পদ্মফুল পর্ব-২০+২১+২২

0
268

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২০|

আদিদ-কে দেখা মাত্র রুবি হোসেনের মুখটা চুপসে গেল। আদিদ হেসে বললো,

‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, মা?’

রুবি হোসেন জোরপূর্বক হাসলেন। বললেন,

‘খুব ভালো। আমি তো ভাবতেও পারিনি তুমি এইভাবে চলে আসবে।’

আদিদ সোফায় বসে জুতা খুলতে খুলতে বললো,

‘ভাবলাম তোমাকে আর বাবাকে একটু সারপ্রাইজ দেই, তাই এইভাবে হুট করে চলে এসেছি। তা, বাবা কোথায়, অফিসে?’

‘হ্যাঁ, তোমার বাবা অফিসে। একটু পর হয়তো চলে আসবেন। তুমি বরং রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি খাবার দিচ্ছি।’

‘না মা, খাবার দিতে হবে না আমি খেয়ে এসেছি। আমি এখন একটু রেস্ট নিব, ইদানিং খুব প্রেশার গিয়েছে আমার উপর।’

‘ঠিক আছে, তুমি তাহলে এখন রুমে গিয়ে একটু ঘুমাও। ঘুম ভাঙলে তোমাকে কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে দিব।’

‘আচ্ছা। ওহহ, পদ্ম’র কী খবর? উনাকে দেখছি না যে, রুমে নাকি?’

‘হ্যাঁ, হয়তো ও এখন ঘুমাচ্ছে।’

‘আচ্ছা তাহলে পরে কথা বলে নিব।’

আদিদ উপরে নিজের রুমে চলে গেল। রুবি হোসেন তখন চিন্তায় মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছেন। ছেলেটা আর আসার সময় পেল না। এমনিতে তাকে জোর করেও আনা যায় না, আর আজই তাকে এইভাবে চলে আসতে হলো। তিনি কোথায় ভেবেছিলেন, আদিদ বাড়ি আসার আগেই তাকে না জানিয়ে ভালোই ভালোই পদ্ম’র বিয়েটা দিয়ে দিবেন। পরে না হয় কিছু একটা বলে ওকে বুঝিয়ে ফেলতেন। কিন্তু এখন, এখন তিনি কী করবেন? আদিদ-কে বিয়ের কথা বললেই সে ছেলের খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করবে। আর তখনই তো বাঁধবে বিপদ। রুবি হোসেন হাত কঁচলাচ্ছে। কীভাবে কী করবে কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না।
.
.
বাইরে অন্ধকার। কুচকুচে কালো অন্ধকার না হলেও আবছা অন্ধকার। সূর্য ডুবেছে অনেক আগেই। তবে পুরোপুরি রাত হয়নি এখনও। এই সময়’টাকে “সন্ধ্যা” বলা হয়। দিনের অন্য সময়গুলোর চেয়ে এই সময়’টা পদ্ম’র একটু বেশিই পছন্দ। আর এই পছন্দের সময়ের তার সবথেকে পছন্দের কাজ হলো, কফি কিংবা চা বানানো। আজ সে কফি বানাচ্ছে। উদ্দেশ্য, ডাক্তারবাবুকে দিবে। বেশ কড়া করে সে দুই কাপ কফি বানালো। ডাক্তারবাবু হয়তো এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। হাতে একটা স্ট্রে নিয়ে পদ্ম ডাক্তারবাবুর রুমের কাছে গিয়ে দরজায় নক করলো। কিন্তু, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও ভেতর থেকে কারোর সাড়া শব্দ শোনা গেল না। আরেকবার নক করতে গিয়েও পদ্ম থেমে গেল। ভাবল, হয়তো ডাক্তারবাবু এখনও ঘুমাচ্ছে। তাই সে আর বিরক্ত করলো না। দুই কাপ কফি নিয়ে গেল রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবের রুমে।
দরজায় নক করে বললো,

‘আসবো, বড়ো মা?’

‘হ্যাঁ, এসো।’

পদ্ম ভেতরে ঢুকল। কফির স্ট্রে টা বেড সাইট টেবিলের উপর রেখে বললো,

‘আমি বানিয়েছি।’

রুবি হোসেন হেসে বললেন,

‘তাই? তাহলে তো খুব মজা হবে।’

পদ্ম প্রসন্ন হাসল। বললো,

‘আচ্ছা, আপনারা খান। আমি রুমে যাচ্ছি।’

পদ্ম বেরিয়ে যেতেই আকবর সাহেব বললেন,

‘তো, ছেলেকে নিয়ে কী ভাবলে? কী বলবে ওকে?’

রুবি হোসেন চিন্তিত কন্ঠে জবাব দিলেন,

‘জানি না। তোমার এই ছেলে আমার সব কাজে ঝামেলা হয়ে দাঁড়ায়। এর আগে সুজানার বেলায়ও এমন করেছে। এমনিতে বাসায় আসার খবর নেই, যেদিন সুজানা-কে এখানে এনেছিলাম সেদিনই তাকে এখানে আসতে হয়েছিল। আরেকটু হলেই তো সেদিন আমরা… যাকগে সেসব। এখন কিছু একটা ভাবতে হবে। এবার আর যেন আগের মতো কিছু না হয়। ভাবো ভাবো, কী করবে সেটা ভাবো। নাও কফি খাও আর ভাবো। মেয়েটা কিন্তু কফি ভালো বানায়।’

অতঃপর কফির কাপে চুমুক দিয়ে দুজনেই চিন্তায় মগ্ন হলেন।

.
পদ্ম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার বিয়ের কেনাকাটাগুলো দেখছে। এই সবকিছু আরাফাতের বাড়ি থেকে পাঠিয়েছে। শাড়ি, গহনা সবকিছুই তার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই একবার শাড়ি গায়ে দিচ্ছে তো একবার গহনা পরছে। দুহাত ভরে চুরি পরে সে খিলখিল করে হাসছে। আজ মনে রং ধরেছে তার। রং তো ধরতেই হতো, কাল যে তার বিয়ে। এখন থেকে সে আর অনাথ না। সেও মা-বাবা পাবে, একটা ছোট্ট বোন পাবে আর পাবে একটা পরিচয়। এর থেকে সুখের আর কী হতে পারে।

পদ্ম সবকিছু দেখে সেগুলো আস্তে আস্তে ভাজ করে আলমারিতে রাখছিল। তখনই তার দরজায় আদিদ এসে নক করলো। বললো,

‘আসবো?’

আদিদ-কে দেখে পদ্ম হেসে বললো,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন।’

আদিদ ভেতরে এলো। বিছানার উপর এত সব জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেখে সে কিঞ্চিত হেসে বললো,

‘অনেক শপিং করেছেন মনে হয়?’

পদ্ম খানিক লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললো,

‘না, এগুলো তো ঐ বাড়ি থেকে দিয়েছে।’

আদিদ ঠিক বুঝলো না। সে পুনরায় প্রশ্ন করলো,

‘ঐ বাড়ি মানে কোন বাড়ি? আপনার মামা বাড়ি?’

‘না না, মামা বাড়ি কেন হতে যাবে? এগুলো তো আরাফাতদের বাড়ি থেকে দিয়েছে।’

এবার যেন আদিদের সবকিছু অদ্ভুত লাগল। এই আরাফাত আবার কে? আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,

‘আরাফাত কে?’

পদ্ম যেন এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে কিছুক্ষণ বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

‘আপনি আরাফাত-কে চেনেন না?’

আদিদ মনে করার চেষ্টা করলো সে আরাফাত নামের আদৌ কাউকে চেনে কিনা। কিন্তু না, তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিল, “না সে এমন কাউকে চেনে না।” আদিদ বিব্রত গলায় বললো,

‘না, আমি তো আরাফাত নামের কাউকে চিনি না।’

পদ্ম পুনরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে রুবি হোসেন বলে উঠলেন,

‘আরে, তোমাকে বলেছিলাম না আরাফাতের কথা? তোমার হয়তো মনে নেই।’

আদিদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘না মা, তুমি আমাকে এই নামের কোনো ব্যক্তির কথা কখনো বলোনি। কে এই আরাফাত? আর উনার বাড়ি থেকে পদ্ম’র যেন এত কিছু কেন পাঠানো হয়েছে?’

আদিদের প্রশ্ন শোনে ক্রমে ক্রমে বিস্ময়ের ছায়ায় আবৃত হচ্ছে পদ্ম। তার মানে কি, ডাক্তারবাবু কিছু জানেন না? কিন্তু বড়ো মা তো বলেছেন তিনি সব জানেন। তাহলে, বড়ো মা মিথ্যে কেন বললেন?

রুবি হোসেন এখন কীভাবে কথা ঘুরাবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। ঠিক সময়ে মাথায় কোনো বুদ্ধি আসে না। কিছু একটা তো বুঝাতে হবে আদিদ-কে। নয়তো পরে পদ্মও তাকে সন্দেহ করবে। উফফ, কী যে ঝামেলা!
তিনি অস্থির কন্ঠে বললেন,

‘বাবা, তোমার হয়তো মনে নেই আমি বলেছিলাম তোমাকে। আচ্ছা সমস্যা নেই, আমি আবার বলবো। চলো আমার রুমে চলো। আর পদ্ম, তুমি বরং এই ফাঁকে সবকিছু গুছিয়ে নাও, কেমন?’

আদিদ-কে এক প্রকার জোর করেই রুবি হোসেন তার রুমে নিয়ে গেলেন। আদিদ ক্রমাগত তাকে প্রশ্ন করেই চলেছে, কে আরাফাত? আদিদ কেন তাকে চেনে না? তার সাথে পদ্ম’র ই বা কী সম্পর্ক? আরও অনেক…রুবি হোসেন বিরক্ত হয়ে আদিদ-কে থামিয়ে বললেন,

‘আমি বলছি তো আদিদ, তুমি থামো এবার।’

আদিদ ক্ষান্ত হলো। জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘বলো মা।’

রুবি হোসেন একবার আকবর সাহেবের দিকে তাকালেন; তারপর শুকনো ঢোক গিলে বললেন,

‘আমরা আসলে পদ্ম’র বিয়ে ঠিক করেছি। আর যার সাথে পদ্ম’র বিয়ে ঠিক করেছি তার নামই আরাফাত।’

আদিদ নির্বাক হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। বিস্ময়ের রেশ কিছুটা কাটিয়ে সে বলে উঠল,

‘আমাকে একবার বললেও না মা। এত বড়ো একটা ডিসিশান হুট করেই নিয়ে ফেললে? পদ্ম’র মত আছে এই বিয়েতে?’

‘হ্যাঁ, ওর মত আছে বলেই তো আমরা রাজি হয়েছি। ছেলে খুব ভালো। ভালো একটা জব করে। আর উনারা পদ্ম’র ব্যাপারে সব কিছু জেনে শুনেই এই সম্মন্ধে রাজি হয়েছেন।’

আদিদ তখন কপাল কুঁচকে বললো,

‘তাই নাকি? তা ছেলের বায়োডাটা দাও আমাকে। আমিও একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখি উনারা কতটা ভালো।’

‘তোমায় এত চিন্তা করতে হবে না। তোমার বাবা সবকিছু খোঁজ খবর নিয়েছেন। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো কালই ওদের বিয়ে। পদ্ম বলেছে, ও কোনো প্রকার আড়ম্বরতা চায় না। মসজিদেই নাকি বিয়েটা হবে। ভেবেছিলাম তোমাকে বলবো, রাতে চলে আসতে। কিন্তু দেখো, কীভাবে সবটা মিলে গেল। বলার আগেই তুমি আজ চলে এলে।’

আদিদ সবকিছু শুনে বললো,

‘মা, সবকিছু এত তাড়াহুড়ো করে কেন করছো? আরেকটু সময় তো নিতে পারতে। একটা বিয়ে বলে কথা। আর উনার মামা মামী-কে খবর দিয়েছো তুমি? উনারা জানেন বিষয়’টা?’

‘জানেন। আমি বলেছি উনাদের। কিন্তু উনারা বলেছেন, উনারা নাকি আসবেন না। বলেছেন, আমাদের যা ভালো মনে হয়, আমরা যেন তাই করি।’

আদিদ বললো,

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আমাকে এখন ছেলের নাম্বার দাও। আমি আগে ছেলের সাথে কথা বলবো, তারপর হবে সবকিছু।’

রুবি হোসেন আদিদ-কে আরাফাতের নাম্বার’টা দিল। আদিদ নাম্বার’টা নিয়ে তার রুমে চলে গেল।

_______________________

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে আদিদ তার রুমে এলো। সে তখন ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল, এগারো’টা বিশ বাজে। ফোন’টা হাতে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়েল করলো সে। কল’টা রিসিভ করে ওপাশ থেকে কেউ সালাম দিল। আদিদ সালামের জবাব দিয়ে বললো,

‘আরাফাত বলছেন?’

‘জ্বি, আপনি কে?’

‘আমি আদিদ, রুবি হোসেনের ছেলে।’

‘ওহহ, আচ্ছা আচ্ছা। ভালো আছেন, আপনি?’

‘জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন?’

‘জ্বি জ্বি, আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি।’

‘তা, আপনি কি এখন ফ্রি আছেন? একটু কথা বলা যাবে?’

‘জ্বি ভাইয়া, বলুন না কী বলবেন?’

আদিদ আজ অনেকদিন পর ছাদে এসেছে। আকাশে থালার মতো চাঁদ’টা দেখে সে আর লোভ সামলাতে পারলো না ছাদে আসার। ভাবলো, আরাফাতের সাথে কথাও বলা হয়ে যাবে আর চাঁদ দেখাটাও হয়ে যাবে।

অনেকক্ষণ সে আরাফাতের সাথে কথা বললো। ছোট খাটো একটা ইন্টারভিউ নেওয়া হয়ে গিয়েছে তার। এবার সে অনেকটা সন্তুষ্ট। ছেলে’টার সাথে কথা বলে তার ভালোই মনে হলো। এখন বাকিটা পদ্ম’র ভাগ্য।

অনেকটা সময় ছাদে নিরালায় পার করলো সে। আগে প্রায়ই ছাদে উঠত, আকাশের চাঁদ দেখত, বিকেলের সূর্য দেখতো। কিন্তু এখন আর সেসব তেমন একটা দেখা হয়ে উঠে না তার। অনেকদিন পর আবার এইভাবে ছাদে এসে চাঁদ দেখেছে সে। আগে চাঁদ দেখে ভালো লাগলেও আজ বিষন্ন লাগছে। ঐ চাঁদের মতো নিজেকেও খুব একা মনে হচ্ছে তার। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। বুকের ভেতরে প্রচন্ড ব্যথাটা টের পায়। সে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ছাদের সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে আবারো জোরে শ্বাস টানে সে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিচ্ছিরি গন্ধ তার নাকে প্রবেশ করে। সে সাথে সাথে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। কিসের গন্ধ এটা? আশে পাশে তাকিয়ে খুঁজতে থাকে। তখনই তার সেই রুম’টার দিকে চোখ যায়। এই রুম থেকেই আসছে গন্ধ’টা। রুমটার কিছুটা কাছে যেতেই গন্ধ’টা আরো তীব্র হয়। পদ্ম ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। এটা তো তার ছোট্ট বেলার খেলার রুম ছিল। বড়ো হয়ে যাওয়ার পর থেকে আর এই রুম’টাতে কখনও উঁকিও দেওয়া হয়নি তার। আজ কী ভেবে তার মনে হলো রুম’টাতে যাবে। দরজায় তালা দেখে সেটা দু একবার ঘুরিয়ে টুরিয়ে দেখে ছেড়ে দিতেই তালা’টা খুলে গেল। আদিদ খুশি হলো তাতে। যাক, তালা’টা নষ্ট হওয়ায় ভালো হয়েছে। সে দরজা খুলে রুমে ঢুকে। ফ্ল্যাশ দিয়ে রুমের লাইট’টা খুঁজে বের করে সেটা জ্বালিয়ে দেয়। রুমের এমন করুণ দশা দেখে আদিদের মায়া হয়। এই রুম’টাতেই এক সময় সে অনেক সময় কাটিয়েছিল, আজ তার এই দশা। বিশেষ করে এই বিচ্ছিরি রকমের গন্ধ’টা সে আর সহ্য করতে পারছে না। নাক চেপে তাই সে রুম’টা ভালো করে দেখতে লাগল। তখন একটা পুরোনো শেলফে চোখ গেল তার। কাছে গিয়ে দেখল সেখানে সুজানার ছবি রাখা। সে নিজেই রেখেছিল। সুজানার সাথে তোলা তার প্রথম ছবি। ছবিটা হাত দিয়ে মুছে পরিষ্কার করলো সে। তারপর একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল সুজানার মুখের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হলো তার খুব কষ্ট হচ্ছে। এই রুমে আর থাকতে পারবে না সে। ছবিটা রেখে পেছন ফিরতেই হঠাৎ কী যেন মনে হলো তার। সে আবার ছবিটা হাতে নিল। কী ভেবে ছবিটা উল্টে দেখল সে। তার মনে হলো ছবির পেছনে কিছু লেখা। খুব ছোট আর অস্পষ্ট। কিন্তু কিছু তো একটা লেখা আছে। আদিদ ঠিক বুঝতে পারছে না। সে সেই রুমের দরজা আটকিয়ে ছবিটা নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো।

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২১|

“তোমার কাছে যতদিনে এই লেখা’টা পৌঁছাবে ততদিনে হয়তো আমি আর বেঁচে থাকবো না। জানতো, ওরা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি, ডাক্তারবাবু। আমাকে বাঁচাও না প্লীজ। আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি ডাক্তারবাবু, প্রচন্ড। তবে সত্যি’টা বলার মতো সাহস আমার ছিল না। পারলে আমায় ক্ষমা করো তুমি…”

নিচে আরেকটু কিছু লেখা ছিল। কিন্তু সেটা অনেকটাই মুছে যাওয়ায় আদিদ কোনোভাবেই সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। আদিদের শ্বাস প্রশ্বাস আটকে আসছে। সুজানা এই ছবির পেছনে কখন এসব লিখল? সে কীভাবে পেল এই ছবি? এই ছবির কথা তো আদিদ তাকে কখনো বলেনি, না কখনো তাকে ছবিটা দেখিয়েছে। তার মানে সুজানা নিশ্চয়ই তার খেলার রুমে গিয়েছিল, আর সেখানেই সে এই ছবিটা পেয়েছে। আর এসব লেখা? সুজানা-কে কারা এত কষ্ট দিচ্ছিল? আর কী এমন সত্যিই বা ছিল যেটা সুজানা তাকে বারবার বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। উফফ! আদিদের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। এই ছবিটা সে আগে কেন দেখল না। এখন তো ভয়ে তার গা শিউরে উঠছে। সুজানার সাথে নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিছু হয়েছে। আদিদ আর থাকতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গেই তার ডিটেক্টটিভ বন্ধু “অভি” কে কল দেয়। কল’টা রিসিভ করতেই আদিদ অস্থির হয়ে বলতে লাগে,

‘দোস্ত, আমার মনে হচ্ছে সুজানার সঙ্গে খারাপ কিছু হয়েছে। খুব খারাপ কিছু। মেয়েটা আমাকে কিছু বলতে চাইছিল। ওর সাথে কেউ বোধ হয় খুব অন্যায় করেছিল। হয়তো সেই লোকটার কথাই সে আমাকে বলতে চাইছিল কিন্তু বলতে পারেনি। শোন, আমি তোকে একটা ছবি পাঠাচ্ছি। তুই ছবিটা ভালো করে দেখ, তারপর বলিস, তুই কী বুঝেছিস। আমার মাথা কাজ করছে না দোস্ত। আমি আর এত টেনশন নিতে পারছি না।’

‘তুই এত হাইপার হোস না। কী ছবি পেয়েছিস তুই? ছবিগুলো আগে আমায় দে। আমি ভালো করে দেখি আগে। তুই একটু শান্ত হ। আমি তোকে আবার কল করছি।’

‘আ-আচ্ছা।’

অভির কাছে আদিদ ছবিটা পাঠায়। দুশ্চিন্তায় সে ভীষণ রকম কাতরাচ্ছে। এতদিন যা ভেবে এসেছে এখন তার সব কিছু উল্টো মনে হচ্ছে তার। সবকিছু ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে। সুজানা এমনি এমনি উধাও হয়নি। ওর সাথে কেউ কিছু করেছে। কপালের ঘামগুলো মুছে আদিদ সুজানার ছবিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখের দৃষ্টি তখন ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে উঠল তাল। বুকের ভেতরের এই অসহ্য যন্ত্রণা সে আর সহ্য করতে পারছে না। ঝিম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে ধপ করে নিচে বসে পড়ে। হাতের ছবিটা বুকের মাঝে চেপে ধরে সে তখন কেবল ঘন ঘন নিশ্বাসই ফেলতে থাকে।
.

চারদিক নিস্তব্ধ। অনেক রাত হয়েছে। বাইরে সো সো করে বাতাস বইছে। রাস্তার ধারের নারকেল গাছগুলো “ঝপাৎ ঝপাৎ” করে আওয়াজ তুলে বাতাসের তালে নেচে চলছে। অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কিছু কুকুরের আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ শুনে আদিদের মনে হচ্ছে, কুকুরগুলোও হয়তো কাঁদছে। রাত হলে মানুষের মতো হয়তো কুকুরদেরও কষ্ট বাড়ে। তাই তারা গভীর রাত হলেই এমন আর্তনাদ শুরু করে। ঘেউ ঘেউ করে জানান দেয় তাদের কষ্টের কথা। যেমনটা দিচ্ছে আদিদ, তার নিরব চোখের জল ফেলে।

অভি তাকে তখন কল করে। আদিদ কল রিসিভ করে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অভি তাকে শান্ত হতে বলে। তারপর বলে,

‘দোস্ত, আমাকে আগে একটু বলতো তুই এই ছবিটা কোথায় পেয়েছিস?’

‘আমার খেলার রুমে। তোর মনে আছে, আমাদের ছাদে আমার একটা এক্সট্রা রুম ছিল। যেখানে আমি আবার সব খেলনা আর পুরোনো জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছি। সেখানেই আমি এই ছবিটা রেখেছিলাম। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে কোনোদিন আর সেই রুমটাতে যাওয়া হয়ে উঠেনি। আজ হঠাৎ কী ভেবে মন চাইলো একটু যাওয়ার জন্য আর তখন এই রুমে গিয়েই আমি এই ছবিটা পাই। আর তার পেছনে এই লেখাগুলো। এই গুলো সুজানার হাতের লেখা। আর সবথেকে আশ্চর্যের কথা কি জানিস? এই ছবির কথা সুজানা জানতোই না। কিংবা সুজানা কোনোদিন আমার ঐ রুমেও যায়নি। তাহলে সে কীভাবে এই ছবি পেল, আর এই ছবিতে এসব কেন লিখল? ওর সাথে কী হয়েছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ও এসব কেন লেখল দোস্ত? ও কি সত্যি সত্যিই আর বেঁচে নেই? কে মে*রে*ছে ওকে? কে?’

আদিদ কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। কথায় আছে, ডাক্তারদের কাঁদতে নেই। কিন্তু, সুজানার এই ডাক্তারবাবু অন্য সবার থেকে আলাদা। সে কাঁদে। সুজানা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই হুট হাট করেই তার কথা ভেবে সে কেঁদে উঠে। সেই হয়তো একমাত্র ডক্টর যে কিনা এইভাবে বাচ্চাদের মতো করে কাঁদে।

অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

‘তুই শান্ত হ আদিদ। এইভাবে ভেঙ্গে পড়লে, আমরা আসল রহস্য ভেদ করবো কী করে? শোন, আমাকে একবার তোর বাড়িতে আসতে হবে। আর তোর সেই রুমটাও একবার ভালো করে চেক করতে হবে। আমার মন বলছে ঐ রুমের মধ্যেই এই রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে। তুই কি কাল ফ্রি আছিস, তাহলে আমি কালই আসবো?’

আদিদ হ্যাঁ বলতে নিলেই তার মনে পড়ল, কাল তো আবার পদ্ম’র বিয়ে। বিয়ের দিন এসব করলে যদি উনার বিয়েতে কোনরূপ বিঘ্ন ঘটে, তখন আবার আরেক ঝামেলা হবে। ঐ মেয়েটাও খুব কষ্ট পাবে। আদিদ তাই ভেবে বললো,

‘এক কাজ করিস, তুই রাতে আসিস। কাল আমাদের বাড়িতে একটা প্রোগ্রাম আছে সেইজন্য চাইলেও তোকে সকালে আনতে পারবো না।’

‘কাল আবার তোদের বাড়িতে কীসের প্রোগ্রাম?’

‘আরে আর বলিস না, আমাদের বাড়িতে একটা মেয়ে থাকে। মা কাল আবার ঐ মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে। আহামরি কিছু না হলেও, এই বাড়িতে যেহেতু বিয়েটা হচ্ছে সেহেতু কিছু মানুষ তো থাকবেই তাই আর কী এত মানুষের মাঝে আর এইসব ঝামেলা করতে চাইছি না। তাই এইসব বিয়ে টিয়ের ঝামেলা মিটলে রাতে তুই আসিস। তখন আর তোর কাজেও কোনো সমস্যা হবে না।’

‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু, আমি এই বিয়েতেও থাকতে চাই। জাস্ট উপস্থিত থাকবো তেমন কিছুই করবো না। আমার কিছু ব্যাপার একটু দেখতে হবে। তাই এই প্রোগ্রামে থাকাটাও আমার খুব জুরুরি।’

আদিদ বললো,

‘ঠিক আছে তাহলে, তুই সকাল সকাল চলে আসিস। আমি তোর অপেক্ষা করবো। এখন রাখছি তাহলে।’

‘আচ্ছা। রেখে সুন্দর করে একটা ঘুম দে। আর এত হাইপার হোস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

কল’টা কেটে দিয়ে আদিদ নিচেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে মনে মনে বললো,

“আর কিছু ঠিক হওয়ার নেই। যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।”

_________________________

সকাল সকাল গোসল করে পদ্ম আস্তে আস্তে তৈরী হতে থাকল। বাইরে ঝকঝকে রোদ। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেই চোখ যেন ঝাপসা হয়ে উঠে। লাল বেনারসী আর হাত ভর্তি রেশমী চুরি পরে সে তার ভেজা চুল মুছে চলছে। বড়ো মা’র কাছে শুনেছে, আরাফাত’রা নাকি রওনা দিয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চলে আসবেন। আর তারপরই তার সেই কাঙ্খিত সময়ও চলে আসবে। যে সময়ের অপেক্ষায় তাদের বুকের ভেতরটা এইভাবে ধরফর করছে।
.

বাইরে গাড়ির শব্দ শুনেই পদ্ম ছুটে বারান্দায় গেল। উনারা কি চলে এসেছেন? পদ্ম দেখল কালো রঙের একটা গাড়ি ঢুকেছে। গাড়িটা বাড়ির কাছে এসে থামল। সেখান থেকে বেশ বড়ো সড়ো দেহের একটা লোক নামল। গায়ে তার সুট কোট আঁটা। চোখের কালো চশমা’টা নামিয়ে লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন দেখছে। হঠাৎই সে উপরের দিকে তাকিয়ে পদ্ম-কে দেখে বিস্মিত হয়। লোকটার সাথে চোখে চোখ পড়তেই পদ্ম জলদি তার রুমে চলে আসে। এই লোকটা আবার কে? এইভাবে তাকায় কেন? পদ্ম ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে নিজের সাজগোজে আবার মনোযোগ দেয়।
.
.
অনেকদিন পর বন্ধুকে দেখে আদিদ প্রচন্ড খুশি হয়েছে। আর তার বিপরীতে তাকে দেখে প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়েছেন আদিদের মা, বাবা। এই ছেলে এখানে কেন? পারছে না শুধু এক্ষুণি তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। রুবি হোসেন আদিদ-কে আড়াল করে নিয়ে অভির এই বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদিদ তাকে সত্য না বলে, কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দেয়। আর উনাকেও তখন বাধ্য হয়ে তার ছেলের কথা মেনে নিতে হয়।

.

দুপুর তিন’টা বেজে চল্লিশ মিনিট। ছেলে পক্ষ চলে এসেছে। ছেলের নাকি মসজিদে কবুল বলাও হয়ে গিয়েছে, এবার মেয়ের পালা। কাজী সাহেব পদ্ম’র রুমে গেলেন। সঙ্গে রুবি হোসেন, আকবর সাহেব আর আরাফাতের চাচাও গেলেন। পদ্ম খুব ভয় পাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে তার। এই তিন অক্ষরের ছোট্ট একটা শব্দ বললেই জীবন পাল্টে যাবে তার। সবকিছু তখন অন্যরকম হয়ে যাবে। তার শরীর যেন হালকা পাতলা কাঁপছে। রুবি হোসেন তাকে বুঝিয়ে চলছেন। এক পর্যায়ে নিজেকে শান্ত করে পদ্ম বলেই ফেলল, “আলহামদুলিল্লাহ, কবুল”। ব্যস, তার বিয়ে…

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২২|

আরাফাত বাড়িতে আসার পর থেকেই অভি যেন কেন বারবার ঘুরে ঘুরে তাকে দেখছে। ব্যাপার’টা আরাফাতও খুব ভালো ভাবে খেয়াল করেছে। সে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে তাতে। আদিদ তার সাথে অভির পরিচয় করিয়ে দেয়। অভি কথার তালে তালে তার থেকে অনেক কিছু জানতে চায়। কথা বলা শেষ করে আদিদ অভিকে নিয়ে তার রুমে চলে যায়। রুমে ঢুকতেই অভি বলে,

‘ছেলেটা মিথ্যে বলছে।’

আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,

‘কোন ছেলে, আরাফাত?’

‘হ্যাঁ। ওর সব কথা সত্যি না। আমি ডেম সিউর, ও তোদের কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে। ও নিজেকে যেমনটা দেখাচ্ছে ও আসলে তেমন না।’

‘তাহলে কেমন ও? ওকে কেন তোর হঠাৎ এত সন্দেহ হচ্ছে?’

‘না, ঠিক সন্দেহ না। আমি নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারছি না। আসলে এত এত খারাপ মানুষ জীবনে দেখেছি যে এখন ভালো মানুষ দেখলেও সন্দেহ লাগে। যাকগে, আমাদের এখন অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে হবে। আমাকে আগে তোর সেই রুমে নিয়ে চল। ঐ রুমে গেলেই আমি সব কিছু বুঝতে পারবো।’

‘হুম, নিয়ে যাবো। তবে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। একটু পরই হয়তো পদ্ম’র বিদায় হয়ে যাবে। তারপরই আমি তোকে সেখানে নিয়ে যাবো।’

‘আচ্ছা। বাই দ্যা ওয়ে, আন্টি আংকেল কি জানে আমি এখানে কেন এসেছি?’

‘না, আমি বলিনি।’

‘ভালো করেছিস। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমাদের এই মিশন’টা হবে সিক্রেট মিশন, বুঝতে পেরেছিস?’

‘হুম, বুঝেছি।’

আরাফাতের বাড়ি থেকে তেমন কেউ আসেনি। যেই কয়জন এসেছে তাদের সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। এখন চলছে বিদায়ের প্রস্তুতি। আরাফাত আর পদ্ম ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে। বাড়ির অন্য সবার সাথে সাথে অভি আর আদিদ ও সেখানে উপস্থিত। রুবি হোসেন আরাফাতের মা’কে বোঝাচ্ছেন। যেমন করে মেয়ের বিয়ের সময় মা তার শ্বাশুরি’কে বোঝায় ঠিক তেমন। পদ্ম খানিক অস্বস্তি আর লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। তার বরাবর’ই বসা ডাক্তারবাবু। সে একবার আলতো চোখে তার দিকে তাকায়। মনে মনে বলে, “এই মানুষ’টার জন্যই হয়তো আজ সে বেঁচে আছে। মানুষ’টার সমস্ত কষ্ট আল্লাহ দূর করে দিক । উনার ভালোবাসাকে উনার কাছে ফিরিয়ে দিক।”

আরাফাতের বাড়ির লোক এবার পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল, এবার তাদের বেরুতে হবে। পদ্ম’র কী হলো কে জানে, সে কেঁদে উঠল। রুবি হোসেন-কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। রুবি হোসেন তখন তার মাথায় তখন হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,

‘ভালো থেকো, মা। এই বাড়িতে হয়তো তোমার অনেক অসুবিধা হয়েছে, আমরা হয়তো ঠিক মতো তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি তার জন্য আমাদের ক্ষমা করো। কিন্তু, ইনশাল্লাহ এখন থেকে তোমার জীবন পাল্টে যাবে দেখো। তুমি তোমার বাকি জীবনটা খুব সুখে কাটাতে পারবে। তোমার জন্য আমার অনেক অনেক দোয়া রইল।’

পদ্ম মাথা তুলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,

‘তোমরা আমার জন্য অনেক করেছো। আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছো। আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি তবে আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমাদের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে, বড়ো মা।’

পদ্ম চোখ মুছতে মুছতে বড়ো মা’কে সালাম করলো। আকবর সাহেবের কাছে গিয়ে উনাকেও সালাম করলো। তারপর সে গেল ডাক্তারবাবুর কাছে। ভেজা গলায় বললো,

‘আমার জন্য আপনাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। খুব জ্বালিয়েছি আপনাকে তাই না? ক্ষমা করবেন। আপনি খুব ভালো মানুষ। দেখবেন, একদিন আল্লাহ ঠিক আপনার দোয়া কবুল করে নিবেন আর আপনি আপনার ভালোবাসাকে আবার ফিরে পাবেন।’

আদিদ আলতো হেসে পদ্ম’র মাথায় হাত রেখে বললো,

‘ভালো থাকবেন। আর কোনো অসুবিধা হলে, অবশ্যই আমাকে জানাবেন।’

পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘আচ্ছা।’
.
.

নতুন বউ নিয়ে বর যাত্রী বেরিয়ে পড়েছেন। সবাইকে বিদায় করে, রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব নিজের রুমে চলে এলেন। আদিদ ও তখন অভি-কে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। তবে গেইটের সামনে তখনও দাঁড়িয়ে রইল কেবল একজন। যিনি তার ময়লা পুরোনো শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন তো আবার কাঁদছেন। যদি পারতেন, হয়তো তিনি পদ্ম-কে কখনো তাদের সাথে চলে যেতে দিতেন না। তিনি তো জানেন, মেয়েটা কে যে তারা বাঁচতে দিবে না।

.

‘এই রুম’টার কথাই তোকে বলেছিলাম অভি।’

অভি নাক টেনে বললো,

‘কিন্তু, এখান থেকে এত গন্ধ আসছে কেন?’

‘আসলে রুমটা অনেকদিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না। মনে হয় কোনো চিপা চাপায় ইঁদুর টিদুর ম*রে পড়ে আছে, তাই এত গন্ধ।’

‘এটা ইঁদুর ম*রা*র গন্ধ? আচ্ছা দরজাটা খুল, ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবো।’

আদিদ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। অভিও পেছন পেছন ভেতরে আসল। চারদিকে প্রচুর ময়লা আর তার সাথে এই বিচ্ছিরি গন্ধ। অভি নাকে রুমাল চেপে ধরলো। তারপর সে বললো,

‘ছবিটা তুই কোথা থেকে পেয়েছিলি?’

আদিদ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,

‘ঐ যে ঐ শেলফের উপর।’

অভি সেখানে গেল। ভালো ভাবে এদিক ওদিক তাকাল। চারদিক এত ময়লা যে কিছু ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অভি আদিদ-কে বললো,

‘এই রুমে তুই কী কী রেখেছিস? তোর প্রয়োজনীয় কিছু আছে এখানে?’

‘না, তেমন কিছু নেই।’

‘তাহলে এক কাজ কর। এখানে যত ড্রয়ার আছে সবগুলো খুল। আমি একটা একটা করে সবগুলো ফার্নিচার সরিয়ে দেখবো।’

‘ঠিক আছে।’

আদিদ আর অভি টেনে টেনে ফার্নিচারগুলো সরাচ্ছে। আর তার দরুন নিচে শব্দ তৈরি হচ্ছে। কিছু শব্দ কানে যেতেই রুবি হোসেন শোয়া থেকে উঠে বসলেন। বললেন,

‘এই তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছো?’

আকবর সাহেব ব্রু কুঁচকে বললেন,

‘কী শুনবো?’

‘আরে উপর থেকে শব্দ আসছে। কেউ কি ছাদের রুমে গিয়েছে নাকি?’

‘ছাদের রুমে কে যাবে আবার?’

‘আরে শুনছো না, ঐ তো ফার্নিচার টানার শব্দ হচ্ছে। চলো তো, উপরে গিয়ে একবার দেখে আসি।’

‘আমি পারবো না এখন উপরে যেতে। তোমার যেতে হলে তুমি যাও।’

রুবি হোসেন তখন কর্কশ গলায় বললেন,

‘তা কেন পারবে? এখন যদি বলতাম, উপর থেকে কোনো মেয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে তখন তো আমার আগেই দৌড় দিতে, যত্তসব।’

রুবি হোসেন একাই ছাদের দিকে উঠতে লাগলেন।
সবকিছু জায়গা থেকে সরানোর পরও তারা তেমন কিছু পায়নি। এখন শুধু বাকি এই আলামারি। এই ভারি আলামারি কীভাবে সরাবে সেটাই তারা বুঝতে পারছে না। আদিদ না করলেও অভি বললো, একবার চেষ্টা করা উচিত। দুজনে খুব শক্তি প্রয়োগ করে আলামারির এক দিক অনেকটা ফাঁক করলো। তারপর আরো চেষ্টা করে আলামারিটা অনেকটাই সামনে নিয়ে এলো তারা। অভি আলামারির পেছনে গেল। এত এত ময়লায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে সে ভালো ভাবে দেখতে লাগল কিছু আছে কিনা। হ্যাঁ, আছে। একটা কামিজ। সে কামিজটা হাতে নিয়ে আলামারির পেছন থেকে বের হতেই দরজার সামনে রুবি হোসেনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাপড়’টা পেছনে ফেলে দিয়ে বললো,

‘আন্টি, আপনি?’

আদিদ পেছন ফিরে তাকাল। রুবি হোসেন চোয়াল শক্ত করে বললেন,

‘তোমরা এখানে কী করছো?’

আদিদ জবাবে বললো,

‘মা, আমরা একটা কাজ করছি।’

‘এই রুমে তোমাদের কী কাজ?’

জ্বলে উঠে বললেন রুবি হোসেন। আদিদ বললো,

‘রেগে যাচ্ছো কেন মা? বললাম তো, আমরা একটা কাজে এসেছি। কাজ শেষ হলে চলে যাবো। এখানে এত রেগে যাওয়ার কী আছে?’

অভির দুই ব্রু এর মাঝখানে একটু ভাজ পড়ল। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো তার। রুবি হোসেনের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। অভির এমন চাহনি তে রুবি হোসেন ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন। বললেন,

‘না, রেগে যাচ্ছি না তো। আমি তো শুধু বলছিলাম, এই গরমে এত ময়লার মাঝে তোমাদের আবার এত কী কাজ থাকতে পারে? আচ্ছা, সমস্যা নেই। কাজ থাকলে, করো কাজ। আমি নিচে গিয়ে একটু রেস্ট নিই।’

‘ঠিক আছে মা। তুমি নিচে যাও, আমরাও কাজ সেরে নিচে নামছি।’

রুবি হোসেন নিচে নেমে গেলেন। রুমে গিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে বললেন,

‘সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।’

আকবর সাহেব বিরক্ত কন্ঠে বললেন,

‘আবার কী হয়েছে?’

রুবি হোসেন তখন চেঁচিয়ে উঠে বললেন,

‘তোমার ছেলে অভিকে নিয়ে ছাদের রুমে গিয়েছে।’

আকবর সাহেব ও ঘাবড়ে গেলেন।

‘কিন্তু কেন?’

‘জানি না আমি। আমার তো এখন ভয় করছে, ওরা যদি কিছু বুঝে ফেলে?’

‘না না, বোঝার কোনো উপায় নেই। ঐ রুমে কোনো কিছুর চিহ্ন’ই নেই যে ওরা কিছু বুঝবে। আর বুঝলেও, আমরা এক কথায় থাকবো, আমরা কিছু জানি না। একেবারে নরমাল থাকো। বেশি হাইপার হলে, ঐ অভি বুঝে ফেলবে।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। আমাদের এখন একদম নরমাল থাকতে হবে। যেন ওরা কিছু পেলেও আমাদের উপর সন্দেহ করতে না পারে।’

অভি তার হাতের কাপড়’টা আদিদের সামনে ধরে বললো,

‘এটা কার?’

আদিদ কাপড়’টা হাতে নিল। কাপড়’টা ভালো ভাবে পরিষ্কার করে বললো,

‘সুজানার?’

তার গলা ধরে এল। হ্যাঁ, এটা সুজানার’ই। অভি বললো,

‘সুজানার কাপড় এখানে কেন? তুই কি সিউর এটা সুজানার?’

‘হ্যাঁ, এটা পরেই ও লাস্ট আমার সাথে দেখা করেছিল। আর তারপর…’

‘সুজানা কি এই রুমে কখনো এসেছিল?’

‘না।’

‘কাপড়’টা দে আমায়।’

অভি কাপড়’টা হাতে নিয়ে বললো,

‘দেখছিস, কাপড়’টার কিছু অংশ ছিড়ে আছে। কাপড়’টা পুরনো বলে কিন্তু ছেড়া না এটা কেউ ছিড়েছে।’

‘কী?’

‘হুম। একটা কাজ কর তো, এই আলমারি’টা খুল। এর মধ্যেই হয়তো সুজানা আছে।’

আদিদ রেগে গেল। ব্রু কুঁচকে বললো,

‘এসব কী বলছিস তুই?’

‘কথা না বলে, যা বলেছি তা কর না।’

আদিদ আলামারি’টা টান দিতেই দেখল সেটা লক করা। অভি বললো,

‘জানতাম লক করা থাকবে।’

কথাটা বলে অভি তার পকেট থেকে চিকন পিনের মতো কিছু একটা বের করলো। তারপর সেই পিনের মতো জিনিস’টা লকের ভেতর ঢুকিয়ে লক’টা ভেঙ্গে ফেলল। আর সে যখন আলমারির দরজাটা খুললো সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ একটা তীব্র গন্ধ তাদের নাকে এসে ঠেকল। গন্ধ’টা এত খারাপ ছিল যে তারা আর সহ্য করতে না পেরে অন্যদিকে ঘুরে গেল। তারপর আস্তে আস্তে গন্ধ’টা একটু দূর হলে অভি তার মোবাইলের ফ্ল্যাশ’টা আলমারির দিকে ধরল। আর তখনই যেন আঁতকে উঠল আদিদ। তার শরীর কাঁপতে লাগল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

‘এ-এটা ক-কার ক*ঙ্কা*ল?’

অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

‘হয়তো সুজানার।’

আদিদ ধপ করে নিচে বসে পড়ে। তার নিশ্বাস আটকে আসছে। মনে হচ্ছে যেন এক্ষুণি হয়তো ম*রে যাবে।

অভি বললো,

‘আগে এটার ডি এন এ টেস্ট করতে হবে, তারপরই সিউর হওয়া যাবে এটা কার ক*ঙ্কা*ল।’

____________________

বাড়িতে হৈ চৈ পড়েছে। পুলিশ দিয়ে ভর্তি বাড়ি। আকবর সাহেব আর রুবি হোসেন এত বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন যেন উনারা এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না। অন্যদিকে আদিদ স্তব্ধ। সে এখনও ঐ রুমেই বসে আছে। অভি তাকে কোনোভাবেই সেখান থেকে আনতে পারছে না। ক*ঙ্কা*ল’টা ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়েছে। সঙ্গে সুজানার বাড়ির লোকদের ও খবর দেওয়া হয়েছে। এখন ডি এন টেস্ট করালেই এই সব কিছুর সমাধান পাওয়া যাবে। অভি তার এক কলিগ-কে বলেছে ঐ রুম আরো ভালো ভাবে সার্চ করতে। আর বাকি সবকিছু তো পুলিশ’রা করছেই।

সে আদিদ-কে কোনোরকমে ধরে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে বললো,

‘এখনই এইভাবে কেন ভেঙ্গে পড়ছিস? আমরা তো সিউর না যে এটা কার ক*ঙ্কা*ল। আমাদের আগে হসপিটালে যেতে হবে তারপর ডি এন এ টেস্ট করাতে হবে। প্লীজ দোস্ত, নিজেকে শান্ত কর। এখনই এইভাবে ভেঙ্গে পড়লে, সব সত্যি জানার পর কী করবি?’

আদিদ ঢোক গিলে তখন বললো,

‘আর কী সত্যি জানার আছে?’

‘আছে, এখনও অনেক কিছু তোর জানার আছে। নিজেকে শক্ত কর। অনেক বড়ো একটা সত্যির মুখোমুখি যে তোকে হতে হবে।’

চলবে…