পদ্মফুল পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
318

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৯|

রুবি হোসেন পদ্ম’র কেবিনে গিয়ে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলেন। আর উনাকে দেখা মাত্রই পদ্ম ভয়ে জড়ো হয়ে বসল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,

‘আমাদের ভুল হয়েছে মা, আমাদের তুমি ক্ষমা করে দাও। আমরা জানি আমরা তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি। তুমি আমাদের উপর খুব রেগে আছো, তাই হয়তো ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করবে না। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমরা সত্যিই খুব অনুতপ্ত। ক্ষমা করে দিও আমাদের। আমাদের ভুলের শাস্তি স্বরূপ আমাদের এখন জেলে যেতে হবে। হয়তো বাকি জীবন’টা ঐ কারাগারের মাঝেই কাটাতে হবে। আমার ছেলেটা একা মা, তুমি ওকে দেখো। ওকে বুঝিও। আর বলো, পারলে যেন ও আমাদের ক্ষমা করে দেয়।’

রুবি হোসেন শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক মুখ মুছলেন। অফিসার বললেন,

‘হয়েছে, এবার চলুন।’

রুবি হোসেন কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,

‘একটু অফিসার…’

এই বলে তিনি পদ্ম’র কাছে গেলেন। পদ্ম বিছানার এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে। রুবি হোসেন তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। ধরা গলায় বললেন,

‘পারলে ক্ষমা করে দিও। নয়তো এই পাপের বোঝা আমাদের সারাজীবন বয়ে চলতে হবে।’

পদ্ম কিছু বলে না। চুপচাপ শক্ত হয়ে বসে আছে। রুবি হোসেন সেই ফাঁকেই তার কোমর থেকে ছুরি’টা বের করে পদ্ম’র পে*ট বরাবর ঢু*কিয়ে দিল। প্রথমে পদ্ম কিছু বুঝলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ তার মনে হলো তার পেটে কেন যেন খুব তীব্র ব্যথা করছে। রুবি হোসেন ততক্ষণে তাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে হেসে বলতে লাগলেন,

‘নিন অফিসার, এবার আপনি আমায় এরেস্ট করুন। এবার আমার মনে হচ্ছে আমি সত্যিই একটা অন্যায় করেছি।’

অফিসার হতভম্ব হয়ে পদ্ম’র পে*টের উপর আটকে থাকা ছুরি’টার দিকে তাকিয়ে আছেন। পদ্ম বাকরুদ্ধ। সেখানের নার্স চেঁচিয়ে উঠল,

‘এটা কী করলেন আপনি?’

রুবি হোসেন হাসছেন। আকবর সাহেবও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। উনার স্ত্রী যে এতটা ভয়ানক সেটা তিনি আগে জানতেন না। অফিসার উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বাকি পুলিশদের ডেকে রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবকে থানায় নিয়ে যেতে বললেন। তারপর তিনি হাতে একটা রুমাল নিয়ে পদ্ম’র পেট থেকে ছুরি’টা বের করতেই সেখান থেকে র*ক্তের বন্যা ছুটল। এতক্ষণ পদ্ম বসে থাকলেও, এবার সে হেলে পড়ল। নিস্তেজ হয়ে জ্ঞান হারাল সে।

.

এত সব খবর মিনিটেই পুরো হসপিটালে ছড়িয়ে পড়েছে। অভি আর আদিদ দুজনেই ছুটে আসে। পদ্ম’র কেবিনে এসে দেখে নার্স তার র*ক্ত বন্ধ করার চেষ্টায় ব্যস্ত। আদিদ-কে দেখে অফিসার বললেন,

‘আপনার মা এটা কী করলেন? এমনিতেই তো উনার অন্যায়ের কোনো শেষ ছিল না এখন আবার উনি একজন মানুষকে আমার চোখের সামনে মা*রতে পর্যন্ত চেয়েছিলেন, উনার মধ্যে কি নূন্যতম মনুষ্যত্ব নেই? কী ভয়ানক মহিলা, ভাবা যায়! আমার চোখের সামনে এত কিছু করেছে…আপনার মায়ের নামে আমি নিজে কেইস লিখবো। আমিও দেখে নিব, উনি কীভাবে বাঁচেন।’

আদিদ জবাবে কিছু বললো না। সে পদ্ম’র কাছে ছুটে গেল। পেটের কাছে র*ক্ত’টা ভালোভাবে পরিষ্কার করে দেখল খুব বেশি একটা ক্ষত না হলেও একটা সেলাই লাগবে। সে নার্স’কে সব জিনিসপত্র আনতে বললো। তারপর অফিসার আর অভিকে বললো,

‘আপনারা দয়া করে বাইরে যান। আমি দেখছি ওকে।’

অফিসার ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,

‘দেখবেন, ম*রে টরে গেলে কিন্তু আপনার মা’কে ফাঁ*সির হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’

আদিদ চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো, সে কেন ম*রে যাচ্ছে না? আর কিসের জন্য বাঁচবে সে? এতকিছুর পরও বুঝি কারো বাঁচতে ইচ্ছে করে…?

.
.

কিছু সময় পর,

আদিদ কেবিন থেকে বেরিয়ে বললো,

‘পদ্ম এখন ঠিক আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।’

অফিসার বললো,

‘ঠিক আছে। আমরা থানায় যাচ্ছি তাহলে। আপনার মা বাবার কাছ থেকে তো এবার সবকিছুর স্বীকারোক্তি নিতে হবে। আর আপনার যদি এই ব্যাপারে কিছু বলার থাকে তবে থানায় এসে বলবেন।’

অফিসার কথাটা বলে চলে যেতে থাকে। আদিদ একবার ডাকে উনাকে। তিনি পেছন ফিরলে আদিদ শক্ত গলায় বলে,

‘অপ*রাধীদের যেন কঠিন শাস্তি হয়।’

অফিসার মাথা নাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যান। অভি বুঝতে পারছে আদিদের বুকের ভেতরটা কেমন করছে। সে আদিদের কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিদ বলে,

‘দোস্ত, এখান থেকে চলে যা। আমি একটু একা থাকতে চাই। প্লীজ, আমাকে আর বিরক্ত করিস না।’

অভি তার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। আদিদ তার কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। অভি জানে আদিদ এখন কেবিনে গিয়ে ফ্লোরে শুয়ে অঝোরে কাঁদবে কিছুক্ষণ। তারপর সে নিজেকে নিজে বোঝাবে। নিজেকে তো বুঝিয়ে সুঝিয়ে যেই ভাবেই হোক বাঁচিয়ে তো রাখতে হবেই, তাই না। আর যদি আজ আত্ম*হ*ত্যা সহজ হতো তবে…তবে আদিদ হয়তো বেঁচে যেত।

কিন্ত আদিদ হয়তো আর কেবিনে যেতে পারবে না, কারণ তার আগেই একটা নার্স এসে বললো, দু’শত বারো নাম্বার কেবিনের পেশেন্টের শরীর নাকি হঠাৎ করে খারাপ করেছে। হলোও তাই, কথাটা শোনা মাত্রই আদিদ আর কেবিনে ঢুকল না, সে তার অসুস্থ মন নিয়েই ছুটল তার অসুস্থ পেশেন্টকে সুস্থ করার জন্য।

অভি হসপিটালে থেকে যায়। সে সেখানের বাকি মেয়েদের কাছ থেকে তাদের বাড়ির ঠিকানা নেয়। সবার বাড়ির লোক আসে। এক ভয়ংকর কান্নায় মেতে উঠে সবাই। হসপিটালে যেন একটা হৈ চৈ লেগে গিয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে মিডিয়ার লোকেরাও চলে এসেছে। তারা আজ জম্পেশ এক ব্রেকিং নিউজ বানাতে পারবে। এসেই তারা পদ্ম সহ বাকি মেয়েদের খুঁজতে থাকে। অভি তাদের কাউকেই ভেতরে যেতে দেয়নি। ইনফ্যাক্ট আদিদের কেবিনেও তাদের ঢুকতে দেয় না। যা বলার সে বলেছে। কারণ সে জানে এই লোকগুলোকে ভেতরে পাঠালে এরা আবার এটা ওটা বলে আদিদের কষ্টকে আরো বাড়িয়ে দেবে। তাই অভি তাদের এটা ওটা বলে কোনোরকমে বিদায় করে।

সব ঝামেলা মেটার পর সে আদিদের কেবিনের কাছে যায়। দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখে সেটা লক করা। অভি নক করে, বারবার দরজা খুলতে বলে কিন্তু আদিদ কোনো জবাব দেয় না। সে কিছুক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে এবার পদ্ম’র কেবিনের দিকে যায়।

ধীর পায়ে পদ্ম’র কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। নার্স তখন বলেছিল পদ্ম’র জ্ঞান ফিরেছে তবে তার মাঝে নাকি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সে এখনও চোখ বুজে পড়ে আছে। হয়তো ঘুমাচ্ছে। অভি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে দেখলে মায়া হয়। এইটুকু বয়সে কত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে। চেহারাতে এখনও তার ফুটে আছে প্রচন্ড ভয়ের ছাপ। কেমন ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্থ হয়ে আছে মুখটা। যেন মনে হচ্ছে, কেউ পদ্ম বিলের তাজা পদ্ম ফুলটাকে উপড়ে ফেলেছে।

অভি কী ভেবে পদ্ম’র মাথায় হাত রাখে। তারপর সেই হাতটা গালে রাখবে ভেবে কাছে নিতেই সে আবার হাতটা সরিয়ে নেয়। কেমন যেন লাগে তার কাছে। সে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আদিদের কেবিনের কাছে গিয়ে আবার সে দরজা ধাক্কাতে আরম্ভ করে।

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩০|

হসপিটাল থেকে একে একে সব মেয়েরা রিলিজ পেল। থানায় গিয়ে সবাই তাদের কমপ্লেন লেখাল। হসপিটালে এখন কেবল পড়ে রইল পদ্ম। তার যে পরিবার নেই, কোনো আত্মীয় নেই। হয়তো তার মামা মামী শুনেছেন এইসব কিছু কিন্তু উনারা পদ্ম-কে একবারের জন্যও দেখতে আসেননি।
দু’দিন হসপিটালে পার করবার পর পদ্ম এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে সেটা শারীরিক ভাবে। মানসিক ভাবে সে এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি। এর মাঝে আদিদ পদ্ম’র কেবিনে অনেকবারই এসেছে তাকে দেখার জন্য। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সে পদ্ম’র সাথে একটা কথাও বলেনি। পদ্ম ভাবছে হয়তো আদিদ তার উপর রেগে আছে, হয়তো সে ভাবছে তার জন্যই তার মা বাবা আজ জেলে। কথাগুলো ভাবলে পদ্ম’র কষ্ট হয়। তার মনে হয় তার জন্য আদিদও কষ্ট পাচ্ছে। সে এখান থেকে চলে যেতে চায়। কিন্তু নার্স দেয় না। আগেরবার তাকে সেই নার্স যতটা না যত্ন করেছিল এবার তার থেকে বেশি করছে। অবশ্য আর একজন মানুষও তার খুব খেয়াল রাখছেন। তিনি হলেন আদিদের বন্ধু অভি। তিনি রোজ একবার হসপিটালে আসেন। আদিদের সাথে দেখা করে পদ্ম’র কেবিনেও আসেন। তার জন্য হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। সেদিন এসে এক গাদা ফল দিয়ে গেছেন। ফল খেলে পদ্ম শরীরে বল পাবে। জোর করে একটা আপেল কেটে খাইয়ে পর্যন্ত দিয়েছেন। যদিও পদ্ম খেতে চাচ্ছিল না কিন্তু তাও খেতে হয়েছিল তাকে।

আজও সকাল সকাল অভি হসপিটালে চলে এসেছে। আদিদের কেবিনে গিয়ে শুনে সে ও.টি তে আছে। তাই সে সময় কাটানোর জন্য পদ্ম’র কেবিনে এলো। পদ্ম তখন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। অভি দরজায় নক করে বললো,

‘আসবো?’

পদ্ম পেছন ফিরে তাকাল। আলতো হেসে বললো,

‘আসুন।’

অভি ভেতরে এসে বললো,

‘ভালো আছো?’

পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘জ্বি।’

প্রতিদিন আসার পর উনার এই একই প্রশ্ন। পদ্মও প্রতিদিন মাথা নাড়িয়ে একই ভাবে জবাব দেয়। অভি জবাব শুনে সোফায় গিয়ে বসে। তারপর ধীর গলায় বলে,

‘আরাফাতকে পাওয়া গিয়েছে।’

পদ্ম চমকে তাকায়। ধরা গলায় বলে,

‘কখন?’

‘এই যে কিছুক্ষণ আগে। আমি মাত্র থানা থেকে এলাম। অফিসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরাফাতকে রিমান্ডে নিবেন। আর তারপরই এই কেইসের সমস্ত জট একেবারে খুলবে।’

পদ্ম কম্পিত কন্ঠে বললো,

‘উনি কি সত্যিই এসব ক-করেছে?’

অভি বললো,

‘তোমার কি মনে হয়, ও কিছু করেনি?’

পদ্ম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বিশ্বাস করা যতটা সহজ, কাউকে অবিশ্বাস করা ততটাই কঠিন। সে তো বাঁচতে চেয়েছিল, ঐ মানুষটাকে ভালোবেসে বাকিটা জীবন কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু একদিনেই কী করে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল? মানুষ এত খারাপ কী করে হয়? এই মানুষগুলো তো জ*ন্তু জানো*য়ারের চেয়েও অধম। পদ্ম অভির দিকে তাকাল। বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,

‘আমি ঐ লোকটাকে ডিভোর্স দিব।’

অভি শান্ত গলায় জবাব দিল,

‘বিয়ে হলেই না ডিভোর্স দিতে। তোমাদের তো বিয়েই হয়নি।’

পদ্ম অবাক গলায় বললো,

‘আমাদের তো বিয়ে হয়েছে। আপনিও তো ছিলেন সেখানে।’

অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

‘না, বিয়েটা সেদিন হয়নি। তুমি একাই সেদিন কবুল বলেছিলে, আরাফাত কবুল বলেনি। আর কাবিননামায় ও সে কোনো স্বাক্ষর দেয়নি। যা হয়েছে তা শুধু তোমার একপক্ষ থেকেই হয়েছে। আর এসব কিছু আরাফাত তার প্রথম জবানবন্দীতে অফিসারদের জানিয়েছে। এখন তাহলে তুমিই বলো, এটাকে কি আর বিয়ে বলে ধরা যায়?’

পদ্ম চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস ফেলে। তারপর চোখ মেলে তাকিয়ে বলে,

‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। এখন আমার একটাই চাওয়া, আল্লাহ যেন ঐ লোকগুলোকে কঠিন শাস্তি দেন।’

‘হুম, শাস্তি তো ওরা পাবেই। তবে আমি তো শুধু ভাবছি আদিদের মা বাবার কথা। ঐ মানুষগুলো কী করে এসব করতে পারলেন। উনারা একবার আদিদের কথা ভাবলেন না। ছেলেটা সুজানাকে কতটা ভালোবাসে। উনারাও স্বীকার করেছেন যে, উনারাই সুজানাকে মে*রেছেন। আর তারপর তাকে ঐ আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছেন। আর এইদিকে সুজানার মা বাবা আর আদিদ তাকে পাগলের মতো খুঁজে গিয়েছে। উনারদের কি একটা বার উনাদের ছেলের প্রতিও মায়া হয়নি? মানুষ এত নিষ্ঠুর কী করে হয়?’

পদ্ম’র চোখ দু’টো ভিজে উঠল। তার তো মা বাবা নেই বলে তার এত কষ্ট। কিন্তু ডাক্তারবাবু, উনার তো সব কষ্ট উনার মা বাবার কারণে। মানুষটা বোধ হয় প্রতিনিয়ত তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কত সহ্য করা যায়। আর যাই হোক, মা বাবা যদি সন্তানকে এইভাবে কষ্ট দেয়, তাহলে কি সেটা মানা যায়?
.

পদ্ম অনেকক্ষণ চুপচাপ ভাবল। হঠাৎ অভি বললো,

‘তুমি কি তোমার মামা মামীর কাছে আবার ফিরে যেতে চাও?’

পদ্ম অস্থির গলায় বললো,

‘না, কখনোই না।’

‘তাহলে কোথায় যাবে?’

পদ্ম কথা হারিয়ে ফেলল। সত্যিই তো কোথায় যাবে সে? তার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। পদ্ম কিছু বলছে না দেখে অভি বললো,

‘আমার সাথে যাবে? আমার নিজের একটা আশ্রম আছে। সেখানে তোমার মতো আরো অনেক মেয়ে আছে। তারা তোমার মতোই এতিম। অনেক সময় অনেক কেইসের দৌলতে আমি ওদের পেয়েছি। সবাই এখন আমার সেই আশ্রমে থাকে। সেখানে একটা নারী সংস্থা তাদের নিয়ে কাজ করছে। তাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে, বিভিন্ন কাজ শেখাচ্ছে, যেন তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। তুমি যদি চাও তবে সেখান থেকে একবার ঘুরে আসতে পারো। সেখানের অন্যান্য সব মেয়েগুলোর সাথে কথা বলে তোমার ভালো লাগবে, দেখো।’

অভির কথার পিঠে পদ্ম কিছু বললো না। অভি আবার বললো,

‘আমি জানি তুমি এখন আর কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে পারবে না। তাই তোমাকে আগে সেখান থেকে একবার ঘুরে আসতে বলছি। সেখানের পরিবেশ দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে, আমি কতটা সত্যি বলছি।’

পদ্ম এবারও নিরব থাকে। অভি বলে,

‘আচ্ছা, তুমি তাহলে ভেবে দেখো। আমি তাহলে এখন আদিদের কেবিনে গিয়ে দেখি ও ও.টি থেকে এলো কিনা, কেমন?’

পদ্ম আস্তে করে বললো,

‘আচ্ছা।’

অভি সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে আদিদের কেবিনে ঢুকল। আদিদ তখন মাত্রই ও.টি থেকে বেরিয়ে এসেছে। অভিকে দেখে সে বললো,

‘কখন এলি?’

‘এই তো কিছুক্ষণ আগে। স্টাফ বললো, তুই নাকি ও.টি তে তাই পদ্ম’র কেবিনে গিয়ে ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। আচ্ছা, তোকে কি অফিসার কল দিয়েছিল?’

‘না।’

‘ওহহ। আরাফাতকেও পাওয়া গিয়েছে। আর ও কী বলেছে জানিস?’

‘না, জানি না আর জানতে চাইও না।’

অভি বিব্রত বোধ করলো। বললো,

‘কেন?’

আদিদ চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল অভির দিকে। তারপর শক্ত গলায় বললো,

‘আমি এসব কথা শুনতে চাই না। এই ব্যাপারে কোনো কথা তুই আমার সাথে বলবি না। যদি অন্য কোনো কথা থাকে তো বল, নয়তো এখান থেকে চলে যা।’

অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আদিদের ডেস্কের সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো। তারপর বেশ গম্ভীর গলায় বললো,

‘পদ্ম’কে নিয়ে কী ভেবেছিস?’

‘উনাকে নিয়ে আমি কেন ভাববো? আমি তো উনার কার্ডিয়ান নই।’

অভি বিরক্ত গলায় বললো,

‘মানলাম তুই ওর গার্ডিয়ান নোস। কিন্তু, এখন তো ওকে নিয়ে তোরই ভাবতে হবে। তাছাড়া আর কে ভাববে বল? ওর তো কেউ নেই।’

আদিদ তার শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে বললো,

‘ভাই, প্লীজ আমাকে ক্ষমা কর। আমি আর কাউকে নিয়ে ভাবতে চাই না। পারবো না আমি। অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার মতো কোনো মন মানসিকতা আমার আর এখন নেই। পারলে তুই ভাব, উনার দায়িত্ব তুই নে। তুই বরং এক কাজ কর, উনাকে তোর আশ্রমে নিয়ে যা। সেখানেই উনার থাকার ব্যবস্থা করে দে। আমি আর পারবো না কারোর দায়িত্ব নিতে, আ’ম সরি।’

অভি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবল। হুট করে বললো,

‘মা বলছিল বিয়ে করার কথা। আচ্ছা, আমি যদি পদ্মকে বিয়ে করে নিই?’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩১|

আদিদ বিরক্ত কন্ঠে বললো,

‘কেন? দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব পড়েছে যে তোকে ঐ মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে? আর তাছাড়া আন্টিও কখনো রাজি হবে না।’

অভি বললো,

‘আমি মা’কে রাজি করিয়ে নিব। মা কবে থেকেই বলছিল আমার কোনো পছন্দ আছে কিনা, আমার যাকে পছন্দ মা নাকি তাকেই ছেলের বউ বানাবে। তাই আমার মনে হয় না মা কোনোভাবে বারণ করবে।’

‘তাহলে তো হয়েছেই, করে ফেল বিয়ে।’

অভি চিন্তিত কন্ঠে বললো,

‘কিন্তু, পদ্ম কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে?’

‘সেটা আমি কী করে বলবো? গিয়ে জিজ্ঞেস কর পদ্মকে।’

অভি কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বললো,

‘তুই ফিউচার নিয়ে কিছু ভাবছিস না? না মানে এইভাবে কি আর একা থাকা যায়?’

আদিদ গম্ভীর সুরে বললো,

‘একা কোথায় দেখলি, তুই আছিস না?’

অভি নরম সুরে বললো,

‘আমি কি সারাজীবন থাকবো? তোর তো একজন জীবনসঙ্গী প্রয়োজন, যে সবসময় তোকে আগলে রাখতে পারবে। তোকে তোর মতো করে বুঝতে পারবে। আর তো….’

‘হয়েছে থাম। আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। যাকে প্রয়োজন ছিল তাকে যখন পাইনি তখন আর কাউকে লাগবে না আমার। আর আমি এইভাবেই ভালো আছি। আর ভবিষ্যতেও এইভাবেই ভালো থাকতে পারবো। আমাকে নিয়ে আর ভাবিস না। তুই তোর কাজ আর বিয়েতে ফোকাস কর।’

অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বললো,

‘আমি জানি তুই সুজানাকে কখনো ভুলতে পারবি না। প্রথম ভালোবাসা কখনো ভুলা যায় না, সেটা আমিও জানি। তবে জীবন তো আর কারোর ভালোবাসার জন্য থমকে থাকে না। জীবন জীবনের গতিতে চলতে থাকে। আর সেই গতির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষকেও চলতে হয়। তোর বর্তমান অবস্থাটা আমি টের পাচ্ছি। যতই তুই উপর দিয়ে নিজেকে খুব স্ট্রং দেখাস না কেন, ভেতরে ভেতরে যে তুই তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিস সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। এতকিছু কে সহ্য করতে পারে, বল? কিন্তু তুই তো কাউকে কিছু বলবি না। যতই কষ্ট হোক মনের মধ্যে সব কিছু চেপে রেখে দিবি। আমাকেও কিছু বলবি না। আর তাই বলছিলাম তোর লাইফে এমন একজন মানুষ দরকার যাকে তুই কিছু মুখ ফুটে না বললেও সে সবকিছু বুঝে নিতে পারবে। এখনই বলছি না যে সবকিছু হোক। সময় নে তুই। নিজেকে প্রস্তুত কর। কিন্তু প্লীজ, থমকে যাস না।’

আদিদ চোখ বুজল। ধীর গলায় বললো,

‘আর কিছু বলবি?’

অভি বলে,

‘না, আমার আর কিছু বলার নেই। পারলে তুই ভাবে দেখিস। এখন উঠছি তাহলে।’

অভি চলে যায়। আদিদ চোখ বুজে চেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকে। এতকিছু ভাবার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই আপাতত তার নেই।

.
.

দুপুরের রোদ কমে প্রকৃতিতে বিকেলের আনাগোনা। এই সময় রাস্তার পাশের বাগানটাতে অনেকেই হাঁটতে আসে। অনেক বাচ্চারা আসে খেলার জন্য। মাঝে মাঝে কিছু কম বয়স্ক ছেলে মেয়েদের দেখা যায়, যারা ঐখানে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করে। আজও সেই বাগানটাতে অনেক মানুষ এসেছে। কেউ এসেছে দলবল নিয়ে বা কেউ এসেছে একা। পদ্ম’র আজকাল বিকেল কাটে ঐ মানুষগুলোকে দেখে। এই যে বাইরে এত হৈ চৈ, এত মানুষের আনাগোনা কিন্তু এই কোনোকিছুই তার মনে কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে না। পদ্ম নিজেও জানে না সে কী ভাবে। কিন্তু সেদিন সে তার ভাবনার মাঝেই অদ্ভুত এক কাজ করে বসে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই সে ফলের ঝুড়ির উপর থেকে ছু*রি টা নেয়। তারপর সেটা তার হাতের উপর বসাতেই সেখানে নার্স চলে আসে। নার্স ব্যাপারটা বোঝা মাত্রই চিৎকার দিয়ে উঠে,

‘কী করছো, পদ্ম?’

নার্সের চিৎকারে তখন পদ্ম’র হুঁশ ফেরে। নিজের হাতে ছু*রি দেখে ভয়ে সেটা ফেলে দেয়। তারপর হুট করেই কাঁদতে আরাম্ভ করে। তার কী হয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারে না। এমন অনেক কিছুই আজকাল সে করছে যেগুলোতে তার কোনো হুঁশ থাকে না।

কিছুক্ষণ পর, তার কেবিনে আদিদ এলো। এসে বললো,

‘এদিকে এসে বসুন। আপনার সেলাই’টা কা*টতে হবে।’

পদ্ম খানিকটা চমকে পেছন ফেরে তাকাল। দেখল আদিদ ব্যস্ত হয়ে সেলাই কা*টার জিনিসগুলো আলাদা করছে। পদ্ম গিয়ে বেডে বসলো। নার্স বললো,

‘শুয়ে পড়ো।’

পদ্ম শু’লো। নার্স তার পেটের উপর থেকে কাপড়’টা সরিয়ে সেলাইটা দেখল ভালোভাবে শুকিয়েছে কিনা। তারপর সে আদিদকে বললো,

‘স্যার, সবকিছু ঠিকঠিক আছে।’

আদিদ কাছে এসে দেখল। তারপর আস্তে করে সাইড থেকে ব্যান্ডেজ’টা খুলল। পদ্ম চোখ বুজে শুয়ে আছে। আগেরবার সেলাই খোলার সময় সে ব্যাথায় অনেক কান্নাকাটি করেছিল। এবারও তার ব্যাথা লাগছে। তবে তার আর এবার কান্না পাচ্ছে না। কারণ এই ব্যাথা সে আর আগের ব্যাথার মতো অনুভব করতে পারছে না। আসলে মনের ব্যাথা বেশি থাকলে সেই ব্যাথার সামনে শরীরের ব্যাথা ফিকে পড়ে যায়।

সবকিছু শেষ করে আদিদ বললো,

‘হয়ে গেছে। এখন শুধু এইখানে এই ঔষধ’টা লাগাবেন, তাহলেই হবে।’

কথা’টা বলে আদিদ ঔষধ’টা নার্সের কাছে দিয়ে বললো,

‘প্রথমবার আপনি লাগিয়ে দেখিয়ে দিন।’

নার্স পেটের ক্ষত অংশে ভালোভাবে ঔষধ’টা লাগিয়ে দিল। আদিদ তখন বললো,

‘কোনো অসুবিধা হলে বলবেন।’

বলেই সে চলে চাচ্ছিল। আবার কী ভেবে ফিরে এসে বললো,

‘আগামীকাল আপনাকে এখান থেকে রিলিজ দেওয়া হবে। কোথায় যাবেন, ভেবেছেন কিছু?’

পদ্ম ঢোক গিলল। আস্তে করে বললো,

‘না।’

আদিদ ঠান্ডা গলায় বললো,

‘অভির একটা আশ্রম আছে। চাইলে সেখানে যেতে পারেন। আর না চাইলে আমি জোর করবো না। তবে এখানেও আমি বেশিদিন কোনো পেশেন্টকে রাখতে পারবো না, নিয়ম নেই। তাই এখন ভেবে দেখুন কী করবেন।’

পদ্ম নিরব হয়ে তাকিয়ে রইল। আদিদ চলে গেল সেখান থেকে। পদ্ম’র চোখের কোণ বেয়ে তরল উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ল। নার্স তার কাছে এসে মোলায়েম কন্ঠে বললো,

‘আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে?’

পদ্ম হাত দিয়ে চোখের কোণ মুছল। মাথা নাড়িয়ে বললো,

‘না।’

‘তাহলে কোথায় যাবে?’

পদ্ম’র কান্না পাচ্ছে। এই এত বড়ো পৃথিবী, অথচ তার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। কী অদ্ভুত! পৃথিবী এত বড়ো হয়ে লাভ’টা হলো কী, যদি না তার মতো একটা ক্ষুদ্র মানুষের এই পৃথিবীতে থাকার মতো কোনো জায়গাই না থাকে।

পদ্ম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বললো,

‘জানি না।’

.

রাত আট’টার দিকে হসপিটালে পুলিশ এলো। দু’জন অফিসার আদিদের কেবিনে ঢুকলেন। তাদের দেখে আদিদ ভীষণ বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললো,

‘বসুন।’

অফিসার দু’জন বসলেন। একজন বললেন,

‘আপনি তো দেখছি কোনো খবরই রাখছেন না। আপনার মা বাবা জেলে, তাদের তো একবার দেখতেও যেতে পারেন।’

আদিদ শক্ত গলায় বললো,

‘সময় হয়ে উঠেনি।’

অফিসার হাত ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে বললো,

‘ডি এন টেস্টের কাজ কতটুকু এগুলো, খবর নিয়েছেন?’

‘এটা খুব সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। তবে ওরা চেষ্টা করছে। বলেছে কাল পরশুর মধ্যে রিপোর্ট বের করে ফেলতে পারবে।’

অফিসার নিশ্বাস নিলেন। বললেন,

‘আপনার মা বাবা তো সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছেন, জানেন সেটা? উনারা নিজের মুখেই বলেছেন যে উনারাই সুজানাকে মে*রেছেন আর শুধু মা*রেনই নি তাকে লুকানোর জন্য ঐ আলমারিতে রেখে দিয়েছিলেন যেন কেউ তাকে খুঁজে না পায়। আর তাছাড়া আপনার মা বাবা বিশাল এক নারী পাচার চক্রের সাথে জড়িত। শুধু পদ্ম না, উনারা আরো অনেক মেয়েকেই এইভাবে ফাঁসিয়েছেন। এখন কাল আমরা উনাদের কোর্টে তুলব। তখন আদালতই সিদ্ধান্ত নিবে উনাদের কী শাস্তি দেওয়া যায়। তাই আপনিও কাল সকাল দশ’টায় কোর্টে চলে আসবেন। আপনাকেও স্বাক্ষী হিসেবে সেখানে থাকতে হবে।’

আদিদের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘আমাকে কি থাকতেই হবে?’

‘জ্বি অবশ্যই।’

আদিদ জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে। কাট কাট গলায় বলে,

‘ঠিক আছে, আমি যাবো।’

অফিসার তারপর বললো,

‘পদ্মকে কখন রিলিজ দিবেন?’

‘কাল।’

‘তো উনি এখন যাবেন কোথায়?’

‘আমি জানি না। আপনারা উনার সাথে গিয়ে কথা বলুন।’

‘ঠিক আছে তাহলে, আমরা উনার কেবিনে যাচ্ছি।’

‘আচ্ছা।’

অফিসাররা পদ্ম’র কেবিনে গেল। তার সাথে অনেকক্ষণ কথা বললো। কাল তাকেও কোর্টে যেতে হবে। তার সাথে হওয়া সমস্ত অন্যায় কোর্টে বলতে হবে। তারপর কোর্ট উনাদের শাস্তি দিবে। কঠিন শাস্তি। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে পদ্ম চলে যাবে। কোথায় যাবে সে জানে না। আচ্ছা, ডাক্তারবাবুর বন্ধুর আশ্রমে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? অফিসাররাও তাকে সেখানেই যেতে বলছে। পদ্ম ভেবে পায় না, ভাবতে গেলেই তার বার বার মনে হয়, “আবার সে ঠকবে না তো?”

চলবে…