পদ্মফুল পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
267

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩২|

একটা রৌদ্রদগ্ধ সকাল। আদালতে মানুষের আনাগোনা ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। পদ্ম এই প্রথম এইরকম একটা জায়গায় এসেছে। কত মানুষ আসছে। একেক জনের একেক সমস্যা। পদ্মও তাদের মতোই একজন। তার থেকে অনেকটা দূরে আদিদ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই তার সামনে দিয়ে পুলিশ তার মা বাবাকে ভেতরে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এই মানুষটা একবারও তাদের দিকে তাকায়নি। পদ্ম তখন আদিদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু মুখ দেখে তো আর মন পড়া যায় না। তার মনের ভেতরে তখন কী চলছিল সেটা কেবল সেই জানে। পুলিশ কিছুক্ষণ পরে এসে পদ্ম আর আদিদ-কে ভেতরে যেতে বলে। তারা ভেতরে যায়। খুব একটা মানুষ না হলেও আছে কয়জন। পদ্ম আর আদিদ গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে। তাদের সামনেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব। দু জনেরই মাথা নত। ছেলের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেন না হয়তো। আর না সেই সাহস পাচ্ছে আদিদ নিজেও। সেও বসে আছে নত মস্তিষ্কে।

কিছুক্ষণের মাঝেই বিচার কার্যক্রম শুরু হলো। আসামী পক্ষের উকিল নানাভাবে বিচারককে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তার এক পর্যায়ে তখন পদ্ম’কে বলা হলো, সামনে গিয়ে তার বক্তব্য পেশ করার জন্য। মনে ভয় হলেও সে এগিয়ে গেল। তার চোখ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে একবার তাকাল। তারপর সে জোরে দম নিয়ে বলতে লাগল সমস্ত ঘটনা। বিচারক সব শুনে রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আপনারা কি সত্যিই এসব করেছেন?’

রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব স্বীকার করলেন সবকিছু। তাছাড়া আর উপায় নেই। সব প্রমাণ হাতের কাছে। মিথ্যে বলেও কোনো ভাবে বাঁচা যাবে না। পদ্ম কাঠগড়া থেকে নেমে যেতেই এবার আদিদকে ডাকা হলো। আদিদ খুব কষ্টে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে গিয়ে মনে হলো যেন তার পা আটকে যাচ্ছে। তবু ও সে কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াল। সামনের দিকে তাকাল না। নিজেকে শক্ত করে একে একে বলে গেল সবকিছু। সবশেষে সে বললো,

‘অন্যায়কারী যেন কোনোভাবেই বাঁচতে না পারে জর্জ সাহেব, এটা আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ রইল।’

আদিদের গলা থেমে যাচ্ছিল। এমন একটা দিনও যে কখনো আসবে সেটা সে কখনও কল্পনাও করেনি। তার মতো পাষাণ না হলে কোনো সন্তান হয়তো নিজ মা বাবার শাস্তি চায় না। সে বড্ড খারাপ একটা মানুষ। বুকটা ফেটে গেলেও সে সবকিছু সহ্য করে সেখান থেকে নেমে গিয়ে নিজের জায়গায় বসলো। তারপর একে একে আরো অনেককেই সামনে আনা হলো। অভিও স্বাক্ষী দিল। আরাফাতকেও আনা হলো। তাকে দেখেই পদ্ম’র রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছিল। আরাফাতও তখন সামনে দাঁড়িয়ে সবকিছু স্বীকার করলো।

সব স্বাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত এবার রায় দিল। রুবি হোসেন আর আকবর সাহেবকে আদালত বিশ বছরের জেল দিয়েছে আর আরাফাতকে দিয়েছে ত্রিশ বছরের। সাথে দিয়েছে মোটা অংকের টাকা জরিমানা।

আদালতের রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আদিদ সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। তার সাথে বেরিয়ে যায় পদ্মও। রুবি হোসেন চলে যাওয়ার আগে ছেলেকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদিদ সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে যায় তার আর পরে খোঁজ পাওয়া যায়নি। অভি তাকে অনেকবার কল দেয় তবে সে কলও রিসিভ করে না।

পদ্ম ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। সে অস্থির হয়ে অভিকে বলে,

‘ডাক্তারবাবু কোথায় গিয়েছেন বলুন তো? ফোন ও তো ধরছেন না। কোনো অসুবিধা হয়নি তো? উনি যেভাবে গাড়ি টান দিলেন।’

‘চিন্তা করো না। আদিদ-কে আমি চিনি। ও আর যাই করুক, কখনো সু*সাইডের মতো কোনো ভুল করবে না।’

‘আমার উনার জন্য খুব খারাপ লাগছে। বারবার কেন যেন মনে হচ্ছে উনার এই কষ্টের জন্য আমি দায়ী।’

‘ধুর বোকা! তুমি কেন দায়ী হতে যাবে? ওর মা বাবা যা করেছেন তার জন্য তো উনাদের শাস্তি পেতেই হতো। সত্যকে কতদিন লুকিয়ে রাখা যায়। একদিন না একদিন তো সেটা সামনে আসবেই। উনাদের এই পরিণতি হওয়ারই ছিল। এখানে কারোর কোনো হাত নেই। ভুল করলে শাস্তি পেতেই হবে, এটাই নিয়ম।’

তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করলো। সেই নিরবতা কাটিয়ে তখন এক পর্যায়ে অভি বললো,

‘তো, তুমি কী ভাবলে? কোথায় যাবে?’

পদ্ম পিটপিট করে তাকাল। গম্ভীর গলায় বললো,

‘জানি না।’

‘আমার আশ্রমে গেলে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে?’

‘না, কিন্তু..আসলে..’

‘বুঝতে পেরেছি। বিশ্বাস করতে পারছো না আমায়, তাই তো?’

‘না না, তা না। আসলে একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।’

‘অস্বস্তির কী আছে? সেখানে তোমার সমবয়সী আরো অনেক মেয়ে আছে। তাদের সাথে সময় কাটালে তোমার ভালো লাগবে।’

পদ্ম খানিকটা নিরব থেকে বললো,

‘ঠিক আছে তাহলে, আমায় নিয়ে চলুন।’

অভি খুশি হলো। বললো,

‘ওকে। তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।’

গাড়ি আসতেই পদ্ম আবার বললো,

‘ডাক্তারবাবুকে একবার বলবো না?’

‘আদিদ জানে। আমি ওকে বলে রেখেছিলাম।’

‘ওহহ।’

অভি গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললো,

‘নাও, এবার তুমি গাড়িতে উঠো।’

পদ্ম গাড়িতে গিয়ে বসলো। যতটা না তার অস্বস্তি হচ্ছে তার থেকে বেশি হচ্ছে ভয়। এত এত বিপদের সম্মুখীন সে হয়েছে যে এখন চারদিকে খালি বিপদই দেখে সে। নিজেকে শান্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে সে। তবু পারছে না। মন শান্ত হচ্ছে না। মেকি ভয়ে বারবার আড়ষ্ট হচ্ছে। পদ্ম চোখ বুজে ঝিম ধরে বসে থাকে। অভি একবার আড়চোখে তাকায় তার দিকে তারপর আবার সামনের দিকে তাকিয়ে তার ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়।

.

পৌঁছতে খানিকটা সময় লেগেছে তাদের। গাড়ি থেকে নেমেই পদ্ম দেখল তার চোখের সামনে বিশাল এক জায়গা। যার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু ছোট ছোট বাঁশের ঘর। বাঁশের ঘর এইজন্যই যে সেগুলো সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা হলেও ছাদ দিয়েছে বাঁশ দিয়ে। দেখতে অদ্ভুত হলেও সুন্দর। কিছুক্ষণের মাঝেই সেখানে অনেক মানুষ চলে এলো। অনেকগুলো মেয়ে সাথে দুজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। মহিলা দুজন এসেই অভিকে বললেন,

‘যাক এতদিনে তবে তোমার পায়ে ধুলো পড়েছে তাহলে। ভেবেছিলাম, হয়তো আমাদের ভুলেই গিয়েছো। তোমাকে দেখে এখন কিছুটা শান্তি পাচ্ছি।’

অভি হাসল। বললো,

‘তোমাদের কি ভুলা সম্ভব? তোমরা তো হলে আমার দ্বিতীয় মা। ভালো আছো তো তোমরা? আর এইদিকে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’

‘হ্যাঁ, আমরা খুব ভালো আছি আর এইদিকেও সবকিছু ঠিকঠাক। আচ্ছা, ঐ মেয়েটা কে?’

অভি পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ও হলো পদ্ম। ও আজ থেকে এখানেই থাকবে। ডানদিকে বাগানের দিকে যে রুমটা আছে, সেটাতেই ওর থাকার ব্যবস্থা করো।’

‘আচ্ছা আমরা ব্যবস্থা করে নিচ্ছি। তার আগে ওকে নিয়ে তুমি ভেতরে এসো।’

সবাই ভেতরে গেল। এই দুজন মহিলাই মূলত এখানের দেখভাল করেন। বেশ ভালো উনারা। উনাদের সাথে কথা বলে পদ্ম’র খুব ভালো লাগল। যদিও সে এখনও ততটা নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। কারণ মানুষ গিরগিটির চেয়েও ভয়নাক, তাই এত সহজেই কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।
পদ্ম’র রুম ঠিক করে দেওয়া হলো। অন্যসব মেয়েরাও পদ্ম-কে বেশ সাদরে গ্রহণ করলো। তারা পদ্ম-কে একটা সাদা রঙের সুতি শাড়ি দিয়ে বললো, “ফ্রেশ হয়ে এটা পরে আসতে।” সাদা রঙ খুব একটা পছন্দ না হলেও পদ্ম শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। সে মেয়েদের মুখে শুনেছে, এখানে আসলে প্রথমদিন নাকি সবাইকে শাড়ি পরানো হয়। আর এই নিয়ম নাকি ঐ দুই মহিলার। তাদের শাড়ি পরা পছন্দ বলে তারা সব মেয়েদেরই প্রথম দিন শাড়ি পরতে বলেন। তবে কেউ যদি পরতে না চায় তবে তাদের জোর করেন না। কারণ এখানে কারোর জোর জবরদস্তি চলে না। এখানে সবাই নিজের মতো স্বাধীন।

শাড়ি পরে বাইরে বের হলো পদ্ম। বসার রুমে অভি বসে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলছে। পদ্ম আসতেই তার চোখ পরল পদ্ম’র উপর। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। সুতি সাদা শাড়ি। ভেজা চুল। বিষন্ন মুখ। সৌন্দর্য বুঝি এর থেকে আর তীব্র হতে পারে না। অভি চোখ নামিয়ে নেয়। প্রেম বড়ো ভয়ানক জিনিস। সে এই বুড়ো বয়সে আর প্রেমে পরতে চায় না। সে শান্ত গলায় বললো,

‘বসো পদ্ম।’

পদ্ম অন্যসব মেয়েদের মতো ফ্লোরে বসে পড়ল। সেটা দেখে অভি মুচকি হাসল আর মনে মনে বললো,

“এমন ভালো আর সহজ সরল মেয়েকেই তো প্রত্যেকটা ছেলে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে চায়।”
.
.
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে অভি আর পদ্ম বাইরের বাগানে হাঁটছিল। অভি তাকে এখানকার বিভিন্ন জিনিস চেনাচ্ছিল। তাছাড়া এটা ওটা বোঝাচ্ছিল। তাকে আশ্বাস দিচ্ছিল যেন ভয় না পায়। আর সে সময়ই অভির একটা কল আসে। সেটা রিসিভ করে কিছুটা সময় পার হতেই অভি চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘এসব কী বলছেন? কখন হলো এসব?’

অভির অস্থিরতা দেখে পদ্মও ভয় পেয়ে গেল। অভি ফোন রেখেই বললো,

‘সর্বনাশ হয়েছে!’

পদ্ম অস্থির গলায় বললো,

‘কী হয়েছে?’

অভি বিচলিত হয়ে বলে,

‘আদিদের এক্সিডেন্ট হয়েছে।’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৩|

হসপিটালে গিয়ে আদিদ-কে দেখে অভি আর পদ্ম থমকে গেল। অভি ছুটে গেল আদিদের বেডের কাছে। মাথায় আর হাতে তার ব্যান্ডেজ করা। ডাক্তার বললো তার নাকি জ্ঞান এখনও ফেরেনি। মাথার আঘাত’টা বেশ গভীর ছিল।

পদ্ম দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে। আদিদের এক্সিডেন্টের কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তার। আদিদের কিছু হলে সে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারতো না।

অভি আদিদের হাত জড়িয়ে ধরে তার পাশে বসে থাকে। আদিদ-কে এর আগে এতটা অসহায় কখনো মনে হয়নি তার। সেই সুদর্শন, সুঠাম পুরুষ মানুষটা আজ কতটা অসহায় হয়ে বেডে শুয়ে আছে। ভালো মানুষগুলোর সাথেই কেন এত খারাপ হয়? দুনিয়াতে তো এত এত খারাপ মানুষ, কই তাদের সাথে তো কখনো কোনো খারাপ কিছু হয় না। যত কষ্ট শুধু ভালোদেরই পেতে হয়। এটাই নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়ম।
.

রাতে আদিদের জ্ঞান ফিরল। আদিদ চোখ মেলে তাকিয়েছে দেখে পদ্ম’র যেন খুশির অন্ত রইল না। সে দ্রুত বাইরে গেল। অভি বাইরে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিল। পদ্ম ছুটে গিয়ে বললো,

‘ডাক্তারবাবুর জ্ঞান ফিরেছে।’

অভি ফোন রেখে দ্রুত কেবিনের ভেতর ঢুকল। আদিদের ঘোলা দৃষ্টি প্রথমেই অভির মুখে পড়ল। তাকে আলতো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘আমার কী হয়েছিল?’

অভি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

‘তুই এক্সিডেন্ট করেছিলি। কে বলেছিল অত স্পিডে গাড়ি চালাতে? আজ যদি তোর কিছু একটা হয়ে যেত? তোর উপর তো আমার খুব ভরসা ছিল। ভেবেছিলাম তুই খুব স্ট্রং। আর যায় হয়ে যাক না কেন, নিজের কোনো ক্ষতি হতে দিবি না। কিন্তু তুই তো আমার ভরসার যোগ্য’ই না। শালার, মরার শখ হয়েছিল না?’

আদিদ জবাব দেয়না। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে কেবল। অভি মুখ ঘুরিয়ে বললো,

‘এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে দেখে আমার একটুও মায়া হচ্ছে না, বুঝেছিস? পড়ে থাক তুই, আমি আর তোকে দেখতে আসবো না।’

আদিদ তাও কিছু বলে না। মাথাটা ঘুরিয়ে সে এবার পদ্ম’র দিকে তাকায়। পদ্ম বিষন্ন মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আদিদ জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। তারপর মৃদু সুরে বলে,

‘আমি মা*রা গেলেই বা কী হতো? বেঁচে থাকা মানেই নিজের কষ্ট বাড়ানো। তার থেকে ম*রে যাওয়াটাই শ্রেয়।’

অভি তার দিকে তেড়ে এলো। বজ্র কন্ঠে বললো,

‘তুই না ডক্টর? তোর মুখে কি এসব মানায়? কেন বলছিস এসব? আমি কি তোর কেউ না? আমায় বুঝি তুই একটুও ভালোবাসিস না?’

আদিদ মুচকি হেসে চোখ বুজে। তখন চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল’টা অভি আর পদ্ম’র দৃষ্টিগোচর হয়। আদিদ চোখ বুজা অবস্থাতেই তীব্র ঝাঁঝাল গলায় বলে,

‘আমার মা বাবার কথা এত কেন মনে পড়ছে? আমি কেন উনাদের ভুলতে পারছি না? আমি তো উনাদের মনে রাখতে চাই না। তাও কেন…কেন বার বার আমার উনাদের কথাই মনে পড়ছে? কেন..কেন..কেন?’

আদিদ থামে। জোরে শ্বাস টানে। দম আটকে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ তখন তার কর্ণকুহুরে কারো তীক্ষ্ণ কান্নার স্বর প্রবেশ করে। আদিদ বিস্মিত চোখে তাকায়। পদ্ম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আদিদ তার ব্রু কুঁচকে ফেলে। বিরক্ত গলায় বলে,

‘এই মেয়েটা কেন কাঁদছে?’

পদ্ম নাক টানে। ধরা গলায় বলে,

‘এই সব কিছুর জন্য আমি দায়ী, ডাক্তারবাবু। আমি আসার পর থেকেই আপনার জীবনে সমস্যা শুরু হয়েছে। সব দোষ আমার। আমার কারণেই হয়েছে এসব।’

এই বলে সে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে আরম্ভ করে। আদিদ আর অভি এক জন অন্যজনের মুখের দিকে তাকায়। আদিদের মেজাজ বিগড়ে যায়। এমনিতেই মাথা টাথা তার ঠিক নেই, এখন আবার এই মেয়ের কান্নার শব্দে তার আরো বিরক্ত লাগছে। তাই সে রাগী গলায় বলে,

‘আপনি থামবেন। আমি কি একবারও বলেছি, এসবে আপনার হাত আছে? অযথা কেন আমায় বিরক্ত করছেন? আপনার জন্য কিছুই হয়নি। যা হয়েছে তা সব ভাগ্যের দোষে হয়েছে। তাই নিজেকে এইভাবে দোষ দেওয়া বন্ধ করুন।’

পদ্ম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। তারপর ঢোক গিলে বললো,

‘আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে। মা বাবা ছাড়া কোনো সন্তানই ভালো থাকতে পারে না। এই তো আমি, প্রতিটা জায়গায় জায়গায় এতটা অপমান এতটা কষ্ট সহ্য করছি তাও সবকিছু মেনে নিচ্ছি কষ্ট করে। কারণ আমি এতিম, আমার মা বাবা নেই, যাওয়ার মতো কোনো আশ্রয় নেই। আর তার থেকেও বড়ো কথা হলো, আমি মেয়ে। আমি চাইলেই সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে পারবো না। কারণ এই পৃথিবী আমার জন্য সেইফ না। কিন্তু, আপনি সেটা পারবেন। যেভাবে খুশি যার সাথে খুশি থাকতে পারবেন। কেউ আপনাকে কিচ্ছু বলবে না। আপনিও অসহায় তবে আমার মতো না। কারণ আপনি ছেলে, আপনি একজন ডক্টর। আপনার পাশে কেউ না থাকলেও আপনি ঠিক একা একাই চলতে পারবেন। কারো সাহায্যের আপনার তেমন প্রয়োজন হবে না। কিন্তু, এই ক্ষেত্রে গিয়ে আমি আটকে যাবো। আমি একা চলতে পারবো না। একা থাকতে পারবো না। আমাকে বাঁচতে গেলে অন্যের সাহায্য নিতে হবে। নিজেকে সবকিছু থেকে সেইফ রাখতে হলে আমাকে কারো না কারোর উপর নির্ভর করে থাকতেই হবে। আমি তাতে বাধ্য। কারণ..ঐ যে আমি মেয়ে। আজ আমার সাথে এত কিছু হয়ে গেল..তাও আমি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকতে হচ্ছে আমাকে। ম*রে যেতে চাইলেই তো আর ম*রে যাওয়া যায় না। তাই আমাকেও বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। আর আপনাকেও এইভাবেই বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এছাড়া আর কিছু করার নেই আমাদের।’

পদ্ম থেমে নিশ্বাস ফেলল। অনেক কিছু বলে ফেলেছে সে। তার কথা শুনে অভি আর আদিদ দুজনেই চুপ হয়ে আছে। ওদের এই চাহনি দেখে পদ্ম’র কিছুটা অস্বস্তি লাগে। সে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘বেশি কথা বলে ফেলেছি, তাই না?’

পদ্ম’র কথা শুনে অভি হেসে বলে,

‘না, বেশি কথা বলোনি। যা বলেছো ঠিক বলেছো। তবে তোমরা কেউ মোটেও অসহায় না। পৃথিবীতে কেউই অসহায় না। সবার পাশেই সৃষ্টিকর্তা আছেন। তাই নিরাশ হওয়া যাবে না। উনি কখন কীভাবে মানুষকে পরীক্ষা নেন সেটা কেউ জানে না। তাই সবসময় ধৈর্য ধরতে হবে। তোমাদের দু’জনকেই বলছি, মাথা থেকে সব উল্টা পাল্টা চিন্তা দূর করে এবার নতুন করে বাঁচতে শেখো।’

আদিদ খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো। বললো,

‘সবাই দেখি খুব কথা শিখেছে। শুধুই আমিই কিছু বলতে পারিনা। ডাক্তার হতে এত এত মোটা মোটা বই মুখস্ত করলাম তাও তোদের মতো এত সুন্দর কথা শিখতে পারলাম না।’

আদিদের কথা শুনে অভি আর পদ্ম হাসে। আদিদ তখন হুট করেই অভিকে জিজ্ঞেস করে,

‘তা, বিয়ে করছিস কবে? আন্টির সাথে কথা হয়েছে?’

তারপর সে আবার পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো,

‘পদ্ম, আপনার কী মত এই ব্যাপারে?’

পদ্ম ঠিক বুঝলো না। সে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললো,

‘কোন ব্যাপারে?’

আদিদ প্রসন্ন হেসে বললো,

‘আপনার আর অভির বিয়ে ব্যাপারে। এখন তো এই বিয়ে খাওয়ার জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে তাই না?’

পদ্ম’র চোখ মুখ কুঁচকে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কপালে চওড়া ভাঁজ পড়ল তার। কাট কাট গলায় বললো,

‘আমি কেন উনাকে বিয়ে করতে যাবো?’

চলবে…

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩৪|

পদ্ম’র প্রতিক্রিয়া দেখে আদিদ অভির দিকে তাকাল। অভি যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। পদ্ম আবারো উঁচু সুরে বললো,

‘কী হলো, আপনারা চুপ করে আছেন কেন? এখানে আমার বিয়ের কথা কোথ থেকে উঠছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ডাক্তারবাবু, আপনি কিছু বলছেন না কেন?’

আদিদ পদ্ম’র দিকে ফিরে তাকাল। গম্ভীর গলায় বললো,

‘আপনি শান্ত হোন। আমি ব্যাপার’টা বুঝিয়ে বলছি আপনাকে। আসলে, অভি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে। আপনি তো নিজেই বলেছেন, আপনি মেয়ে, আপনার বেঁচে থাকার জন্য এক জনের সাহায্য প্রয়োজন। আর অভি সেই সাহায্যটা আপনাকে করতে চাইছে। ওকে চাইলে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। তবে এখনই বলছি না, আগে কিছুদিন ওর আশ্রমে থাকুন। নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলুন। ওর সাথে সময় কাটান। তারপরই আস্তে আস্তে সিদ্ধান্ত’টা নিন। তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।’

পদ্ম কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সে অভির দিকে তাকাল। পদ্ম’র তাকানো তে অভির অস্বস্তি’টা আরো বেড়ে গেল। পদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘আমি সুস্থ নই। না মানসিক ভাবে, আর না শারীরিক ভাবে। আমি জানি আমি একা বাঁচতে পারবো না। আমার সাহায্যের প্রয়োজন। আর সেই জন্যই আমি আপনার সঙ্গে আপনার আশ্রমে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার মতো আরো অনেক মেয়ে আছে। তারা কেউ বসে নেই। ওরা নিজেদের মতো স্বাবলম্বী হচ্ছে। ওরা তো কেউ এখনও বিয়ে করেনি। আপনি তো তাদের মধ্যে থেকে কাউকে বিয়ে করতে চাননি, তবে আমাকে কেন? বলুন?’

অভি থমকে গেল। এই প্রশ্নের কী জবাব হতে পারে সেটা তার জানা নেই। সে জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। পদ্ম নত মস্তিষ্কে বললো,

‘আমি অসহায়। বড্ড অসহায়। নিজেকে অসহায় বলে দাবি করতে কারোরই ভালো লাগে না। কেউই পৃথিবীতে দয়া নিয়ে বাঁচতে চায় না, আর সেটা আমিও চাই না। কিন্তু আফসোস, আমাকে সেইভাবেই বাঁচতে হবে। এই বিয়ে’টা করে আপনি আমার উপর দয়া করতে চান, তাই না? আমি জানি, আপনি না বললেও আমি বুঝি। আমার মতো মেয়েকে কেউ এমনি এমনি বিয়ে করতে চাইবে না। যদি না তার আরাফাতের মতো অসৎ উদ্দেশ্য থাকে কিংবা সে আপনার মতো দয়ালু না হয়। এমনিতেও আপনি আর ডাক্তারবাবু আমার জন্য অনেক করেছেন। এখন শুধু আমাকে আপনার ঐ আশ্রমে থাকতে দিন, আমার তাতেই চলবে। আমি আর নতুন করে এই বিয়ে নামক বস্তুতে নিজেকে আর জড়াতে পারবো না। ক্ষমা করবেন আমায়।’

কথাগুলো বলে পদ্ম কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। অভি আর আদিদ তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পথে। সে চলে যেতেই অভি বিরক্ত গলায় বললো,

‘তোকে এখনই এসব কথা বলতে হলো?’

আদিদ কাঁচুমাচু করে বললো,

‘আরে আমি তো ভেবেছিলাম, তুই হয়তো উনাকে সব বলে দিয়েছিস।’

অভি মুখ কালো করে আদিদের পাশে বসলো। বিরস গলায় বললো,

‘সত্যিই, মেয়ে মানুষগুলো না একটু বেশিই বুঝে। আমি কি একবারও বলেছি ওকে দয়া করে বিয়ে করবো? মানে নিজে নিজেই সব ভেবে নিয়েছে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দিল না। ধ্যাত!’

আদিদ আলতো হাসল। বললো,

‘এত প্যারা নিস না। তুই তো একসময় মেয়ে পটানোর ওস্তাদ ছিলি। আবার না হয় সেই বিদ্যা’টা এখন কাজে লাগাবি।’

‘পাগল হয়েছিস! এই বয়সে এসে আমি এখন মেয়ে পটানোর জন্য মেয়ের পেছন পেছন ঘুরবো? ইমপসিবল। মেয়ে পটানো ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ আছে। ও বিয়ে করতে না চাইলে আমিও ওকে জোর করবো না। মা’র কাছে আরো অনেক মেয়ে আছে, মায়ের পছন্দেই না হয় একজনকে বিয়ে করে নিব।’

আদিদ তখন গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,

‘মেয়েটার প্রেমে পড়িস নি?’

‘কেন, প্রেমে পড়া কি বাধ্যতামূলক?’

‘না, তুই তো প্রেমে পড়তে জানিস। হুটহাট যে কারোর প্রেমে পড় যাস। আমার কত নার্সকে দেখেও তো..’

‘আরে কী শুরু করেছিস? এসব আগের কথা এখন তুলছিস কেন? তখনের আমি আর এখনের আমি’র মাঝে বিশাল পার্থক্য। এখন আর আমি প্রেমে পড়ি না, বরং মেয়েরা আমাকে দেখে প্রেমে পড়ে।’

আদিদ হাসে। বলে,

‘তা তো পড়বেই। দিন দিন যা হ্যান্ডসাম হচ্ছিস, কবে যেন মেয়েরা তোকে তুলে নিয়ে যায়। পরে দেখা যাবে ডাক্তারি ছেড়ে আমাকে উল্টো গোয়েন্দা হয়ে তোকে খুঁজে বের করতে হবে।’

আদিদের কথা শুনে অভি হেসে উঠে। তার সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠে আদিদ নিজেও। হাসতে হাসতেই হঠাৎ আটকে যায় সে। মনে হয়, অনেকদিন পর সে আবার এইভাবে প্রাণ খুলে হেসেছে। নয়তো সে তো এই হাসি ভুলতেই বসেছিল। আদিদ তখন হুট করেই অভির হাতটা জড়িয়ে ধরে। অভি খানিকটা অবাক হয়ে তাকায়। আদিদ জড়ানো গলায় বলে,

‘তুই আমাকে কখনো ছেড়ে যাস না, দোস্ত। আমাকে তুই সারাজীবন আগলে রাখিস, প্লীজ।’

অভি শক্ত করে আদিদের হাতটা ধরে। বলে,

‘যতদিন বেঁচে থাকবো, আমি এইভাবেই তোর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবো।’

আদিদের তখন মনে হয় পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর সম্পর্কই টা মনে হয় এই ‘বন্ধুত্ব’ই’। পৃথিবীর সব মানুষ স্বার্থপর হলেও একজন বন্ধু কখনও স্বার্থপর হয় না। যেখানে মা সন্তানকে, সন্তান মা’কে বিশ্বাস করতে পারে না সেখানে দুইজন দুই ভিন্ন স্বত্বার মানুষ কী সুন্দর একে অপরকে বিশ্বাস করে নেয়। এটাই হয়তো বন্ধুত্বের শক্তি। এই শক্তি আর অন্য কোনো সম্পর্কে নেই আর হয়তো কখনো জন্মাবেও না।
.
.
পদ্মকে অনেক খোঁজার পরও কোথাও পাওয়া গেল না। অভি বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। মেয়েটা গেল কোথায়? তখন যে কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তারপর থেকে আর তার মুখদর্শন পাইনি কেউ। এখন তো অনেকটাই রাত হয়ে গিয়েছে, এত রাতে কোথায় গেল মেয়েটা?

অভি রিসিপশনে গিয়ে খোঁজ নিল, কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হলো না। সে আবার আদিদের কেবিনে গেল। আদিদ বসে বসে নিজের হাতের ব্যান্ডেজ’টা দেখছিল। অভি এসে চিন্তিত গলায় বললো,

‘দোস্ত, পদ্মকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।’

আদিদ ব্রু কুঁচকে ফেলল।

‘খুঁজে পাচ্ছিস না মানে? হয়তো নিচ তলায় রেস্ট রুমে আছে।’

‘নেই, আমি খুঁছে এসেছি। কোথাও নেই।’

‘কী বলিস? রাগ টাগ করে আবার কোথাও চলে টলে গেল নাকি?’

‘আমারও তো তাই মনে হচ্ছে। এখন কী করি বলতো?’

‘ওর নাম্বারে একটা কল দে।’

‘নাম্বার পাবো কই থেকে। ওর ফোন তো মিসিং।’

‘ওহ তাই তো। তাহলে এক কাজ কর। নার্স শিমুকে ডাক। উনার সাথে আবার পদ্ম’র খুব ভালো সম্পর্ক। ডেকে দেখ, উনি কিছু জানেন কিনা?’

আদিদের কথা মতো অভি গিয়ে নার্সের সাথে কথা বললো। নার্স তখন বললো পদ্ম নাকি হসপিটালের ছাদে গিয়ে বসে আছে। তার নাকি খুব মন খারাপ তাই সে আজ ছাদ থেকে নামবেই না। নার্সের কথা শুনে অভি বিরক্ত হলো।
সে ছয়তালা পার হয়ে লিফট দিয়ে ছাদে উঠল। ছাদে পা রাখতেই সে অনেক খানি চমকে গেল। কী চমৎকার সুর। সে কিছুটা এগিয়ে যেতেই সুর’টা আরো গাঢ় হলো। সে ধীর পায়ে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থামল। পেছন থেকে দেখে অভি বুঝতে পারলো এটা পদ্ম। এই শুনশান পরিবেশে তার তীক্ষ্ণ সুর বুকের ভেতরকার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে তুলছে। সে মিহি কন্ঠে গেয়ে যাচ্ছিল,

…দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ও পারে-
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে ।।
বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী-
এসো এসো পারে হয়ে মোর হৃদয়মাঝারে ।।
তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে,
বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে ।
কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি
আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে….

চলবে…