আকাশ স্বচ্ছ। গত দুদিনের বর্ষনে শহরের কিছু কিছু আবাসিক এলাকা তো প্রায় ডুবে যাচ্ছে যেন। মায়া দর্শিনীর সাথে কথা বলার সময়ই আকাশ ভেঙে ঝরঝর করে আবার বৃষ্টি নামলো।

মায়া ফোনটা খাটে রেখে ছুট লাগালো ছাদের দিকে। সকালে জামা-কাপড় শুকাতে দিয়েছিলো ছাদে। সিঁড়ির দিকে আসতেই তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সে আবার ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে গেলো। ঘরের ভিতর দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে হাঁক পারলো,
“শাশুড়ি, শাশুড়ি। কোথায় আপনি?”

মায়ার ডাকের বিপরীতে কোনো শব্দ এলো না৷ মায়া কণ্ঠ আরেকটু উঁচু করে ডাকলো,
“শাশুড়ি, কোথায় আপনি?”

ডাকের পর মিনিট দুই পেরুতেই মোহনা ছুটে এলো। চুল গুলো তার এলোমেলো, চোখ গুলো ফুলে আছে। বোধহয় এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো।

মোহনা হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করেই বিরতিহীন কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে, বউ? কী হয়েছে?”

মায়া নিজের মাঝে হাসি চেপে ন্যাকা স্বরে বললো,
“আসলে আমার আজ সারাদিন শরীরে জ্বর জ্বর ভাব। এদিকে দেখুন বৃষ্টি এসেছে। ছাদে কত গুলো কাপড় দিয়ে ছিলেন না সকালে? সে গুলো বোধহয় ভিজে চুপসে গেছে। আপনি গিয়ে নিয়ে আসবেন একটু?”

মোহনার ঘুমন্ত মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই হায় হায় করে ছুটলো ছাদে। মায়া মিটমিটিয়ে হাসছে। প্রায় মিনিট তিন পর ঠাস করে আওয়াজ এলো,সাথে মোহনার আর্ত চিৎকার। মায়া জানতো এমন কিছুই হবে। বৃষ্টির সময় ছাদ পিছলে থাকে । আর মোহনা কাপড় বাঁচাতে ছুট লাগালেই পিছলে পড়বে। অবশেষে তার বুদ্ধি সফল হলো।

মায়া আরেকটু সময় অপেক্ষা করে ‘কী হলো’ ‘কী হলো’ বলে ছুটে গেলো। তন্মধ্যেই বিপ্রতীপ অফিস থেকে ফিরেছে। মায়ের চিৎকার শুনে সেও দৌড়ে গেলো ছাদে।

_

মোহনা সোফায় বসে কাতরাচ্ছে। তার ডান পা’টার ভীষণ বাজে অবস্থা। পড়ে হয়তো ভেঙে গিয়েছে। বিপ্রতীপ বরফ ঘষছে, তার বাবা বসে আছে পাশেই। মায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

বিপ্রতীপ বরফ ঘষতে ঘষতে বিহঙ্গিনীর উদ্দেশ্য হাঁক ছাড়লো,
“বিহু,বিহু কোথায় তুই? বিহু?”

বিহঙ্গিনীর রুম থেকে কোনো শব্দ এলো না। বিপ্রতীপ বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে আবার ডাক দিলো,
“বিহু,কোথায় গেলি?”

তবুও কোনো শব্দ বা প্রতিত্তোর এলো না। বিপ্রতীপের ভ্রু কুঁচকে এলো। মায়ার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“বিহু কী বাড়িতে নেই?”

বিপ্রতীপের প্রশ্নে মায়া ঠোঁট উল্টালো। ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“জানিনা। ছোটদি তো আজ বাড়ি থেকে বের হয় নি।”

বিপ্রতীপের কুঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকালো। তড়িঘড়ি করে সে উঠে বিহঙ্গিনীর রুমের সামনে গেলো। দরজা সামান্য ঠেলতেই খুলে গেলো হা করে। ঘর পুরো ফাঁকা,কোথাও কেউ নেই। বিছানার উপর কেবল একটা সাদা কাগজ উড়ছে যা কলমদানি দিয়ে আটকে রাখা।

বিপ্রতীপ ছুটে গেলো। কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তেই চক্ষু চড়কগাছ। ছুটে গেলো আবার বসার রুমে। তার শরীর কাঁপছে। ঘাম ছুটছে শরীরের শিরদাঁড়া বেয়ে।

মোহনা ছেলেকে ঘামতে দেখে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“বাবু,কী হলো? বিহু কই?”

বিপ্রতীপ মায়ের দিকে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে কাঁপা গলায় বললো,
“মা,বিহু চলে গিয়েছে। পালিয়ে গিয়েছে, বিহু।”

#চলবে